সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -৪৮

পর্বঃ৪৮
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষেধ।)

‘তোমার শ্বাশুড়ি যখন বিয়ের পর প্রথমবার রান্নাঘরে গিয়েছিলো বেচারি রান্না জানা সত্ত্বেও তরকারি পুড়িয়ে ফেলেছিলো। আমার মা আবার ছিলেন খুতখুতে স্বভাবের। নতুন বউ তরকারি পুড়ে ফেলেছে এটা নিয়ে সে আহাজারি করে। এরপরই তোমার শ্বাশুড়ি আমার কাছে এসে কান্না করতে করতে বলেছিলো আমার কখনো ছেলে হলে তার বউকে দিয়ে রান্নাই করাবো না। বউমা তোমার শ্বশুড়িকে জিজ্ঞেস করো তার এসব মনে আছে কিনা।’,কথাটা বলে আরমান শেখ জোরে জোরে হাসতে থাকে।

‘তোমার কি মনে হয় এসব আমি ভুলে গেছি? তোমার মায়ের ঐদিনের ব্যবহারে খারাপ লেগেছিলো তবে তিনি অনেক ভালো মানুষ ছিলো। অনেক কিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। আমিও আমার বউমাকে সব শিখিয়ে দিবো যা জানি। বউমা আবার তার ছেলের বউকে শেখাবে।’,মিসেস রিনা কথাগুলো বলে।

মিসেস রিনা আর আরমান শেখের কথা শুনে রাইদা কাশতে থাকে। সায়ন পানির গ্লাসটা রাইদার দিকে এগিয়ে দেয়। গ্লাসটা নিয়ে পানি খেয়ে নেয় রাইদা।

‘ছেলের বউকে দিয়ে কাজ করাবা বলে মেয়েকে কাজ শেখাওনি? মানুষ তো তোমাকে বলবে দজ্জাল শ্বাশুড়ি।’,কথাটা বলে সায়ন রাইদার দিকে তাকায়।

‘মেয়েকে কাজ তার শ্বাশুড়ি শেখাবে আমি কেনো শেখাবো? আর তোর কি মনে হয় একমাত্র বউমাকে দিয়ে কাজ করাবো আমি? মেয়েকে বিয়ে দিলে সে পর হয়ে যাবে কিন্তু বউমা সারাজীবন আমার সাথে থাকবে তাই সেই আমার আপন ঠিক বলেছি না বউমা?’

মিসেস রিনার মুখে এমন কথা শুনে রাইদা কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না।

‘তুমি যেহেতু বলেছো ঠিকই হবে।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘ছেলের বউ চলে আসছে তাই আমাকে এখন তোমরা তাড়ানোর প্লান করছো? ঠিক আছে চলে যাবো।’,সায়ন্তিকা অভিমানী স্বরে বলে।

‘জলদি বিদায় হ বহুত জ্বালাইছিস।’,সায়ন বলে।

‘বাবা ভাইয়া কি বলে শুনছো? আমি নাকি জ্বালাই? আমাকে সত্যি তোমরা এতো জ্বলদি তাড়িয়ে দিবা?’,সায়ন্তিকা কান্নান ঢং করে বলে।

‘তোদের দুই ভাই বোনকে বের করে দিবো বাসা থেকে। দু’জনে এক সাথে মিলে গলা ধরে কান্না করবি।’,মিসেস রিনা জবাব দেয়।

‘তা তো দিবাই বউমাকে পেয়ে গেছো এখন আমরা তো পর।’,সায়ন মিসেস রিনার কথায় ফোঁড়ন কেটে বলে।

মিসেস রিনা সায়নের কথার প্রতিবাদে কিছু বলে যা রাইদার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। কয়েক মূহুর্ত খাবার টেবিলে বসে তার নিজেকে কেমন অপরিচিত লাগছে। গভীর ভাবনায় ডুবে যায় সে।

তার মা কখনোই তার সাথে এভাবে ভালোবাসে কথা বলেনি। খাবার টেবিলে কখনোই সে তার মা-বাবাকে একত্রে পায়নি। ছোট বেলা তো দূরে থাক বড় হওয়ার পরও রাইদা একা একা খেতো অনেক সময় তার বাবাকে পাশে পেতো তবে কখনোই তার বাবা এভাবে তার সাথে মজা করেনি কিংবা খোলাখুলি ভাবে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করেনি যদিও এখন সময় বদলানোর পর মান্নান রাফায়েত একটু একটু করে মেয়ের সাথে মিশে তার সমস্যা গুলো জানার চেষ্টা করে।

হুট করে রাইদার খারাপ লাগা বেড়ে যায়। সায়নের পরিবারের আচরণ কিংবা তার প্রতি দেখানো ভালোবাসা অবিশ্বাস লাগছে। কোনো পরিবারের মধ্যে এতোটা বন্ডিং থাকতে পারে তা এতোদিন অজানা ছিলো তার কাছে।

রাইদার চোখ জোড়ায় অশ্রুরা এসে হানা দেয়। অশ্রুসিক্ত নয়ন সকলের থেকে আড়াল করতে খাবার রেখেই উঠে রুমে চলে যায় সে।

‘বউমার আবার কি হলো? সায়ন দেখ তো ওর আবার শরীর খারাপ লাগছে কিনা।’,আরমান শেখ চিন্তিত হয়ে সায়নকে বলে।

‘আমি দেখছি তোমরা খাওয়া শেষ করে আসো।’,খাবার রেখে হাত ধুয়ে সায়নও যায় রুমের দিকে।

বেসিনে হাত ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হয় রাইদা। খারাপ লাগাগুলো জমে তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। এই মূহুর্তে কিছুই ভালো লাগছে না তার।
রাইদা রুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে মাথা নুইয়ে থাকে।

‘কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? নাকি আবার মাথা ঘুরাচ্ছে?’,সায়ন এসে রাইদার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে।

রাইদা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। সায়ন চিন্তিত হয়ে রাইদার দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘কি হলো রি অনেক খারাপ লাগছে? তুমি বসো আমি ডাক্তারকে কল দিচ্ছি।’,কথাটা বলে সায়ন যেতে নিলে রাইদা তার হাত টেনে আঁটকায়।

সায়ন ঘুরে আবারো রাইদার দিকে তাকায়। রাইদা বসা থেকে উঠে চোখ বন্ধ করে সায়নকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। হঠাৎ রাইদার কান্নায় সায়ন ভ্যাবাচ্যাকা খায়। অস্থিয় হয়ে রাইদার কান্না থামানোর চেষ্টা করে।

‘বউ কাঁদছো কেনো? আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছো? বলো আমায় কি হয়েছে।’

রাইদা কোনো জবাব না দিয়ে সায়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। সায়ন কি করবে ভেবে পায় না। রাইদার কান্না তার সহ্য হচ্ছে না আবার কি হয়েছে সেটাও বুঝতে পারছে না।

‘বউমা কান্না করছে কেনো? তুই কি বলেছিস বল।’,মিসেস রিনা রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করে।

‘আমি তো কিছু করিনি ও কেনো কাঁদছে তাও বলছে না।’,সায়ন অসহায় চেহারা বানিয়ে বলে।

‘সর তুই দূর যা। নিশ্চয়ই মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছিস। এমনিতেই অসুস্থ তার উপর ওর সাথে করছিস ঝামেলা। তুমি আমার কাছে আসো।’,মিসেস রিনা রাইদাকে টেনে জড়িয়ে ধরে।

রাইদাও নিঃসংকোচে মিসেস রিনাকে জড়িয়ে ধরে তবে এতক্ষণে কান্না বেগ কমেছে।

‘কি হলো হঠাৎ? ‘,আরমান শেখ সায়নকে জিজ্ঞেস করে।

‘সেটা তো বলছে না। আমার মনে হয় ওর খারাপ লাগছে কোনো কারণে।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘আর কাঁদে না এমনিই শরীর অসুস্থ এতো কান্না করলে শরীর আরো খারাপ লাগবে।’,মিসেস রিনা রাইদার চোখ মুছে দিয়ে বলে।

‘শুনো বউমা সায়ন কিছু বললে সোজা এসে আমাকে বলবা আমি ওকে চাকরি থেকে বের করে দিবো।’,আরমান শেখ রাইদাকে বলে।

‘এভাবে বলবেন বস আমি বেকার হলে আমার স্ত্রী কে কি খাওয়াবো? প্লিজ আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি করবেন না।’,সায়ন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে।

‘বউমার চিন্তা করতে হবে না তার শ্বশুড় আছে তাকে দেখাশোনা করার জন্য তুমি নিজের চিন্তা করো।’,আরমান শেখ সায়নকে বলে।

‘ঠিক আছে আমিও আমার শ্বশুড়বাড়ি গিয়ে উঠবো।’,সায়ন বলে।

বাবা-ছেলের কথা শুনে রাইদা হেঁসে দেয়। রাইদার হাসি দেখে সায়ন স্বস্তি পায়।

‘এই যে বউমায়ের শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি আপনারা এখন বের হন আমি ঘুমাবো।’,সায়ন তার বাবা মাকে তাড়া দিয়ে বলে।

‘বিশ্রাম করো বিকালে আমরা আড্ডা দিবো।’,মিসেস রিনা রাইদার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।

রাইদা মাথা নাড়িয়ে মিসেস রিনাকে সুন্দর একটা হাসি উপহার দেয়। মিসেস রিনা আর আরমান শেখ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সায়ন্তিকা এতক্ষণ দরজার বাহির থেকে সব দেখছিলো। বাবা মা চলে যেতেই সে রুমে প্রবেশ করে।

‘দেখো আমি তোমাকে না দেখেই আগে থেকেই ভাবী মনে করি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তোমার সাথে ভার্সিটিতে আমার একটা ঝামেলা সেটা অন্য বিষয় তবে বাসায় তো তুমি আমার একমাত্র ভাবী। ভাইয়া যদি তোমাকে কখনো কষ্ট দেয় কিংবা তোমার কথা না শুনে তুমি আমাকে বলবা। দু’জনে মিলে ভাইয়াকে শায়েস্তা করবো। ভার্সিটিতে তুমি আমার শত্রু কিন্তু বাসায় আমার একমাত্র ভাবী।’,সায়ন্তিকা এসে রাইদাকে বলে।

রাইদা কথার জবাব না দিয়ে সায়ন্তিকাকে জড়িয়ে ধরে। সায়ন্তিকা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু রাইদা এভাবে তাকে জড়িয়ে ধরায় সে কিছুটা বিস্মিত।

‘বাহ্! ঘরের সব নতুন বউয়ের পক্ষ নিয়ে আমাকে পর করে দিলি। ঠিক আছে আমিও দেখবো কে তোর আবদার মেটায়।’,সায়ন বলে।

‘কেনো ভাবী মেটাবে আমার আবদার।’,সায়ন্তিকা জবাব দেয়।

‘এখন সর আমার বউকে ছাড়। যা রুম থেকে বের হ।’,সায়ন্তিকার হাত টেনে রুমের বাহিরে বের করে দেয় সায়ন।

‘ভাইয়া এটার শোধ কিন্তু নিবো পরে।’
সায়ন্তিকার বাকি কথা না শুনে সায়ন দরজা লাগিয়ে দেয়।
রাইদার ফোন বেজে উঠলে রাইদা দেখে অর্ক কল দিয়েছে। ফোন নিয়ে কল রিসিভ করে।

‘কিরে তোর কোনো খবরই নেই গতকালকে থেকে। কতগুলো কল দিয়েছি তুই কল ব্যাকও করিসনি। কোনো সমস্যা হয়েছে?’,অর্ক চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘আসলে একটু অসুস্থ হয়ে গেছিলাম সেইজন্য আজকে অনুশীলনে আসতে পারিনি।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘আরে রাখ তোর অনুশীলন। তুই এখন কোথায় আছিস? শরীর কেমন তোর?’,অর্ক আবারো জিজ্ঞেস করে।

‘আমি ঠিক আছি এখন। পরে তোকে বিস্তারিত সব বলবো কল রাখছি।’,কথাটা বলে রাইদা কল কেটে দেয়।

সায়ন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রাইদার কথা শুনছিলো। কল কাটতেই সে এগিয়ে এসে রাইদার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কোলে বসায়।

‘বিছানায় আরো জায়গা আছে আমি সেখানেই বসতে পারবো।’,রাইদা সায়নকে বলে।

‘সেটা তো আমিও জানি কিন্তু আমি তোমাকে বিছানায় বসতে দিতে চাচ্ছি না।’,সায়ন রাইদার কোমড় শক্ত করে জড়িয়ে বলে।

‘সরুন আমার বিরক্ত লাগছে।’

‘তুমি আমার থেকে কিছু লুকাতে চাচ্ছো কিন্তু পারছো না। এই টুকু আমি বুঝতে পেরেছি আফরিনের বিষয় নিয়ে তুমি আমার উপর রাগ করে নেই। তুমি রাগ করেছো অন্য কোনো বিষয় নিয়ে যেটা হয়তো অতীতে আমি করেছি।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা মৃদু হাসে।

‘আপনি স্মার্ট অনেক। এইটুকুতেই সব বুঝে নিলেন কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। আর রইলো আফরিনের কথা সে যদি আপনার স্ত্রী ও হয় তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি বরং হাসতে হাসতে তার হাতে আপনকে তুলে দিবো। অন্যের জিনিস কখনোই রাই নেয় না।’

রাইদার কথা শুনে সায়ন ক্ষেপার বদলে জোরে জোরে হাসতে থাকে।সায়নের এমন কাজে রাইদা ভড়কে যায়।

‘ঠিক আছে তুলে দিও আমার সমস্যা নেই। তুমি যদি আমাকে ছাড়া থাকতে পারো আমার তো সমস্যা নেই। আগে তো তোমাকে ছাড়া থাকতে শুধু আমি কষ্ট পেতাম এখন তো তা না তুমিও কষ্ট পাও আমাকে ছাড়া থাকতে। তুমি স্বীকার করো না অথচ ঠিকই আমার সাথে রাগ করে না খেয়ে নিজের এই অবস্থা করেছো। তোমার কি মনে হয় আমি এগুলো বুঝি না?’

সায়নের কথা শুনে রাইদা সায়নের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে যায়।

‘তোমার রাগ করার নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ আছে সেটা নিয়ে আমি কিছু বলবো না তবে এমন কিছু করো না যা আমাদের দু’জনকে কষ্ট দিবে।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা জবাব দেয় না। পাঞ্জাবি পাল্টে গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শোয় সায়ন।
একটু পর রাইদা গিয়ে বিছানায় বসে ফোন টিপতে থাকে।

..

বিকাল বেলা মিসেস রিনার সাথে রাইদা যায় ছাদে। মিসেস রিনা শৌখিন মানুষ। ছাদের ছোটখাটো একটা বাগান করেছেন নিজেই। রাইদার ঘুরেঘুরে ছাদবাগানের গাছ গুলো দেখছিলো। অনেক রকম ফুলগাছ সহ শাক সবজিও রয়েছে। মিসেস রিনা গাছ গুলোর আগাছা পরিষ্কার করছিলো আর তাকে নিপা সাহায্য করছিলো। ছাদের কিনারায় এসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে রাইদা।
মিসেস রিনার কাছ থেকে শুনেছে দোতলা এ বাড়িটা সায়নের দাদা শখ করে বানিয়েছিলো। তার নাকি ডুপ্লেক্স বাড়ির শখ ছিলো তাই তো সারাজীবন পরিশ্রম করে এটা বানিয়েছে। সম্পত্তি ভাগের সময় সায়নের দাদা তার বাবাকে এটা দিয়েছে কারণ তার বিশ্বাস ছিলো আরমান শেখ বাড়িটা তার স্মৃতি হিসেবে আগলে রাখবে।

বাসার মেইন গেটে নজর গেলে রাইদা দেখে সায়ন দারোয়ানোর সাথে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে। কি বলছে তা তো শোনার উপায় নেই তবে সায়নের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সিরিয়াস কিছু বলছে। রাইদার ইচ্ছে করে সায়নকে জ্বালাতে। ছাদের মেঝেতে তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে ছোট ছোট মাটির শক্ত দলা পেয়ে যায়। কয়েকটা মাটির দলা হাতে নিয়ে সায়নের দিকে তাক করে ছুঁড়ে মারে।

প্রথম টা লাগেনি তবে পরেরটা সায়নের পিঠে লাগে। পরপর আরো কয়েকটা মাটির দলা রাইদা ছুঁড়ে মারে। কি হচ্ছে দেখার জন্য সায়ন ঘুরলে তার কপালে এসে একটা দলা লাগে। ছাদে তাকিয়ে রাইদা দেখে সে যা বুঝার বুঝে যায়। রাইদা লুকানোর আগেই ধরা পড়ে যায়।

‘ছাদে আসতেছি তারপর এর শোধ নিবো দাঁড়াও।’,সায়ন চিল্লিয়ে বলে।

রাইদা ভেংচি দিয়ে মিসেস রিনার কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। ছাদে ছোট একটা টেবিল আর চারটে চেয়ার রয়েছে। ছুটির দিনে পরিবারের সকলে এসে এখানে বসে গল্প করে। নিপা ছোট টব গুলো এনে টেবিলে রাখছে সেগুলোর আগাছা কেটে পরিষ্কার করে দিচ্ছে মিসেস রিনা।

ছাদে এসে চেয়ার টেনে ধপ করে রাইদার পাশে বসে সায়ন। রাইদা সায়নকে দেখে না দেখার ভান করে।

‘মা তোমার কল এসেছে।’,সায়ন মিসেস রিনাকে বলে।

‘তো ফোন দে কথা বলি।’,মিসেস রিনা বলে।

‘তোমার ভাবী কল দিয়েছিলো আমি বলছি তুমি বিজি তাই কল কেটে দিয়েছে।’,সায়ন বলে।

‘তুই ও না সবসময় উল্টাপাল্টা কাজ করিস। ফোন কই আমার দে।’

‘ফোন তো নিচে রেখে আসছি। মনে হচ্ছিলো মামি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চাচ্ছিলো।’

সায়নের কথা শুনে মিসেস রিনা উঠে চলে যায়।

‘তুই আছিস কেনো ভাগ এখান থেকে।’,নিপাকে ধমক দিয়ে সায়ন বলে।

নিপাও ছাদ থেকে চলে যায়। রাইদা উঠে যেতে নিলে সায়ন আঁটকায় তাকে। রাইদা সরে ডানে গেলে সায়নও ডানে যায়, রাইদা বামে গেলে সে ও বামে যায়।

‘কি সমস্যা? এভাবে ব*খা*টের মতো রাস্তা আটঁকাচ্ছেন কেনো?’,রাইদা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে।

‘বউয়ের পথ আটঁকালে যদি ব*খা*টে উপাধি পেতে হয় তাতেও আমার সমস্যা নেই।’,সায়ন হেঁসে বলে।

‘আপনি হলেন বুড়া নিব্বা। বয়স দেখছেন নিজের? এই বয়সে এমন ভাব করেছেন যেনো নতুন নতুন প্রেম করতেছেন।’

‘প্রেম তো করতেছি নতুন বউয়ের সাথে। তখন ছাদ থেকে আমার দিকে মাটি ছুড়ছিলা সেটার শোধ তুলি কি করে বলো তো।’

‘সরুন আমি নিচে রুমে যাবো কাজ আছে।’
রাইদা সায়নের থেকে পালাতে চায় তার আগেই সায়ন রাইদাকে ধরে ফেলে। এক মুঠো মাটি নিয়ে রাইদার গালে গলায় ঘষে দেয়।

‘এইটা কি করলেন পুরো সাদা জামাটা শেষ! দাঁড়ান দেখাচ্ছি।’,কথাটা বলে রাইদা দুই হাতের মুঠোয় মাটি নিয়ে সায়নের পুরো মুখে ঘষে দেয়।

সায়ন্তিকা ছাদে এসেছিলো ফোন কানে দিয়ে। রাইদা আর সায়নকে মাটি ছোড়াছুড়ি করতে দেখে তাড়াতাড়ি ফোন কান থেকে নামিয়ে দু’জনের কান্ড দেখতে থাকে। সায়নের নজর ছাদের গেটের দিকে গেলো ছুটে গিয়ে সায়ন্তিকার মাথায় মাটি দিয়ে চলে যায় ছাদ থেকে। সায়ন্তিকা রাগে চেচামেচি করতে থাকে। রাইদা আস্তে আস্তে এসে সায়ন্তিকার গালে মাটি লাগিয়ে সে ও পালায়। বেচারি সায়ন্তিকা আহাম্মকের মতো দুজনের যাওয়ার পানে তাকায়।
কাঁদো কাঁদো মুখ করে নেমে নিজের রুমে যায় গোসল করতে।

..

সন্ধ্যার পর বসার ঘরে আড্ডা বসে। রাইদা,আরমান শেখ,সায়ন আর সায়ন্তিকা মিলে ক্যারাম খেলতে শুরু করে। রাইদা, আরমান শেখ এক দলে আর সায়ন, সায়ন্তিকা এক দলে। মিসেস রিনা পাশে বসে ভিডিও কলে তার বাবার সাথে কথা বলছে। নিপা বসে খেলা দেখছে আর মাঝে মাঝে রাইদাকে সাহায্য করছে।

‘বাবা তুমি তো চুরি করছো দাগের বাহির থেকে মেরে। এইটা মানি না।’,সায়ন্তিকা আরমান শেখকে বলে।

‘হ্যা হ্যা আমিও দেখেছি তুমি দাগের বহিরে থেকে মারছো।’,সায়ন তাল মিলিয়ে বলে।

‘অসম্ভব আমি দগের ভেতর থেকেই মেরেছি। এই বউমা স্বাক্ষী ও দেখেছে।’,আরমান শেখ বলে।

‘হ্যা দাগের ভেতর থেকেই মেরেছে তোমরা শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছো।’,রাইদা বলে উঠে।

‘ঠিক আছে আমরাও এভাবে মারবো।’,সায়ন বলে।

ক্যারাম খেলায় আরমান শেখ আর রাইদা জিতে যায়। খেলা শেষ হতেই নিপা টেবিলে খাবার দেয়। রাইদা অবাক হয় এতো জলদি তারা খেতে বসছে।

‘সবে তো রাত নয়টা বাজে এতো জলদি রাতের খাবার খাওয়া হবে?’,রাইদা নিপাকে জিজ্ঞেস করে।

‘রাতের খাওয়া শেষ হলে সবাই একসাথে ছবি দেখতে বসবে। ছুটির দিনে রাতের বেলা জলদি খেয়ে সবাই একত্রে ছবি দেখে এইটা আমি যতদিন ধরে এবাসায় আছি ততদিন ধরে দেখতেছি এই নিয়ম। মাঝে মাঝে বাহিরেও ঘুরতে যায়।’,নিপা জবাব দেয়।

এমন অদ্ভুত নিয়ম শুনে রাইদা অবাক হয়। তার বাসায় সে কখনো টিভি দেখেছে বলে মনে পড়ে না। কয়েকবার বাবার সাথে বসে একটু ক্রিকেট দেখেছিলো তাও কিছু সময়ের জন্য কিন্তু কখনোই এভাবে পারিবারিক সময় কাটায়নি।

খাবারের টেবিলে দুপুরের মতো আরমান শেখ খোশগল্প শুরু করেন। খাবার টেবিলে এমন পরিবেশ রাইদা বেশ এনজয় করতে শুরু করে। সে যে এই বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে মিশেছে এখনো একদিনও হয়নি অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে এরা কতজনমের চেনা। রাইদা ভাবতে পারেনি সায়নের পরিবারের লোকজন এতো সহজে তাকে মেনে নিবে।

খাওয়া শেষ হতেই বসার ঘরে সকলে চলে আসে। নিপা পপকর্ণ ভেজে তিনটা বাটি ভর্তি করে এনে টি-টেবিলে রাখে।
মিসেস রিনা, আরমান শেখ এক সোফায় বসে। সায়ন্তিকা,নিপা সিঙ্গেল দুটো সোফা দখল করে। রাইদা এসে নিপার পাশের সোফায় বসে।

সায়ন একটা হরর মুভি টিভিতে চালিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে দেয়। রাইদার পাশে এসে বসে মুভি দেখতে শুরু করে।

যখনই ভয়ঙ্কর দৃশ্য টিভির স্কিনে আসছে নিপা একটা করে চিৎকার দিচ্ছে, সাথে সাথে সায়ন্তিকা নিপার মুখ চেপে তাকে ধমক দিচ্ছে।আরমান শেখ, রিনা পপকর্ণ খাচ্ছে আর নিজেদের গল্পের মাঝে মাঝে ছবি দেখছে। রাইদা পুরো পরিবারকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে।

‘দেখছো বাবা মায়ের মধ্যে এখনো কত প্রেম আর তুমি আমার সাথে খালি ঝগড়া করো। ‘,রাইদার কানে ফিসফিস করে সায়ন বলে।

‘আপনি যেমন লোক আপনার সাথে তেমনই করি।’,রাইদা সায়নকে চিমটি দিয়ে বলে।

‘কেমন লোক আমি?’

‘আপনি বদ লোক আর অসভ্য।’

‘ঠিক আছে তাহলে একটু বদ গিরি করি। মা তোমার বউমার নাকি শরীর খারাপ লাগছে ওকে রুমে নিয়ে গেলাম।’
সায়নের এমন কথা শুনে রাইদা অবাক হয়ে যায়।

‘হ্যা নিয়ে যা ঘুমাক ওর তো বিশ্রাম দরকার।’,মিসেস রিনা জবাব দেয়।

সায়ন রাইদার হাত টেনে সোফা থেকে উঠায়। রাইদা কিছু না বলে সায়নকে রেখে রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে।
দরজা লাগিয়ে সায়ন হাসতে হাসতে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। রাইদার হাত ধরে টানতে থাকে।

‘কি চাই?’,রাইদা রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করে।

‘বউকে চাই।’,সায়ন দুষ্টু হেঁসে জবাব দেয়।

‘যান তাহলে আফরিনের কাছে আমাকে বলছেন কেনো?’

‘বউ সামনে থাকতে আমি আফরিনের কাছে কেনো যাবো?’

‘আচ্ছা যাবো তার আগে তোমার হাতের ক্যানোলা খোলা দরকার। উঠো এটা খুলে দেই।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা শোয়া থেকে উঠে বসে। ফাস্ট এইড বক্স এনে সায়ন রাইদার মুখোমুখি বসে। ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ সরিয়ে ক্যানোলা খুলে সেখানে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়। ব্যথা লাগলেও রাইদা কোনো শব্দ করেনি। সায়ন যে মনে করে তার হাতের ক্যানোলা খুলে দিয়েছে বিষয়টা তার ভালো লেগেছে।

‘দেখো রি ছোট্ট এই জীবনে আমরা যা চাই সব পাই না। তিনটা ইচ্ছার মধ্যে যদি একটা ইচ্ছা পূর্ণ হয় সেটা নিয়ে না ভেবে অপূর্ণ থাকা ইচ্ছা দু’টো নিয়ে ভাবি। অথচ এমনও মানুষ আছে যাদের একটাও ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। তোমাকে আমি ভালোবাসি এটা হাজার কোটি বার বলেও আমি বুঝাতে পারবো না ঠিক কতটা ভালোবাসি। তুমি আমায় অপছন্দ করো কিংবা আমাকে ভালো না বাসো তাতে আমার কখনোই মাথা ব্যথা ছিলো না কারণ তোমাকে দেখার পর আমি সবসময় তোমাকেই চেয়েছি। যদিও আমি কখনো কল্পনাও করিনি এভাবে তোমাকে পেয়ে যাবো সারাজীবনের জন্য। তোমার কি মনে হয় এতো সহজে আমি তোমাকে আমায় ফেলে যেতে দিবো?’

রাইদার সায়নের কথাগুলো শুনে তার দিকে তাকায়। রাইদার ডান হাত টেনে মুঠোবন্দী করে নেয় সায়ন।

‘আফরিন আমার ছোট বেলার বন্ধু হয়। ওর একটা সমস্যার কারণে আমার ঐ ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছিলাম। পাশের আন্টি এসে খালি ওকে প্রশ্ন করতো তাই ও ভয়ে বলছিলো আমার স্ত্রী সে এই কথা আমাকে জানায় সেই সময় আমি পাত্তা দেইনি। ভেবেছিলাম বলুক বলে যদি ওর সম্মান বাঁচে। সেদিন তুমি কল দেওয়ার পর ও ভেবেছিলো সেই আন্টি কল দিয়েছে কারণে একমাত্র ঐ আন্টি আর কাজের মেয়েটা জানতো আফরিন আমার ফ্ল্যাটে থাকে।’

সায়নের কথার প্রেক্ষিতে রাইদা কিছু বলতে নিলে সায়ন রাইদার মুখ চেপে ধরে।

‘চুপ তুমি কিছু বলবা না আমি বলবো তুমি শুনবা,বুঝছো?

সায়নের কথায় রাইদা মাথা নাড়ায়

‘তুমি আমাকে কোন ভুলের শাস্তি দিতে চাইছো আমি জানি না আর জানতেও চাই না। শুধু বলবো তুমি দূরে থেকে আমায় শাস্তি না দিয়ে সারাজীবনের জন্য আমার সাথে থেকে যাও। যা শাস্তি দিবা আমি মাথা পেতে নিবো। এক মূহুর্ত তোমায় না দেখলে তোমার কথা না শুনলে নিজেকে পাগল পাগল লাগে। তুমি আমার অভ্যেস রি। আমার ভুল মাফ করতে বলছি না কিন্তু আমাকে একটা সুযোগ দাও কথা দিচ্ছি এবার আর কোনো ভুল করবো না।’

‘কিন্তু আমি আপনাকে অপছন্দ করি আপনার পূর্বে করা কাজের জন্য।’,নিরবতা ভেঙে রাইদা বলে।

রাইদার কথা শুনে সায়ন আলতো হেঁসে রাইদার গালে হাত রাখে।

‘অপছন্দ করো আমি জানি আর এটাও জানি তুমি আমার উপর দুর্বল হয়ে গেছো। আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমারও কষ্ট হয়। আমরা একে অপরের প্রতি দুর্বল কিন্তু আমাদের মধ্যে পার্থক্য হলো আমি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করি আর তুমি কিছুই প্রকাশ করো না।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। বসা থেকে উঠে বারান্দায় যেতে নিলে সায়ন বাঁধা দেয়।

‘পালাচ্ছো কেনো? এভাবে আর কত পালাবে বলো। আরেকটা সুযোগ দাও নতুন করে সব শুরু করি। কথা দিচ্ছি তোমাকে আর কষ্ট পেতে দিবো না।’

রাইদার কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে সায়ন বলে। রাইদা কিছু না বলে সায়নের দিকে তাকায়। হাত দিয়ে রাইদার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে থাকে সায়ন।

‘পরী!’, সায়ন জড়ানো কন্ঠে রাইদার দিতে তাকিয়ে বলে।

‘কে পরী?’,রাইদা সায়নকে প্রশ্ন করে।

‘তুমি পরী।’
সায়নের উত্তর শুনে রাইদা হেঁসে দেয়।


(চলবে..)

(প্রায় ৩০০০ শব্দের পর্ব দিয়েছি আশা করি আপনাদের কাছ থেকে গল্প নিয়ে মন্তব্য পাবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here