স্বপ্নময়_ভালোবাসা ❤ পর্ব ১০

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
||পর্ব-১০||

কিছুক্ষণ বাদেই আমাদের রিসিপশন থেকে ডাক আসে।আমি মাকে নিয়ে রিসিপশনের দিকে যাই। রিসিপশনে যেতেই রিসিপশনের মেয়েটি আমাদের উদ্দেশ্য করে বললো,

“স্যার বললেন আপনারা চেম্বারে যেতেন।”
আমি মুখে একটা সৌজন্যতার হাসি টেনে বললাম,
“ধন্যবাদ।”
মেয়েটি হাসিমুখে ধন্যবাদ গ্রহণ করে তারপর আবার বললো,

“আপনারা একটু কষ্ট করে এখানেই দাড়ান।স্যারের পি.এ এসেই আপনাদের চেম্বারে নিয়ে যাবে।”
আমি মেয়েটির কথায় মাথা নাড়ি। দুই মিনিট নাগাদ অপেক্ষা করার পর আকাশের পি.এ এসে আমাদের চেম্বারে নিয়ে যায়।আমি স্বচ্ছ কাঁচের আয়না ভেদ করে টুপ করে মাথাটা ঢুকিয়ে দিতেই আকাশ হন্তদন্ত দাড়িয়ে যায়।আমরা ভেতরে ঢোকার পর সে মাকে সালাম করে ।মা সালামের জবাব গ্রহণ করপন।বলেন,

“ভালো আছো,বাবা?”
“আলহামদুলিল্লাহ,ভালো আছি,আন্টি ।আন্টি প্লিজ এখানে এসে বসুন।”
আমি এবং মা টেবিলের সামনের দুটো চেয়ারে বসি।
আকাশও তার জায়গায় বসে ভদ্রতার সহিত চোখ থেকে সাদা ফ্রেমের চশমাটা খুলে নিচে রেখে বললো,
“আসতে কোনো সমস্যা হয়নি ত, সানা?”
“নাহ,সমস্যা হয়নি।তবে ফাঁকফোকরে মায়ের হালকা মাথা ঘুরিয়েছে। ”
“আচ্ছা।খাওয়াদাওয়া করেছিস?”
“হুম।”
“ওহ।তা যেটা বলতে চাইলাম আন্টির কী কী প্রবলেম আমাকে একটু বিশ্লেষণ করে বল।ফোনে ভালো করে কথা বলতে পারি নি।”
আমি আকাশকে মায়ের অসুখের ব্যাপারে সবটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলি।আকাশ ধৈর্য্য সহকারে সবটা শুনে। বললো,

“আগে কোথায় দেখিয়েছিস?”
“কুমিল্লা মর্ডানে।”
“ওখানের রিপোর্ট গুলো দে। ”
আমি আকাশের দিকে রিপোর্টগুলো এগিয়ে দিই।আকাশ রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে।দেখা শেষ করে আমার দিকে ফিরে বললো
“এই রিপোর্টে দেখাচ্ছে আন্টির হার্ট দুর্বল আর বুঁকে ব্যথাটা হার্ট উইকের কারণেই হচ্ছে।”

“হুম কুমিল্লার ডাক্তারও তাই বলেছে।”
“শ্বাসকষ্ট,ঘাম,বমি এবং মাথাঘোরা এসব আবার নতুন করে যোগ হয়েছে,তাই না? ”
“হু,আকাশ।তবে, ব্যথাটা বেশি।বাট ক্রিটিকাল কিছু?
“প্রথম সব রোগই স্বাভাবিক।তবে,ঠিকমতো সেবা-যত্নের অভাবে স্বাভাবিক রোগটাও অনেক সময় অস্বাভাবিক হয়ে যায়!”

আকাশের এহেন কথায় আমার বুকের ভেতরটায় ছ্যাৎ করে উঠে।মাকে আমার ঠিকভাবে যত্ন নেওয়া হয়েছে ত?নাকি টাকার অভাবে ঠিকমতো ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারিনি।কোনোদিন ওষুধ খেয়ে থাকতেন,আবার কোনোদিন খেতেন না!ভাবতেই মনের কোটরে একটা আক্ষেপতার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।যথেষ্ট সামলিয়ে নিজেকে আকাশের সামনে স্বাভাবিকভাবে প্রদর্শন করে বললাম,

“প্লিজ,আকাশ?মাকে ভালো করে পরিক্ষা করে দ্যাখ মায়ের শারিরীক অবস্থা কেমন।আর বমি,ঘামানো,মাথাঘোরা এসব কেন হচ্ছে !এসব ত আগে ছিল না!”
“আমি দেখবো,সানা।অস্থির হোস না।অনেকটা সময় নিয়েই আমি আন্টিকে ভালোভাবে দেখবো।”
“ধন্যবাদ,আকাশ।”

পরে আকাশ মার দু’টো পরিক্ষা নেয়।একটা বুক এক্সরে,আরেকটা রক্ত পরিক্ষা। রিপোর্ট আজ দেওয়া হবে না।কাল সকালে হাতে পাবো আকাশ তাই বললো।
তারপর মোটামুটি সব শেষ হলে খালামণির বাসায় যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াই ওমনি আকাশ বললো,
“সানা,আর কিছু সময় থাকতে পারবি?আমার ডিউটি টা শেষ হলে বাইরে বের হবো।”

আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এখন বেলা বারোটা বাঁজে।ওর বেরুতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি।তাই দু’পাশে মাথা নেড়ে বললাম,
“স্যরি,আকাশ!দেখতেই পারছিস মা ভীষণ ক্লান্ত।এতটা সময় মাকে নিয়ে থাকাটা আরো রিস্কি।এতটা পথ জার্নি করে আসলাম মার এখন বিশ্রাম নেওয়াটা জরুরী।”
“কিন্তু আন্টিকে নিয়ে এসে আমার চেম্বার থেকে খালি মুখে যাবি?এটা আমি মানতে পারবো না।”
আমি হেসে দিলাম।বললাম,
“সময়ের সুবিধা বুঝা লাগে।এখন তোরজন্যে এই সময়টা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট!আমাদের জন্যে কত সময় ব্যয় করেছিস,অথচ তারইমধ্যে তুই আরো দুই তিনটে রোগী দেখতে পারছিস।সমস্যা নেই,আরেক দিন আসলে তখন মুখ ফুরে খেয়ে যাবো।ওকে?”

আকাশ কিছু বললো না।শুধু স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।হয়তো,মনে মনে আফসোস করছে মাকে হঠাৎ এভাবে নিয়ে এসে আবার এভাবে চলে যাবো!

তারপর আকাশলে বিদেয় দিয়ে বাইরে চলে আসি।হাসাপাতালের বাইরে আসলে খালামণিকে কল করি।বাসায় কিভাবে কিভাবে যেতাম খালামণি তার ডিটেইলস বলেন।আমি সবটা ভালোভাবে বুঝে নিয়ে মাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে সি.এন.জি খুঁজতে থাকি।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সি.এন.জি পেয়ে যাই।সি.এন.জি ড্রাইভারকে এড্রেস বলেই সি.এন.জি তে মাকে নিয়ে উঠে বসি।

।সি.এন.জি জ্যাম-ঝাঁপলা ক্রস করে স্বাভাবিক গতিতে চলছে।মাথাটাকে খানিক স্বস্তি দিতে স্থির রাখতেই হঠাৎ আমার মনঃকাশে চাপা এক উত্তেজনা ধক করে জ্বলে উঠে!ভাবি নি আজ ওই লোকটির বাসায় এভাবে যেতে হবে।ওই লোকটির মুখোমুখি হতে হবে!আচ্ছা,যখন লোকটির মুখোমুখি হব তখন কী স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে থাকতে পারবো?সহজ-সাবলীলাতা বজায় রাখতে পারবো?
জানি না এর উত্তর!জানি না এর ব্যাখ্যা।বুকের ভেতরটায় শুধু টুংটাং বাজছে অভিপ্রেত লজ্জায়,অপ্রস্তুততায়,কুন্ঠায়!!হৃৎস্পন্দন বারবার কেঁপে উঠছে।হাতের তালু,কানের পিছনে,পায়ের তালুতে গড়গড়িয়ে ঘামের অজস্র স্রোত বইছে তা সি.এন.জির ঝটকা বাতাসেরও রুক্ষতাকে হার মানাচ্ছে

কিছু সময় পর সি.এন.জি তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে পৌঁছায়।আমি মাকে নিয়ে সি.এন.জি থেকে নামি।তারপর ড্রাইভারের উনার ভাড়া মিটিয়ে উনাকে বিদেয় করি।তারপর খালামণিকে কল করি।খালামণি কল রিসিভ করতেই বললাম,
“জ্বী,খালামণি আমরা নিউমার্কেট দশতালা বিল্ডিং এর নিচে দাড়িয়ে আছি।”
খালামণি ব্যস্ত কন্ঠে বলেন,
“একটু ওখানে দাঁড়াও কষ্ট করে।আমি নিচে দারোয়ানকে পাঠাচ্ছি। ”
“জ্বী,আচ্ছা। ”

পরমুহূর্তে দারোয়ান এসে আমাদের গেইট খুলে দিয়ে ভেতরে আসতে বললো।আমরা ভেতরে ঢুকি।মা
সামনে তাকিয়ে এত বড় বিল্ডিং দেখে ধাঁধায় পড়ার মতো অবস্থা হয়ে বলেন,
“আল্লাহ! শাহিদা এতবড় বিল্ডিং করে ফেললো! যখন আমি আসলাম তখন মাত্র দু’টা ফ্ল্যাট কিনে থেকেছিল!”
দারোয়ান মুঁচকি হেসে দিয়ে বললো,
“ম্যাডাম,যুগ দিনকে দিন পরিবর্তন হয়।”
“হুম।”

শুধু যে মা অবাক হলেন তা নয়।আমিও বেশ অবাক হলাম।বিশেষত,বিল্ডিং এর আউট রাউন্ডটা দেখে।একদম ছোট একটা রাউন্ড।কিন্তু এর মাঝে তাক লাগানোর মতো কিছু এলিমেন্টস আছে!রাউন্ডটার পশ্চিম পাশে বিভিন্ন ফুলের খুপরি।তার কার্নিশ ঘেঁষে উত্তর দিকে আবার লতাপাতা যুক্ত একটা বটবৃক্ষ। ওটির একটা ডালের সাথে ঝুলন্ত দোলনা।
উত্তর দিক থেকে চোখ সরানোর পর পূর্ব দিকে তাকালে সরু একটা গাঢ় নীলের সুইমিংপুল!তাতে কিছু শাপলা ফুঁটে আছে!সিনটা মুহূর্তেই আমি ফটোগ্রাফি করে নিই।

তা দেখে দারোয়ান হেসে উঠে।হাসির মাঝেই বললো,
“আমাদের তুরাব স্যার খুব শৌখিন মানুষ।এটা ওটা নিঁখুতভাবে সাঁজাতে পছন্দ করেন।এখানে যা সুন্দর তারচেয়েও সুন্দর উনার চিলেকোঠার রুম,আর ছাদের বেষ্টনী টা!দেখলেই চোখ সরাতে পারবা না।”
“ওহ,আচ্ছা। ”
“আপনাদের আজ তুরাব স্যারই রিসিভ করতেন।ঝামেলা হয়ে গেলো অফিসে উনার কি নাকি আর্জেন্ট মিটিং ছিলো তাই আসতে পারে নি!”
মা বললেন,
“তুরাব এখন অফিসে?”
“জ্বী।”
“ওহ আচ্ছা।
এরইমধ্যে আমরা বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করি।মা চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ ফ্লোরে একটি গাড়ি ছাড়া কিছুই দেখতে পাননি।তাই হা হা চোখে বলেন,
” তোমার শাহিদা ম্যাম কত তালায় থাকে?”
“একদম উপরের দু’তালায়!”
“তাহলে সিড়ি বেয়ে যেতে হবে নিশ্চয়ই ?সিড়ি দিয়ে ত আমি উঠতে পারবো না।এক তালায় না উঠতেই হাঁপিয়ে যাবো।”
দারোয়ান মায়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“ম্যাডাম সিড়ি দিয়ে উঠতে হবে না।লিফট আছে।”
“ওহ,আচ্ছা।তাহলে সমস্যা নাই।”

আমরা লিফটে করে দশ সেকেন্ডের মাথায় আন্টির বাসার সামনের এসে দাঁড়াই ।কলিংবেল চাপতেই খালমণি দরজা খুলে দেয়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here