সোনাবউ পর্ব ৫

#সোনাবৌঃ
৫ম পর্বঃ
মোর্শেদা হোসেন রুবী
*************
দেশে ফিরেই গ্র্যান্ড পার্টি দিলো মেরাজ।সব বন্ধুদের তাদের পরিবার সহ দাওয়াত দিলো।আলিফের বাসায়ও এসেছে দাওয়াত দিতে।বেল বাজলে আলিফই দরোজাটা খুলে দিলো।
স্বর্ণা ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে ছিল।হঠাৎ মেরাজকে দেখতে পেয়ে দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল।
ভয়ে ওর কন্ঠনালী শুকিয়ে গেছে।
আড়ালে দাঁড়িয়েই স্বর্ণা শুনতে পেলো মেরাজ বলছে-“তুই তো শালা বিয়ে করে ফেললি হুট করে,খবরও দিলিনা”!
আলিফ হাসল-“কিভাবে খবর দেবো?তুই তো দেশে ছিলিনা”!
-“হ্যাঁ,তা অবশ্য ঠিক।তোর নতুন ভাবীর সাথে এসে পরিচিত হয়ে যাস!ভালো লাগবে!”
আলিফ কোনো মন্তব্য করলোনা।মেরাজ দাঁড়িয়ে গেল-“আজ উঠিরে…!যাস কিন্তু,ভাবীকে নিয়ে যাস্..!”
-“ও..আসলে এ ধরনের প্রোগ্রামে কমফোর্ট ফিল করেনা!”
-“ওওহ্…আচ্ছা,,পারলে তুই যাস,গেলাম!ভাবীকে আমার সালাম শুভেচ্ছা দুটোই রইল।”
মেরাজ চলে যাবার পর গেট আটকে আলিফ ভেতরের দিকে তাকালো,একটু আগে স্বর্ণাকে ডাইনিঙে দেখেছিল।এখন নেই।
…..
স্বর্ণা দৌড়ে নিজের ঘরে এসে হু হু করে কেঁদে ফেলল।দুহাতে মুখ চেপে কাঁদতে লাগল।কেন কাঁদছে ও নিজেও জানেনা।এমন সময় আলিফের পায়ের শব্দে দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেস্টা করলো।
আলিফ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে হাতের ঘড়িটা খুলে রাখছে ঠিকই কিন্তু ওর চোখ ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে স্বর্ণাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
স্বর্ণা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে।
আলিফ ওর এই স্বাভাবিক হবার অভিনয়ে ম্লান হাসল।তারপর স্বর্ণার সামনে গিয়ে বসল।স্বর্ণা ওকে এভাবে বসতে দেখে নড়েচড়ে বসল।আলিফ জিজ্ঞেস করল-“কি হয়েছে,মন খারাপ?”
স্বর্ণা মৃদু হেসে বলল-“না তো!”

আলিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল-“যে চোখ ভালোবাসতে জানে সে চোখকে ফাঁকি দেয়া এতো সহজ না।”
স্বর্ণা কান্না চাপলেও সে যে আবেগাক্রান্ত তা ওর নিঃশ্বাসের ওঠানামা দেখলেই বোঝা যায়।আলিফকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বর্ণা ওড়না টেনে অযথাই নিজেকে আরো ভালভাবে ঢা
আলিফ একটা ট্যিসু এগিয়ে দিয়ে বলল-“চোখটা মোছো!”
স্বর্ণা ট্যিসুটা নিয়ে চোখের কোণে চেপে ধরতেই চোখের থেমে থাকা অশ্রুগুলো গড়গড়িয়ে নেমে এলো।আলিফ ওর শান্ত হবার অপেক্ষা করল।কিছুক্ষণ পর স্বর্ণা নিজেই বলল-“আমি জানি,আপনি আমার উপর রাগ করছেন!কারন আমার কান্না করা উচিত না”!
-“ভুল জানো!”(আলিফ মৃদু স্বরে বলল)বরং এটাই স্বাভাবিক।তুমি না কাঁদলেই বরং অবাক হতাম!”
স্বর্ণা অবাক হয়ে তাকালে আলিফ ওর গালে মৃদু চাপড় মেরে উঠে গেল।
স্বর্ণা নিজেও উঠল,পেছন থেকে বলল-“আ..আমাকে মাফ করে দিন!”
আলিফ চলে যাচ্ছিল।
একথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল-“কিসের জন্য?”
-“এই যে,আপনার মনে কষ্ট দিলাম!…আসলে আমি আবেগ চাপতে পারিনি!”
আলিফ স্বর্ণার মুখোমুখি হয়ে বলল-“এক শর্তে মাফ করতে পারি..”!
স্বর্ণা তাকালে বলল-“যদি তোমার সুখ- দুঃখ সব কিছুতে আমাকে বন্ধু মনে করে তার ভাগ দাও তো!”
স্বর্ণা কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে মাথা নাড়ল।

আলিফ দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে ধরল।স্বর্ণা সেদিকে তাকিয়ে আস্তে করে আলিফের বুকে মাথাটা ঠেকাল।আলিফ ওর মাথাটা নিজের বুকেরসাথে চেপে ধরল।স্বর্ণার মনে হলো ওর ছাব্বিশ বছরের জীবনে এর চেয়ে প্রশস্ত জায়গা সে আর পায়নি।

….
পরদিন মা’কে বলে স্বর্ণাকে নিয়ে বেরুলো আলিফ।লাইব্রেরী থেকে বই কিনলো,স্বর্ণার জন্য দুটো ভালো বোরকা আর জিলবাব কিনল।কেনাকাটা শেষে একটা চাইনীজে রাতের খাবার সেরে বেরোতে যাবার পথে মেরাজের সাথে মুখোমুখি হয়ে গেল ওরা।
মেরাজই ওদের প্রথম দেখল-“আরে,বন্ধু তুই…পরিচয় করিয়ে দেই,ও..জেসমিন!আমার ওয়াইফ!”
আলিফ সেদিকে তাকালোনা কারন মেরাজের কনুই ধরে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সে যথেষ্ট খোলামেলা আধুনিক পোষাক পড়েছে।

মেরাজ স্বর্ণার দিকে তাকাল।স্বর্ণার মুখ নিকাবে ঢাকা থাকায় চিনতে পারলোনা বটে তবে মেরাজ তাকিয়ে যেন একটু থমকে গেল।স্বর্ণা আলিফের পেছনে প্রায় লুকিয়ে যেতে চাইল।
মেরাজ হেসে বলল-“নিশ্চয়ই ভাবী এটা!ভাবি,আমার শুভেচ্ছা রইল আপনাদের দুজনকে।একদিন আসবেন বাসায়….চলি রে!”আলিফের দিকে তাকাল।

আলিফ বেরিয়ে গেলে মেরাজ ভেতরে ঢুকে ভালো টেবিল খুঁজল বসার জন্য।হঠাৎ কি মনে হতেই জেসমিনকে ‘আসছি’বলে দৌড়ে বাইরে বেরুল।
আলিফ আর স্বর্ণা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।মেরাজের বুকের ভেতর হাতুড়ীর ঘা পড়ল।মেয়েটির দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি,চোখ সবকিছু স্বর্ণার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ মেরাজকে।মুখ নিচু করে ভাবতে ভাবতে সামনে তাকিয়ে দেখল ওরা নেই।চলে গেছে।
মেরাজ ফিরে গেল চাইনীজে।কিন্তু অনেক বড় একটা চিন্তা ওর সামনে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিলো!আলিফের বউকে ওর এতো চেনা মনে হলো কেন?কে সে?
……

এক অদ্ভুত তাড়না কাজ করছে মেরাজের মধ্যে।তার মন বলছে ওই মেয়েটাকে সে চেনে।কিন্তু কিভাবে সম্ভব?নানান ভাবনায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে।পরদিন সকালে বারান্দায় অনেকখন পায়চারী করলো একবার না একবার তো দেখা যাবেই মেয়েটিকে।না দেখা পর্যন্ত মেরাজের মন শান্ত হবেনা।জানতে হবে কে ঐ মেয়ে?
….
সেদিন…তারপরদিন….তারপরদিন…প্রতিদিন যতক্ষণ বাসায় থাকে মেরাজের নজর থাকে বারান্দায়।কিন্তু গত সাতদিনে একবারের জন্যেও মেয়েটি বারান্দায় আসেনি।আলিফ আসে,বসে বই পড়ে।বুয়া আসে কিন্তু মেয়েটা আসেনা।
অবশেষে একদিন ধরা পড়লো সে মেরাজের চোখে।মেরাজের মনে হলো ও শ্বাস নিতে ভুলে গেছে।মেয়েটি চারপাশে হালকা চোখ বুলিয়ে বারান্দির গেটে দাঁড়িয়েই নিজের ভেজা চুলগুলো টাওয়েল দিয়ে হালকা কয়েক চাপড় দিলো।
মেরাজের বিস্মিত চোখের সামনে টাওয়েল মেলে দিয়ে সরে যাবার আগেই মেরাজ বারান্দায় বেরিয়ে এলো।স্বর্ণা নিজের জায়গাতেই জমে গেল।মনে হলো ওর পা দুটো কেউ স্ক্রু দিয়ে মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে।মেরাজের চোখে বিস্ময় না বেদনা তা বোঝা গেলোনা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here