সূর্যাস্ত,পর্ব:৯

#সূর্যাস্ত
পর্ব-৯

বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ করে এলো। এরা তখন নদীর ধারে একটা শুকনোমতো গাছের ডালে বসে আছে। একটা রসালো গাছের পাতা চিবুচ্ছে দুজন।

“এই শীতেও বৃষ্টি হবে নাকি?” রোদ্দুর একটু আশঙ্কায় আছে।

“হতেই পারে।”

“তখন আমরা থাকব কোথায়?”

“ভিজব। কী আর করার! ওফ! তোমার তো জ্বর! দেখি এখন কী অবস্থা।” শ্রাবনী রোদ্দুরের কাছে সরে এলো। কপালে হাত দিয়ে দেখল কপাল ঠান্ডা। সে সরে যেতে চাইলে রোদ্দুর হাত ধরে ফেলল। কী যেন হয়েছে তার। ঘোর লাগা চোখে চেয়ে আছে শ্রাবনীর দিকে। শ্রাবনী বেশ অপ্রস্তুত হলো। তবে হাত ছাড়িয়ে নিল না। তার ভালো লাগছে। এই বুনো পরিবেশে এইটুকু যেন হতেই পারে, তাতে কী বাঁধা!

রোদ্দুর ওকে খুব কাছে টেনে নিল। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে দমকা হাওয়া এসে পুরো প্রকৃতিটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল। ভয়ে ছিটকে ওঠল ওরা। পশুপাখির চিৎকারে বন একেবারে সরব হয়ে উঠল! কতগুলো হরিণ ছুটে গেল ওদের সামনে দিয়ে। মাথার ওপর অজস্র পাখি আর বানরের চেঁচামেচি। পানিতে আলোড়ন দেখা গেল।

“ঝড় হবে নাকি!” ভীত গলায় বলল শ্রাবনী।

“হ্যাঁ। একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে হবে।”

“কিন্তু এখানে আশ্রয় পাব কোথায়?”

স্রোতের ঘূর্নি ওদের পায়ের নিচ দিয়ে বয়ে গেল। গাছে গাছে বাড়ি খেয়ে ভয়ানক এক তান্ডব শুরু হয়ে গেল। ওরা গায়ে গা লাগিয়ে বসে রইল গাছটা শক্ত করে ধরে।

আধঘন্টার মতো পার হয়েছে রোদ্দুরের ঘড়িতে। ওদের মনে হচ্ছে যেন কত ঘন্টা পেরিয়ে গেছে দুর্যোগে পড়ে। তান্ডব যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎই শেষ হয়ে গেল। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পোকারাও যেন ডাকতে ভয় পাচ্ছে!

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো সব। শ্রাবনী খেয়াল করল সে রোদ্দুরের সাথে লেপ্টে বসে আছে। দ্রুত সরে বসল। পানি নেমে গেছে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে৷ শীতের দিনের কুয়াশা জমা আঁধার নামছে খুব দ্রুত। শ্রাবনী এগিয়ে গেল। রোদ্দুর কোনো প্রশ্ন না করেই গেল তার পিছু পিছু। অল্প ঝড়ে তেমন কিছু হয়নি, শুধু একটু নাড়িয়ে দিয়ে গেছে বনটা। অনতিদূরে একটা জিনিস দেখে চমকে সেদিকে গেল শ্রাবনী। যা ভেবেছিল তাই। ছোট্ট একটা হরিণ শাবক। মরে পড়ে আছে। বাদামির মধ্যে ধূসর ফুটকি৷ কী মিষ্টি দেখতে! রোদ্দুর বলল, “চলো ওকে দিয়েই ডিনার করি। খিদেয় পেট চো চো করছে।”

যদিও রোদ্দুরেরও ইচ্ছে ছিল না এত সুন্দর জীবটাকে খাওয়ার, তবে উপায় নেই আর।

হরিণের বাচ্চার কচি মাংস দিয়ে বেশ ভালো ভোজ হলো তাদের। রাতে ঘুমানোর সময় সমস্যা শুরু হলো। নিচে শোওয়া যাবে না। কাদাপানিতে আগুনও জ্বালানো যায় না। খাওয়ার সময় কোনোরকমে জ্বালিয়ে রেখেছিল, এখন সম্ভব নয়। কাদামাটির এলাকায় ঢুকে পড়েছে ওরা। আগুন না থাকলে ভয় ভয়ও লাগতে থাকে সারাক্ষণ। গভীর বনে দুজন মানুষ যেন আদিম অধিবাসী!

গাছের ডালে বসেছিল ওরা। হঠাৎ কী একটা শ্রাবনীর গায়ে ঝপ করে পড়ল। লাফিয়ে উঠল সে। একটা বিশাল সাইজের গিরগিটি। গা ঘিনঘিনে শরীর। সেটা ফেলে আবার উঠে বসল গাছে। কিন্তু পোকামাকড় পণ করেছে তাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। একটা ইঞ্চি দুই সাইজের শুঁয়োপোকা রোদ্দুরের প্যান্টের ভেতর ঢুকে গেছিল। ভাগ্যিস অন্ধকার ছিল, নয়তো যা অবস্থা হয়েছিল! শ্রাবনীর সামনে আর মুখ দেখাতে পারত না সে।

রাতটা প্রায় নির্ঘুম কাটল। সকালে দেখা গেল দু’জনের হাত পায়ে লাল লাল ছোপ। ওরা বাকি হরিণের মাংস দিয়ে সকালের খাবার সেরে আবার হাঁটতে শুরু করল। এই এলাকাটা দ্রুত পার হওয়া প্রয়োজন।

সকাল প্রায় এগারোটা। ঘটল এক ভয়ানক কান্ড!

ওরা অনেকদূর হাঁপিয়ে উঠেছে। রোদ্দুর হাতমুখ ধুতে পানির কাছে গিয়েছিল। কাদার মধ্যে পা ডুবে যায় এমন অবস্থা। প্যান্ট কাদায় মাখামাখি। মাথায় খানিক পানি দিয়ে ফেরার সময় একটু শুকনো জায়গা দেখে দেখে পা ফেলতে লাগল। হঠাৎ একটা শক্তমতো জায়গায় পা রেখে দাঁড়াতেই দুলে উঠল সে। মনে হলো ভূমিকম্প শুরু হয়েছে! উল্টে পড়ে গেল কাদার মধ্যে। যখন সম্বিত ফিরল, তখন ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে দেখল তার সামনে বিশাল হা নিয়ে উপস্থিত মস্ত কুমির! সে তখন কাদার মধ্যে চিনতে না পেরে কুমিরের নাকের ওপর দাঁড়িয়েছিল! সারা শরীর হিম হয়ে এলো রোদ্দুরের।

গড়িয়ে কোনোরকমে মরন কামড় থেকে রক্ষা পেল সে। কিন্তু কুমির প্রচন্ড দ্রুতগতিতে ধেয়ে এলো তার দিকে। শুকনো জায়গা হলে ঝেড়ে দৌড় লাগাত রোদ্দুর। এখানে উপায় নেই। কাদার মধ্যে এক পা যেতেও অনেক সময় লাগে। সে উপায় না দেখে ঝপ করে লাফ দিল পানিতে।

কুমিরটা যেন বিস্তৃত হাসি দিল! শিকার তার এলাকায় ঢুকে পড়েছে। এবার আয়েশ করে লাঞ্চ করতে পারবে। ভারী শরীরটা অসম্ভব দ্রুতগতিতে দুলিয়ে সেও নেমে পড়ল পানিতে। রোদ্দুরের কাছাকাছি পৌঁছুতে তার এক মিনিটও লাগল না।

শ্রাবনী এতক্ষণ মৌচাক ভেঙে মধু আনতে ব্যস্ত ছিল। একগাদা কামড় খেয়ে খানিকটা মধু নিয়েও এসেছে। কিন্তু রোদ্দুরকে খুঁজে পাচ্ছে না৷ হঠাৎ তার চোখ পানিতে যেতেই চমকে উঠল। ভীষণ আলোড়ন হচ্ছে একটা জায়গায়। বিশাল কিছু হুটোপুটি করছে যেন! সেই ঘূর্ণিতে চকিতে রোদ্দুরের শার্ট দেখা গেল! পরক্ষণেই রক্তের বুদবুদ উঠতে শুরু করল সেখান থেকে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here