সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -২৯

পর্বঃ২৯
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)

রাত বাড়ছে সাথে কমছে গাড়ির হর্ণের শব্দ। জ্যাম নামক বিরক্তিকর বিষয়টা রাত বাড়লে কমে যায়, যার ফলে বাড়ি ফেরার রাস্তাটার দূরত্ব কম মনে হয়।

সময় রাত ১টা, সিলভার রঙের হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয় সায়ন। গ্যারাজে গাড়ি পার্ক করে গাড়ির চাবি আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে বাসার দরজায় কলিংবেল দেয়। দরজা খুলে মিসেস রিনা মুখ আঁধার করে দাঁড়িয়ে থাকে।

‘কি হলো তোমার চাঁদ মাখা মুখে এমন আমাবস্যা কেনো? বাবার সাথে ঝগড়া করেছো নাকি আবার?’,সোফায় বসে জুতা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

‘একদম কথা ঘুরাবি না। বউমাকে বাসায় আনবি না সেটা বুঝলাম কিন্তু আমাকে নিয়ে গিয়ে তো দেখা করাতে পারিস সেটাও করাচ্ছিস না। এমন না যে তোর শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে চাচ্ছি যাবো তো তোর ফ্ল্যাটেই সমস্যা কোথায়?’, মিসেস রিনা সায়নের পাশে বসে কথাগুলো বলে।

‘তোমার বউমা যে অনেক জেদি এটাই বড় সমস্যা। এক মূহুর্ত হাসবে পর মূহুর্তে রেগে যাবে বিনা কারণে। ফ্ল্যাটটা আমার সেটা জানলে ও কখনোই থাকতে চাইবে না তাই মিথ্যা বলে ওকে নিজের ফ্ল্যাটে রাখছি। এখন ওরে যদি এ বাসায় আনতে চাই ভাববে স্বামীর অধিকার খাটাতে চাই আবার তোমাকে যদি দেখা করাতে নেই তখন ভাববে সংসারে বাঁধতে চাচ্ছি তাই পরিবারের সাথে দেখা করাচ্ছি।’, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সায়ন বলে।

‘সবই বুঝলাম কিন্তু একবার ফোনে কথা তো বলাতে পারিস নাকি সেটাতেও তোর বউ রাগ করবে? বউয়ের ছবিও দেখাস না।’,অভিমানীর স্বরে বলে মিসেস রিনা।

মিসেস রিনার অভিমান দেখে সায়ন মিসেস রিনার কোলে মাথা রেখে সোফায় শুয়ে পরে।

‘বিষয়টা তেমন না আসলে শুরু থেকেই তেমার বউমার সাথে এতো ঝামেলা করেছি আবার বিয়েটাও হয়েছে ঝামেলা করে তাই এখন আমি নিজের কোনো ইচ্ছে ওর উপর চাপিয়ে দিয়ে আমার প্রতি ওর মনোভাব আর নষ্ট করতে চাই না। সে তো সরাসরি বলে দিয়েছে আমাকে অপছন্দ করে।’

সায়নের কথা শুনে মিসেস রিনা চুপ হয়ে যায়। হাত দিয়ে সায়নের চুল গুলো হাতরে দেয়।

‘খাবার গুলো ওর কেমন লেগেছে কিছু বলেছে?’,মিসেস রিনা উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘খাবারগুলো দেখে অনেক খুশি হয়েছে। আমি যখন বের হচ্ছিলাম বললো তোমাকে ধন্যবাদ দিতে। তোমার চিংড়ি ভুনা নাকি ওর মায়ের রান্না থেকেও মজা।’

সায়নের কথা শুনে মিসেস রিনা অনেক খুশি হয়।

‘তোমার ছেলে আজকে ম্যানেজারকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চৌদ্দ দিনের ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। এখন বুঝলাম তার কেনো ছুটি লাগবে। ইমতিয়াজ সায়ন তোমার কি মনে হয় মাত্র চৌদ্দ দিনে বউকে পটিয়ে ফেলবা?’, বসার ঘরে ঢুকে সোফায় বসে কথাগুলো বলে সায়নের বাবা আরমান শেখ।

‘বউ পটানো এতো সহজ নাকি তাও যদি হয় বাঘিনী! ছুটিটা নিয়েছে কারণ ওরে এই মূহুর্তে একা ছাড়া উচিত না। বাসার বাহিরে একা থাকছে কখন কোথায় যায় ঠিক নেই, এখন তো আমার উচিত স্বামী হিসেবে ওরে চোখে চোখে রাখা।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘চৌদ্দ কেনো দরকার হলে তুই এক মাস ছুটি নে তাও বউমাকে বাসায় নিয়ে আয় জলদি।’,মিসেস রিনা বলে সায়নকে।

‘তোমার ছেলে ছুটি নিলে অফিসের কাজ কে করবে? ম্যানেজার কি সব পারবে নাকি? এক কাজ করি যতদিন ছুটি ততদিনের বেতন কেটে রাখবো।’,হাই তুলে বলেন আরামন শেখ।

‘বেতন কাটলে তোমার অফিসের সামনে বসে অন্বেষণ করবো। এখন তো আমি সিঙ্গেল না বউ আছে, বউকে খওয়াতে পড়াতে হলেও টাকা লাগবে। এখন শ্বশুর মশাই দিচ্ছে কিন্তু বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে বউয়ের ভার্সিটির সেমিস্টার ফি ও তো আমার দেওয়া উচিত। এই বিবাহিত ব্যাচেলরের বেতন কাটবেন না প্লিজ স্যার।’,মিসেস রিনার কোল থেকে উঠে আরমান শেখের সামনে দুই হাত জোর করে কথাগুলো বলে সায়ন।

সায়নের কথা শুনে মিসেস রিনা আর আরমান শেখ দু’জনেই শব্দ করে হাসে।
হসির শব্দ পেয়ে সায়ন্তিকা রুম থেকে বের হয়।

‘কিরে তোর চেহারার এই অবস্থা কেনো? ভার্সিটি পছন্দ হয় নায়?’,আরমান শেখ সায়ন্তিকাকে জিজ্ঞেস করে।

‘তোমার মেয়ে ভার্সিটির সিনিয়র আপু দ্বারা বিরক্ত।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘আর বলো না আমি নাচ পারি না সেই আমাকে ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে নাচ করার জন্য সিলেক্ট করছে। কে সিলেক্ট করছে জানো ঐ আপুটা। আমাকে জব্দ করতে উনি এই কাজ করছে শিওর আমি। কালকে থেকে অনুশীলন আর আমি এখনো অজুহাত খুঁজে পাচ্ছি না যেটা বলে এই অনুশীলন থেকে বাঁচবো।’, সায়ন্তিকা জবাব দেয়।

‘দাও তোমার মেয়েকে বুদ্ধি আমি রুমে গেলাম ঘুম পাচ্ছে অনেক।’,কথাটা বলে সায়ন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

‘খাবি না? আমি অবশ্য বাসায় ফিরে তোর মায়ের সাথে খেয়েছি।’,আরামান শেখ জিজ্ঞেস করে সায়নকে।

‘না তোমার বউমার সাথে খেয়ে এসেছি।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘নিপা চা দিচ্ছে তোর বাবাকে তোর রুমে চা পাঠাবো?’,মিসেস রিনা জিজ্ঞেস করে সায়নকে।

‘না কিছু লাগবে না এখন আর। গেলাম আমি ঘুমাতে কালকে কাজ আছে।’,কথাগুলো বলে নিজের রুমে চলে যায় সায়ন।

আরমান শেখ সায়ন্তিকার সাথে ছোট মিটিং বসায় কীভাবে কি করা যায়। রান্নাঘর থেকে নিপা এসে চা দিয়ে যায়। বাবা মেয়েকে গল্প করতে দেখে মিসেস রিনা রুমে চলে যায়।

..

রুমে এসে গায়ের শার্টটা খুলে বিছানায় রেখে ওয়ারড্রবের উপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে বিছানায় বসে সায়ন। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে যত্নসহকারে লাইটার দিয়ে তাতে আগুন ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে রাইদার কথা।

আজকে রাইদার ব্যবহার সায়নের কাছে কিছুটা ভিন্ন লেগেছে। তখন কোলে তুলে নিলেও রাইদা কোনো প্রতিবাদ করেনি উল্টো হাসতে থাকে বিষয়টা সায়নকে অবাক করার সাথে সাথে ভাবতে বাধ্য করছে। সায়নের সাথে আগের তুলনায় ভালো ব্যবহার করেছে রাতে খাইয়ে তারপর বাসায় ফিরতে বলেছে সবকিছু ভেবেই সায়ন খুশি হবে নাকি চিন্তিত হবে সেটাও বুঝতে পারছে না। রাইদার বাবার কাছ থেকে শুনেছিলো রাইদা বেশ জেদি যেটা করতে চায়না সেটা ওরে দিয়ে করানো অসম্ভব আর এই দু’দিনে সায়নের প্রতি রাইদার কোনো অনুভূতি আসবে এটা যে অসম্ভব তা জানে সায়ন।

হুট করে চোখ খুলে সামনে থাকা দেয়ালে তাকায় সায়ন।

‘যা হবার হোক রি আমার কাছে আছে আমাকে আপন করে নিচ্ছে এতে এতো ভাবার কি আছে? আমিই বেশি ভাবছি হয়তো ওর দিক থেকে সত্যিই অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে। আমার তো রি কে চাই শুধু বাকি সব চুলোয় যাক এতে যদি ও আমার প্রা*ণ নিজ হাতে নিয়ে নেয় আমি রাজি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার ছাড়বো না রি।’,একা একা কথাগুলো বলতে থাকে সায়ন।

হাতের সিগারেটটা শেষ করে বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে নেয় সায়ন।

গোসল করে বের হয়ে বিছানায় গিয়ে শোয় সায়ন। চোখ বন্ধ করে পাশের বালিশটাকে জড়িয়ে ধরে সেই বালিশের কভারটা থেকে রাইদার ব্যবহৃত শ্যাম্পুর আলতো ঘ্রাণ আসছে, গ্রাম থেকে বালিশের কভারটা এনেছিলো।

ধীরে ধীরে ঘুমে এসে ভর করে সায়নের নয়নে। প্রেয়সীর কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে।
….

সকাল সকাল হাই তুলে ঘুম চোখে ক্লাস করছে রাইদা। গত রাতে এসাইনমেন্ট করতে বসেছিলো যার কারণে রাত জাগতে হয়েছে তাকে। ঘাড় এপাশ ওপাশ করে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে সে।

ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের ফেলেই ক্যান্টিনে দৌড় দেয় রাইদা। ক্যান্টিনে বসে নিজের পছন্দের মিল্কশেক অর্ডার করে।
অর্ক,বাপ্পি,পায়েল এসে চেয়ার টেনে বসে। ডিউটি থাকায় রুহি আসেনি আর ফাহিম সারারাত এসাইনমেন্ট করে বাসায় ঘুমাচ্ছে।

‘তোদের এসাইনমেন্ট শেষ হয়েছে? আগামীকালকে জমা দিতে হবে। আমার তো এখনো অর্ধেক বাকি।’,বিরক্ত হয়ে বলে বাপ্পি।

‘আমার অল্প বাকি আজকে করলেই শেষ হবে।’,রাইদ জবাব দেয়।

‘আমারটা শেষ আমি আগেই করে ফেলেছিলাম তোদের মতো ডেডলাইনের আগের কান্নাকাটি করি না।’,পায়েল জবাব দেয়।

‘অর্কের তো চিন্তা নেই ওরটা তো অন্য কেউ করে দেয়।’,গলা ঝেরে বলে রাইদা।

রাইদার কথা শুনে অর্ক চোখ গরম করে তাকায়। অর্কের দিকে তাকিয়ে গা জ্বালানি এক হাসি দেয় রাইদা।

‘ফালতু কথা বললে তোরে এসাইনমেন্ট গুলিয়ে খাইয়ে দিবো।’,অর্ক গম্ভীর স্বরে বলে।

‘আপু আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।’,সায়ন্তিকা এসে রাইদার সামনে দাঁড়িয়ে বলে।

সায়ন্তিকার কথা শুনে রাইদা হাসি থামিয়ে তাকায়।

‘বলো শুনছি।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে নাচের লিস্টে আমার নামটা দিয়েছেন সেটা কেটে দেন আমি নাচতে ইচ্ছুক না।’,সায়ন্তিকা বলে উঠে।

‘কি বললে? আমাকে কি তোমাদের ডিপার্টমেন্টের পিওন লাগে? নিজের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কথা বলো আমায় কেনো এসব বলছো আজব?’,বিরক্ত হয়ে বলে রাইদা।

‘আপনিই তো ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে নাচের জন্য সবাইকে সিলেক্ট করেছেন। আমি নাম দেইনি তারপরও আপনি আমার নামটা দিয়েছেন।’,সায়ন্তিকা রাইদার কথার বিপরীতে বলে।

‘দেখো এইবার আমি ব্যস্ত থাকায় অনুষ্ঠানে নাচের জন্য কাউকে সিলেক্ট করিনি সব করেছে ডিপার্টমেন্টের হেডরা। তোমার উচিত ছিলো আমাকে এসব বলার আগে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খোঁজ নেওয়া। চিলে কান নিয়ে গেছে কথাটা শুনে চিলের পিছনে না দৌড়ে কানে হাত দিয়ে আগে দেখো কানে আছে কিনা।’,সায়ন্তিকাকে কথাগুলো বলে রাইদা।

রাইদার কথা শুনে সায়ন্তিকা মুখ ভাড় করে ফেলে।
ছোটু এসে রাইদার মিল্কশেক টেবিলে রাখে।

গ্লাসটা হাতে নিয়ে সায়ন্তিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে রাইদা,’মিল্কশেক খাবা? দাঁড়িয়ে আছো কেনো এখনো এখানে?’

সায়ন্তিকা লজ্জা পেয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়।

‘আমি একটু আসতেছি তোরা ক্লাসে যা খাওয়া শেষ করে।’,ফোন হাতে কথাগুলো বলে বাপ্পি ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়।

‘আজকে তো মেয়েগুলোকে নাচের অনুশীলন করাতে হবে দূর ঝামেলা।’,বিরক্ত হয়ে রাইদা বলে।

‘তুই তো প্রথম সেমিস্টারে সেধে এই ঝামেলা ঘাড়ে নিয়েছিস সেই জন্য এখন প্রতি সেমিস্টারের ওরিয়েন্টেশনে তোর হাতে ঝামেলা ধরিয়ে দেয়।’,পায়েল রাইদাকে ফোঁড়ন কেটে বলে।

‘বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই আমার এসাইনমেন্ট বাকি তাই জলদি বাসায় ফিরবো। তোর তো কাজ নেই তুই আমার বদলে মেয়েগুলাকে অনুশীলন করাবি। আমি জাস্ট প্রথমে গিয়ে উঁকি মেরে দেখবো বাকিটা তুই বুঝবি।’,রাইদা পায়েলকে বলে।

‘তুই বললি আর আমি শুনবো নাকি? তোর ঝামেলা তুই বুঝ।’,রাইদাকে ভেংচি দিয়ে পায়েল বলে।

‘ঠিক আছে আমার কাছে আবার কোনো সহায়তা চাইলে আমিও এভাবে বলবো।’
রাইদার কথা শুনে পায়েল হেঁসে দেয়।

‘অর্ক তোর কিছু হয়েছে? তোকে চিন্তিত লাগছে।’,রাইদা জিজ্ঞেস করে।

‘আপুর সম্পর্কের কথা বাসায় জেনে গেছে সেটা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। আপুর প্রেমিক বেকার তাই বাসায় বলেছে সম্পর্ক ভেঙে দিতে।’,অর্ক জবাব দেয়।

‘বড় ভাইয়া কি বলেছে এ বিষয়ে? ‘,রাইদা আবারো প্রশ্ন করে।

‘ভাইয়ার অফিসের এক কলিককে তার ভীষণ পছন্দ সে চায় সেই ছেলের সাথে আপুকে বিয়ে দিতে। বললো কাল কিংবা পরশু সেই কলিককে বাসায় দাওয়াত দিয়ে এনে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিবে।’,হতাশ হয়ে অর্ক বলে।

‘তুই চিন্তা করিস না যেদিন সেই ছেলেকে দাওয়াত দিবে আমাদের জানাবি। আমরা গিয়ে ঐ ছেলেকে বুঝাবো সাথে ভাইয়াকে ও বুঝাবো।’,অর্কের বাহুতে হাত রেখে রাইদা বলে।

রাইদার কথা শুনে অর্ক কিছুটা ভরসা পায়।
কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ক্লাসের সময় হলে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে তিনজনে ক্লাসে চলে যায়।

..

এক ফ্যাক্টরির সামনে এসে গাড়ি থামায় সায়ন। ফোন বের করে ‘শ্বশুর মশাই’ নামে সেভ করা নাম্বারে কল দেয়। দুবার রিং হতেই কল রিসিভ করে মান্নান রাফায়েত।

‘তুমি চলে এসেছো?’,মান্নান রাফায়েত ফোনের অপরপাশ থেকে জিজ্ঞেস করে।

‘জি শ্বশুড় মশাই, আপনার কি সময় লাগবে?’,সায়ন জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি দু’মিনিট অপেক্ষা করো আমি আসছি।’,মান্নান রাফায়েত জবাব দেয়।

কল কেটে গাড়িয়ে থেকে নেমে সায়ন ফ্যাক্টরির দিকে তাকায়। সায়ন যতটুকু জানে এই ফ্যাক্টরির অফিসের ম্যানেজার মান্নান রাফায়েত। গত রাতে যখন রাইদার সাথে শপিং সেরে ফ্ল্যাটে ফিরে তখন মান্নান রাফায়েত কল দিয়ে আজকে দেখা করতে বলে তাই ঘুম থেকে উঠেই সায়ন দেখা করতে এসেছে।

‘তোমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম আসো আমরা পাশের ক্যাফেতে বসি।’,মান্নান রাফায়েত এসে সায়নকে বলে।

‘আরে না সমস্যা নেই। আপনি কি আজকে ফ্যাক্টরি ভিজিটে এসেছেন?’,সায়ন মান্নান রাফায়েতকে প্রশ্ন করে।

‘হ্যা সাপ্তাহিক ভিজিটে এসেছি। রাইদা কি ভার্সিটিতে?’

‘আমার সাথে ওর এখনো দেখা হয়নি। বাসা থেকে বেরিয়ে এখানে আসলাম আপনার সাথে দেখা করতে।’

‘আমি জানতাম মেয়েটা তোমাকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিবে। ওর মায়ের সাথে ঝগড়া হলে আমাকে ওর মা ফ্ল্যাট থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিতো আবার রাগ কমলে নিজেই ডেকে ভেতরে নিতো। মেয়েটা রাগের ধরণ পেয়েছে একদম মায়ের মতো।’

কথাগুলো বলে মান্নান রাফায়েত জোরে জোরে হাসতে থাকে। সায়নও হেঁসে দেয় শ্বশুড়ের কথা শুনে।

হাঁটতে হাঁটতে ক্যাফেতে চলে আসে দু’জনে। ভেতরে প্রবেশ করে এক কর্নারে বসে জামাই শ্বশুড়।

‘গতরাতে কল দিয়ে দেখা করতে বললেন কোনো সমস্যা? ‘, ইতস্তত করে সায়ন প্রশ্নটা করে।

‘আমি অনেক ভেবে দেখলাম রাইদার বিষয়ে তোমাকে কিছু কথা জানানো উচিত যেহেতু তুমি ওর স্বামী তার উপর তোমাদের মধ্যে ঝামেলা চলছে। রাইদার ছোট বেলা নিয়ে কিছু কথা জানাতে তোমায় এখানে ডেকেছি।’

মান্নান রাফায়েতের কাছ থেকে এমন কথা শুনে সায়ন আগ্রহ প্রকাশ করে কথা গুলো শোনার জন্য।

‘বলুন আমি শুনতে চাই।’,সায়ন আগ্রহী হয়ে বলে।

‘আমার আর রাইদার মায়ের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়েছিলো। আমার বাবা রাইদার নানার বন্ধু ছিলো। একবার বাবা তার বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যায় তখন রাইদার মা রওশনকে সাথে করে নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে আনে। ঢাকায় এসে রওশন আর গ্রামে ফিরতে চায় না তাই সকলের সম্মতিতে আমার সাথে বিয়েটা পড়ানো হয়। রওশনের বয়স অল্প ছিলো আর ও পড়তে চাইতো তাই বাবা ওরে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। মা-বাবা কখনোই রওশনকে সংসারের দায়িত্ব একেবারে নিতে বলেনি তারা চাইতো রওশন নিজের পড়াশোনা শেষ করে তারপর সংসার সামলাক আর আমিও বাঁধা দিতাম না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে রাইদার ওর মায়ের গর্ভে চলে আসে যার কারণে রাইদার মা অনেক মন খারাপ করে।’, এই টুকু বলে মান্নান রাফায়েত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

সায়ন কৌতুহল চোখে মান্নান রাফায়েতের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘রাইদা পেটে থাকায় ওর মা অনেক অসুস্থ হয়ে যায় যার ফলে ও সেই বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। রাইদার জন্মের পর থেকে ওর রওশন ওর প্রতি অনেক উদাস থাকতো। ওর খালি মনে হতো রাইদা ওর স্বাধীনতা, আনন্দ, সুখ সব কেঁড়ে নিয়েছে। এসব দেখে বাবা পরের বছর রওশনকে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে বলেন কিন্তু সে বছর আমার বাবা দুনিয়া ত্যাগ করেন। বাবা চলে যাওয়ায় সংসারের সব দায়িত্ব আমার উপর এসে চাপে। রাইদার মা কে আমি ঠিক মতো সময় দিতে পারতাম না। একসময় রওশন বান্ধবী বানিয়ে ওদের সাথে ঘুরতে শুরু করে আমি বাঁধা দিতাম না তবে এতো কিছুর মধ্যে আমার মেয়েটা অবহেলায় বড় হতে থাকে। রাইদা তার দাদীর কাছে থাকতো কিন্তু ওর যখন দুই বছর বয়স তখন মা ও চলে যায় আমাদের ছেড়ে, আমার মেয়েটা তার দাদীকে হারিয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়। মেয়েটার দেখাশোনা হয় না ঠিক মতো তাই আমি ওরে হোস্টেলে দিয়ে দেই। রওশন যখন আবারো প্রেগন্যান্ট হয় রাইদার বয়স তখন দশ। ভেবেছিলাম রাইদা বাসায় থাকলে রওশনের ভালো লাগবে তাই ওকে হোস্টেল থেকে নিয়ে এসেছিলাম বাসায়। রাইদা বাসায় ফেরার এক সপ্তাহের মাথায় রওশনের মিসক্যারেজ হয় যায় সম্পূর্ণ দোষ রওশন দেয় রাইদাকে। ছোট মেয়েটা কি বুঝেছিলো কে জানে নিজেই নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বলে তাকে যেনো হোস্টেলেই রেখে আসি। আমিও নিজের স্ত্রীকে সামলাতে গিয়ে মেয়ের কথা ভুলে যায়। মেয়েটাকে একটু আদর কিংবা ভালোবাস দেইনি।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে মান্নান রাফায়েতের গলা ধরে আসে। সায়ন কি বলবো কোনো কথাই খুঁজে পায় না।

‘রাইদা যখন ক্লাস এইটে উঠে তখন সে জেদ করে নানা বাড়িতে গিয়ে থাকবে হোস্টেলে নাকি ওর ভালো লাগে না আর। ওর কথায় বরিশালে ওর নানা বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। রাইদার নানা-নানী ওরে আদর করতো তবে ওর খালারা তেমন পছন্দ করতো না ওরে। এক বছর থাকার পর এক রাতে কল দিয়ে রাইদা কান্নাকাটি করে তাকে যেনো আমার কাছে এনে রাখি আমিও মেয়ের কথা না ফেলে ওরে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করি। ওর সাথে গ্রামে কি হয়েছিলো জানিনা সেটা তবে ঢাকায় ফেরার পর মেয়েটা আমার অন্যরকম হয়ে যায়। কারো সাথে কথা বলতো না,কারো সাথে মিশতো না। স্কুলে ভর্তি করানোর পর তিনমাস সে ক্লাসই করেনি এক রুমে নিজেকে বন্দি করে ফেলেছিলো। ধীরে ধীরে মেয়েটা স্কুলে যেতে শুরু করে আর তখনই এক নতুন রাইদাকে আমরা আবিষ্কার করি, মেয়েটা সম্পূর্ণ বদলে যায়। ছোট বেলা থেকেই মায়ের সাথে দূরত্ব আমার কাছে বাবার আদর না পাওয়া মেয়েটা আজ এক রেখা,জেদি, কারো কথা শোনেনা।’

‘গ্রামে রি এর সাথে কি হয়েছিলো সে বিষয়ে কখনো কিছু বলেছে ও?’,মান্নান রাফায়েতের কথা শেষ হতেই প্রশ্ন করে সায়ন।

‘না আজ পর্যন্ত কখনোই সেই উত্তর আমরা পাইনি তবে ওর মা বলেছিলো তোমার সাথে নাকি রাইদার ঝামেলা হয়েছিলো। তুমি নাকি রাইদাকে কল দিয়ে বিরক্ত করতে তাই ওর মা ফোন সিম ভেঙে ফেলেছিলো রাইদার।’

‘সেই জন্যই এতোবছর কল দিয়েও রি এর সেই নাম্বার খোলা পাইনি। আপনার কি মনে হয় আমি ওর সাথে কোনো অসভ্যতা করেছি? গ্রামে থাকাকালীন রি কে কখনোই আমি বিরক্ত করিনি শুধু যখন ও ঢাকা ফিরে তখন বারবার ওরে কল দিতাম কথা বলতে কিন্তু ও আমার কল রিসিভ করতো না।’

‘দেখো বাবা তোমাদের মধ্যে কি নিয়ে ঝামেলা তা আমি জানি না তবে তোমার জন্য রাইদার ঐ অবস্থা হয়েছে সেটা আমি নিশ্চিত না কারণ এতে আমারো দোষ আছে রাইদার মায়েরও দোষ আছে আবার হতে পারে তুমি ছাড়াও গ্রামে থাকাকালীন এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যা ওকে কষ্ট দিয়েছে।’

‘আমারো মনে হয় গ্রামে ওর সাথে কিছু একটা হয়েছিলো যেটার কারণে ও আমার উপরও রেগে আছে।’,চিন্তিত হয়ে সায়ন বলে।

‘তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ কখনোই আমার মেয়েকে একা ছেড়ে দিও না। এতগুলো বছর ওর এলোমেলো ভালোবাসা বিহীন কেটেছে। তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছে তুমিই পারবে আমার মেয়েটাকে আগলে রাখতে। রাইদার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি তোমাকে দিলাম বাবা। আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো কখনো কষ্ট দিও না।’

মান্নান রাফায়েত সায়নের হাত ধরে বলে।

‘আপনি চিন্তা করবেন না আপনার দেওয়া এতো বড় দায়িত্ব আমি যথাযথ পালন করবো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার মেয়েকে আগলে রাখবো। ‘

‘আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন আর রি রাগ করে এমন কিছু করে আর ওকে কষ্ট দিয়েন না।’,সায়ন মান্নান রাফায়েতকে অনুরোধের স্বরে বলে।

‘এতো বছর পর রওশন তার ভুল বুঝতে পেরেছে তাই তো সে তার মেয়েকে কাছে চায় কিন্তু মেয়েটা এতো ট্রমার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এখন শক্ত পাথরে পরিণত হয়েছে। রাইদা এবার নিজেকে রওশনের থেকে দূরে সরিয়ে রওশনকে কষ্ট দিতে চায়। মা মেয়ের এই অবহেলার খেলায় মাঝে আমি অসহায়ের মতো চেয়ে আছি। একমাত্র অর্কই ওর জীবনে আসা বন্ধু যাকে ও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে আর ছেলেটাও ওর বিশ্বাস আগলে রেখেছে। এখন ভার্সিটিতে গিয়ে আগের তুলনায় অনেকটাই বদলেছে তবে রাগ, জেদ কমেনি।’

‘রি কে আমি আপনাদের কাছে আগের রি হিসেবে ফিরিয়ে দিবো আমাকে একটু সময় দিন। উপর থেকে শক্ত খোলস ধারণ করলেও ভেতরটা বড্ড নরম ওর।’

সায়নের কাছ থেকে উত্তর পেয়ে মান্নান রাফায়েত কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়।


চলবে..

(পর্বটা পড়ে লাইক,কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন কেমন লাগছে। কমেন্টে আপনাদের মতামত আশা করছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here