হলুদ খাম, পর্ব:৬

#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম_রিয়া

___________________[৬]___________________

মুহুর্তেই তনুর সারা শরীর কেপে উঠল, অদ্ভুত উত্তেজনায় সায়নের পিঠ খামছে ধরল তনু। সায়ন সলজ্জ হেসে তনুর কানেকানে বলল,

” ভালবাসি প্রেয়সী!
_______________________

সাথেসাথেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল তনু, তার কাধ ঝাকিয়ে ডাকছে তনিমা।
তনু কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বসল, তনিমা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে সিট ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,

” আমতলী এসে গেছি, তনু উঠে আয়।

তনু লাগেজ নিয়ে মায়ের পিছুপিছু হেটে বাস থেকে নেমে এলো।
তারা বাস থেকে নেমে দাড়াতেই বাসটা দ্রুত বেগে স্থানটা ত্যাগ করল।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব, তনিমা একটা সিএনজি ঠিক করে উঠে বসল।
তনুও লাগেজ দুটো নিয়ে উঠে বসতেই সিএনজি ছেড়ে দিল।

গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলছে সিএনজি, দুপাশে সবুজের সমারোহ।
সূর্য ডোবা রক্তিম আকাশে এক ঝাক পাখি উড়ে যাচ্ছে। সারাদিনের প্রখর তাপদাহের পর ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারিদিকে।

তনু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল, আহ! কি প্রশান্তি!! এই প্রশান্তি শহরের দালানকোঠার ভিড়ে পাওয়া যায় না।
সেখানে চলে যান্ত্রিক জীবন, যেখানে মাঝেমধ্যে নিঃশ্বাস নিতেও ভীষণ কষ্ট হয়।

নানানরকম ফলফলাদির গাছে ঘেরা বাড়ির বিশাল উঠানে পা রাখতেই দূর থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল।
বড়বড় সিড়ির ধাপ বেয়ে উঠে বারান্দায় এসে দাড়ালো তনিমা আর তার মেয়ে।

বাড়ির কেয়ারটেকার হাসু তাদের লাগেজ দুটো আগেই ওপরতলায় নিয়ে গেছে।
তনুর বড় মামি সেলিনার সাথে টুকটাক কথা বলে তনিমা ফ্রেশ হতে ওপরে গেলো। তনুও তার পিছুপিছু ওপরে উঠতে লাগলো।

ছোট্ট ছোট্ট ধাপের সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ওপর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো সে।
নিশ্চয়ই স্নেহা আপুর মেয়ের কান্না! দোতলায় উঠে সেলিনা ওয়াশরুমে গেলো।
বাচ্চার কান্নার উৎস অনুসরণ করে একটা ঘরে এসে দাড়ালো তনু!!

বিছানায় আধশোয়া হয়ে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে স্নেহা, তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
এক হাতে মাথা রেখে শুয়ে অন্য হাত দিয়ে তালপাতার তৈরি হাতপাখা ঘোরাচ্ছে সে। তনুকে দেখা মাত্রই প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলল,

” আরে তনু! কখন এলি!? ফুপ্পি কোথায়!?

” মাত্রই এসেছি আপু, আম্মু ফ্রেশ হতে গেছে।

স্নেহার মেয়ে খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছে, চার্জার ফ্যানটা বাচ্চার মাথার কাছে দিয়ে উঠে বসল স্নেহা।
তনু বাচ্চাটার কপালে আলতো করে চুমু খেলো। স্নেহার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল,

” একদম তোমার মতো লাগছে, কত্তো কিউট দেখতে!

” সবাই বলছে ও ওর আব্বুর মতো দেখতে হয়েছে। একমাত্র তুইই বললি যে ও আমার মতো দেখতে!

প্রতিত্তোরে তনু মুচকি হাসল, স্নেহা হাতপাখা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

” ভীষণ গরম পড়ছে আজ, বিকেলে আসা থেকেই দেখছি ইলেকট্রিসিটি নেই। তারমধ্যে বড় চার্জার ফ্যানটারও চার্জ শেষ!

” হুম, আজ ভীষণ গরম পড়ছে। ইলেক্ট্রিসিটি কখন আসবে কে জানে!! আচ্ছা আপু বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

” আচ্ছা যা।
_____________________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
তনিমা আর সেলিনা মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠে স্নেহার ঘরে এলো।
বেডের পাশে ছোট কাঠের টেবিলের ওপর একটা চার্জার লাইটের আলো জ্বলছে। সেটার আলো প্রায় শেষের পথে।

বাচ্চাটাকে কোলে তুলে তনিমা আদর করল, ঘনকালো পাপড়ি খুলে চোখ মেলে তাকালো বাচ্চাটা।
পরক্ষণেই আবার ঘুমে তলিয়ে গেলো সে। সেলিনা হেসে বলল,

” বুঝলে আপা! এ মেয়ের নাম রাখা নিয়ে বেধেছে এক ঝামেলা। কেউ কোনো নামই ঠিক করতে পারছেনা। যেটাই বলা হচ্ছে সেটাই রিজেক্ট করে দিচ্ছে স্নেহা!

” নাম রাখা নিয়ে অতো চিন্তা করতে হবে না ভাবি, দেখো ইমরান নিশ্চয়ই মেয়ের নাম ভেবে রেখেছে।

স্নেহা চোখ কপালে তুলে বলল, ” ওর আশায় বসে থাকলে আমার মেয়ের আর নাম রাখা লাগবেনা ফুপ্পি! ওকে যখনই জিজ্ঞেস করি, বলে ” ও সময় এলে দেখা যাবে।
এটা শুনতে শুনতে মেয়ের আকিকার সময় চলে এলো! এখনও উনি কোনো নামই বলতে পারলেন না!!

স্নেহার কথা শুনে হেসে ফেলল তনিমা আর সেলিনা, এরমধ্যেই তনুর ছোট মামি রাবেয়া চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তনিমা স্মিত হেসে বলল,

” কেমন আছো ভাবি!? রাইসা, রুশা ওরা কোথায়!?

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপা, রাইসা বোধহয় আসতে পারবে না। ওর শ্বশুরের নাকি গতকাল স্ট্রোক হয়েছে, সারারাত জামাই সহ দুজনেই হসপিটালে ছিলো। এখন এক সপ্তাহ না হলে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেবে না। অসুস্থ শ্বশুরকে রেখে আসবে কিভাবে বলো!

” আল্লাহ ওনাকে সুস্থতা দান করুক!! তা রুশা কোথায়!? ও আসেনি!?

” এসেছে তো, ওর ফোনে নাকি নেটওয়ার্ক প্রবলেম হচ্ছে! তাই ফোন নিয়ে একবার এদিক দৌড়াচ্ছে আবার ওদিক দৌড়াচ্ছে!!

__________________________

বাড়ির কেয়ারটেকার হাসু মিয়া পান চিবাতে চিবাতে ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাড়ালো।
তনুর নানার এক বন্ধুর ছেলে সে। বন্ধু মারা যাওয়ার পর থেকে হাসু এই বাড়িতেই বেড়ে উঠেছে। সেলিনা তাকে দেখে বলল,

” হাসু ভাই! কিছু বলবেন!?

” আইজ রাইতে কি রান্না করমু ভাবি!?

” বাজার থেকে মুরগী আনছেন না!? ওটা কাটতে লাগেন আমি আসতেছি।

” ভাবি! ঐডা তো ডেকি(মাঝারি সাইজ) মুরগী, সবডা না রানলে কুলাইবো!?

” সবটাই রান্না করবো, চলেন ভাই মুরগীটা জবাই করে নিই।

হাসু আইচ্ছা বলে সেলিনার পিছুপিছু চলে যেতে নিলে স্নেহা বলে উঠল, ” হাসু চাচা! ইলেকট্রিসিটির কি হল!? কখন আসবে!?

” অহ, আমি তো কইতে ভুইলা গেছিলাম। আইজ বোধহয় কারেন্ট আইবো না, কারেন্টের লাইনে কি জানি একটা সমইস্যা হইছে!

স্নেহা আরেকদফা বিরক্তি নিয়ে বাচ্চার পাশে শুয়ে পড়ল। তারমানে আজ সারারাত তালপাখা চালিয়ে যেতে হবে! হাসু একগাল হেসে বলল,

” গেরামের অবস্থা বুঝেনিতো! কারেন্ট আইলে অনেকক্ষণ থাহে, কিন্ত গেলে আর আসার নাম নাই!! আইচ্ছা আমি হারকিন( হারিকেন) জ্বালায় আনি। চাজ্জার লাইডের আলো তো ফুরায় যাইতাছে!!

স্নেহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” তাই আনেন চাচা!

হাসু চলে যেতেই রাবেয়ার ফোন বেজে উঠল, তনুর ছোট মামা কল করেছে।
ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
তনিমা একটা চিরুনি দিয়ে চুল আচড়াতে আঁচড়াতে বলল,

” আচ্ছা সায়ন কোথায় রে!? আজ আসেনি!?

” এসেছে তো, এসেই এলাকার ছেলেপুলেদের সাথে বাজারে আড্ডা দিতে গেছে।

” তা কি করছে ও আজকাল!? গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে এমবিএও তো শেষ!!

” হুম, ও তো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেই সরকারি চাকরি আর বিসিএস এর জন্য প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করেছে। এখন দেখা যাক, ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি জব পেয়ে যাবে।

” আমিন!
____________________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
ওয়াশরুমের দরজার গায়ে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে রেখেছে তনু।
হাতে পানি নিয়ে মুখে ঝাপটা মারছে। যে গরম পড়ছে, একেবারে গোসল করতে পারলে ভালো হত।

হুট করে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অফ হয়ে যেতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেলো চারপাশ।
তনু চরম বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে আন্দাজে পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে।

দেয়াল ধরে ধরে নিচু হয়ে ফোনটা হাতে নিল, অন করতে গিয়ে বুঝল ফোনের চার্জ শেষ!
তনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলো।

স্নেহার ঘর থেকে আসা টিমটিমে আলোয় আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে সে।
তনু সেদিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছনে কারো উপস্থিতি পেয়ে থমকে গেলো। ভয়ে আতংকে সে পেছনে ফেরার সাহস পাচ্ছেনা।

ঠিক তখনই কোমরে কোনো পুরুষালী বলিষ্ঠ হাতের ছোয়া পেয়ে চমকে উঠল তনু! এক ঝটকায় তার হাতটা সরিয়ে চেচিয়ে উঠলো সে!!

সাথেসাথেই কারও ফোনের ফ্ল্যাশলাইট এসে তার মুখে পড়ল। সায়ন তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইট তনুর মুখে মেরে বলল,

” এমন পেত্নীর মতো চেচাচ্ছিস কেনো রে!? অন্ধকারে তোকে দেখে আমার তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়!!

সায়নের কন্ঠঃ পেয়ে তনু চিৎকার থামিয়ে চোখ মেলে তাকালো।
ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল আলো হাতের তালু দিয়ে আড়াল করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সায়নের দিকে।

স্পষ্ট দেখতে না পেলেও আবছা দেখতে পাচ্ছে সে, টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে দাঁড়িয়ে আছে সায়ন।
মাথাভর্তি ঝাকড়া চুলগুলো একপাশ করে ওলটানো। গালভরা খোচাখোচা দাড়িও রেখেছে!! তনু নিজ মনে বলে উঠল,

” সায়ন ভাইয়া কি দিন দিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছে!!

_______________________________

এদিকে চেচামেচি শুনে তনিমা আর স্নেহা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়।
রুশাও কোত্থেকে এসে সেখানে উপস্থিত হল। তনিমা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,

” কি হয়েছে রে!? এতো চেচামেচি কিসের!!?

তনু কিছু বলতে পারছেনা, সায়নের সাথে চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিল সে।
সায়ন পরিস্থিতি সামলাতে থমথমে গলায় বলল,” কিছু হয়নি, তনু অন্ধকারে ভয় পেয়েছে!

বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে সায়ন নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তনিমা সেদিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

” আমি নিচে যাচ্ছি, দেখি ভাবিরা কি করছে।

তনিমা নিচে নেমে যেতেই স্নেহাও বাচ্চা নিয়ে ঘরে চলে গেলো।
তনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ তার ভেতরে ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে!

আড়াই বছর পর নিজের ভালোবাসাকে দেখেছে সে!! ভয়ংকর অনুভূতি!!!
মনে হচ্ছে তনুর প্রাণ ভোমরাকে সায়ন তার পাজড় নামক খাচায় বন্দী করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে!!!!
মাঝেমধ্যে হয়তো সেটার গলা টিপে দেখছে বেচে আছে কি না!!!!!

রুশা ধীর পায়ে তনুর কাছে এসে বলল, ” এই তনু! তোর ফোনে কি এখানে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে!?

তড়িৎ গতিতে তনু দৃষ্টি উঠিয়ে রুশার দিকে তাকালো, রুশার চোখেমুখে একরাশ উদ্বিগ্নতা!
তনু কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা, নিজ মনেই প্রশ্ন করল,

“আচ্ছা এই মেয়েটাকে এখন কষিয়ে একটা চড় মারলে কি সে অজ্ঞান হয়ে যাবে!?
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here