সেই তো এলে তুমি পর্ব -০৪+৫

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৪
#Saji_Afroz

দু’দিন বাদেই নিখিল তায়শাকে দেখা করার প্রস্তাব দেয়। তায়শাও রাজি হয়। এই দু’দিন সে আবারও উপহার পাঠিয়েছে। তার বাড়ির সবাই আশিক পাঠিয়েছে ভেবে মহাখুশি। কেবল সে-ই সত্যটা জানে।
মোবাইলে কথা হয় বলে ফেইসবুকে আর ব্লকটা অবধি খোলা হয়নি তায়শার। যদিও তার নিখিলের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। সে তো পছন্দ করে আশিককে৷ বিয়ের আগে কিছু দামি উপহার যদি নিখিলের কাছ থেকে পায় তবে সমস্যা কি!
আজ যেহেতু প্রথম দেখা করছে, নিশ্চয় আজও কোনো উপহার দেবে। এই ভেবে সে তৈরী হতে থাকে।
বুশরা তাকে দেখে বলল, কোথাও যাওয়া হচ্ছে?
-হু।
-আশিক ভাইয়া দিন দিন এত রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছে?
-হলে তো ভালোই হত।
-মানে?
-বলতে চেয়েছি হচ্ছে তো ভালোই হলো।
-তা আর বলতে!
-তোরা কি খাবি বল? রেস্টুরেন্ট থেকে নিয়ে আসব।
.
আলিয়া খাতুন রুমে আসলেন। তায়শার কথা শুনে বললেন, মা কে জিজ্ঞাসা করলে সওয়াব হলেও পেতি।
-আমার এত সওয়াবের দরকার নেই। এমন না যে ওর জন্য আনলে তোমরা না খেয়ে থাকবে!
-এই মেয়ে তোকে কি জাদু করছে কি জানি!
-বের হওয়ার সময় মেজাজটা খারাপ করিও না তো।
.
বুশরা আর না দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পথে তার ফুফা তাকে থামিয়ে বাজারের ব্যাগটা হাতে দিয়ে বললেন, আজ মাছ এনেছি। কয়েক রকমের এনেছি৷ আজ সরষে ইলিশ রান্না করতে পারবি?
-জি পারব।
.
বাজারের ব্যাগের ভেতরে তাকিয়ে বুশরা বলল, ফুফাজান?
-কি?
-কিছু মাছ বাজার থেকে কেটে আনতে পারতেন? তাহলে ঝামেলা টা কম হত।
.
তিনি বিরক্তমাখা কণ্ঠে বললেন, তুই থাকতে বাজার থেকে কেটে আনব কেন? সারাদিন বাসায় বসে করিস কি? যাহ। সব মাছ কেটে ফ্রিজে রেখে দে।
.
আলিয়া খাতুন এসে বললেন, হয়েছে কি?
.
বুশরা রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। তার দিকে তাকিয়ে আকবর আলী বললেন, নবাবজাদীর আবদার শোনো? মাছ কেটে আনতাম বাজার থেকে।
-এটা বলছে ও?
-হু।
.
তিনি রেগেমেগে রান্নাঘরে গিয়ে বললেন, ফুফাকে এসব কথার বলার মানে কি? তোর দায়িত্ব নিয়ে কি ভুল করে ফেলছে সে?
-তোমাকে সবসময় বলি ফুফু। কাঁচা মাছের গন্ধ আমার ভালো লাগে না।
-তোর বাপের মতো ভিনদেশী তো না আমার জামাই, যে অঢেল টাকা পড়ে আছে তার! আবার টাকা খরচ করে মাছ কেটে আনবে?
-তবে তুমিই তো একটু হাত লাগালে পারো।
.
আলিয়া খাতুনের মেজাজ বিগড়ে যায়। সামনে মাছ নিয়ে বসে থাকা বুশরার বা গালে সজোরে চড় বসিয়ে দেন তিনি।
এটা নতুন কিছু নয়! এসব অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
বুশরা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। আর আলিয়া খাতুন চেঁচামেচি করতে করতে বেরিয়ে গেলেন-
এই বয়সে এসেও নাকি আমি মাছ কাটব। তোকে কিসের জন্য পালতেছি আমরা। দুইটা ডিম পাড়লেও তো আমাদের লাভ হত!
.
.
নিখিল বসে আছে রেস্টুরেন্টে বেশকিছুক্ষণ হলো। তায়শাকে প্রবেশ করতে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল সে। তায়শা এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। কারণ সে নিখিলকে চেনে না। নিখিলই এগিয়ে আসে তার কাছে। নিখিলকে যেমনটা ভেবেছিল তেমনটা সে নয়। স্মার্ট তবে সুদর্শন না। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসেনা। আশিক তো আছেই তার জন্য।
নিখিলের সাথে বসে সে গল্প করতে থাকে। নিখিল আবারও একগাদা উপহার তার হাতে ধরিয়ে দেয়।
তায়শা বোনদের গল্প করলে তাদের জন্যও খাবার প্যাকিং করে দেয় নিখিল। এরপর তায়শাকে প্রশ্ন করলো, তোমাকে কেউ কি উপহার দিয়ে প্রপোজ করলে বেশি খুশি হবে তুমি?
-ডায়মন্ড রিং! অবশ্য জানি এটা আমার মিথ্যে স্বপ্ন। এমন কেউ করবে না।
.
তখনো তায়শা জানতো না তার জন্য কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সামনে!
সেদিনের মতো সে বাসায় চলে আসে। এদিকে প্রায় তার ফোন ওয়েটিং পায় আশিক। সে আজ অনেকটা রাগ নিয়েই তায়শাকে ফোন দেয়। তায়শা নিখিলের দেওয়া বার্গারে কামড় বসিয়েছে মাত্র। আশিকের ফোন আসতেই নাফিশা রিসিভ করে বলল, আপনার পাঠানো খাবারই আমরা খাচ্ছিলাম।
.
বুশরাও উচ্চশব্দে বলল, ধন্যবাদ আশিক ভাই।
.
এদিকে তাদের কথা শুনে তায়শার গলায় খাবার আটকে যায়। সে কাশতে শুরু করলে বুশরা তাকে পানি দেয়। ওদিকে নাফিশাকে আশিক জিজ্ঞাসা করলো, আমার পাঠানো খাবার মানে?
.
তায়শা দ্রুত ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে আসে। সে বলল, আসলে তুমি তো শালিদের জন্য কিছুই দাও না৷ তাই আজ আমি কিছু খাবার নিয়ে এসে ওদের বললাম তুমি দিয়েছ।
-ওহ এই ব্যাপার! আচ্ছা আমি সবটা বুঝি বলো? আমাকে শিখিয়ে দিলেই পারো।
-সব শিখিয়ে দিতে হয়? পারো না মাঝেমধ্যে এটা ওটা সারপ্রাইজ দিতে?
-দেব কি, তোমাকে তো আজকাল পাইনা। থাকো কই সবসময়? ফোনও প্রায় ওয়েটিং এ থাকে।
-আসলে হয়েছে কি, প্রাকটিকাল এর জন্য ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলতে হয়। গ্রুপ নিয়ে কাজ বুঝো তো।
.
মিথ্যে বলে কোনো রকমে আশিককে সামলে নেয় সে। ফোন রাখতেই নিখিলের মেসেজ আসে-
কাল একই জায়গায় দেখা করতে পারবে? সারপ্রাইজ আছে।
.
তায়শার ইচ্ছে না থাকার পরেও সারপ্রাইজ এর কথা শুনে সে রিপ্লাই দিলো-
হু পারব। তবে এমনিতেও বললে করতাম। সারপ্রাইজ এর প্রয়োজন নেই।
-আছে আছে। কাল আসো। আমি জানি তুমি অনেক খুশি হবে।
.
তার মানে আবারও উপহার পাবে সে! আজ রাতেও আর ঘুম হবে না। কি দিতে পারে নিখিল?
.
.
পরেরদিন কথামতো সকালে একই রেস্টুরেন্টে আসে তায়শা। আজ সে উত্তেজনায় নিখিলের আগেই চলে এসেছে। খানিকবাদে নিখিল আসে। কিন্তু তার হাত খালি দেখে হতাশ হয় তায়শা। উপহার আনতে কি ভুলে গেল না কি সে?
খাবারের অর্ডার দিলে খাবার আসে। খাবার খাওয়াও শেষ হয়ে যায়। এরপর তায়শা তাড়াহুড়ো করতে থাকে। কারণ অহেতুক তার সাথে বসে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে তায়শার নেই। নিখিল একটি বক্স বের করে এগিয়ে দেয় তায়শার দিকে। সাথে রয়েছে একটি কার্ড । তায়শা চটজলদি তার হাত থেকে বক্সটি নিয়ে খুললো। একটি সুন্দর রিং দেখে সে অবাক হয়ে বলল, রিং?
.
নিখিল বলল- ইটস ডায়মন্ড!
.
তায়শা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। জীবনের প্রথম সে ডায়মন্ড ছুঁতে পেরেছে!
সে আঙুলে পরে ছবিও তুলে ফেলে। নিখিল বলল, কার্ডটি খুলে দেখো?
.
ডায়মন্ডের রিং এর কাছে এই কার্ডটি যেন খুবই তুচ্ছ তায়শার কাছে। সে বলল, বাসায় গিয়ে দেখি?
-উহু। এখুনি দেখো। যা আমি বলতে পারছি না তা এখানে লেখা আছে।
.
তায়শা ভ্রু কুচকে সেটি হাতে নিয়ে খুললো। লেখাটি পড়ে তার মাথায় যেন ভাজ পড়লো। লেখা আছে-
বিয়ে করবে আমায়? অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।
.
সে নিখিলের দিকে তাকিয়ে বলল, উত্তরটা পরে দিই?
.
নিখিল বলল, ইটস ওকে।
.
নিখিল ভেবেছিল তায়শা এখুনি তাকে ভালোবাসে জানিয়ে দেবে। মেয়েটা নিশ্চয় তাকে লজ্জা পাচ্ছে। তাই সে তাকে সময় দিতে রাজি হয়।
তায়শা আর সময় নষ্ট না করে উঠে পড়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুনোর সময় নিজের বাইকে তায়শাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চায় নিখিল। সে রাজি হয় না। সি.এন.জি ঠিক করে তাতেই বাড়ি চলে আসে। আসার সময় নিখিল বলল, সাবধানে যেও।
.
সে মিষ্টি করে হেসে বলল, অবশ্যই।
.
তখনো নিখিল জানতো না, তার সাথে মিষ্টিমুখে হেসে তায়শার এটিই শেষ কথা বলা।
.
.
তায়শা বাড়িতে এসে রিং টা লুকোতে যাচ্ছিল। তখনি তা দেখে ফেললো বুশরা। সে নাফিশাকে ডাকতে যাবে তখনি তার মুখ চেপে ধরে তায়শা বলল, হুশ! এটা কাউকে দেখানো যাবে না এখন।
-কেনো? দেখে মনে হচ্ছে অনেক দামি। সেইজন্য?
-আরে না। এটা বাসর রাতের উপহার। এখুনি দিয়ে ফেলেছে। তাই আরকি।
-ও আচ্ছা! কিন্তু আমাকে তো একটু দেখা।
.
তায়শা তাকে দিতেই বুশরা বলল, এত চকচক করছে যে? এই তুই আশিক ভাইয়ার থেকে জোর করে ডায়মন্ড নিস নি তো?
-আরেহ না। এটা ডায়মন্ড না। ভালো আর দামি পাথরের তাই এমন চিকচিক করছে।
.
বুশরা কিছু বলার আগে আলিয়া খাতুনের ডাক আসে। সে রিং টা ফেরত দিয়ে তড়িঘড়ি করে ছুটে যায় সেদিকে। তায়শা তা আলমারিতে রেখে হাফ ছাড়ে। এরপর বিছানায় এসে শরীরটা এলিয়ে দেয় সে।
.
নিখিল সম্পর্কে সে যতটুক জেনেছে, বড়োলোক পরিবারের ছেলে সে। কিন্তু তায়শার পাশে একদমই তাকে মানাবে না। সে যাকে নিয়ে চলবে, মানুষটাকে অবশ্যই মানানসই হতে হবে। আশিক তার জন্য সঠিক। দেখতেও নিখিলের চেয়ে ঢের ভালো। তারও সুন্দর দোতলা বাড়ি আছে। আর কোনো ভাই-বোনও নেই। শুনেছে অনেক জমি-জমাও আছে। একজন ছেলের জন্য এসব যথেষ্ট। আর বুশরা বলে, গাড়িও নিয়ে নেবে। নিজেই তো ব্যাংকার। এদিকে নিখিল এখনো ছাত্র৷ তার সমবয়সী। যা আছে সবকিছু না কি চাচাতো ভাই দেখাশোনা করে। কৌশলে জেনে নিয়েছিল, সবকিছুই নাকি তার চাচার সম্পদ। চাচাতো ভাই যে তাকে কিছু দেবে গ্যারান্টি কি? বাড়িটা দু’জনের হলেও বিজনেস তো চাচার মানে চাচাতো ভাই এর। দুই ভাই একসাথে কাজ করলেও মূলত ব্যবসাটা ছিল বড় জনের। যা এখন চাচাতো ভাই সামলায়। এখন বেকার নিখিলের জন্য বিয়েটা ভাঙলে তারই ক্ষতি হবে।
নাহ, যা উপহার পাওয়ার পেয়ে গেছে সে। এখন সময় এসেছে নিখিলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার।
এই ভেবে সে নিখিলকে মেসেজ পাঠায়-
দেখো নিখিল তুমি অনেক ভালো ছেলে। কিন্তু তোমার সাথে আমার হবে না। মাত্রই জানলাম বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে৷ আর বাবাকে আমি কষ্ট দিতে পারব না। আমায় ক্ষমা করে দিও৷ তোমার মতো স্টুডেন্ট ছেলের সাথে বিয়ে দেবে না আমায়। দরকার হলে তোমার দেওয়া সব উপহার নিয়ে যেও।
.
শেষের লাইনটা লিখতে কষ্ট হলেও লিখে দেয় তায়শা। উপহার যে ফেরত নেবে না এটা ভালোভাবেই জানে। সে ভেবেছে নিখিল হয়তো সব মেনে নেবে সহজেই। কিন্তু না। নিখিল তাকে ছাড়ার পাত্র না। সেই থেকে এখনো অবধি পড়ে আছে তার পেছনে।
.
.
দেখা করে গিয়ে মাত্র বিয়ে ঠিক আছে এমন একটা মেসেজ আশা করেনি নিখিল। সে তায়শাকে অনেকবার বুঝিয়েছে৷ তার পরিবারের সাথে কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু তায়শা তাকে গুরুত্ব-ই দিলো না। বরং করতে থাকলো অবহেলা। হুট করে তার এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না নিখিল।
.
আগের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিখিলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। ঘড়ির দিকে তাকালো নিখিল। একজনকে সে একটি কাজ দিয়েছিল। বলেছিল সকালেই সবটা জানাবে। তার ফোনেরই অপেক্ষা করছে সে।
অবশেষে ফোনটা আসে। ওপাশ থেকে সবটা শুনে তার রাগ আরও বেড়ে যায়।
সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইকে উঠে বসে। সোজা চলে আসে ভাই এর অফিস রুমে।
নিহির কাজে ব্যস্ত ছিল। নিখিলকে দেখে সব ফাইল এক পাশে রেখে বলল, তুই এখানে?
.
নিখিল তার ভাই এর পাশে এসে বলল, তায়শা আমাকে ইচ্ছে করেই কষ্ট দিয়েছে ভাইয়া। ওর বিয়েটা অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। এরপরেও সে আমার সাথে অভিনয় করেছে।
-কীভাবে বুঝলি?
-ওর এলাকার এক ছেলের মাধ্যমে খোঁজ নিয়েছি।
-বলিস কি! বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও তোর সাথে এই অভিনয় কেনো?
-সেটা আমি জানিনা।
কিন্তু আমি এটা মানতে পারছি না, আমাকে ঠকিয়ে সে এত সহজে আর কাউকে বিয়ে করে নেবে।
-তুই কি চাস এখন?
-আমি ওকে শাস্তি দিতে চাই।
-তবে ঘৃণা করছিস ওকে?
-নাহ। ঘৃণা করা এত সহজ না ভালোবাসার মানুষকে।
-তবে?
-ওকে যেভাবেই হোক, বিয়েটা আমিই করতে চাই। এটাই হবে ওর জন্য বড়ো শাস্তি।
.
নিহির বলল, ভেবে বলছিস তো?
-হু।
-তবে তুই শেরওয়ানি পছন্দ করে নে। বাকিটা আমার কাজ।
.
নিখিল আনন্দিত হয়ে বলল, সত্যি?
-হু।
-কিন্তু কি করবে তুমি? কথা বলতে গিয়ে তো কিছুই পারলে না।
-সেটা আমার উপরেই ছেড়ে দে। এখন আর কথাতে কাজ করব না।

.
নিহির ড্রয়ার থেকে কিছু টাকার বান্ডেল বের করে নিখিলকে দিয়ে বলল, শেরওয়ানি নিয়ে আয়।
.
নিখিল তা নিয়ে ছুটলো শপিংমলের দিকে৷ সে জানে, তার ভাই যা বলে তাই করে! আরেকবার বিশ্বাস করতে চায় সে তার ভাইকে। #সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৫
#Saji_Afroz

বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেছে বুশরার বাড়িতে। বাড়ির ছাদটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। স্টেজ করা হয়েছে এখানে। গায়েহলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠান এখানেই হবে৷ তাছাড়া পুরো বাড়িতে করা হয়েছে লাইটিং। ফুল দিয়েও হয়েছে সাজানো চারিপাশ। হরেক রঙের কাপড় দিয়ে করা হয়েছে ডেকোরেশন।
যখন থেকে বুশরা বুঝতে শিখেছে, মা বাবা বলতে যে পৃথিবীতে যে কেউ আছে সে জানতো না। সে জানতো তার সবচেয়ে আপনজন ফুফু আম্মা ও ফুফা জান। যদিও তারা বুশরার খেয়ালই রাখতো না। কিন্তু ওতটুক বাচ্চা কি ওসব বোঝে?
তায়শার যখন জন্ম হয়, তখন বুশরা যেন তার আপন কাউকে পায়! বয়সে পিঠাপিঠি হলেও তায়শার খেয়াল রাখতো বুশরা। তারা একসাথে বড়ো হতে থাকে। এরপর সে বুঝতে শেখে সবচেয়ে কাছের মানুষ একমাত্র বোন-ই হয়। তায়শাও তাকে ভালোবাসতো এবং বাসে। সবসময় তার পাশে থেকেছে সে।
একবার তো স্কুলের বেতন দিতে গিয়ে টাকা হারিয়ে ফেলে বুশরা। তায়শা নিজের জমানো টাকা সহ মা এর কাছ থেকে টাকা চুরি করে তাকে বেতন দিতে সাহায্য করে। এভাবে সবসময় তার পাশে থেকেছে তায়শা। আজ সেই তায়শার গায়েহলুদ। আর কাল বিয়ে। ভাবতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে বুশরার।
তায়শা ও নাফিশা পার্লারে গেছে। আলিয়া খাতুন কাজের বাহানায় বুশরা কে যেতে দেননি। যদিও তায়শা নাছোড়বান্দা ছিল। তিনি বলেছেন, ওদের সাজ শেষ হলেই বুশরা কে পাঠাবেন তিনি।
এই নিয়ে বেশ কয়েকবার মা কে ফোন দেয় তায়শা। আলিয়া খাতুন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এই মুহুর্তে বুশরার যাওয়া সম্ভব না। বাসায় অনেক কাজ।
তায়শা এতক্ষণে চলে আসার কথা। হলুদের সাজে তাকে কেমন লাগছে তা দেখার জন্য মনটা ছটপট করছে বুশরার। তাইতো কিছুক্ষণ পর পরই মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে দেখছে সে তায়শা আসছে কি না।
কিছু এঁটো প্লেট বাটি ধুয়েমুছে আবারও গেইটের সামনে আসে বুশরা। এইবার সে তায়শাকে দেখতে পায়। রিকশা থেকে সে ও নাফিশা নামছে।
বুশরা দ্রুত তার পাশে এসে তাকে নামতে সহায়তা করে। এরপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মাশাআল্লাহ! আমার বোনটাকে হলুদ পরী লাগছে।
.
তায়শা হলুদ শাড়ি ও হলুদ রঙের ফুলের গহনা পরেছে। তাকে দেখতে হলুদ ফুলের রাজ্যের রানীদের মতো লাগছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই! সে বলল, লাগছে তাইনা?
-একদম।
-রুমে আয় তো। আশিককে ভিডিও কল দিই।
.
তারা রুমে এসে আশিককে ফোন দেয়। আশিক তাকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। বুশরা বলল, কি ভাইয়া? মশা ঢুকে যাবে তো মুখে।
.
আশিক হেসে বলল, তায়শা কোথায়?
-আপনার সামনে এটা কে?
-একে তো আমি চিনি না। তায়শা কে চিনি।
.
তায়শা বলল, ঠিক আছে। তবে এই বউটা অন্য কারো গলায় মালা পরিয়ে আসুক?
.
আশিক বলল, এই না! আমি তো মজা করছিলাম।
.
তাদের কথা বলতে দিয়ে বুশরা রান্নাঘরে চলে আসে। আলিয়া খাতুন তাকে বললেন, মহারানীর ছুটাছুটি শেষ হয় না?
-তায়শা এসেছিল। দেখতে গিয়েছিলাম।
-তায়শা আসছে?
-হু। অনেক সুন্দর লাগছে ওকে।
-আমার মেয়েটায় তো এমন।
-বলছি কি আর কি করতে হবে আমায়? না মানে আমিও তৈরী হয়ে নিতাম?
-তোকে এখানে কে দেখবে? এত জলদি হতে হবে না। সবাই খাওয়াদাওয়া শেষে হবি। সবকিছু কি আমি সামলাব?
-ওসবের জন্য তো কাজের মহিলারা আছে।
-কাজের মহিলাদের দিয়ে ঘরের সব কাজ হয়না। আর ওরা কি জানে কাদের কেমন আপ্যায়ন করতে হবে! তুই এত কথা বলছিস কেন?
মিষ্টির বাক্স থেকে কয়েক প্লেট মিষ্টি নিয়ে আয়। আমার ননদরা এসেছে।
.
এই বলে তিনি রুমের দিকে চলে যায়। বুশরা নাস্তা ও মিষ্টি প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে আসে রুমে। সবাইকে সালাম জানিয়ে তাদের হাতে হাতে দেয় সে। একটা প্লেট কম হয়। এইজন্য আলিয়া খাতুন তাকে কথা শোনায়।
-বলি কি কাজ চুরি করার অভ্যেস কেনো? এখন গিয়ে আবার নিয়ে আয়।
-আপনিই তো বলেননি কয় প্লেট লাগবে।
-মুখেমুখে কথা না বলে এসে দেখে যেতেও পারতি। যা গিয়ে আরেকটা প্লেট নিয়ে আয়।
.
সে চলে যেতেই আলিয়া খাতুনের ছোট ননদ পারভীন বললেন, ভাবী ওর সাথে ওমন করো কেনো? মেয়ে তো খারাপ না। সবার কত খেয়াল রাখে।
-ওর মা আমার ভাই এর সংসারটা তছনছ করে দিছে। তাই এমন করি। ও কি জানে ওর জন্মের আগেই অন্য কারো জন্য ওর মা ওকে মেরে ফেলতে চাইছিল? ওইরকম মা এর মেয়ে আর কেমন হবে! আমার জানা আছে।
.
বুশরা চলে আসলে তিনি থেমে যান। সে প্লেট দিয়ে চলে গেলে আবারও বলতে শুরু করেন, আমি চাই না ও ওর মা এর মতো হোক। এইজন্যই কড়া শাসনে রাখি।
.
.
নিজের শেরওয়ানি টা উল্টেপাল্টে দেখছে নিখিল। খয়েরী রঙের একটি শেরওয়ানি কিনেছে সে। কিন্তু নেওয়ার পর মনে হচ্ছে আরও ভালো নিতে পারতো।
সে ভাবনায় পড়ে যায়। তখনি তার দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। নিখিল তার মা ভেবে সেটি লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু নিহিরের কণ্ঠ শুনে দরজা খুলে দেয় সে।
নিহিরকে শেরওয়ানি দেখিয়ে বলে, ভাইয়া দেখো তো? আমার মনে হচ্ছে এটা ভালো হয়নি।
-খারাপ কোনদিকে?
-রঙ টা কি বেশ গাঢ় হয়ে গেল?
-উহু। ভালোই লাগছে।
-মনেহচ্ছে শপ এ আরও ভালো ছিল।
.
নিহির হেসে বলল, এটাই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।
-মানে?
-মানে জাস্ট কবুল বলা হবে। তোর বিয়ে কতটা ধুমধাম করে দেব দেখে নিস। তখন দশদিন ঘুরে একটা শেরওয়ানি নিস৷ আর এখনো যদি আরেকটা নিতে ইচ্ছে হয় তো নে।
-না থাক। তখনি নেব বরং।
-হু।
-আচ্ছা তায়শা কী রঙের জামা পড়বে কাল?
-সেটা যেন আমাকে বলেছে।
.
নিখিল হাসলো। কিন্তু মুহুর্তেই তার মুখে অন্ধকার নেমে এল। নিহির কি হয়েছে জানতে চাইলে বলল, মা কে কীভাবে ম্যানেজ করবে?
-করে নেব। উনার একমাত্র ছেলে তুই। নিশ্চয় মেনে নেবেন সবটা।
– দুই মাত্র ছেলে। বড়ো ছেলে তো তুমিই।
-সেটা আর বলতে! এখন ঘুম দে একটা। কালকে ফ্রেশ লাগতে হবে।
-ওকে।
.
.
একে একে সবাই-ই স্টেজে এসে হলুদ লাগিয়ে দেয় তায়শা কে। বাকি আছে বুশরা। নাফিশাকে পাঠানো হয়েছে তাকে ডাকার জন্য।
এত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বুশরা৷ তাই সে মাত্রই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। সাথে সাথে নাফিশা এসে হাজির হয়। তাকে জোর করে ছাদে নিয়ে আসে। বুশরার পরণে পুরাতন জামা, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। তাকে এইভাবে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না তায়শার। নিশ্চয় তার মা এর জন্যই তৈরী হওয়ার সময় পায়নি। আশেপাশে অনেক মানুষ বলে তায়শা নিশ্চুপ রইলো। বুশরা তায়শাকে হলুদ লাগানোর সময় সে খেয়াল করলো, তার চোখে পানি৷ তায়শার চোখেও পানি চলে আসে। দু’বোন নীরবে কাঁদতে থাকে। তখনি এক বোরকা পরিহিত চিকন কণ্ঠের মহিলা বলল, কান্নাকাটি পরে হবে৷ আগে আমি হলুদ লাগাই।
.
তারা চোখ মুছে নেয়। মহিলাটি তায়শাকে হলুদ লাগানোর সময় বুশরা তার হাত ধরে ফেললো৷ তায়শা অবাক হয়ে বলল, কি রে?
-এটা তো কোনো মহিলা বলে মনে হচ্ছে না আমার।
.
তায়শা ঘাবড়ে যায়। সে বলল, তবে?
-ছেলে মেয়ে সেজে এসেছে।
.
তায়শা ভাবে নিখিল আসেনি তো? এতগুলো মানুষের সামনে যদি ঝামেলা করে? কিন্তু বুশরার হাসি দেখে সে যেন প্রাণে বেঁচে যায়।
ছেলেটির হাতটি ছেড়ে বুশরা ফিসফিসিয়ে বলল, এটা হলো আশিক ভাই।
-আশিক?
-হু। তোকে হলুদের সাজে দেখতে এসেছে। আসার আগে আমায় বলেছিল। এইভাবে আসতে আমিই বুদ্ধি দিই।
.
বিষয়টা কেউ বুঝতে পারলো না৷ কিন্তু তায়শা আশিককে নিয়ে নিচে নেমে আসতে চাইলে আলিয়া খাতুন তাদের থামিয়ে বলল, কে উনি? আর কোথায় যাচ্ছিস তুই?
-অনুষ্ঠান তো শেষ। এখন নাচানাচি হবে। শাড়ি পরে তক নাচতে পারব না। তাই আমি শাড়িটা বদলাতে যাচ্ছি। আর ও হচ্ছে আমার বান্ধবী। ভদ্র বান্ধবী। তাই এভাবে এসেছে। সেও চলে যাচ্ছে। ভাবলাম এগিয়ে দিই।
-আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আয়।
.
আশিককে নিয়ে নিজের রুমে এসে দরজাটা আঁটকে দেয় তায়শা। সবাই ছাদে থাকায় এখানে কেউ নেই। গানবাজনা শুরু হয়ে গেছে। এদিকটা কেউ আসারও সম্ভাবনা নেই৷ আশিক মুখের কাপড়টা সরিয়ে বলল, ওহ শান্তি!
.
তায়শা হাসতে হাসতে বলল, তুমি এইভাবে?
-হবু বউকে ফোনে দেখে বাস্তবে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
.
তায়শা হাসে। আশিক এসে তাকে কাছে টেনে নেয়৷ হুট করে আশিকের এমন কাণ্ডে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় তায়শা। আশিক তার মুখে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, এত সুন্দর আমার বউটা।
-এখনো হইনি। কাল হব।
-হতে আর কতক্ষণ?
-যতক্ষণ আছে ততক্ষণই সবুর করো।
.
আশিক তাকে আরও বেশি কাছে টেনে বলল, শুধু একটা চুমু দাও তাহলে?
-দেব তো।
-সত্যি?
-হু। যদি না ছাড়ো একটা কেনো অনেকগুলো কামড় দেব।
.
এই বলে আশিকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজাটা খুলে দেয় তায়শা। এরপর বলল, যাও তো এখন। কাল এতক্ষণে তো তোমার সাথেই থাকব।
-আর কি করব?
-কি করবে?
.
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে আশিক বেরুনোর সময় বলল, কি করব না সেটা বলো?
.
সে চলে যায়। লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে যায় তায়শার৷ কাল আসলেই কি হবে?
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা পান করছে নিহির। খালেকুজ্জামান এসে বললেন, ওই বাড়ির মেয়েরা কাল যেই পার্লারে সেজেছিল আজও সেখানেই সাজবে। খবর নিয়েছি আমি।
-শিওর?
-হুম।
-বেশ তাহলে! ওখান থেকে তায়শা কে নিয়ে আসা হবে আজ।
.
চলবে
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here