সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -২৪

পর্বঃ২৪
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)

‘আজকের মূল আকর্ষণ যেটার জন্য সকলেই এতক্ষণ অপেক্ষা করে বসে আছেন তাদের এখন স্টেজে ডাকবো পারফর্ম করার জন্য। তার আগে তাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই। যেই ব্যান্ডটা এখন স্টেজে আসবে তার সদস্যরা কিন্তু এখনো ভার্সিটির স্টুডেন্ট।খুবই কম সময়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা নিজেদের পারফরম্যান্স দিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ছয় বন্ধুর বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসায় গড়ে তোলা সেই ব্যান্ডটা বেঁচে থাকুক অনেক বছর। কর তালির মাধ্যমে সবাইকে ওয়েলকাম করার অনুরোধ করছি ফ্রেন্ডস ব্যান্ডকে।প্লিজ ওয়েলকাম ওয়ান এন্ড অনলি দা ব্যান্ড নেম ফ্রেন্ডস।’

কথাগুলো বলে স্টেজ থেকে হোস্ট নেমে যায়। স্টেজের আলো নিভে মিউজিক বেজে উঠে তখনই ডান পাশের সিঁড়ির দিকে স্পর্ট লাইটটা পড়লে সাদা রঙের টপ আর স্কার্ট পরিহিত পায়েলকে হাসিমুখে দেখা যায়। মিউজিকের সাথে তাল মিলিয়ে স্টেজে উঠে পায়েল পারফর্ম করতে থাকে। পায়েলের পিছন থেকে বাপ্পি এসে ওকে সঙ্গ দিয়ে তাল মেলাতে থাকে। বাম পাশের সিঁড়ি দিয়ে অর্ক এসে দু’জনের সাথে তাল মেলাতে থাকে। মাঝে পায়েল আর ডানে বাপ্পি বামে অর্ক সমানতালে গানের সাথে তাল মিলিয়ে পারফর্ম করতে থাকে। হুট করে মিউজিক বন্ধ হয়ে যায় পুরো স্টেজের লাইট বন্ধ হয়ে যায়। আবারো লাইট জ্বলে উঠলে স্টেজে সবার সামনে গম্ভীর মুখে রাইদাকে দেখা যায়।রাইদাকে দেখে অডিয়েন্স চিল্লানি দিয়ে ‘রাই..রাই..রাই’ বলে চিল্লাতে শুরু করে।

মিউজিক বেজে উঠলে রাইদা এক্সপ্রেশন পাল্টে হাসিমুখে পারফর্ম করতে শুরু করে।
রাইদা,অর্ক,পায়েল,বাপ্পি চারজন মিলে গ্রুপ পারফর্ম করতে শুরু করে।

ব্যাক স্টেজে ফাহিম আর রুহি মিউজিক কন্ট্রোল করছে। ফাহিম খুব মনোযোগ দিয়ে মিউজিক গুলো দিচ্ছে আর পাশে থাকা রুহি তাকে সাহায্য করছে।

দর্শকের সারিতে বসে যামিনী, রুবেল,শ্রেয়া,সায়ন রাইদার গ্রুপের পারফরম্যান্স দেখছে। সায়ন জানতই না আজকে অনুষ্ঠানে রাইদার গ্রুপ আসবে। শেষ মূহুর্তে যখন সে যখন লিস্ট চেক করে তখনই জানতে পারে। তবে স্টেজের পারফরম্যান্স দেখে সায়নের মোটেও ভালো লাগছে না। রাইদা এভাবে নাচছে আর দর্শকের সারিতে থাকা ছেলেরা ওর নাম নিয়ে বারবার চিল্লাছে এতে সায়ন মহা বিরক্ত। রুবেল নিজের চোখকে বিশ্বাসই করাতে পারছে না যার সাথে তখন ঝগড়া করেছে সেই মেয়ে রাইদার বান্ধবী। রুবেল রাইদাকে নিজের ছোট বোন ভাবে সেখানে রাইদার বান্ধবীর সাথে তার ঝগড়া করা উচিত হয়নি বিষয়টা বুঝতে পেরে রুবেল লজ্জিত হয়। শ্রেয়া আর যামিনী পুরো পারফরম্যান্স এনজয় করতে থাকে।

‘আরাফ কই?’,আশেপাশে তাকিয়ে যামিনী রুবেলকে জিজ্ঞেস করে।

‘কই আবার ক্যামেরা নিয়ে স্টেজের সামনে আছে।’,রুবেল জবাব দেয়।

যামিনী চোখ ঘুরিয়ে সায়নের দিকে তাকিয়ে বুঝে সায়ন এই পারফরম্যান্স দেখে খুশি না।

সাদা টপের উপর নীল রঙের জ্যাকেট সাথে সাদা ফর্মাল প্যান্ট পরিহিত রাইদার ছবি তুলছে স্টেজের নিচে দাঁড়িয়ে আরাফ। রাইদা আরাফকে এখনো খেয়াল করেনি। রাইদার পারফরম্যান্স শুরু হতেই ক্যামেরা নিয়ে আরাফ চলে আসে ছবি তুলতে।

গ্রুপ পারফর্ম শেষ হলে দর্শকরা করতালি দেয়। রাইদা হাঁপাতে হাঁপাতে দু হাত তুলে সকলের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ায়।

‘ওয়ান্স মোর, উই ওয়ান্ট রাই-অর্ক ডুয়েন্ট পারফরম্যান্স। রাই-অর্ক ডুয়েট..ডুয়েট।’

দর্শকরা চিল্লিয়ে বলতে থাকে। রাইদা মাথা নাড়িয়ে না না করতে থাকে।

হোস্ট স্টেজের নিচ থেকেই বলে,’দর্শকদের দাবি রাই-অর্ক ডুয়েট চাই।’

পায়েল আর বাপ্পি স্টেজ থেকে নেমে যায়।রাইদা আর অর্ক নিজের জায়গায় দাঁড়ালে ফাহিম মিউজিক দেয়। শুরু হয় রাইদা আর অর্কের ডুয়েট পারফরম্যান্স। ওদের দু’জনকে এভাবে পারফর্ম করতে দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না ওরা শুধু বন্ধু।

‘দু’জনকে মানিয়েছে বেশ।আমার জানা মতে ওদের মধ্যে প্রেম নেই কিন্তু সন্দেহ হয়।শুধু বন্ধু হলে কি এতো সুন্দর কেমিস্ট্রি জমে নাকি? অবশ্যই কিছু ওদের মধ্যে আছে।’,সায়নের পিছনে বসা মেয়েটা রাইদা আর অর্ককে নিয়ে কথাগুলো বলতে থাকে তার বান্ধবীকে।

এতোক্ষণ সায়ন মেজাজ কন্ট্রোল করে বসে থাকলেও এবার আর পারে না। হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে বসা থেকে উঠে স্থান ত্যাগ করে।

রাইদা আর অর্কের পারফরম্যান্স শেষ হলে দর্শক আবারো হাত তালি দেয়।হোস্ট স্টেজে এসে রাইদার হাতে মাইক দেয়। পায়েল,বাপ্পি,ফাহিম,রুহি স্টেজে এসে দাঁড়ায়।

‘সিনিয়র এবং জুনিয়রদের কাছে থেকে আজকে এতো ভালোবাসা পেয়ে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি আমি। আজকে এই ভার্সিটিতে পারফর্ম করে আমরা আনন্দিত আশা করছি আপনাদেরকে কিছু সুন্দর মূহুর্ত উপহার দিতে পেরেছি।ভালো থাকবেন সবাই।’,মাইকে কথাগুলো বলতে থাকে রাইদা।

একে একে রাইদার পুরো গ্রুপ স্টেজ থেকে নেমে যায়। যেই রুমে রাইদা,রুহি,পায়েলকে প্রথমে বসতে দেওয়া হয়েছিলো সেখানে ওরা চলে যায়। বাপ্পি,ফাহিম, অর্ক বাহিরের বিষয় মিটিয়ে আসবে।

রুহি,পায়েল রুমে ঢুকে বসে আছে আর রাইদা গেছে ওয়াশরুমে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে রুমের দিকে যেতে থাকে তখনই হাত ধরে কেউ হেঁচকা টান দেয়। রাইদা চিৎকার করতে নিলেই দেখে সামনে সায়ন দাঁড়ানো। ঘাড় ঘুরিয়ে রাইদা আশে পাশে তাকায়।

‘এখানে তুমি আমি ছাড়া কেউ নেই।সবাই স্টেজের দিকে এখন এখানে কেউ আসবে না।’,গম্ভীর মুখে সায়ন বলে।

সায়নকে দেখে রাইদা বুঝে যায় প্রচন্ড রেগে আছে কিন্তু কেনো রেগে আছে সেটা অজানা।

‘কেউ নেই সেই জন্য সুযোগে অসভ্যতা করতে চলে এলেন? হাত ছাড়ুন।’,সায়নের ধরে রাখা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে রাইদা।

‘তোমাকে এসব ছাড়তে হবে রি।আমার মোটেও ভালো লাগেনি ঐভাবে তোমার বন্ধুর সাথে পারফর্ম করাটা।আমার বউকে অন্য ছেলে স্পর্শ করুক আমার ভালো লাগে না সেটা তোমার বন্ধু হলেও আমি এসব মানবো না। আর তোমার বন্ধু তোমার হাত,কোমড়ে অসংখ্য বার স্পর্শ করেছে আবার কোলেও তুলেছে বলো কীভাবে আমি নিজের মেজাজ সংযত রাখবো এসব দেখে? তোমার বন্ধু না হলে স্টেজে উঠে ওর হাত পা ভে*ঙে দিতাম।’

‘আপনার বউ হওয়ার আগে আমি এমনই ছিলাম।এভাবেই স্টেজ পারফর্ম করে আসছি কলেজ লাইফ থেকে।এখন আপনি যদি এটা মানতে না পারেন ছেড়ে দেন আমাকে কে বলছে ধরে রাখতে?’

রাইদার কথাগুলো আগুনে ঘি ঢালার মতো সায়নের রাগে কাজ করে। বাম হাত দিয়ে রাইদার দু’গাল চেপে ধরে। ব্যথা অনুভব হতেই চোখ বন্ধ করে ডান হাত দিয়ে সায়নের হাত সরানোর চেষ্টা করে রাইদা।

‘রি আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না।আমি যেমন ভালোর ভালো তেমন খারাপের খারাপ। আমাকে বাধ্য করনো নিজের রাগটা সবার সামনে আনতে।বিয়ের আগে কি করছো তাতে আমার কিছু যায় আসে না এখন কি করবা সেটা আমার মাথা ব্যথা।তুমি আমার প্রেমিকা না বউ তাই আমার কথা মানতে বাধ্য তুমি।’

কথাগুলো বলে রাইদার গাল থেকে হাত সরিয়ে ফেলে সায়ন।

‘আমার গলা চেপে একেবারে মে*রেই ফেলুন।আপনার যন্ত্রণা আমার একদম ভালো লাগে না। বিয়ে হতে না হতেই নিজের অধিকার দেখাতে আসছেন আমিও বলে দিলাম আমি আপনার একটা কথাও শুনবো না। এই ব্যবহার দিয়ে আমার মন তো দূর আমার কাছ থেকে সম্মান ও পাবেন না। আপনাকে আমার বর হিসেবে মানি না আর কখনো মানবোও না।’,সায়নের হাত টেনে রাইদা নিজের গলায় চেপে ধরে।

সায়ন চোখ বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে।রাইদা সায়নের ডান হাত থেকে নিজের বাম হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরে।হুট করে রাইদার কোমড়ে হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে আনে সায়ন।বাম হাত দিয়ে রাইদার কোমড় জড়িয়ে রাখে আর রাইদার হাত ছেড়ে ডান হাত দিয়ে রাইদার চুল গুলো ঠেলে পিছনে দেয়।

‘আচ্ছা এসব বিষয়ে আমরা না হয় পরে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করবো। এখন চলো আমার সাথে এখানে থাকতে হবে না আর।’,গলার স্বর নরম করে বলে সায়ন।

মূহুর্তেই সায়নের এমন রুপ দেখে রাইদা প্রচন্ড অবাক হয়।

‘আপনি একজন ভালো দেখে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান।আপনার আচরণ তো আকাশের মতো এই মেঘ তো এই বজ্রপাত।’,দু’হাতে দিয়ে সায়নের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলে রাইদা।

সায়ন কোনো রিয়াকশন না দিয়ে রাইদার দিকে তাকিয়ে থাকে এই সুযোগে রাইদা সায়নকে জোরে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে। ধাক্কা খেয়ে সায়ন দু পা পিছিয়ে যায়। রাইদা সময় নষ্ট না করে দ্রুত দৌড়ে সেখান থেকে পালায়।

দৌড়ানো অবস্থায় পিছনে তাকিয়ে দেখতে থাকে সায়ন আসছে কিনা তখন সামনে কারো সাথে ধাক্ক খায়। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে লোকটা রাইদার হাত ধরে ফেলে।

‘সরি আসলে আমি..।’,আর কিছু সামনে তাকিয়ে রাইদা দেখে আরাফ তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

‘কিছু হয়েছে রাই? দৌড়াচ্ছিলে কেনো?এনি প্রবলেম?’,আরাফ প্রশ্ন করে।

‘হাত ছাড়ুন। কিছু হয় নি এমনি দৌড় দিয়েছি।’
রাইদার কথা মতো ধরে রাখা হাতটা আরাফ ছেড়ে দেয়। রাইদা পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আরাফ আর চুপ থাকে না।

‘আমার ইগনোর কেনো করছো রাই? আমার দোষটা কোথায় যদি বলতে তাহলে নিজেকে বুঝাতে পারতাম।’

আরাফের কথা শুনে রাইদা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। রাইদার টলমল চোখ দেখে আরাফের বুকে মোচড় দেয়। আরাফ এগিয়ে এসে রাইদার সামনে দাঁড়ায়।

‘তোমার চোখে অশ্রু কেনো? আমি কি তোমায় আমার কোনো কথা দিয়ে কষ্ট দিয়েছি? আমাকে ক্ষমা করো রাই আর কখনোই তোমাকে এসব প্রশ্ন করবো না।’

‘আপনার দোষ নেই সব দোষ আমার ভাগ্যের। এ জন্মে আমি আর আপনার সাথে কথা বলতে চাই না আরাফ। আপনি আর কখনোই আমার সামনে আসবেন না প্লিজ এটা অনুরোধ আমার।’

হাত জোর করে কথাগুলো বলে রাইদা পিছনে ঘুরে হাঁটা দেয়।আরাফ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রাইদার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। পকেট থেকে একটা রিং বের করে সেটা মুঠোবন্দি করে ফেলে।আজকে কত স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলো রাইদাকে সব বলবে কিন্তু রাইদার এমন ব্যবহারে সব মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।
আরাফের মনে নানান প্রশ্ন উঁকি দেয়।

‘তবে কি রাইদা অন্য কাউকে ভালোবাসে? না না রাইদাকে দেখে কখনো মনে হয়নি রাইদা অন্য কাউকে ভালোবাসে। সকল প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।’,বিরবির করে কথাগুলো বলে রিং টা মুঠোবন্দি করেই হাঁটা দেয় রাইদা যেখান থেকে গিয়েছে সেখান থেকেই।

রুমে ঢুকে রাইদা ফোন নিয়ে অর্ককে কল দেয়।

‘আমার শরীর খারাপ লাগছে জলদি এখানে থেকে আমাকে বের কর।’,রাইদা বলে।

‘মেইন গেটের সামনে অনেক ভীড় জমেছে কীভাবে বের করবো বল। তুই একটু কিছুক্ষণ ধৈর্য্য ধর আমি গাড়িটা সাইডে এনেই তোকে নিয়ে যাবো।’,ফোনের অপরপাশ থেকে অর্ক জবাব দেয়।

‘আমি আর এক মিনিটও থাকতে চাই না এখানে প্লিজ বুঝার চেষ্টা কর।’

‘ঠিক আছে আমি আসছি।’
অর্ক কল কেটে চিন্তায় পড়ে যায় কীভাবে এখানে থেকে বের করবে রাইদাকে।মেইন গেটের সামনে ভীড় জমেছে ছবি তোলার জন্য। ফাহিম আর বাপ্পিকে বিষয়টা বললে ওরাও চিন্তায় পড়ে যায়।

হুট করে দরজায় কেউ নক করে। পায়েল গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রুমের ভেতর যামিনী আর শ্রেয়া প্রবেশ করে।ওদের দুজনকে দেখে পায়েল কোনো রিয়াকশন না দিলেও দরজায় দাঁড়ানো রুবেলকে দেখে রেগে যায়।

‘আপনি এখানে কি করছেন? এখন কি জামায় জুস ঢিল দিতে এসেছেন?’, রুবেলের দিকে রেগে কথা গুলো বলে পায়েল।

‘আমি আপনার সাথে দেখা করতে আসিনি এসেছি আমার ছোট বোন রাইয়ের সাথে দেখা করতে,সরুন আমার সামনে থেকে।’,রুবেল পায়েলকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে।

‘কি ব্যপার পায়েল কিছু হয়েছে?’,রাইদা জিজ্ঞেস করে।

‘আমার পায়ে তখন জুস ঢিল দিয়েছিলো এই লোকটা।’,পায়েল রুবেলের দিকে আঙুল তুলে বলে।

‘কিরে রুবেল দিনদিন কি ছোট হচ্ছিস নাকি? ওর সাথে এমনটা করা তোর উচিত হয়নি।এক্ষুণি সরি বল মেয়েটাকে।’,যামিনী রুবেলকে ধমক দিয়ে বলে।

‘তখনই তো সরি বললাম আবার কয়বার সরি বলুম? উনি তো খুরুম পায়ে দিয়ে আমার পায়ে পাড়া দিছে তখন যে আমি ব্যথ্যা পাইছি সেটা কিছু না?’,রুবেল প্রতিবাদ করে বলে।

‘আমি তো ইচ্ছে করে পায়ে পাড়া দেইনি তারপরও সরি বলেছি কিন্তু আপনি তাও জুস ঢিল দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছেন।’,পায়েল রাগী স্বরে বলে রুবেলকে।

‘আরে আপু সমস্যা নেই রুবেল ভাই হয়তো ইচ্ছে করে করেনি।পায়েল বিষয়টা এখানেই মিটমাট করে ফেল আর বাড়াস না।’,রাইদা পায়লকে চোখ গরম করে বলে।

পায়েল রাইদার কথায় চুপ হয়ে যায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে রুবেলের প্রতি তার রাগ উপচে পড়ছে।

‘কেমন আছো রাই?তোমার পারফরম্যান্স দারুণ ছিলো আশা করি আমার বিয়েতে তুমি সুন্দর সুন্দর পারফর্ম করবে।শুনো তোমার পুরো গ্রুপ নিয়ে আমার বিয়ের সকল অনুষ্ঠানে আসবা।’,যামিনী গিয়ে রাইদাকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘আমি ভালো আছি আপু। আমরা অবশ্যই তোমার বিয়েতে আসবো।’,রাইদা হেঁসে বলে।

‘এরা দু’জন তোমার সেই বান্ধবী যাদের কথা বলেছিলো আমাকে?’,যামিনী জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যা আপু এই হলো পায়েল আর এই হলো রুহি।’
রাইদার কথা মতো পায়েল আর রুহি এগিয়ে এসে যামিনীর সাথে আলাপ করে।শ্রেয়া এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে চুপ করে পায়েলই গিয়ে তার সাথে কথা বলে প্রথমে। শ্রেয়াও পরে হেঁসে কথা বলে।

‘রাই পিছনের গেট দিয়ে বের হওয়ার ব্যবস্থা করেছি তোরা আয়।’,বাপ্পি বলে।

বাপ্পির কথা শুনে রাইদা যামিনী কে ছেড়ে নিজের ব্যাগ হাতে নেয়।

‘অর্ক আর ফাহিম কোথায়?’,রাইদা জিজ্ঞেস করে।

‘ওরা নিচে আছে।আমাকে বললো তোদের তিনজনকে গাড়িতে নিয়ে বসাতে তারপর ওরা আসবে।’,বাপ্পি বলে।

‘আপু আমি চলি পরে দেখা হবে।ভালো থেকো আর কল দিও আমাকে।’,রাইদা যামিনীর হাত ধরে বলে।

‘চলো রাই আমি এগিয়ে দিচ্ছি তোমাদের।’,রুবেল কথাটা বলে উঠে।

রুবেলের কথা শুনে পায়েল আগেই রুম থেকে বের হয়। রাইদার যামিনীর সাথে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বের হলে দেখা হয় আরাফের সঙ্গে। আরাফ রাইদাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছে। সকলকে দেখে আরাফ চুপসে যায়। রাইদা একবার আরাফের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে হাঁটা দেয়। আরাফ অসহায়ের মতো রাইদার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। হাতের মুঠোতে রাখা আংটিটা পকেটে ভরে নেয়।

রাইদা,রুহি,পায়েল,বাপ্পি গাড়িতে উঠে বসে।কিছুক্ষণ পর অর্ক আর ফাহিম আসে। ওরা গাড়িতে উঠে বসলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়।বাকিরা কথা বলতে থাকে কিন্তু রাইদা মুখ ভাড় করে রাখে। ফোন বেজে উঠলে রাইদা দেখে সায়ন কল দিয়েছে। কল কেটে রাইদা ফোন সাইলেন্ট করে দেয়।একটু পর সায়ন আবারো কল দেয়,পরপর কয়েকবার কল দেয় কিন্তু রাইদা কল রিসিভ করে না।

রাইদার বাসার সামনে যখন গাড়ি থামে তখন রাত দশটা বাজে প্রায়। গাড়িতে এখন শুধু ড্রাইভার,রাইদা,পায়েল আর অর্ক আছে বাকিরা নিজেদের বাসার এলাকায় নেমে গেছে। অর্কের বাসা ফেলে এসেছে কিন্তু অর্ক নামেনি সে রাইদাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই নিজের বাসায় যাবে।

রাইদা গাড়ি থেকে নেমে হাত নাড়িয়ে দু’জনকে বিদায় দেয়।গাড়ি চলে গেলে বিল্ডিং এ ঢুকে। লিফট এ উঠে চলে আসে চার তলায়। বাসার কলিংবেল চাপ দিতেই মর্জিনা খালা দরজা খুলে। রাইদা কোথাও না তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে যায়। রুমের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতে নিলেই রওশন আরা রুমে প্রবেশ করে।
রাইদা তাকে পাত্তা না দিয়ে ড্রেসিং টেবিল এর সামনে বসে মেকআপ রিমুভ করতে শুরু করে। রওশন আরা গম্ভীর মুখে রাইদার কার্যকলাপ দেখতে থাকে।

‘কিছু বলবে? এভাবে তাকিয়ে আছো মনে হচ্ছে আমি শিকার আর তুমি শিকারী। সুযোগ পেলেই হামলে পড়বে আমার উপর।তোমার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছো।’,মেকআপ তুলে রওশন আরাকে জিজ্ঞেস করে রাইদা।

‘তুই বিয়ে করেছিস এটা কি সত্যি? ‘,গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে রওশন আরা।

রওশন আরার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে রাইদা বিচলিত হয় না। সে মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো যে কোনো দিন রওশন আরা এসব জানতে পারবে সেটা ভেবেই।

‘কে বললো এই নিউজ?’,রাইদা চুল আঁচড়ে জিজ্ঞেস করে।

‘তুই কি চেয়ারম্যানের সেই লাফাঙ্গা ভাগিনাকে বিয়ে করছিস? যেটা জিজ্ঞেস করি সেটার উত্তর দিবি বাড়তি কথা বলবি না।’

‘যে খবর দিয়েছে সে তো বলেছেই বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে আবার
জিজ্ঞেস করছো কেনো নাকি বিস্তারিত শুনতে চাইছো?’

রাইদার এমন খামখেয়ালি কথা শুনে রওশন আরা রেগে যান। দ্রুত হেঁটে এসে রাইদার চুল ধরে ডান গালে চ*ড় বসায়।

‘তোর যখন ঐ ছেলেই পছন্দ ছিলো তাহলে বললি না কেনো আমাদের? সেই সময়ই আমার সন্দেহ হইছিলো ঐ ছেলের সাথে তোর প্রেম আছে না হলে ছেলের ঠ্যাকা পড়ছে নাকি তোর পিছন পিছন ঘুরবে? এত বছর ধরে প্রেম করলি কিন্তু এমন ভান করেছিস যেনো তুই সাধু।বিয়ে যখন ঐ ছেলেকেই করতে চাচ্ছিলি তখন এতো নাটক করলি কেন গ্রামবাসীর সামনে?’

‘এই বিষয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না।’
রাইদা রওশন আরার সামনে থেকে সরে ওয়াশরুমে যেতে নিলে রওশন আরা রাইদার চুল টেনে ধরে।

‘বিয়ে করছিস আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না? বিয়ে না হলে জানতামই না ঐ ছেলের সাথে তোর প্রেম চলে। এখন বুঝলাম হুটহাট করে বন্ধুদের সাথে তোর এতো ঘুরা হতো কিসের আসলে তুই বন্ধুদের নাম করে ঐ ছেলের সাথে ঘুরতি।’

রওশন আরার মুখে আজেবাজে কথা শুনে রাইদা আর মেজাজ ধরে রাখতে পারে না চিৎকার করে উঠে।

‘অনেক হয়েছে তোমার ফালতু কথা এখন চুপ করো। যা জানো না তা নিয়ে দয়াকরে কিছু বলবা না।আমার রুম থেকে বের হও এক্ষুণি। ‘

দরজার দিকে ইশারা করে রাইদা বলে। রাইদার কথা শুনে রওশন আরা আরে চেতে যান, আবারো রাইদার ডান গালে আবার চ*ড় দেন।

‘ছি ছি তোর মতো মেয়ে আমি পেটে ধরছি ভাবলেই এখন আমার কেমন লাগে।আমি তো আগেই জানতাম তুই আমাদের মুখে চুনকালি দিতে জন্ম নিছিস।’

‘না আমার ঐ লোকটার সাথে কোনো সম্পর্ক কখনো ছিলো না এখন আছে।বিয়েটা হয়েছে শুধুমাত্র গ্রামের লোকদের কারণে। আমি তো বিয়ে করতেই চাচ্ছিলাম না জোর করে বিয়ে পড়ানো শুরু করে শেষে খালামনির কথায় আমি কবুল বলি।যেই বিয়েতে আমার মত ছিলো না সেই বিয়ে আমি মানি না।’

‘তোর বাপ আসুক আজকে তারপর তার আদরের মেয়ের কীর্তি শুনে বিচার করবে।’

রওশন আরার কথার মাঝে কলিংবেল বেজে উঠে। মর্জিনা খালা গিয়ে দরজা খুলে। হুড়মুড়িয়ে রাইদার রুমে মান্নান রাফায়েত প্রবেশ করে।

‘কি হয়েছে কল দিয়ে কান্নাকাটি কেনো করছিলে তখন?’,স্ত্রীকে প্রশ্ন করে মান্নান রাফায়েত।

‘তোমার মেয়ে ঘুরতে গিয়ে বিয়ে করে ফিরেছে তাও এমন এক ছেলেকে যার চরিত্রে সমস্যা। মাইমুনা আজকে আমাকে কল দিয়ে সব বিস্তারিত বলছে। রাতের বেলা নাকি তোমার মেয়ে ঐ ছেলের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় ছিলো তখন গ্রামবাসী ধরে বিয়ে পড়িয়ে দেয় আর সেই কথা তোমার মেয়ে আমাদের জানায় নায়।’,রওশন আরা রেগে বলতে থাকেন কথাগুলো।

‘একদম সায়নের চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলবা না। ও হয়তো একটু পাগলামি বেশি করে কিন্তু ওর চরিত্র যথেষ্ট ভালো। তোমার বোন বানিয়ে বানিয়ে বললো আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে? বিয়েটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো, না এতে আমার হাত ছিলো না সায়নের। কোনো কিছু না জেনে সেই বিষয়ে নাক গলাবা না।’,রওশন আরার কথার বিপরীতে বলে রাইদা।

‘এখন ঐ ছেলে ভালো হয়ে গেছে একেবারে তুলশী পাতা? যা তাহলে ঐ ছেলেকে বল ওর বাসায় তোরে নিয়ে আমাদের ঘাড় থেকে যেনো বোঝা নামায়।’,রাইদার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে রওশন আরা।

মান্নান রাফায়েত রওশন আরাকে থামায়,রাইদাকে সাইডে নিয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞেস করে।

‘তুই আমাকে বিস্তারিত বল কি হয়েছে।’,মান্নার রাফায়েত জিজ্ঞেস করে।

রাইদা কথার কোনো জবাব দেয় না।

‘কি হলো বল সব।’,রাইদার বাহু ধরে মান্নান রাফায়েত জিজ্ঞেস করে।

‘কি করে জবাব দিবে ওর মুখ আছে নাকি?’,রওশন আরা মুখ বাকিয়ে বলে।

‘আরেকটা কথা বললে এ বাসা থেকে আমি বেড়িয়ে যাবো আর ফিরবো না এটা বলে দিলাম।’,রাইদা দাঁতে দাঁত চেপে বলে।

‘বের হ আমার বাসা থেকে এখনই বের হবি। তুই একটা আপদ আমাদের ঘাড়ে।তোর জন্মের পরই যত দুঃখ কষ্ট আছে আমার জীবনে আসছে। জন্মের সময় নিজের দাদাকে খাইছিস এরপর দাদীকে খাইছিস।আমি শিওর আমার পোলাটারেও তুই খাইছিস। আমার বাপের বাড়ি গেলি আমার বাপটারেও খাইলি।তুই একটা অপয়া মেয়ে তোর পা যেই বাড়িতে পড়বে সেই বাড়ির মানুষ গুলো শেষ করেই বের হবি।’

রওশন আরার মুখে এমন কথা শুনে রাইদা আর এক সেকেন্ড ও সেখানে দাঁড়ায় না। লাগেজ বের করে নিজের কাপড় চোপড় ভরতে শুরু করে। মান্নান রাফায়েত বারবার রাইদাকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। লাগেজে কাপড় ভরে রাইদা সোজা চলে যায় ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বের হতে। পিছন থেকে মান্নান রাফায়েত রাইদার হাত ধরে আটঁকায়।

‘আমাকে যেতে দাও বাবা না হলে তুমি আমার ম*রা মুখ দেখবে।’

রাইদার এমন কথায় মান্নান রাফায়েতের হাত আলগা হয়ে যায়। দরজা খুলে লাগেজ টেনে নিয়ে রাইদা সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। মান্নান রাফায়েত অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।


চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here