হারানোর বেদনা পর্ব -১০

#হারানোর_বেদনা
#পর্ব_১০
#লেখক_দিগন্ত
নিলয় আর ঘোমটা পরিহিত নারীটি সামনাসামনি বসে আছে।নিলয় বলতে লাগল,
-“এত লজ্জা পাচ্ছ কেন লামিহা? আমাদের তো সত্যি বিয়ে হচ্ছেনা।এটা তো মেঘলাকে ধরার জন্য শুধু একটা নাটক।কিন্তু মেঘলাতো এখনো এলো না তারমানে ও সত্যি বেঁচে নেই।আমি আগেই তোমায় বলেছিলাম।যাইহোক এখন তাহলে আমি পরিকল্পনামাফিক নাটক করতে শুরু করি যে আমি মেঘলার যায়গা কাউকে দিতে পারবো না।তাই এই বিয়ে হবে না।”

ঘোমটার ভেতর থেকে মেঘলার কন্ঠ ভেসে আসে।সে বলে,
-“নাটক তো তুমি শুরু থেকেই করছ নিলয়।আর কত নাটক করবে? একটুও কি হাফিয়ে যাওনি নাটক করতে করতে? আমি তো তোমার নাটক দেখে সত্যি ক্লান্ত হতে গেছি।”

চিরচেনা কন্ঠটি শুনে নিলয়ের মনে অদ্ভুত এক ঢেউ খেলে যায়।কতদিন পর সেই চেনা কন্ঠস্বর।এই কন্ঠস্বরেই তো একসময় পাগল ছিল সে।নিলয় অস্ফুটস্বরে বলে,
-“মেঘলা….”

মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে মেঘলা বলতে থাকে,
-“হ্যাঁ আমি মেঘলা।লামিহাকে ওর পাপের শাস্তি দিয়েছি।এবার তোমার পালা।”

এতদিন পর মেঘলাকে দেখে নিলয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এই তো সেই চেনা মুখ, চেনা চোখ।মেঘলাকে তো সে সত্যি ভালোবেসেছিল।কি এমন হতো যদি মেঘলা তার সাথে এমন না করতো? তাহলে তো আজও তারা সুখে সংসার করতে পারত।

নিলা এতদিন পর নিজের মাকে জীবিত দেখে কেঁদে দেয়।সে দৌড়ে এসে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে।লতিফার চোখেও জল চলে আসে।

লতিফা অনেক আগেই মেঘলার ব্যাপারে সব জেনে গেছেন।মেঘলা তার বৌমা হলেও তাকে নিজের মেয়ের মতোনই দেখেন লতিফা।নিজের ছেলের করা অন্যায়ের জন্য মা হিসেবে তিনি লজ্জিত।তাই তো মেঘলার সাথে মিলে সব পরিকল্পনা করেছে।

নিলয় মেঘলাকে দেখে বলতে শুরু করে,
-“আমি জানতাম তুমি ফিরবে।আমার কাছে তোমায় ফিরতেই হতো।”

মেঘলা গগণবিহারী হাসি হেসে বলে,
-“হ্যাঁ আমি ফিরলাম।ফিরতে আমাকে হতোই তোমার কাছে।কারণ তোমার মতো শয়*তানকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত তো আমি শান্তি পাবো না।”

-“মেঘলা…আমার ভুল হয়ে গেছে।তুমি কি পারোনা আমায় ক্ষমা করতে আমি সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে চাই।”

-“তুমি যদি সামান্য কোন অন্যায় করতে তাহলে আমি খুব সহজেই তোমায় ক্ষমা করতাম কিন্তু তুমি এমন সব অন্যায় করেছ যার কোন ক্ষমা নেই।তুমি কত শত মেয়ের জীবন ন*ষ্ট করেছ, তোমার মাদ*ক ব্যবসার কারণে না জানি কতগুলো যুবক বিপথে চলে গেছে।কত বাবা-মা দিনরাত চোখের জল ফেলেছে।এত মানুষের অভিশা*প নিয়ে কিভাবে আমি তোমার সাথে সংসার করবো? শুধু তাই নয় তুমি আমার পুরো পরিবারের খু*নি।এমনকি আমাকেও মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছ।এত অন্যায় করার পরেও তুমি ক্ষমা চাইছ!”

-“আমি জানি আমি অন্যায় করেছি কিন্তু…..”

-“আর কোন কথা বলবে না।আজই হবে তোমার শে*ষ দিন।”

কথাটা বলে একটা ছু*রি বের করে নিলয়ের দিকে এগিয়ে যায় মেঘলা।নিলয় চোখ বন্ধ করে নেয়।চোখ বন্ধ করে বলে,
-“আমি অনেক পাপ করেছি।আজ আমি সব পাপ স্বীকার করলাম।এতো এতো পাপের মাঝে শুধু একটাই ভালো কাজ করেছিলাম আর সেটা হলো তোমাকে ভালোবেসে।তাই আজ তোমার হাতে ম*রতেও আমার কোন আপত্তি নেই।মে*রে ফেলো আমায় মে*রে ফেলো।”

নিলয়ের কথাটা শুনে মেঘলার হাত আটকে যায়।তার চোখ দিয়ে ঝর্ণার মতো পানি ঝরতে থাকে।মেঘলাও তো নিলয়কে খুব ভালোবেসেছিল।এই ভালোবাসা যে ছিল সত্য,সুন্দর।কেন এমন হলো? কেন তার ভালোবাসা এভাবে তাকে ঠকালো? কথাটা ভাবতে ভাবতেই মেঘলা পিছিয়ে আসতে থাকে।নিলয় যতোই খারাপ হোক তাকে মেঘলা ভালোবাসে।নিলয় যতই মেঘলার পরিবারের সবার খু*নি হোক মেঘলা নিলয়ের খু*নি হতে পারবে না।নিলয় যতোই মেঘলাকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করুক মেঘলা নিলয়ের কিছু করতে পারবে না।

মেঘলাকে পিছিয়ে যেতে দেখে নিলয় তাকে কাছে টেনে নেয়।তারপর মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে এটাই হয়তো তাদের শেষ জড়িয়ে ধরা।

মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে নিলয় বলতে থাকে,
-“এখন আমার আর এমনিতেও কিছু নেই।এত মানুষের ঘৃণা নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না।শুধু আমার এখন একটাই ইচ্ছে আমি আমার ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা নিয়ে ম-রতে চাই।আমার ভালোবাসার মানুষের হা*তে মরতে চাই।”

মেঘলা শুধু একটা কথাই বলে,
-“কেন? কেন? কেন আমার সাথে এমন হলো? তুমি কেন ভালো হলেনা? তোমার মিথ্যে অভিনয়টা কেন সত্য হলো না? কি ক্ষতি হতো যদি তুমি ভালো মানুষ হতে?”

-“আমি নিরুপায় ছিলাম মেঘলা।বিশ্বাস করো আমি আগে একদম এরকম ছিলাম না।স্কুল-কলেজে থাকতে আমি খুব ভীতু আর শান্ত ছেলে ছিলাম।আমার ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করে বড় হয়ে আর্মি হবো।বাবার ব্যবসায় জড়ানোর কোন ইচ্ছে ছিলনা।কিন্তু একদিন আমি আমার বাবার এসব অন্যায় কাজ সম্পর্কে জানতে পারি।সেদিন আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসি এবং সিদ্ধান্ত নেই বাবার সব অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলবো।কিন্তু বাবা আমায় ভয় দেখিয়ে বলল, আমি কিছু করলে মাকে মে*রে ফেলবে।সেই ভয়ে আমি বাড়িতে ফিরে আসি।এরপর বাবা আমায় নিজের এই অসৎ কাজের সাথে জড়িয়ে নিলেন।আমিও আস্তে আস্তে টাকা আর ক্ষমতার নেশায় পাগল হয়ে বাবার এইসময়ে অন্যায় কাজের শরিক হয়ে যাই।একসময় বাবাকেও ছাপিয়ে যাই এবং নিজের রাজত্ব তৈরি করি।তুমি জানো আমার বাবা যে শেষের দিকে প্যারালাইজড হয়ে ছিল বাবার ঐ অবস্থাও কিন্তু আমি করেছিলাম।কারণ আমি সব ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইতাম।তবে আমি চাইনি আমার সন্তান আমার মতো খারাপ পথে চলে আসুক।তাই আমি ওকে তোমার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম।আমি চাইতাম আমার মেয়ে তোমার শিক্ষায় বড় হোক।”

মেঘলা এবার ফুপিয়ে কেঁদে দেয়।লতিফা,নিলা সবার চোখেই জল।

নিলয় আরো বলে,
-“আজ আমি আমার সব দোষ স্বীকার করলাম।আমি নারী এবং মা*দক পা*চারের সাথে যুক্ত।আমিই মেঘলার পুরো পরিবারকে খু*ন করিয়েছি।রুদ্রকেও আমি ফাঁসিয়েছি।রুদ্র কোন অন্যায় করেনি।ও বিনা দোষে একবছর কারাগারে কা*টাল।আর না আমি আর কোন অন্যায় করব না।কিন্তু আমি জানি বেঁচে থাকলে আমি অন্যায়ের পিছু ছাড়তে পারবো না।তাই আমি ম*রে যাব।তাহলেই সব অন্যায়ের বিনা*শ হবে।”

কথাটা বলে মেঘলার হাত ধরে ছু*রিটা জোর করে নিজের বুকে ঢুকিয়ে দেয় নিলয়।মেঘলা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

নিলয় মৃত্যুর আগেও হাসিমুখে বলে,
-“ভালো থেকে মেঘলা।পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।আমার হাতে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করা আমার জীবনের সবথেকে বড় পাওনা।”

কথাটা বলা শেষ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিলয়।মেঘলা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল।ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে মেঘলা।

নিলা,লতিফা সবাই নিলয়ের দিকে ছুটে আসে।নিলয় ততক্ষণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।

মেঘলা ঢপ করে নিচে বসে পড়ে।তারপর নিলয়ের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বলে,
-“ক্ষমা চাও তুমি ক্ষমা? কোনদিনও পাবে না।আমি তোমায় কখনো ক্ষমা করবো না।কিভাবে পারলে আমায় এভাবে ছেড়ে চলে যেতে।আমি তো কখনোই এটা চাইনি।তুমি যতই খারাপ হও আমি তোমায় মে*রে ফেলতে চাইনি।আমি চেয়েছি তুমি তোমার অপরাধের শাস্তি পাও।কিন্তু এইভাবে কেন আমাকে দিয়ে নিজেকে শে*ষ করলে তুমি? জীবনে কি কম কষ্ট দিয়েছ যে আজ আবার এভাবে আমায় নিজের খু*নি বানিয়ে সর্বোত্তম শাস্তিটা দিলে? আমি তোমাকে হারানোর বেদনা তো সহ্য করে নেব কিন্তু নিজের হাতে তোমার এই মৃত্যু আমি কিভাবে মানব? না আমি মানব না আমি মানব না।”

কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দেয় মেঘলা।তার ব্যবহার পুরো উন্মাদের মতো ছিল।

এরমধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হয়।নিলয় যেহেতু তার সব দোষ স্বীকার করেছে তাই রুদ্র এখন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে।রুদ্রও চলে এসেছে।

আফজাল শেখ রুশাকে রুদ্রর হাতে তুলে দিয়ে বলে,
-“মেঘলা এতদিন ধরে তোমায় মেয়েকে যত্ন করে রেখেছিল।”

এতদিন পর নিজের মেয়েকে ফিরে পেয়ে রুদ্র তাকে কোলে তুলে নেয়।

মেঘলা তখনো উন্মাদের মতো আচরণ করছিল।নিলা মেঘলাকে বলে,
-“আম্মু তুমি প্লিজ স্বাভাবিক হও।আমার দিকে দেখো।আব্বু যা অন্যায় করেছে তারজন্য একদম সঠিক শাস্তি পেয়েছে।তুমি এভাবে কেঁদোনা।”

মেঘলা মলীন হেসে বলে,
-“আমি জানি।তোকে একটা কথা বলি নিলা জীবনে কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করবি না।সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবি।”

নিলা সম্মতি জানিয়ে বলে,
-“আমি কখনো অন্যায়কে সাপোর্ট করব না।”

মেঘলা নিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।তারপর লতিফার হাতে নিলাকে তুলে দিয়ে বলে,
-“আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবেন।ওর সব দায়িত্ব এখন থেকে আপনার।”

কয়েকজন লেডি পুলিশ আসে মেঘলাকে নিয়ে যেতে।মেঘলা রুদ্রকে বলে,
-“আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে তোমায় অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে রুদ্র।সবকিছুর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।এখন তোমার কাছেও আমার অনুরোধ আমার শাশুড়ী মা আর মেয়েটাকে দেখে রেখ।সাথে নিজের মেয়েরও খেয়াল রেখ।রুশা এই এক বছরে আমার অনেক আপন হয়ে গেছে।”

পুলিশ এরপর মেঘলাকে ধরে নিয়েই যায়।কোর্টে কেস উঠলে লামিহা,নিলয় আর নজরুলকে মে*রে ফেলার জন্য মেঘলার ১৪ বছরের জেল হয়।
(চলবে)
[]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here