হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব -১৫+১৬

Part 15+16
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-১৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

রাত এগারোটা। শুদ্ধ বসে আছে একটা ল্যাপটপ নিয়ে। তার সামনেই বইয়ের স্তূপ সাজিয়ে বসে আছে ধারা। তার কোলের উপর একটা মোটা বই। বইয়ের গভীরে তার দৃঢ় মনোযোগ। তার খোলা রেশমী কালো চুলগুলো কাঁধ জুড়িয়ে এসে পড়েছে সামনে। সেদিকে ধারার ভ্রুক্ষেপ নেই। শুদ্ধ’র দেখে ভালো লাগলো। যেই স্বপ্নটা ধারাকে নিয়ে সে দেখেছে, সেই স্বপ্নের রেশ ধীরে ধীরে এখন ধারার মনেও সঞ্চারিত হচ্ছে। এতদিনে ধারাও তার পড়াশোনার দিকে ভালোমতোই ঝুঁকে গেছে। মন দিয়ে নিচ্ছে সে পরীক্ষার প্রস্তুতি। শুদ্ধ খানিক গলা খাকারি দিয়ে ধারাকে ডেকে বলল,

‘কি ব্যাপার ধারা? আজকে দেখি আপনি একবারও ঘুমে ঝিমাচ্ছেন না। এতো রাত হবার পরেও!’

ধারা স্মিত হেসে বলল,
‘আজকে আমি দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম। আপনি তো আপনার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাই দেখেননি। তাছাড়াও এখন পড়াটা অনেকটাই ধরতে পারছি বলে পড়ে ভালো লাগছে।’

‘এমনভাবেই যদি পড়তে থাকেন না তাহলে দেখবেন আপনি ইনশাআল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবেন।’

‘চান্স পাবো কিনা আমি শিওর বলতে পারছি না। কিন্তু আমার ভয় লাগছে। বাবা আর কাকা এখনও কিছু জানে না। বাবা তো আমাকে আর পড়াতেই চায়নি। একারণেই তো বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আর এখন তাকে না বলেই আমি পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছি তার উপর বিভাগ পরিবর্তন করে….না জানি বাবা শুনলে কি করে!’

ধারাকে আশ্বাস দিয়ে শুদ্ধ বলল,
‘ধারা, এতো ভয় পাবেন না। আপনি কোন ভুল করছেন না। প্রতিটা কাজের দুটি অংশ থাকে। ঠিক অথবা ভুল। যতক্ষণ আপনার বিবেক জানে আপনি কোন ভুল করছেন না ততক্ষণ তা নিয়ে কখনো শঙ্কিত হবেন না। আপনার বাবাকে আপনি সবটা খুলে বলবেন। আপনাকে আমি পড়ালেখা করাবো। আপনার যতদূর ইচ্ছা আপনি পড়বেন। বলেছি না! সবসময় মনে রাখবেন আমি আপনার পাশে আছি।’

ধারা নানা শঙ্কায় থেকেও একটা ভরসার হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ বলল,
‘একবার ইউনিভার্সিটিতে গেলে এসব কিছুই আর তখন আপনার মনে থাকবে না। ইউনিভার্সিটির লাইফটা যে কি না দেখলে মিস করবেন।’

‘আপনি খুব মিস করেন বুঝি?’

‘হুম। খুব! এতোবছর বন্ধুদের সাথে থাকতে থাকতে বন্ধুগুলা একদম আপনের থেকেও বেশি হয়ে যায়। আমরা যে একসাথে কত আড্ডা মজা করতাম! সেগুলো মনে পড়লে আপনাআপনিই মন ভালো হয়ে যায়। আমার তো অনেকগুলো ফ্রেন্ড ছিল। আপনার কয়জন ফ্রেন্ড ধারা?’

ধারা মনে মনে কিছু ভাবলো। তার আসলে কোন ফ্রেন্ড নেই। এই কথাটা যে শুনে সেই অবাক হয়। এখন এটা শুদ্ধ জানলে নিশ্চয়ই তাকে এ নিয়েও ক্ষ্যাপাবে। এদিকে ধারা মিথ্যাও বলতে চায় না। তাই বলল, ‘আমি বলবো না।’

শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

‘এমনিই।’

‘এমনিই মানে?’

‘এমনিই মানে এমনিই।’

শুদ্ধ ধারার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?’

শুদ্ধ ঝুঁকে পড়ায় ধারার মাথাও কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। শুদ্ধ একদম তার চোখের মধ্যে তাকিয়ে আছে। একটা ঢোক গিলে ধারা কাঁচুমাচু করতে লাগলো। শুদ্ধ যেভাবে ধারার মনের সব কথাই বুঝে যায় না জানি আবার এবারো বুঝে ফেলে। ধারাকে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিলো লোডশেডিং। হঠাৎ চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় শুদ্ধ তার ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অন্ধকার দেখে চমকে সোজা হতে যেতেই শুদ্ধ’র মাথার সাথে জোরে একটা বারি খেলো ধারা। শুদ্ধ ব্যাথাটা চেঁপে গিয়ে সোজা হয়ে বসলো। অন্ধকারে না বুঝে আবারো সেখান থেকে সরতে গিয়ে আবারো শুদ্ধ’র মাথার সাথে আরেকটা বারি খেলো ধারা। শুদ্ধ এবার বলেই ফেললো,
‘ছোটবেলায় মাথায় শিং গজাবার মজাটাকে আপনি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন তাই না ধারা! আমার মাথায় শিং গজাবার চান্স থেকে বাঁচিয়ে কৃতার্থ করলেন।’

কপালে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে ধারা বলল,
‘আপনি এখন খোঁচা না মেরে কোন লাইট নিয়ে আসুন।’

শুদ্ধ গিয়ে নিচ থেকে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আসলো। ধারার সামনে রেখে দিলে আবার বই খুলে পড়তে বসলো ধারা। আর শুদ্ধ ব্যস্ত হলো তার নিজের কাজে। শ্রাবণ মাস চলে যাবার পরপর বৃষ্টিরও বহুদিন হলো কোন হদিস নেই। ভ্যাপসা গরমে বৈদ্যুতিক ফ্যান ছাড়া কোন উপায় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই গরমে ধারা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেলো। কিছুতেই পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারলো না। শুদ্ধ বলল,
‘কারেন্ট তাড়াতাড়ি আসবে বলে তো মনে হয় না। আজকে আর পড়তে হবে না ধারা। আপনি শুয়ে পড়ুন।’

ধারা গলা থেকে তার নীল রঙের ওড়নাটা একটু আলগা করে একটা খাতা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল, ‘এই গরমের মধ্যে শুয়েই কি হবে! ঘুম তো আর আসবে না। যেই গরম!’

শুদ্ধ খেয়াল করলো আসলেই খুব গরম। রুমের মধ্যে টিকে থাকা মুশকিল। একবার বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ধারার হাত ধরে টেনে বলল,
‘চলনে বাইরে যাই।’

ধারা কিছু বলার আগেই শুদ্ধ তাকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে এলো। বাইরে ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের আলো নারকেল গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে প্রবেশ করে উঠোনে আলো রেখার নকশা তৈরি করেছে। কৃত্রিম আলোর ছুটি হওয়ায় জোৎস্না যেন আজ পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেয়েছে। শুদ্ধ রান্নাঘরের বেড়ার গায়ের সাথে টাঙানো একটা শীতল পাটি নিয়ে আসে। তারপর উঠোন পেরিয়ে ধারাকে নিয়ে চলে এলো পুকুর পাড়ে। ধারা অভিভূত হয়ে গেলো। সামান্য চাঁদের আলোও যে কতো সুন্দর হতে পারে এই মুহুর্তে এইখানে না দাঁড়ালে কেউ বুঝতে পারবে না। আকাশের হাজারও তারকারাজির মাঝখানে হীরকখণ্ডের ন্যায় জ্বলজ্বল রত একটা পূর্ণ চাঁদ। যার স্থবির প্রতিবিম্ব পড়েছে পুকুরের স্বচ্ছ জলে। সেই আলোয় উজ্জ্বলতা পেয়েছে পুকুরের মাঝে জন্ম নেওয়া পদ্ম ফুলের দল। আহা, কি সুন্দর!

পাড় ঘেঁষে জন্মানো ঘাসের উপরে শুদ্ধ হাতের শীতল পাটি টা বিছিয়ে দিলো। তার উপরে ধারাকে বসতে বলে নিজেও বসে পড়লো সে। হালকা শীতল হাওয়া বইছে বলে তাদের দুজনেরই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনে জ্যোৎস্না বিলাসের পর শুদ্ধ’ই প্রথমে ডেকে উঠলো,
‘ধারা!’
ধ্যান ভঙ্গ হয়ে ধারা জবাব দিল,
‘হুম?’
‘একটা গান শুনান তো!’
‘আমি গান পারি না।’
‘গান কেউই পারে না। আবার পারে সবাই। কি সুন্দর পরিবেশ দেখেছেন? শুনান না একটা গান।’
ধারা লজ্জা পেয়ে বলল,
‘উহুম! আমারটা ভালো হয় না।’
‘আহা! শুনান না একটা। আপনাকে তো স্টেজে পারফর্ম করতে বলছি না! অতো ভালো হওয়া লাগবে না। আপনি যেমন পারেন গাইবেন। প্লিজ শুনান না একটা গান।’
ধারা বিব্রত হতে হতে বলল, ‘আপনি কিন্তু হাসতে পারবেন না।’
‘আচ্ছা।’
ধারা সামনে তাকিয়ে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে আস্তে আস্তে গাইতে লাগলো,
‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
সাথী মোদের ফুল কুঁড়ি,
লাল পরী, নীল পরী…..

এতটুকু গাইতেই শুদ্ধ বহু কষ্টে হাসি চেঁপে রেখে হঠাৎ ফস করে হেসে ফেললো। ধারা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘আপনাকে কিন্তু আমি বলেছিলাম আপনি হাসতে পারবেন না। আপনি হাসলেন কেন? আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম আমি ভালো গাইতে পারি না।’
শুদ্ধ হাসি থামাতে থামাতে বলল,
‘আপনার গাওয়াতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা হলো গানে।’
‘কেন? গানে কি সমস্যা?’
‘এমন একটা সুন্দর পরিবেশে, পাশে এমন একটা হ্যান্ডসাম ছেলে থাকলে যে কিনা সম্পর্কে আপনার হাজবেন্ড হয় সেখানে কি কেউ এমন গান গায়!’
ধারা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল, ‘তাহলে কেমন গান গায়? আপনিই বলে দিন।’
শুদ্ধ কিছুটা থেমে বলল, ‘আচ্ছা ধারা আপনাকে এই পর্যন্ত কয়টা ছেলে লাভ লেটার দিয়েছে?’
ধারা দ্রুত জবাব দিয়ে ফেললো, ‘একটাও না।’
শুদ্ধ চরম আশ্চর্যের স্বরে বলল, ‘কি বলেন! আপনাকে তো বইয়ের পরিভাষায় সাংঘাতিক সুন্দরীই বলা যায়। আর আপনি কিনা কোন লাভ লেটার পাননি?’
ধারা ভ্রুকুটি করে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। তার ঠিক ছয় ইঞ্চি দূরত্বেই বসে আছে ছেলেটা। গায়ে পাতলা একটা সাদা শার্ট। হাতা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করে রাখা। বাতাসে গোছানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উঠছে। মুখে একটা দুষ্ট হাসি। যার মূলে আছে শুধু ধারাকে ক্ষ্যাপানো। ধারা গভীর অতীতে ঝাঁপ দিয়ে দেখলো ক্লাস ফোর এ থাকতে তাকে তার স্কুলেরই একটা ছেলে খাতায় আই লাভ ইউ লিখে দিয়েছিল। তা দেখে ধারা সেটাকে নোংরা কথা ভেবে এতোটাই জোরে জোরে কেঁদেছিল যে ছেলেটা হেড মাস্টারের কাছে বিচার যাওয়ার ভয়ে আর কোনদিন ধারার সামনেই আসেনি। কিভাবে যেন এই কথাটা ধীরে ধীরে পুরো স্কুলে ছড়িয়ে যায়। তারপর থেকে প্রাইমারী থেকে হাইস্কুল, সব ছেলেদের মাথাতেই এটা গেঁথে যায় এই মেয়েকে আর যাই হোক প্রপোজ করা যাবে না। তারপর কলেজেও ধারার নিরামিষ মার্কা স্বভাবের জন্য সব ছেলেরা তার থেকে দূরে দূরেই থাকতো। একারণেই হয়তো আজ পর্যন্ত তার কাছে কোন লাভ লেটার আসেনি। কিন্তু এই কথাটা মরে গেলেও খোঁচারাজকে জানানো যাবে না। তাই ধারা তার কথা কাঁটাতে শুদ্ধকে উল্টা প্রশ্ন করলো, ‘আমারটা বাদ দিন। আপনি কয়টা লাভ লেটার পেয়েছেন?’
মাথার নিচে একটা হাত রেখে পাটিতে শুয়ে পড়ে শুদ্ধ বলল, ‘কতগুলো! বেশিরভাগই ইউনিভার্সিটিতে থাকতে।’
ধারা প্রশ্নটা করেছিল এমনি এমনিই। শুদ্ধ’র উত্তর শুনে আকাশ থেকে পড়ে বলল, ‘আপনাদের ওখানে মেয়েরাও লাভ লেটার দেয়?’
‘আপনি শহরের মেয়েদেরকে কি ভাবেন? ওদের মনে যেটা থাকে সেটা ওরা প্রকাশ করে দেয়। অবশ্য সবাই না।’

‘তারপর? আপনি একসেপ্ট করেছেন কয়টা?’

শুদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বিশেষ একজনের অপেক্ষায় আছি। সে করলেই একসেপ্ট করবো।’

ধারার হঠাৎ ই কেন যেন খুব লজ্জা করতে লাগলো। আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে ফেললো সে। ঠিক তখনই তার বাম কাঁধে কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পড়তেই পুরো পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলো ধারা। পেছন থেকে উঠে বসে শুদ্ধ ধারার কানে কানে গাইতে লাগলো,

“এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!
ছুঁয়ে দিলে হাত,
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা
চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি
পাখার ব্লেড-এর তালে সোজাসুজি কথা বলি!
আমি ভাবতে পারিনি,
তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার
শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ!
আমি থামতে পারিনি,
তোমার গালে নরম দুঃখ,
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ!”

শুদ্ধ’র গান থেমে যাওয়ার পরও ধারা সেভাবেই জমে রইলো। তার শরীরের প্রতিটি লোম যেন দাঁড়িয়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নতুন একধরণের মাতাল শীহরণে তার মন হয়ে উঠেছে আন্দোলিত। মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ, তার উপচে পড়া জ্যোৎস্না, পুকুর ছুঁয়ে ভেসে আসা শীতল হাওয়া, তার উপরে কানের কাছে এমন গান, স্পেশালি শুদ্ধ’র ওমন জড়ানো গলার স্বর….সরল অনুভূতি এলেমেলো না হয়ে কি পারে!

ধারা ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। আর সঙ্গে সঙ্গেই চলে এলো কারেন্ট। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা আস্তে আস্তে বলল,
‘বাড়িতে যাবেন না? কারেন্ট চলে এসেছে।’
শুদ্ধ বসে থেকেই তার সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘হুম, দেখলাম তো। আচ্ছা ধারা! আমার গান কেমন হয়েছে বললেন না তো!’
কিছু না বলে মৃদু হেসে বাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো ধারা। শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘সাবধানে ধারা! আপনি পড়ে যাচ্ছেন।’
অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের দিকে লক্ষ করে ধারা বিভ্রান্ত স্বরে বলল,
‘কোথায়?’
মুচকি হেসে দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে শুদ্ধ বলল,
‘প্রেমে!’

#পর্ব-১৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

সকাল থেকেই শুদ্ধদের বাড়িতে একটা জমজমাট ভাব। শহর থেকে শুদ্ধ’র কিছু ফ্রেন্ড এসেছে। সবগুলোই মেয়ে। সকাল দশটা নাগাদ রূপনগর গ্রামে পৌঁছেছে তারা। সারাদিন থেকে আবার সন্ধ্যার পরে চলে যাবে। সবকিছু আগে থেকেই পূর্বপরিকল্পিত ছিল। তারা সবাই শহুরে, কখনো গ্রাম দেখেনি। শুদ্ধদের বাড়িতে আসার ইচ্ছে সেই ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকেই ছিল। অবশেষে একটা শক্ত পরিকল্পনা করে চলেই এসেছে সবাই। প্রায় চার পাঁচটা মেয়ে। সবার পরনেই আধুনিক পোশাক। সাথে সুন্দরীর খেতাব তো আছেই। সকাল থেকেই তাদেরকে বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছে ধারা। খোদেজার সাথে রান্না বান্নায় সাহায্যর সাথে সাথে তার আড়চোখের দৃষ্টি শুধু সেদিকেই যাচ্ছে। একটু আগে খোদেজা বলেছিল ধারাকে, মেহমানদের ট্যাং গুলিয়ে শরবত বানিয়ে দিতে। ধারা কিছু ফলমূল কেটে সাথে শরবতের গ্লাস নিয়ে ট্রে সমেত গেলো শুদ্ধ’র ফ্রেন্ডদের কাছে। শুদ্ধ ওদের সাথেই বসে খোশগল্পে মজেছে। এদের মধ্যে সবাই যে শুদ্ধ’র ভালো ফ্রেন্ড এরকম নয়। কেউ কেউ ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড আর ভালো ক্লাসমেট সূত্রেও আছে। ধারা সেখানে গিয়ে শুনতে পেলো শুদ্ধ বলছে,
‘তোরা একা চলে এলি কেন? রাকিব, শিহাব, তুহিন ওদেরকেও সাথে নিয়ে আসতি।’

শুদ্ধ’র সবথেকে ভালো ফ্রেন্ড তিশা বলল,
‘কেন? ওদেরকে নিয়ে আসতে হবে কেন? ঐ হারামীগুলা যে এর আগে একা একা বেড়িয়ে গেলো! তখন আমাদের আনছিলো? ওরা ছেলেরা ছেলেরা একা বেড়িয়ে গেছে এখন আমরা মেয়েরা মেয়েরা একা বেড়াবো। আমরা মেয়েরাও কোন কিছুতে কম না।’

শুদ্ধ মৃদু হাসলো। তিশা বলে উঠলো,
‘তুই হাসবি না। তুই হইলি গিয়া আরেকটা হারামী। একা একা বিয়ে করে ফেললা! আমাদের খবর দিছিলা?’

‘খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়ে গেছে রে। কাহিনী আছে অনেক। তোরা বুঝবি না।’

‘তুই তোর কাহিনী নিয়া চুপ থাক! তোর বউরে ডাক। গল্প করি।’

ধারা ট্রে হাতে ওদের সামনে গিয়ে নামিয়ে রাখলো। তিশা আর বাকি সবাই আরো একবার ভালো মতো দেখে নিলো তাদের সামনে দাঁড়ানো উনিশ বছরের সুন্দরী মেয়েটিকে। তিশা একটু এগিয়ে এসে শুদ্ধকে চোখ মেরে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘বউ তো দেখি ভালোই সুন্দর। দিন তো মনে হয় ভালোই কাটছে!’

শুদ্ধ ওঁকে থামিয়ে বলল, ‘ধ্যাৎ! চুপ কর তো।’
তিশা চুপ হয়ে গেলো। ধারা শুধু বিস্ময় চোখে ও’র সামনের মেয়েগুলোকেই দেখতে লাগলো। একেকটার চাইতে একেকটা সুন্দর। চলন বলনও অন্যরকম। সবাই দেখতেই কতো স্মার্ট! পোশাক আশাকেও ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। ধারা খেয়াল করলো এদের মধ্যে সবচাইতে বেশি সুন্দরী মণিকা নামের ছিপছিপে গড়নের মেয়েটা ধারাকে একদম পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তাকানোর ধরণটাও একটু অদ্ভুত। ধারা ভাবতে লাগলো, এই এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে, এই সবগুলোই কি শুদ্ধ’র ফ্রেন্ড? একটা মানুষের এতো ফ্রেন্ড থাকে? ছেলেদের এতো মেয়ে বন্ধু থাকার কি দরকার? আর দেখো, এদের সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে! হাসি যেন আর বাঁধ মানছে না। আর আমার সাথে যখন কথা বলে তখন একটা কথার মধ্যে দুইটাই থাকে খোঁচা।
শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তোরা দেখ আশেপাশে ঘুরে ঘুরে। আমি একটু দুই মিনিটের জন্য আসছি।’

শুদ্ধ চলে গেলে বাকি সবাইও ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুদ্ধদের বাড়ি দেখতে লাগলো। ধারা শুধু আড়াল থেকে নজর রাখতে লাগলো মেয়েগুলোর উপর। এর মধ্যে মণিকা নামের মেয়েটিকে দেখলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বারবার ঠিকঠাক করছে। তার পাশে থাকা মেয়েটি ও’র কান্ডে ক্লান্ত হয়ে বলল,
‘আর কতক্ষণ লাগাবি? চল বাইরে যাই।’
‘দাঁড়া, আর এক মিনিট। দেখ তো আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?’
‘ভালোই লাগছে।’
মণিকা দুষ্টুমি করে চোখ মেরে বলল,
‘হট লাগছে?’
‘আরে বাবা হ্যাঁ।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মণিকা বলল,
‘আচ্ছা, আমি কি আগে দেখতে কম হট ছিলাম? শুদ্ধ’র আমার প্রতি ইন্টারেস্ট না জন্মিয়ে এই গ্রামের মেয়েটার ভেতর এমন কি পেলো?’

পাশের মেয়েটি বলল, ‘তুই যথেষ্ঠ হট ছিলি আর আছোস। যার বিয়ে যার সাথে লেখা তার সাথেই হবে। এগুলা নিয়ে ভেবে লাভ নাই এবার চল তো৷ তোর প্রেজেন্ট বয়ফ্রেন্ডও কি কম হ্যান্ডসাম নাকি!’

‘তা ঠিক। তবে শুদ্ধ’র ব্যাপারটাই আলাদা। এখন আর কি করার! চল বাইরে যাই।’
মণিকা চলে গেলে ধারা পেছন থেকে মেয়েটার দিকে তাকিয়েই রইলো। মণিকার পরনে ব্লু টপস আর হোয়াইট জিন্স। চুলগুলো কার্লি করা। দেখতেই কতো স্মার্ট লাগে। আর অপরদিকে ধারা….! ধারা মুখ ফুলিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার পরনে গোলাপি রঙের ছাপা তোলা থ্রি পিছ। মাথার চুল গুলো বেণি করা। একদম সাধারণ। ধারা আরেকবার পেছন থেকে মণিকার দিকে তাকিয়ে নিজের চুলের বেণিটা খুলে ফেললো৷ তার রেশমীর মতো লম্বা সোজা চুলগুলো হঠাৎ ছাড়া পেয়ে বাতাসে তাল মেলাতে লাগলো। সেভাবেই বাইরে চলে এলো ধারা। বাইরে এসে দেখলো তিশা শুদ্ধকে বলছে,
‘ঐ, এখানেই আর কতক্ষণ থাকবো? আশপাশটা তো দেখলামই। তোর খামারে নিয়ে চল৷ আমাদের ব্যাচের সবার থেকে ডিফারেন্ট তুই কি করতাছোস ঐটা দেখতে হবে না!’

শুদ্ধ বলল, ‘এখনই যাবি?’

‘হুম। আমি গাড়ি ড্রাইভারকে বলে আসি।’

শুদ্ধ হাসতে হাসতে বলল, ‘গাড়িতে যাবি? তুই কি এখনও শহরে আছোস ফাজিল? পায়ে হেঁটে যেতে হবে ক্ষেতের উপর দিয়ে। ঐখানে গাড়ি নিলে গ্রামবাসী তোদের ধরে পিটাবে।’

ওরা সবাই যাবার জন্য রওনা হলো। তিশা ধারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘আরে ধারা! তুমিও চলো। বুঝতে পারছি তুমি অনেকবার গিয়েছো, তোমার নতুন করে দেখবার কিছু নেই। তাতে কি হয়েছে? আমাদের সাথেও না হয় দেখলে আরেকবার।’

ধারা কি বলবে ভেবে পেলো না। কারণ সে তো এর আগে কখনো শুদ্ধ’র খামারে যায়নি। সত্যি বলতে তার কখনো মাথাতেই আসেনি এটা। শুদ্ধ জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে ধারার দিকে তাকিয়ে রইলো। সত্যিই ধারার যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি বোঝার জন্য। নয়তো কোন কিছুর জন্যই শুদ্ধ ধারাকে জোর করতে চায় না। তিশা ওরা একটু এগিয়ে গেলে শুদ্ধ ধারার কাছে এসে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ধারা, আপনি যাবেন?’
ধারা বলল, ‘হুম।’
ধারার সত্যিই যেতে মন আছে নাকি নেই ভেবেই শুদ্ধ আবারো বলল, ‘আপনার যেতে ইচ্ছা না করলে থাক। আমি তিশাকে কিছু একটা বলে বোঝাতে পারবো৷’
ধারার কিঞ্চিৎ রাগ হলো। বলল, ‘কেন? আমি যেতে পারবো না কেন?’
‘না মানে আপনার যদি অসুবিধা হয়ে থাকে তাই বললাম।’
‘আপনার ফ্রেন্ডদের যদি অসুবিধা না হয় তাহলে আমার হবে কেন? তাদের মধ্যে একজন যেতে না চাওয়ায় তখন দেখলাম তাকে খুব বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিচ্ছেন। আর এখন আমাকে এটা বলছেন কেন? আমি যাবোই।’
ধারা হনহনিয়ে গিয়ে তিশাদের পিছু নিল। শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ তো ধারার ভালোর জন্যই বলেছিল। এতে এমন রাগ করার কি হলো?

গ্রামের পথে নামতেই সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে এই শহুরে চালচলনের মেয়েগুলোকে দেখতে লাগলো। তাদের পোশাকগুলোই বেশি আকর্ষণ করছে গ্রামবাসীদের। ধারা তখন চুল ছেড়ে আসলেও পথে নামতেই মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে নিলো। সে বউ মানুষ। আবার কে দেখে কি বলে! ওরা গ্রামের ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে যেতে লাগলো। মাটি দিয়ে বানানো একদম সরু যাবার মতো একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা। শুদ্ধ আর ধারার অভ্যাসের কারণে তেমন অসুবিধা না লাগলেও তিশাদের বেশ অসুবিধা লাগলো। একেকজন হাঁটতে গিয়ে বারবার একেক দিকে কাত হয়ে যায়। এই বুঝি বারবার পাশের ধানের ক্ষেতে পড়তে গিয়েও বেঁচে যায়। ওদের কান্ড দেখে ধারার কিঞ্চিৎ হাসি পেলো। শুদ্ধ বারবার উদ্গ্রীব হয়ে বলতে লাগলো, ‘সাবধানে যাস।’ ধারার হাসি গায়েব হয়ে গেলো। আল পেরিয়ে সামনে এলো ছোট্ট একটা গর্তের মতো। পানি জমে ডোবার মতো হয়ে রয়েছে। তার উপরে একটা ছোট্ট গাছের গুঁড়ি ফেলে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মণিকা দেখেই বলল,
‘অসম্ভব! এটার উপর দিয়ে যাবো কিভাবে? পা দিলেই তো মনে হয় পড়ে যাবো। আমি বাবা পারবো না।’
বাকিদেরও একই মত। শুদ্ধ বলল, ‘এছাড়া তো উপায় নেই। একটু চেষ্টা কর, পারবি। মাত্র দু কদম ফেললেই তো হয়ে যাবে। এই দেখ এই যে, মাটি থেকে এক পা গাছের গুঁড়িতে ফেলবি তারপর আবার আরেক পা ওপারের মাটিতে। সিম্পল।’
শুদ্ধ একবার করে দেখালোও। কিন্তু শহুরে মানুষ, জীবনেও যা চোখে দেখেনি তা কি আর তাদের বোধগম্য হবে! ধারার কাছেও এটা কিছুই লাগলো না। এমন ছোট গর্তের উপর গাছের গুঁড়ি দিয়ে পার তো সে কতোই হয়েছে। সেদিন নেহাত অনেক লম্বা সাঁকো ছিল বলে তার পা পিছলে গিয়েছে। আজকেরটা তো সে অনায়াসেই পার হতে পারবে।
সবার আবারো একই কথা শুনে শুদ্ধ গাছের গুঁড়ি পার হয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে আয়। তাহলে তো আর পড়বি না।’
সবাই তাই করলো। শুদ্ধ’র হাত ধরে সবাই আল্লাহ আল্লাহ করতে লাফিয়ে টাফিয়ে চিৎকার করতে করতে অবশেষে একে একে সবাই পার হতে লাগলো। মুখ আংশিক ভার হয়ে গেলো ধারার। এমন লাফানোর কি আছে? হাত না ধরে কি আর পার হওয়া যেতো না! একে একে যখন সবার শেষ হয়ে গেলো তখন খুশিমুখে শুদ্ধ’র দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো ধারা। কিন্তু শুদ্ধ’র নজরে তা পড়ার আগেই সে ঘুরে গেলো। ধারার মুখ ফুলে গেলো। আসল কথা ধারার অভ্যেস আছে, সে পারবে ভেবেই শুদ্ধ’র খেয়ালেই আসেনি আবারো হাত ধরার কথা। তার উপরে ধারা সকাল থেকেই যেভাবে উল্টো রিয়্যাক্ট করছে। তাই আর তাকে আজ বেশি ঘাটছে না শুদ্ধ। কিন্তু ধারার মনে তো তখন চলছিল অন্য কিছু। সে মুখ ফুলিয়ে গটগট করে গাছের গুঁড়ি পেরিয়ে গেলো। আবারো সামনে পড়লো ক্ষেতের আল। আর শুরু হলো একেকটা মেয়ের নাচানাচি। শুদ্ধ বারবার বলতে লাগলো, ‘সাবধানে যাস।’
আর ধারা মনে মনে মুখ ভেংচি দিতে লাগলো।

অবশেষে ওরা গিয়ে শুদ্ধ’র খামারে পৌঁছালো। বিস্ময় নিয়ে সেখানটায় তাকিয়ে রইলো সবাই। সবথেকে বেশি বিস্মিত হলো ধারা। সম্পূর্ণ অন্যধরণের উৎকৃষ্ট অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় চলছে কৃষিকাজ। একটা অংশে দেখতে পেলো গাছের উপরে কেমন যেন নেট দিয়ে ঘরের মতো প্রস্তুত করা। একেকটা গাছের সোজাসুজি ঝুলছে একেকটা সরু দড়ি। এই দড়ি বেঁয়ে গাছগুলো সব উপরে চলে যাবে। আর দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এই ব্যবস্থার ফলে খুব অল্প জায়গার মধ্যেই অধিক গাছ ফলনের সুযোগ পাচ্ছে। আরেক অংশে দেখলো সব গাছের গোড়ায় গোড়ায় সোজাসুজি গিয়ে একটা সরু পাইপের মতো স্থাপন করা। সেই পাইপ থেকে গাছের গোড়ায় গোড়ায় আস্তে আস্তে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। এটাকে বলে ড্রিপ ইরিগেশন। এর ফলে পানি সেচের ঝামেলা তো নেই ই বরং পানি খুব সাশ্রয় হচ্ছে। ওরা সবাই ঘুরে ঘুরে শুদ্ধ’র নতুন ধরণের খামার দেখতে লাগলো। ধারা অধিক অবাক হলো ধান ক্ষেতে গিয়ে। একটা বড় ট্রাক্টরের মতো একদম ভিন্ন ধরণের গাড়ি ক্ষেতের উপর দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর তার থেকে অটোমেটিক ধানের চারা কাঁদা পানিতে রোপন হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন, যে কাজটা করতে একজন কৃষককে অনেক সময় নিয়ে একটা একটা করে বিভিন্ন স্থানে রোপন করতে হতো সেটা নিমিষেই খুব দ্রুত একসাথে অনেকগুলো চারা রোপন হচ্ছে। এমন যন্ত্র ধারা এর আগে কখনো দেখেনি। শুধু ধারা কেন এই গ্রামের কেউই হয়তো দেখেনি। কৃষিতে যে আজকাল প্রযুক্তির প্রয়োগে কতো পরিবর্তন এসেছে তা শিক্ষার অভাবে তাদের এখনো চক্ষুগোচর হয়নি। ধারা যখন বিস্ময় নিয়ে সবটা দেখছিলো তখন তিশা এসে ধারার পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘সবকিছু শুদ্ধ কতো সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে তাই না ধারা! ও আসলেই একটা জিনিয়াস। নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের জোরেই সবার থেকে ভিন্ন পথে হাঁটা দিয়ে তা সম্ভবও করে তুলছে। ইনশাআল্লাহ ও পারবে। তোমার ভাগ্য যে কতোটা ভালো তা তুমি জানো না ধারা। শুদ্ধ’র মতো একটা হাজবেন্ড সচরাচর পাওয়া যায় না। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে কতো মেয়েরা ও’র পেছনে ঘুরেছে! বড়লোক থেকে বড়লোকের মেয়েরা ওঁকে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ও কারো ডাকেই সাড়া দেইনি। সবসময় নিজের লক্ষে স্থির হয়ে থেকেছে। শুধু বলতো সব বিয়ের পর, বিয়ের পর। বউয়ের সাথেই প্রেম করবো। পাগল একটা! আজকালকার দিনে এমন ছেলের কথা কখনো শুনছো? আমার বন্ধুটা খুব ভালো। ওঁকে কখনো হারাতে দিয়ো না ধারা। সবসময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখো। ভাগ্য কিন্তু বারবার সুপ্রসন্ন হয় না।’
———–

তিশা ওরা সবাই সন্ধ্যা হবার আগেই চলে গেলো। বাড়ি নিরিবিলি হয়ে গেলো আবার। তবুও ধারা সেদিন আর পড়ায় মনোযোগ বসাতে পারলো না। বারবার নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নায় দেখতে লাগলো সে। ওর মাথায় শুধু মণিকার চেহারাটাই ভাসতে লাগলো। একসময় রাতের খাবারের ডাক পড়লো। ধারা সকালে বেশি করে রুটি বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল৷ সেই রুটিগুলোই গ্যাসের চুলায় বসে বসে ভাজছে খোদেজা। গরম গরম খাবার জন্যই এখন শুদ্ধ আর ধারাকে খেতে ডেকেছে সে। চুমকি ঘুমিয়ে পড়েছে বহু আগেই। রাতের খাবার আর খেতে উঠবে বলে মনে হয় না। ধারা ভাবনা মুখে খেতে বসলো৷ খোদেজা শুদ্ধ’র প্লেটে দুটো রুটি আর ধারার প্লেটে দুটো রুটি দিয়ে বলল সামনের পিরিচে রাখা ভাজি দিয়ে খেতে। ধারা নিজের পিরিচের ভাজির অর্ধেক অংশই কমিয়ে রাখলো৷ রুটিও একটা রেখে দিলো। সে এমনিতেও খুব বেশি একটা খায় না। শুদ্ধ দেখে বলল, ‘আপনি তো দেখি সবই রেখে দিচ্ছেন ধারা। আপনি একদম বাচ্চাদের মতোন। খেতেই চান না। সব সময় বেশি বেশি করে খাবেন।’
ধারা নিজের ভাবনা থেকেই হঠাৎ ফট করে বলে উঠলো, ‘আপনি আমাকে বাচ্চাদের মতোন বললেন কেন? আমি কি দেখতে হট না?’

শুদ্ধ সবে তখন রুটির একটুকরো ছিঁড়ে মুখে দিতে যাচ্ছিল। ধারার কথা শুনে থেমে গিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে ফেললো সে। ধারা থতমত খেয়ে গেলো। কি বলে ফেললো সে এটা? খোদেজা অন্যদিকে ফিরে রুটি ভাজছিলো বলে ধারার কথা শুনতে পায়নি। হঠাৎ শুদ্ধকে ওমন হাসতে দেখে বারবার উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো কি হয়েছে? কি হয়েছে? শুদ্ধ বলবে কি! সে নিজের হাসিই থামাতে পারছে না। উদ্ভটের মতো কথাটা বলে ফেলায় ধারা প্রথমে যতোটা না বিব্রত হয়েছিল এখন আবার সম্পূর্ণ অন্য কারণে তার মুখ ঝুলে গেলো। শুদ্ধ এতো হাসছে কেন? সে কি আসলেই হট না?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here