হঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছি পর্ব ২১+২২

#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_Unexpected_Love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-21

কষ্ট!
মানুষের জীবনে কষ্টই যদি না আসে তাহলে তো জীবন বৃথা।জীবনের আসল মানেটাই থাকলো না।কষ্ট ছাড়া কি জীবনের মোহ বুঝা যায়? একদম ই না। আজ প্রীতির খুব কষ্ট হচ্ছে।আহসান বাড়ির আদরের একমাত্র মেয়ের চোখের পানি আজ যেনো বাধ ই মানছে না।

মেঝেতে বসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে এলোমেলো হয়ে আছে প্রীতি।হাটুতে মুখ গুজে কাদছে আর বারবার একটা কথাই ভাবছে,

-আমি কেনো এমন করলাম?আমার বাবার কি টাকার অভাব?সামান্য বিষয়টাকে আমি এতোদূর কেনো গড়ালাম?আমি সবসময় মানুষকে কেনো এতো বিরক্ত করে তুলি?কেউ আমাকে ভালোবাসে না।সবাই আমাকে খারাপ মেয়ে ভাবে। কেনো কেনো?আমি কি এতোটাই খারাপ?সত্যি তো আমি তো জানতাম ৬৩ টাকা ফেক্সি হয় না।তাও এই সামান্য বিষয়টাকে এতো কম্পলিকেটেড কেনো বানালাম?

ভেবেই আবারো ডুকরে কেদে উঠলো ও।

প্রীতির কান্নার মাঝেই ওর ফোনে টুং করে একটা আওয়াজ হলো।

প্রীতি মাথা তুলে দেখলো সেই নাম্বার থেকে ১০০০ টাকা ফেক্সি করে পাঠিয়েছে।প্রীতি ফোনটাকে এক দূরে আছাড় মারলো।নিমিষেই ফোনটা গুড়োগুড়ো হয়ে গেলো।

রাগে দুঃখে অপমানে লজ্জায় প্রীতির চোখের পানি মোটা মোটা হয়ে পড়তে শুরু করলো।হাত পা ছড়িয়ে চিতকার করে কাদতে পারলে যেনো প্রীতির এই অপমানের কষ্টটা কমতো।বালিশে মুখ গুজে ও গুমড়ে কেদে উঠছে বারবার।

_____________________________

কাল রাতের পর নীলাভের হুট করেই জ্বর।

আচ্ছা মন খারাপ থাকলে কি মানুষের জ্বর হয়?হতেও পারে। কারন লোকে বলে মন ভালো না থাকলে শরীর ভালো থাকে না।আচ্ছা নীলাভের কি মন খারাপের জ্বর না কি অনুশোচনার জ্বর?কাল রাতে নানান চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক করেছে।

মন খারাপ হয়েছে দুটো কারন ভেবে। একটা হলো তার বাবা এতো অসুস্থ শুধুমাত্র তার জন্য। আরেকটা হলো সে একটা মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলেছে।

আর অনুশোচনা হয়েছে সে কেনো আগেই তার বাবাকে বুঝলো না কেনো নিজের জেদের বসে বাবাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো?।আর মেয়েটার সাথে এভাবে রেগে কথা বলাটা একদম উচিত হয় নি।

কিন্তু পরক্ষনেই নীলাভ ভাবছে, না..একদম ঠিক হয়েছে।মেয়েটা একটু বেশি বেশি করছিলো।একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিলো।এতোটা বাড়াবাড়ি করার জন্য এটা তার প্রাপ্য ছিলো।নীলাভ কোনো ভুল করে নি।সারারাত এসব ভেবেই কেটেছে।মনের ভেতর কোথাও খচখচ করছে তার।

সারারাত ঘুমাতে পারে নি নীলাভ বার বার সেই মেয়েটার কথাই মনে পড়ছিলো।আচ্ছা মেয়েটা কি কেদেছে?অনেক কষ্ট পেয়েছে?পেলেই বা আমার কি?

মনকে নানান বুঝ দিয়েও সে পারছে না।সে একবার মেয়েটার চেহারা কেমন হবে সেটা ভাবতে বসলো।চোখ বন্ধ করে মেয়েটার চেহারা ভাবতে গেলেই প্রীতির কান্না মাখানো মুখ টা ভেসে উঠলো নীলাভের চোখের সামনে।

নীলাভ ধরফর করে উঠে বসলো।মাথা কাজ করছে না।সব কিছু উলোটপালোট লাগছে।এসব কি হচ্ছে।কেনো নিজেকে এতোটা খাপছাড়া লাগছে?কি হচ্ছে আমার সাথে এসব?

নীলাভ কপালে ঘাম মুছতে গেলেই আবিষ্কার করলো তার কপাল অনেক গরম সাথে শরীর ব্যাথা তার মানে কি তার জ্বর হয়েছে?এর জন্যই সে এমন আবোল তাবোল করছে?

ঠিক তখনি ঘরে নীলা চৌধুরী প্রবেশ করলেন।তিনি নীলাভের এমন চেহারা দেখে আঁতকে উঠলেন।বড় বড় পা ফেলে নীলাভের কাছে গিয়ে নীলাভের কপালে হাত রাখলেন।না…ছেলের তার ভিষণ জ্বর।

নীলা চৌধুরী জলদি কাপড় ভিজিয়ে এনে ছেলের কপালে দিয়ে রাখলেন।নীলাভ কে ওষুধ খাইয়ে নীলা চৌধুরী নীলাভকে শুইয়ে দিলেন।নীলাভের মাথার কাছে বসে তিনি নীলাভের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।তার চোখে পানি এসে গেছে।সকালে ছেলের সাথে ওমন ব্যাবহার করেছেন ভাবলেই বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে।

আচ্ছা?তার ছেলের কি এর জন্যই জ্বর?সকালে খারাপ ব্যাবহার করেছে।তার ছেলের সাথে তো তিনি কখনোই এভাবে কথা বলেন নি।আজই প্রথম।নীলাভ তো ইচ্ছা করে কিছু করে নি।তাও এতোগুলা কথা কেনো শুনালো সে।

নিজেকে অনেক খারাপ মনে হচ্ছে তার।অনেক বাজে মা সে।
ভেবেই নীলা চৌধুরী ডুকরে কেদে উঠলেন।

নীলাভ জ্বরের ঘোরেই চোখ পিটপিট করে তাকালো।মায়ের চোখে পানি দেখে সে দুর্বল হাসি দিয়ে বলল,

-কেদো না মা।সত্যি আমি তোমার ভালো ছেলে হয়ে উঠতে পারি নি।না বাবার খেয়াল রেখেছি আর না তোমার জন্য কিছু করতে পেরেছি।তুমি কতো চাও একটা বউমা সেটা আমি জানি মা।কিন্তু দেখো কিছুই করতে পারি না।আমি অনেক খারাপ মা।

নীলা চৌধুরী ছেলের এমন আহত কথায় আরো বেশি কেদে উঠলেন।ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

-কে বলেছে? আমার ছেলে তো দুনিয়ায় সবার সেরা।সেরা ছেলে আমার।আমার ছেলের মতো আর একটাও নেই।হিরার টুকরো আমার।

নীলাভ জ্বরের ঘোরেই কাপা কাপা হাতে মায়ের শাড়ির আচল ধরে বলে উঠলো,

-প্রীতিকে তোমার অনেক ভালো লাগে তাই না মা?কিন্তু জানো মেয়েটা না একটা পাগল গাধা কিচ্ছু বুঝে না।যেখানেই যায় সেখানেই ঝামেলা বাধিয়ে বসে থাকে।যেখানেই যাবে একটা না একটা ব্যাথা পাবেই ও।আর অনেক বাচাল।আমার সাথে ওর কোনো দিকেই ম্যাচ খায় না।কিন্তু মেয়েটা বেশ ভালো। অনেক নরম মনের মেয়ে।জানো মা,ও না অনেক মিশুক আর আমি তো মিশতেই পারি না কারোর সাথে।আমরা টোটালি আলাদা।

নীলা চৌধুরী ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,

-বাবা,তোর পছন্দ হয় প্রীতিকে?যদি দুজন মানুষ পুরোপুরি আলাদা হয় তাহলে তাদের মনের মিল থাকে। বুঝলি?

নীলাভ আস্তে গলায় বলে উঠলো,

-না মা।আমার প্রীতিকে ভালো লাগে কিন্তু ভালোবাসা?সেটা তো না।আমি তো প্রীতিকে ভালোই বাসি নি মা।ভালোই বাসি নি ভালো লাগে শুধু ভালোবাসি নি…শুধু ভালোলাগা

নীলাভ এককথা বারবার বিরবির করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো।

নীলা চৌধুরী কিছুক্ষন ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।নীলাভের জ্বরের ঘোরে বরাবরই কথা বলার অভ্যাস। জ্বর হলেই সে ঘুমের ঘোরে কথা বলে আরেকজনের মাথা নষ্ট করে দেয়।

কিন্তু জ্বরে আর মত খেলে না কি মানুষ সত্যি কথা বলে। আজ তার জ্বলন্ত প্রমান নীলা চৌধুরীর সামনে। তার নিজের ছেলের মনে যা ছিলো সব বলেছে।আসলেই তো ভালোলাগা আর ভালোবাসা তো এক নয়।ভালো তো অনেক কেই লাগতে পারে।কিন্তু ভালোবাসা তো আমরা হাতে গুনা কয়েকজনকে বাসতে পারি।

,

তৌফিক চৌধুরী এখন একটু সুস্থ হয়েছেন।নীলা চৌধুরী একবার স্বামীকে দেখে বিছানায় হেলান দিয়ে ছেলের কাছে বসলেন।একটামাত্র ছেলে তার অনেক আদরে মানুষ করেছেন। সেই ছেলের জ্বরে সে কি করে অন্যঘরে থাকবেন।তার উপর ছেলেকে আজ সে অনেক কড়া কথা শুনিয়েছেন।মনটা তার বড্ড খারাপ।ছেলেও তার অভিমান করে সারাদিন কিচ্ছুটি মুখে তুলেনি।শুধু রাতে তৌফিক চৌধুরীর জোরাজুরিতে একটু খাবার মুখে তুলেছে।

নীলা চৌধুরী সারারাত ছেলের মাথার পাশে বসে ছিলেন।শেষ রাতের দিকে ছেলের মাথার পাশে বসেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।

নীলাভ তো জ্বরের ঘোরে সেই কখন ই ঘুমিয়ে পড়েছে।হয়তো সকালে উঠে কিচ্ছু মনে থাকবে না ওর।সকালে মাকে নিজের মাথার পাশে বসে থাকতে দেখে হয়তো নীলাভ অবাক হবে।কপালে জলপট্টি দেখে হয়তো সে অবাক হবে।ভাববে যে, কোথা থেকে এলো এই জলপট্টি?গা যখন ব্যথা করবে মাথা যখন ঝিমঝিম করবে তখন হয়তো নীলাভ ধরতে পারবে ওর মাথার কাছে মায়ের বসে থাকার কারনটা।

______________________________

বিষন্ন মনে ফাকা রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে প্রীতি।

আজ স্নেহা নেই ওর সাথে।বাড়ি থেকে প্রীতিকেও অনেক বার বারন করা হয়েছে যাতে আজ ভারসিটি না যায়। কিন্তু না… সে শুনবে না।সে আজ যাবেই।

সুর্যের ব্যাপক তাপ।

প্রীতির হাতে তার নতুন ফোন।নতুন সিম।প্রীতি একবার ঘড়িটে টাইম দেখে নিলো।

এরপর আবার হাটা শুরু করলো। আজ তার বাম চোখ টা অনেক লাফাচ্ছে।বাম চোখ লাফানো না কি ভালো না?বাম চোখ লাফালে না কি দুঃখ হয়?কিছু খারাপ ঘটে?প্রীতি এসব বিশ্বাস করে না।তবুও কেনো জানি আজ ভালো লাগছে না।সবকিছু বিষাদময় লাগছে।তিক্ততায় ঘিরে উঠেছে যেনো চারিপাশ।

আনমনে হাটতে হাটতেই হুট করে প্রীতির সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো।প্রীতি মারাত্মক ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।নিজের বুকে থুতু দিয়ে সামনে সচেতন দৃষ্টিতে তাকালো।কিছু বলার জন্য আঙ্গুল উচু করতেই সামনের মানুষটিকে দেখে সে বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে গেলো।গলার স্বর উচু করে বলে উঠলো,

-আপনি???
# হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_Unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-22

সূর্যের সোনালী আলোয় চারিদিকে চিকচিক।

রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কম।এই রাস্তা টুকু বরাবরই একটু ফাকা ফাকা টাইপের।এই রাস্তা টুকু পেরোলেই সামনে মোড়। সেই মোড়ে থেকে আবার মানুষের ব্যস্ততার শব্দ শোনা যায়।চারিদিকে মানুষের গুঞ্জন পাওয়া যায়। ব্যস্ত পায়ের পদাচরন।মানুষে মানুষে গরম বাড়ে তখন।
কিন্তু এই ফাকা ফাকা রাস্তায় প্রীতির চমকিত চোখ কে আরো খানিকটা চমকে দিয়ে তনয় মুচকি হেসে বলে উঠলো,

-আশা কর নি বুঝি?

প্রীতি এবার স্বাভাবিক হয়ে এলো।ভ্রু দুটোকে কিঞ্চিৎ কুচকিত করে বলে,

-সেটাই কি স্বাভাবিক না?

তনয় নিজের ঝাকড়া চুলগুলোকে পিছের দিকে এলিয়ে দিয়ে আবারও হাসলো।প্রীতি খুব সতর্কতার সহীত সেদিকে তাকালো।এর মতি গতি মোটেও ভালো ঠেকছে না প্রীতির কাছে।তনয় বলে,

-রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছো যে?

প্রীতি -হম…ভার্সিটি যাচ্ছি।

তনয়-চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দেই।

প্রীতি -তার কোনো দরকার নেই।আমি হেটেই যাবো।

তনয় -না চলো আমি পৌঁছে দেই।আফটার অল হবু বউকে তো আর রাস্তায় ছেড়ে রাখতে পারি না।

তনয়ের ঠোটের কোণে বাকা হাসি।প্রীতি একবার আড়চোখে তনয়কে দেখে নিয়ে আর কোনো কথা বাড়ালো না।চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসলো।তনয় গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।প্রীতি তনয়ের দিকে ঘুরে বলল,

-আপনি এখানে কেনো? কি করছেন এই সময়ে?

তনয়-কাজে এসেছিলাম একটু।

প্রীতি -কি কাজ?

তনয় -এমনিই অফিসিয়াল কাজ।

প্রীতি -ওহ…

তনয় একটু বাকা হেসে বলে উঠে,

-যাই হোক একটা নিউজ আছে।তোমার জন্য গুড না কি বেড বুঝতে পারছি না।

প্রীতি ভ্রু কুচকে বলে,
-কি?

তনয় কপালের চুল গুলো আবার মাথার পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

-আজ মে বি বাবা মা সকাল সকাল তোমাদের বাড়িতে গেছে।

প্রীতি -কেনো?

তনয় বেশ চমৎকার করে হেসে বলল,

-আমাদের বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে।সব ঠিক থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের বিয়ে।

প্রীতি বিচলিত হয়ে কিছুক্ষন চেয়ে রইল তনয়ের দিকে।বিয়ে টা তাহলে ওর করতেই হবে।প্রীতির চোখ শুকনো কিন্তু গলাটা কেমন যেনো ভেজা ভেজা।ও ঠোঁট টিপে ধরা গলায় বলে উঠলো,

-এতো তাড়াতাড়ি কেনো?কোনো আগাম সতর্কবার্তা না দিয়ে বিয়ের ডেট ফিক্সড?

তনয় আবারো মুচকি হাসলো।প্রীতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সেদিকে। তনয় ছেলেটা দেখতে খারাপ না।উচা লম্বা বডি সব দিক থেকেই পার্ফেক্ট। কিন্তু নীলাভের মতো নয়।কারন নীলাভের মতো তনয়ের দুটো নীল চোখ নেই।গোলাপি ঠোঁট নেই।বিরক্তে চোখ মুখ কুচকে কথা বলতে পারে না তনয়।তনয় তো কোনো কিছু বলার আগেই রেগে যায়।শুধু কেনো যেনো প্রীতির সাথে কথা বললেই ও সবসময় হাসে।তনয় বলে উঠলো,

-আমাদের বিয়ে তো ঠিক ই শুধু ডেট ফিক্সড টা করা বাকি ছিলো।আর নিজের হবু বউকে আর কতোদিন নিজের থেকে দূরে রাখবো বলো।এতো কিউট বউকে না জানি কখন কে কোথা থেকে এসে নিয়ে চলে যায়।

প্রীতি তনয়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ তনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।আজ তনয় সবকিছুতে একটু বেশি বেশি বলছে বলে প্রীতির মনে হচ্ছে।প্রীতি অন্যদিকে ঘুরে তাকালো।

বেশ কিছুক্ষনপর কোনো কিছু উদ্ধার করার মতো করে আচমকা প্রীতি বলে উঠলো,

-আচ্ছা, আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?

এমন ভাবে প্রীতি কথাটা বলল যেনো তনয় ‘না’ বললেই প্রীতি বিয়েটা ভেঙে দিতে পারবে।আর ওর দৃঢ বিশ্বাস তনয় ওকে ভালোবাসে না।প্রীতির সব ঝল্পনা কল্পনার মাঝে পানি ঢেলে তনয় বলে উঠলো,

-অবশ্যই বাসি।

প্রীতি মাথায় বাজ পড়ার মতো ভঙ্গি করে বলল,

-বাসেন?

তনয় -হম।

প্রীতি আবার বলে উঠলো,

-আচ্ছা প্রেমে পড়েছেন আমার?

তনয় গাড়ি চালাতে চালাতেই জবাব দিলো,

-হম….ভালোবাসি আর প্রেমে পড়বো না?

প্রীতি – কোনটা আগে করেছেন?ভালোবেসেছেন না কি প্রেমে পড়েছেন?

তনয় স্টেয়ারিং এ হাত দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে উঠলো,

-এমন আজব প্রশ্ন করছো তবুও উত্তর দিচ্ছি।

প্রীতি নিরাশ গলায় বলে উঠলো,

-হম দিন।আগে ভালোবেসেছেন না কি প্রেমে পড়েছেন?

তনয়- অবশ্যই আগে ভালোবেসেছি।ভালো না বাসলে প্রেমে কীভাবে পড়বো?তুমি দেখো না মানুষ প্রেম করার জন্য আগে প্রপোজ করে, আই লাভ ইউ বলে তারপর তারা রিলেশনশিপে যায়।সে হিসেবে আমিও আগে তোমায় ভালোবাসেছি এরপর প্রেমে পড়েছি সিম্পল…

তনয়ের এমন অযোক্তিক কথা শুনে প্রীতি নিঃশব্দে তাচ্ছিল্য হাসলো।জানালার দিকে ঘুরে বসলো ও।বাইরে শূন্যে দৃষ্টি রাখলো।চোখের কোনে পানি জমে গেছে।যে পানি বলছে, “আমি যা চেয়েছি তা পাই নি।”

প্রীতি তনয়ের আড়ালে চোখের পানি মুছলো।

_____________________________

চৌধুরী বাড়ি গমগম করছে মানুষে।তেমন মানুষ ও আবার না।হাসি ঠাট্টার শব্দ শুনা যাচ্ছে।এই সকালে কে এসেছে?

ভাবতে ভাবতেই নীলাভ বাড়িতে ঢুকলো।ও ওর অফিসে গেছিলো চাকরিটা কেনো ছেড়েছে?এর জন্য ওর বস ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলো।

,

নীলাভ বাড়িতে ঢুকেই দেখলো রাফিয়া আহসান প্রনয় আহসান আর স্নেহা এসেছে।

নীলাভ একটু বিচলিত হয়েছিলো এদেরকে এই সময়ে দেখে।তারপরও সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিলো।স্নেহার সাথে হাসিমুখে কথা বলে নিজের ঘরে ঢুকলো।

বেশকিছুক্ষন পর নীলা চৌধুরী নীলাভকে ডাকলেন সকালের খাবার খাওয়ার জন্য।নীলাভ খুব সকালে বেরিয়ে গিয়েছিলো।আর এখন দুপুর হয়ে এসেছে।

কথা বলার এক পর্যায়ে রাফিয়া আহসান নীলা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-মেয়ের তো বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেললাম ভাবী।

নীলা চৌধুরী চমকে উঠে বললেন,

-বিয়ের ডেট?কবে?

রাফিয়া আহসান মুচকি হেসে বলে,

-আজ সকালেই তনয়ের বাবা মা এসে ছিলো হুট করে।বিয়ের ডেট টা ফিক্সড করেই ওরা চলে গেছে।ওরা চলে যাওয়ার পরেই তো ভাইয়ের অসুস্থের কথা শুনে আমরা আপনাদের বাড়িতে আসলাম।

নীলা চৌধুরী মলিন মুখে বললেন,

-ওহ কবে বিয়ে?

রাফিয়া চৌধুরী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন,

-সামনের ২০ তারিখ।

নীলা চৌধুরী অবাক কন্ঠে বলে উঠলেন,

-সামনের ২০ তারিখ তাহলে আর মাত্র পনেরো দিন বাকি।

নীলাভ সিড়ি দিয়ে নামছিলো তখন।রাফিয়া আহসানের কথা শুনে এক মুহুর্তের জন্য সে থমকে দাড়িয়েছিলো।কেমন যেনো সবকিছু নিস্তব্ধ লাগছিলো।

নীলাভ আস্তে আস্তে হেটে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো।

সোফা আর ডাইনিং রুম টা এক সাথে।সোফায় বসে সবাই কথা বলছে।আর নীলা চৌধুরী ছেলের তদারকি করছে কখনো ভাত বেড়ে কখনো তরকারি বেড়ে কখনো বা পানি দিয়ে।

সবকিছুই ঠিক ঠাক চলছিলো কিন্তু হঠাৎ প্রনয় চৌধুরীর ফোনে কল আসে।প্রীতির কল!প্রনয় চৌধুরী দেখে অবাক হয়।এ সময় তো প্রীতি কল দেয় না। প্রীতি তো ভারসিটিতে।

প্রনয় আহসান কল রিসিভ করলেন।রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে মেয়ের কান্নার শব্দ কানে এলো তার।আত্মা ধক করে উঠলো।তার আদরের মেয়ে কাদছে।প্রনয় আহসান চট করে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

সবাই কথা বলা বাদ দিয়ে সেদিকে উতকন্ঠ চোখে তাকালো।প্রনয় আহসান অস্থির কন্ঠে বলে উঠলেন,

-কি হয়েছে মা আমার। কাদছো কেনো মা?কিয়ে হয়েছে?

ওপাশ থেকে অস্পষ্ট স্বরে ভেসে আসলো,
-বাবা আমাকে বাচাও বাবা বাচাও।

আর কিছু বলতে পারলো না ফোনটা কেটে গেলো।প্রনয় আহসান বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করলেন কিন্তু কোনো কাজ হলো না।

চৌধুরী বাড়ির কাজের মেয়েটা টিভি দেখছে।চ্যানেল পাল্টটাতে পাল্টাতে সে খবরের চ্যানেল দিলো তখনই শুনতে পেলো সবাই ‘ঢাকা শহরে বড় সন্ত্রাসী ঢুকেছে। বিভিন্ন ভারসিটি কলেজ হাইজ্যাক করেছে। অনেক ছেলে মেয়ে আহত হয়েছে। নিহত ও হয়েছে।’

এবার সবাই প্রীতির কান্নার কারনটা ধরতে পেলো।

রাফিয়া আহসান একমাত্র মেয়ের বিপদের খবর শুনেই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, আমি বলেছিলাম আমি বলেছিলাম আজ ভারসিটি না যেতে। তাও জেদ ধরে গেলো।আমার কলিজার টুকরা।এখন এখন কি হবে?

রাফিয়া আহসান কাদতে কাদতে এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।

নীলাভ খাবার ছেড়ে উঠে পড়লো।টেবিলের উপর একটা গাড়ির চাবি দেখতে পেলো সে।চাবিটা নিয়েই ও তাড়াতাড়ি বলে উঠে,

-আংকেল আপনি চিন্তা করবেন না আমি আছি।আমি প্রীতিকে নিয়ে আসবো সহি ছালামত ভাবে।

নীলাভ আর এক সেকেন্ড দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো।নীলাভ শক্ত অনেক শক্ত কিন্তু কিছু কাছের মানুষের প্রতি সে দুর্বল অনেক দুর্বল।প্রীতিও কি তাহলে সেই লিস্টে নাম লেখাচ্ছে।না কি এটা শুধুই মানবতা?

_________________________

প্রীতি একটা বেঞ্চের নীচে বসে আছে ।মুখ চেপে বারবার কেদে উঠছে ও।শরীর বারবার কেপে উঠছে।

,

প্রীতি ভারসিটি আজ আগেই ছুটি হয়ে গিয়েছিলো।ভারসিটি থেকে বের হবার সময় প্রীতির মনে পড়লো যে ও নিজের নোট টা ক্লাসে রেখে এসে পড়েছে।সেটা নিতে গিয়েই ওর দেরি হয়ে যায় আর সবাই বের হয়ে যায়।আর সেই মুহুর্তেই সন্ত্রাসীরা ভারসিটিতে ঢুকেছে।মূলত আজ ভারসিটি এর কারনেই আগে ছুটি দিয়েছিলো।কিন্তু প্রীতি জানতো না।

,

ভারসিটির গেটে পুলিশ।সবাইকে ভারসিটির বাইরে নিরাপদ ভাবে বের করে দিয়েছে।কিন্তু ভেতরে যে প্রীতি আছে সেটা কেউ জানে না।পুরো ভারসিটি সন্ত্রাসীরা ঘেরাও করে ফেলেছে।

প্রীতি কাদতেই একটু শব্দ করে কেদে উঠলো।সাথে সাথে ও নিজের মুখটাকে চেপে ধরলো।বাইরে কারোর পায়ের শব্দ শুনা যাচ্ছে।কেউ আসছে এই দিকেই আসছে।প্রীতির চোখ বড় বড় হয়ে এলো।প্রীতি সামনের বেঞ্চের নীচে বসে ছিলো।প্রীতি এক বেঞ্চের নীচ থেকে আরেক বেঞ্চের নিচে যেতেই বেঞ্চে পা লেগে বিকট শব্দ হলো। তখনি কেউ একজন ঠাস করে দরজা টা খুলে ফেলল।

প্রীতি দেখে আতকে উঠলো।কালো লম্বা গড়নের একটা লোক।হলুদ দাত গুলো বের করে হি হি করে সে হাসছে।লোকটা একটা বিকট হাসি দিয়ে বলল,

-আমি আগেই ভেবেছিলাম এখানে কেউ আছে।আর পেয়েও গেলাম।আরে আমি গ্যাং লিডার আমার চোখ ফাকি দেওয়া এতো সহজ না।তুই… তুই হবি আজ আমার শিকার।

প্রীতিকে ভালোভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো।ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে ভেজালো।

প্রীতি নিজের ব্যাগ টা বুকে চেপে আছে।চোখের নিচে পানি।গালে বেয়ে পড়া পানি গুলো শুকিয়ে গেছে।ঠোঁট দুটো কালো হয়ে আছে।শরীর টা বার বার ঝাকুনি দিয়ে উঠছে।

লোকটা প্রীতির কাছে যেতেই প্রীতি নিজের হাতের ব্যাগ দিয়ে লোকটার মাথায় এক বারি দিলো।

,

নীলাভ ভারসিটির গেটের সামনে এসে দেখলো পুলিশরা ঘেরাও করে আছে গেটের চারিপাশে।এখন কাউকে ডুকতে দেবে না।উপায়ন্তর না পেয়ে ভারসিটির পেছনে আসলো।খুব সতর্কতার সহীত সে দেয়াল টপকালো।ভারসিটির ভেতরে ঢুকে গেছে সে।ভারসিটির রুমের দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে যেতে লাগলো।আর প্রত্যেক রুমের দরজা হালকা খুলে দেখছে প্রীতি আছে না কি।

একটা রুমের দরজা হালকা ফাক করে নীলাভ তাকালো। না… কেউ নেই।যেই নীলাভ সামনে ঘুরলো ওমনি কেউ তাকে আঘাত করার জন্য এগিয়ে আসলো নীলাভ তার আগেই পাঞ্চ মেরে দিলো লোকটার মুখে। লোকটার মুখ চেপে ধরে ইচ্ছামতো মারতে লাগলো।সামনে আরো বেশ কিছু গুন্ডা এলে নীলাভ সবাইকে এভাবেই সতর্কতার সহীত সরাতে লাগলো।

,

প্রীতির ব্যাগের ওজন কম এই টুকু ওজনের একটা ব্যাগ দিয়ে মারাতে গ্যাং এর লিডারের কিছুই হলো না।সে এবার ক্ষেপে গেলো।ঝাপিয়ে পড়লো প্রীতির উপর।

প্রীতি হাত পা ছুড়ছে।কিল দিচ্ছে ঘুসি দিচ্ছে তবুও পারছে না।শরীরে একবিন্দু শক্তি ও নেই ওর।অনেক চেষ্টার পরেও না পেরে প্রীতি থেমে গেলো।

লোকটা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে প্রীতির গলায় মুখ নিতে গেলেই কেউ তার এক ঝাক মাথা ভর্তি চুল টেনে উপরে তুলল।
রক্তিম আভার চোখের মালিক সে ।কি ভয়ানক চোখ! মনে হচ্ছে সামনে যা পাবে তাই জ্বলসে দিবে।

গ্যাং এর লিডার লোকটা কিছু বলার আগেই উড়াধুরা তাকে মারতে লাগলো।আর মুখ দিয়ে নানান ভাষায় গালি দিলো সেই ভয়ানক চোখের মালিকটি।

চলবে🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here