হঠাৎ_বসন্তে পর্ব ১

“এক্সকিউজ মি মিস, আপনার শাড়ীর আঁচলটা সামলে রাখুন। ” হঠাৎ একটা পুরুষালি কণ্ঠ রুহির কর্ণগোচর হতেই সে চমকে উঠলো। দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরেই একটা ছেলেকে দেখে সে মোটামুটি আতঙ্কিত হয়ে পরলো। কোনো কথাই তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না তার। ঠিক এসব কারনেই সে বাইরে বের হতে চায় না। তার উপর আবার এমন বিশেষ বিশেষ দিনে তো মোটেও নয়।

রুহি পুরোপুরি পিছনে ফিরে শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলো,
” আমাকে বলছেন?”

নির্ভয়, রুহির দিকে চেয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললো,
” জ্বি মিস, আপনাকেই বলছি। আপনার শাড়ীর আঁচলের অনেকখানিই মাটি ছুঁয়েছে। ”

নির্ভয়ের কথা শুনে রুহি চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের শাড়ীর আঁচল দেখে নিলো। আসলেই তো…. অনেকখানি আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শুরু থেকেই কি এমনটা ছিলো? কোথায়? হোস্টেলে শাড়ী পরার সময় তারিন আর লিজা তো এ বিষয়টা দেখিয়ে দেয়নি তাকে। ইশ, শুধু শুধু তাদের দোষ দিয়ে লাভ কি? শাড়ী তো সে নিজেই পরেছে। সে হিসেবে আঁচল বড় ছোটো হওয়ার ব্যাপারটা তাকেই লক্ষ্য রাখতে হতো। আগে থেকে দেখে রাখলে এমন পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই পড়তে হতো না। নিজের বোকামিতে নিজেই লজ্জিত হচ্ছে রুহি।

রুহিকে ঘাড় ঘুরিয়ে থাকতে দেখে নির্ভয়ের বেশ হাসি পাচ্ছে। আজ পর্যন্ত সে এমন মেয়ে খুব কমই দেখেছে, যে শাড়ী নামক বস্ত্র পরেও এতো খামখেয়ালি হয়ে থাকে। পহেলা বসন্তের এ দিনে যেসব মেয়েরা বাহিরে ঘুরতে বের হয়, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের সৌন্দর্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকে। কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি সেই ‘প্রত্যেকেটা মেয়ের’, মধ্যে নয়। সে ব্যতিক্রমী। শাড়ীর সাথে মিলিয়ে যে হিজাব পরেছে সেটার নিচ থেকেও গুটিকয়েক চুল বেড়িয়ে আসছে। পুরো মুখমন্ডলের নানা জায়গায় ছোট্ট ছোট্ট টিস্যুর টুকরো লেগে আছে। হয়তো ঘর্মাক্ত মুখ মুছতে গিয়ে এমনটা হয়েছে।
নির্ভয় রুহিকে আলতো স্বরে ডাকলো,
” আঁচল নিয়ে কোনো গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পরলেন বুঝি?”

নির্ভয়ের কথায় চট করে মাথা তুলে সামনে তাকালো রুহি। নির্ভয়ের চোখেমুখে রম্যতার যে ছাপ ফুটে উঠেছে তা রুহির নজর এড়ালো না। রুহি স্মিত হেসে বললো,
” জ্বি না। এমন কিছুই না৷ আমি আসলে দেখছিলাম, ঠিক কতোটা বড় হয়েছে আঁচলটা।”

নির্ভয় মুখ লুকিয়ে হেসে ফেললো। বললো,
” আমি ভাবছিলাম, আপনি বোধদয় দেখছিলেন, শাড়ীর সাথে কতশত ময়লা এসে আটকে আছে। ”
এই বলে সে রুহির দিকে তাকালো। রুহির গোলগাল মুখখানা অপমানে থমথমে হয়ে আছে। নির্ভয় সেদিকে তোয়াক্কা না করে আবারো বললো,
“আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে আপনার শাড়ীর আঁচল লক্ষ্য করছিলাম৷ এ সময়ের মধ্যে যে আপনার আঁচল কত চিপস, চকলেটের প্যাকেট, শুকনো ফুল, ধুলোবালি নিয়ে ঘুরেছে তার ইয়ত্তা নেই।”
এই বলে নির্ভয় শব্দ করে হেসে উঠলো।

নির্ভয়ের কথাবার্তা এবং হাসি রুহির শরীরে যে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে তা বোধহয় নির্ভয় খুব একটা টের পাচ্ছে না৷ রুহি ভিতরে ভিতরে এ মূহুর্তে প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করছে, এবং রেগেও আছে। তার মন চাইছে নির্ভয়কে দু চারটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু নির্ভয় অপরিচিত মানুষ হওয়ার দরুন এমন কাজটা সে করতে পারছে না। আচ্ছা? এই তারিন এবং লিজা কোথায় গেলো? মেয়ে দুটোকে সে প্রায় বিশ মিনিট যাবত আশেপাশে কোথায় দেখছে না। বেশ ক’বার সে ফোনও করেছিলো দুজনকে। কিন্তু কেউই কল রিসিভ করেনি। আবার কি কল করবে?
রুহির এ ভাবনার মাঝেই তার ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা ফোনটা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। হালকা চমকে উঠে সে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলো তারিন কল করেছে। এতোক্ষণ তার কলের অপেক্ষাই তো করছিলো রুহি! অবশেষে কল এলো।
রুহি দ্রুত ফোন রিসিভ করে কানে চেপে নিয়ে বললো,
” দোস্ত, কোথায় তোরা? আমি সেই কখন থেকে তোদের কল করছি! এতোক্ষণ কি রেস্টুরেন্টে একা একা বসে থাকা যায়?”

ওপাশ থেকে তারিন অপরাধী সুরে বললো,
” সরি রে দোস্ত। আমি জীবনের সাথে ঘুরতে বেড়িয়ে পরেছি।”

তারিনের এহেন কথায় রুহি যেনো আকাশ থেকে পরলো। তাকে একা রেখে ঘুরতে বেড়িয়েছে! সে বিস্মিত হয়ে বললো,
” তোর আক্কেল জ্ঞান কিছু আছে? তোদের জোরাজুরি এই সো কল্ড পহেলা ফাল্গুনে বের হয়েছি আমি৷ আর তোরাই আমাকে রেস্টুরেন্টে রেখে গায়েব! হাউ ক্যান ইউ ডু দিস টু মি ইয়ার?”

” তোকে নিয়ে অর্ধেক সময় ঘুরে তারপর জীবনের সাথে ঘুরার কথা ছিলো আমার৷ কিন্তু জীবন সময়ের আগেই চলে আসে। এজন্যই তোকে রেখে বেড়িয়ে আসতে হয়েছে আমাকে।”

রুহি এ মূহুর্তে প্রচণ্ড রেগে আছে৷ দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো,
” ঐ লিজার কি হয়েছে? ও কোথায়? ”

” লিজাও ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেড়িয়েছে।”

রুহির প্রচণ্ড রাগে ধমকের সুরে বললো,
” তোদের বয়ফ্রেন্ডদের গুষ্টি কিলাই। অসহ্য, বিরক্তিকর, ফালতু। না আছে তোদের আক্কেল, না আছে তোদের বয়ফ্রেন্ডদের আক্কেল। একদম সোনায় সোহাগ। আজকে হোস্টেলে আয়, তারপর দেখ কি করি।” এই বলে সে খট করে ফোন কেটে দিয়ে সামনের দিকে তাকালো। নির্ভয় তো আরো কয়েকটা ছেলে মেয়ে তার দিকে প্রচণ্ড আশ্চর্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তেই তার সব রাগ, লজ্জায় পরিণত হয়ে গেলো। এভাবে সবার তাকিয়ে থাকার কারণটা সে খুঁজে পেলো না। আচ্ছা, তারিনের সাথে যে সে উচ্চস্বরে কথা বলেছে তা শুনতে পেয়েছে নাকি এ ছেলেমেয়েগুলো? সর্বনাশ! এমন হলে তো মানসম্মান প্রায় শেষ হয়ে গেলো রুহির। নাহ, সাহস করে এদের যেতে বলতে হবে। নাহলে এভাবেই তার দিকে তাকিয়ে থাকবে এরা।

রুহি লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে গরম চোখে তাকিয়ে বললো,
” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো সবাই? কোনো কাজ নেই?”

রুহির কথা শোনা মাত্রই ছেলেমেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা, সমালোচনা করতে করতে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রুহি এবার চট করে নির্ভয়ের দিকে তাকিয়ে ঝেঁঝে উঠা গলায় বললো,
” আপনি কি দেখেছেন? আপনার কোনো কাজ কাম নেই?” এই বলে রুহি আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো না। বড় বড় পা ফেলে উল্টো দিকে ঘুরে সে হাঁটা ধরলো।

এদিকে নির্ভয়, রুহির কথায় থতমত খেয়ে গেলো। রুহির কথার ঝাঁঝে সে বেশ অবাকও হলো বটে। আনমনে ভাবতে লাগলো, মেয়েটা বড্ড অদ্ভুত তো! কতো রূপ আছে তার! শুরুতে একদম বোকাসোকা ধরনের মনে হয়েছিলো। অথচ এখন একদম রণচণ্ডী রূপে হাজিরা দিয়ে গেলো!

নির্ভয় পাশ ফিরে রুহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। রুহির শাড়ীর আঁচল এখনো মাটি ছুঁয়ে চলছে। আশেপাশের ধুলোবালিতে হলদেটে কমলা রঙের শাড়ীর আঁচলটা ঘোলাটে রঙ ধারণ করেছে। নির্ভয় কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। তারপর কি মনে করে হালকা হেসে রুহির পিছনে ছুটা শুরু করলো।

#চলবে

#হঠাৎ_বসন্তে
#লেখনীতে:সারা মেহেক
#পর্ব:১

( এক পর্বেই শেষ করতে চেয়েছিলাম ছোটগল্পটা। কিন্তু বড় হয়ে যেতো। আর এখন এতো বড় পর্ব লেখার সময় নেই। এজন্য দু পর্বে ভাগ করলাম। আগামী পর্বে শেষ হয়ে যাবে।®সারা মেহেক
#ষড়_চিত্তের_নোঙর আগামীকাল দিনের বেলা দেওয়ার চেষ্টা করবো। শিওর না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here