পর্ব ৯+১০
#হিংস্রতায়_ভালবাসা
#পর্ব_০৯
#রীমা_শারমিন
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে অবাক হওয়ার সাথে সাথে প্রচন্ড রাগও হচ্ছে। তাই হাতটা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম এক ঝটকায়।
— আপনি আমার হাত ধরার সাহস পেলেন কি করে ?
— তার আগে তুমি বলো সেদিন শপিংমল থেকে আমাকে দেখে ওভাবে কেন চলে গেছিলে?
— প্রশ্নটা আমি আগে করেছি!
— আমাকে তোমার হাত ধরার জন্য আবার সাহস লাগবে নাকি? আগে তো লাগেনি!
— সাহস লাগবে বইকি, আর যদি আগের কথা বলেন তাহলে বলতে চাইবো তখন আপনার অধিকার ছিল যেটা এখন নেই।
— আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে।
— ভুল? কিসের ভুল আর কার ভুলের কথা বলছেন আপনি? আমারতো মনে হয় ভুলটা আমার ছিল আপনার মতো একটা ছেলেকে বিশ্বাস করা।
— তুমি আমাকে ভুল বুঝছো প্রান! আমি তোমাকে সবটা জানাতে চাই, একটা অন্তত সুযোগ দাও আমাকে।
— সময় আর সুযোগ সবসময় চাইলেই পাওয়া যায় না তানভি। অনেক দেরি হয়ে গেছে, অনেক দেরি আর কিছু করা সম্ভব নয়….
আমি আর এক মুহুর্তের জন্যও সেখানে না দাঁড়িয়ে দৌড়াতে লাগলাম। চোখের পানি মুছতে মুছতে সামনে থাকা আহিলকে দেখতে না পেয়ে ধাক্কা খেলাম ওনার সাথে। আহিল প্রচন্ড রেগে আমার দিকে দাতে দাত চেপে তাকিয়ে রইল। আমি কিছু না ভেবেই আহিলকে জরিয়ে ধরে কাদতে লাগলাম। এই মুহুর্তে কান্না করা ছাড়া নিজেকে হালকা করার আর কোন ভালো উপায় আমার জানা নেই।।আহিল আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,,,
— তুমি এখানে কেন এসেছ প্রানো,তোমার তো ভিতরে থাকার কথা ছিল?
আমি কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর আহিলকে বললাম আমাকে যেন বাসায় নিয়ে যায়।
তানভির সামনে দিয়ে আহিলের হাত ধরে হেটে যাচ্ছি আর তানভি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
আহিল গাড়ি ড্রাইভ করছে আর আমি ওর একহাত জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আছি।চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল আমার আর তানভির সেই পুরনো দিনের স্মৃতি।
তানভি পুরো নাম তানভির রহমান তীব্র কিন্তু আমি ওকে সবসময় তানভি বলেই ডাকতাম। তানভি আর আমার পরিচয় হয় ভার্সিটি ওঠার শুরুর দিকে। তানভি আমার চার বছরের সিনিয়র ছিল। প্রথমে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম আর সেখান থেকেই একটা অন্যরকম সুন্দর সম্পর্কের শুরু।। তানভি ছিল আমাদের ভার্সিটির সবচেয়ে শান্ত ছেলে। প্রথমে তো ওর সাথে আমার কোনভাবেই বুনতো না। সারাক্ষণ ঝগড়া লেগেই থাকত। অবশ্য সেটার জন্য বেশিরভাগ সময় আমিই দায়ী থাকতাম। ভার্সিটির এক স্যারের বিদায়ের ইভেন্ট থেকেই ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় কেননা সেখানে আমরা জুনিয়র আর সিনিয়র সবাই মিলে বিভিন্ন এরেঞ্জমেন্ট করেছিলাম। তখনই টুকটাক কথা বলতে বলতে ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যায়। যেটা পরবর্তীতে ভালবাসায় টার্ন নেয়।ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে তানভি আমাকে প্রপোজ করলে আমি আর না করতে পারিনি।
রাগ, অভিমান,খুন-শুটি,প্রেম-পাগলামি সবমিলিয়ে খুব ভালোই চলছিল আমাদের সম্পর্ক।
আমরা খুব হ্যাপি কাপল ছিলাম। ভার্সিটির সবাই জানত আমাদের সম্পর্কটা। বিপত্তি ঘটে তানভির স্কলারশিপ নিয়ে। হঠাৎ করেই তানভি আমার সাথে কথা বলা কমিয়ে দেয়।দেখা করে না,কিছু জিজ্ঞেস করলে ঠিকঠাক উত্তর দেয় না। আমি বুঝতে পারছিলাম না আসলে সমস্যা টা কোথায়। আমি খুব ডিপ্রেশড হয়ে যাই। সিদ্ধান্ত নেই এই বিষয়টা নিয়ে তানভির সাথে সরাসরি কথা বলবো। ক্যাফেতে বসে ছিলাম তখনই তানভির এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়, ওর কাছ থেকে আমি জানতে পারি তানভি স্কলারশিপ পেয়েছে। আর কিছুদিন পরে ও ইংল্যান্ড চলে যাবে অথচ এই বিষয়টা আমার কাছ থেকে সম্পুর্ন লুকিয়ে গেছে। প্রায় একঘন্টা পরে তানভি আসে। সেদিন তানভি শুধু একটা কথাই বলেছিল,সবকিছুর আগে ওর ক্যারিয়ার। আমিও আর কিছু বলিনি সোজা চলে এসেছিলাম। আর কখনো কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি। আজ এতো বছর পরে অতীত আমার পিছু ধাওয়া করতে করতে আবার ফিরে এসেছে।
গাড়ি এসে বাসার সামনে থেমেছে। আমি সোজা বাসার ভিতরে চলে এলাম।বাথরুমে গিয়ে একটা লম্বা শাওয়ার নিলাম। চোখের পানি আর শাওয়ারের পানি মিলে মিশে একাকার। যে কষ্টটা এতদিন বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম তানভিকে দেখে পুরনো দগ্ধ ঘা যেন আবার তাজা হয়ে গেছে।। চিৎকার করে কাদলাম কিছুক্ষণ। মনকে হালকা করার জন্য কাঁদার চাইতে আর ভালো কিছু নেই। প্রায় একঘন্টা পরে বের হলাম বাথরুম থেকে।। আহিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছিল।আমি গিয়ে কাধে হাত রাখতেই আমার দিকে ঘুরে তাকাল।আহিলের চোখ চিকচিক করছিল,চোখে পানি স্পষ্ট। হয়তো আহিল কাঁদছিল কিন্তু এমন পাষানের চোখ দিয়ে কি অশ্রু ঝরা যৌক্তিক? কেন জানি আমার মানতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
— আহিল আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন?
— কিছু না তুমি ঘুমাও গিয়ে।
— আপনি ঘুমাবেন না?
— আমার দেরি হবে, তুমি যাও।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে ঘুমাতে চলে গেলাম।এপাশ ওপাশ করছি বারবার কিন্তু ঘুম আসছে না। আর আহিলও সেই কখন থেকে বারান্দায় বসে আছে। জোর করে চোখ বন্ধ করে রেখেছি কিন্তু একটু পরে একাই চোখ মেলে যায়।
কিছুক্ষণ এমন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে শেষে উঠে বসলাম। সময় রাত দুইটার কাছাকাছি এখন।পা টিপে টিপে গিয়ে আহিলের পাশে দাড়ালাম। আহিল আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,,
— তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন জান?
— আমি এসেছি আপনি বুঝলেন কি করে? আমিতো কোন আওয়াজ করিনি?
আমার কথা শুনে মনে হলো আহিল স্মিত হাসল।হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরে পাশে বসাল। তারপর বলল,,
— আমি বুঝতে পারি জান,তুমি যখনই আমার আশেপাশে থাকো আমি বুঝতে পারি। তোমাকে দেখা লাগে না, তুমি আমার কাছাকাছি থাকলে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে আমার মধ্যে।আর এই ফিলিংসটা আমার তুমি ছাড়াও
— আমি ছাড়াও কি আহিল?
— কিছু না।
— তাই বুঝি,কিছু না ?
— হুম। ছাদে যাবে?
— এতো রাতে?
— হুম!
— কিন্তু কেন?
— আজ আকাশে অনেক বড় থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে। ওই চাঁদকে আরেকটা চাঁদের সাথে আলাপ করাবো!!
— ধ্যাৎ কি যে বলেন না!!
— কি যে বলি না,চলো দেখাচ্ছি!!
আহিল আমাকে কোলে তুলে সিড়ির দিকে হাটা শুরু করল।এই বাড়িতে আসার পরে আর একদিন শুধুমাত্র আমি ছাদে এসেছিলাম। আর আজকে আসলাম। ছাদের এককোনে একটা দোলনা আছে। আহিল আমাকে সেখানে নিয়ে বসাল। আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে চাঁদের দিকে ইশারা করে বলল,,
— ওই যে দেখ,ওই চাঁদের সাথে আমার কাছে থাকা চাঁদটার মিল পাও কি না?
আহিল কথা বলতে বলতে আমার কোলের ওপর শুয়ে পড়ল।আর আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে আহিলকে দেখে যাচ্ছি।
— আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে প্রানো?
আমি আহিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর আহিল চোখ বন্ধ করে চুপ করে আছে।খানিকটা সময় পার হয়ে গেল নীরবতায় শুধু নিশ্বাসের শব্দ ছিল। হঠাৎ করে আহিল বলতে শুরু করল,,
— এক দেশে এক রাজা আর রানী ছিল। রাজা নিজে পছন্দ করে রানীকে নিয়ে আসে।।রাজা রানীকে অনেক ভালবাসতেন। কিন্তু দিনে দিনে রানী রাজার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। কিছুদিন পরে তাদের রাজ্যে একটা রাজকুমারের আগমন হয়।রাজা ভাবে হয়তো এখন সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু নাহ,কিছুই আর আগের মতো হয় না। রাজার প্রতি রানীর অবহেলা দিন দিন বেড়েই চলে। এমনকি রাজকুমারও বড় হতে থাকে বাড়ির দাসীর হাতে।রানীর কাছে রাজকুমারকে দেয়ার মতো কোন সময়ই ছিল না।রাজকুমার দাসীকেই মা ডাকতে শুরু করে।রাজকুমারের যখন পনের বছর বয়স তখন রানী রাজার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে পাশের রাজ্যের এক রাজার সাথে নতুন করে ঘর বাধে।আর রাজা মানে রাজকুমারের বাবা এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।ছোট রাজকুমার ভাবতে থাকে আজ যদি তার মা এমন কিছু না করতেন তাহলে রাজকুমারের জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো। রাজকুমার একা একা বড় হতে থাকে আর ভাবতে থাকে তার বাবা যদি তার মা কে অবাধে চলতে বাধা দিত তাহলে হয়তো তার মা এতটা সাহস কখনোই পেত না।আর তার বাবার এমন পরিনতি কখনোই হতো না। রাজকুমার সিদ্ধান্ত নিল সে সবসময় নারীদের থেকে দূরে থাকবে।কোন দিনও নারীদের সংস্পর্শে যাবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই রাজকুমার এক সুন্দরী রাজকন্যার দেখা পায়। আর তাকে ভালবেসে ফেলে এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রাজকুমার তার বাবার মতো ভুল করবে না বলে ঠিক করে আর সেজন্য……..সেজন্য……
— সেজন্য? আহিল
আহিল ঘুমিয়ে যায় গল্প বলতে বলতে। আমি আহিলের ঘুমটা ভাঙাতে চাইলাম না।তাই ওকে আর জাগালাম না কিন্তু আহিল হঠাৎ করে এমন গল্প কেন বলল? এমন মনে হচ্ছিল যেন,কারও জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তাহলে কি এটা আহিলের নিজের সাথে ঘটে যাওয়া?এটার সত্যতা আমার জানতে হবে, কার কাছে জিজ্ঞেস করবো। যদি এটা আহিলের নিজের সাথে ঘটে থাকে, তাহলে আহিল নিজের মধ্যে কতটা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে? আমি ভাবতে পারছি না আর!!
#পর্ব_১০
#রীমা_শারমিন
সকালের পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর সুর্যের মিষ্টি আলো চোখে পরতেই ঘুম ভেঙে গেল আমার।আহিল এখনো আমার কোলেই শুয়ে আছে। আজ আহিলকে দেখে অন্যরকম লাগছে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেও কেন জানি ভালো লাগছে।নিষ্পাপ একটা বাচ্চার মতো করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।
— সকাল সকাল আমার মুখের দিকে এমন করে তাকিয়েই আছো কেন?
আহিলের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম কারণ, আহিল চোখ বন্ধ করেই কথাটা বলল।
— আমি আসলে,
— তুমি আসলে কি? আর এ কি আমরা এখনো ছাদে কেন?
— আসলে কাল আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাই আর আপনাকে জাগাই নি।
— ওওও,আমি ঘুমিয়ে গেছি আর তুমি সারারাত জেগে আমাকে পাহাড়া দিয়েছো, তাইতো?
— না আসলে ব্যাপার টা এমন না।
— ব্যাপার টা এমনই জান। তোমার চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তুমি ঘুমাওনি রাতে, চোখ লাল হয়ে আছে।
— ওইটা কিছু না।
— তুমি বললেই হবে, চল নিচে এক্ষুনি।
— হুম, চলুন!
নিচে নেমে আসতেই শুনতে পেলাম কলিং বেল বাজছে।। আমি যেতে নিতে আহিল আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখে ওনার ম্যানেজার সিনহা আংকেল দাঁড়িয়ে আছে ওনার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
— আরে আংকেল আপনি এতো সকালে,কি ব্যাপার?
— আসলে তোমাকে আমি রাত থেকে কল করে যাচ্ছি কিন্তু তুমি ফোন তুলছো না। আর সকালেও অনেক বার কল করেছি। ভাবলাম কোন সমস্যা হয়েছে কি না, তাই চলে এলাম।
— ওওও,আসলে কাল অনেক রাত অবধি ছাদে ছিলাম আর ফোনটা ঘরে ছিল। তাই দেখতে পাইনি।
— ওওও আচ্ছা,, তোমার সাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিল।
— আপনি বসুন,আমি ফ্রেশ হয়ে এক্ষুনি আসছি।
আহিল চলে যেতে আমি চা নিয়ে সিনহা আংকেলের কাছে গেলাম। উনিই একমাত্র ব্যক্তি যে আহিলকে ছোট থেকে চেনে আর ওর বিজনেস বা পারিবারিক সব কথাই জানে। আর আমার সব প্রশ্নের উত্তর আশা করি ওনার কাছে পাবো।
— আংকেল আপনার চা!
— আরে প্রানো মা যে,,কেমন আছো তুমি?
— আমি ভালো আছি আংকেল, আপনি?
— আমিও ভালো আছি মা।
— আংকেল আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে, যদি আপনার সময় হয় তো।
— বলো মা কি বলবে?
— এখন না আংকেল, বিষয়টা গোপন শুধু আপনি আর আমার মধ্যে থাকবে, আহিলকে জানানো যাবে না।
— আচ্ছা আমি সময় করে বিকেলে আসবো আজ তাহলে।
— কিন্তু আহিল?
— আহিল আজ বিকেলে বাসায় আসবে না মা। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো!
— কেন?
এরমধ্যে আহিল চলে এল ফ্রেশ হয়ে।
— কি কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে?
— তেমন কিছু না, প্রানো মাকে জিজ্ঞেস করছিলাম কেমন আছে? অনেকদিন কথা হয়নিতো।
— ওও আচ্ছা,,প্রানো তুমি এখন ভেতরে যাও নাস্তা বানাও আমি আংকেলের সাথে কথা বলি।
আমি চলে এলাম রান্নাঘরে।আহিল হয়তো আহিল আমার সামনে কোন ধরনের ব্যবসায়িক আলোচনা করেনা।
আহিলের পয়েন্ট অফ ভিউঃ
— হুম আংকেল এবার বলুন এমন কি হয়েছে যার জন্য আপনি এত চিন্তিত?
— রাশেদ চৌধুরীকে তুমি সেদিন অপমান করে বের করে দিয়েছিলে, যার কারণে উনি আমাদের সাথে সকল ডিল ক্যান্সেল করে দিয়েছে।
— so what? ওনাকে ছাড়া কি আমার বিজনেস চলবে না?
— আমি সেটা বলছি না!
— তাহলে?
— বিষয়টা হচ্ছে,, উনি আমাদের সকল শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে বেশি দাম দিয়ে প্রায় ৬০% শেয়ার কিনে নিয়েছে।
— what?এসব কি বলছেন আপনি? আর এত কিছু হয়ে গেল কিন্তু আমি কিছুই জানি না।
— আমিও প্রথমে জানতাম না কিন্তু যখনই জেনেছি তোমাকে জানানোর জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি তো কল রিসিভই করোনি।
— ওকে আমি দেখছি কি করা যায়। মিস্টার রাশেদ চৌধুরী,, তোকে আমি দেখে নেব।। আপনি চলুন এখন আমাদের সাথে নাস্তা করে যাবেন।
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে এমন সময় নয়না হাত দিয়ে ইশারা করে লিফট থামাতে, আহিল ভেতরে থাকায় ও হাত দিয়ে লিফট থামায়।নয়না তাড়াহুড়ো করে প্রায় হুমড়ি খেয়ে লিফটে প্রবেশ করে আর একদম আহিলের গায়ে পড়ে যায়।লিফটে কেউ না থাকায় সেই সুযোগ টা কাজে লাগায় নয়না।
— মিস নয়না are you okay??
— yeah,,thank you so much sir and good morning!!
— good morning..how are you?
— fine, you?
— I’m well,,,সো মিস নয়না আপনি একটু পরে আমার কেবিনে দেখা করবেন ওকে?
— সিওর স্যার।
লাঞ্চ টাইমে সবাই লাঞ্চে চলে যায় নয়না আহিলের কেবিনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন উকি দিয়ে দেখে আহিল চোখ বন্ধ করে বসে কিছু একটা ভাবছে। নয়না নক করল,,
— স্যার আসবো?
— আরে নয়না এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।
আহিলের মুখে তুমি ডাক শুনে নয়নার মনে লাড্ডু ফুটতে থাকে।
— আমার কথা ভাবছিলেন স্যার, সত্যি?
— হ্যাঁ, কেন ভাবতে পারিনা?
— হ্যাঁ হ্যা, কেন নয়? আপনি লাঞ্চে যাবেন না স্যার?
— যাব না ভাবছি।
— কেন স্যার?
— ক্যানটিনে খেতে আর ভালো লাগছে না।
— স্যার আমি শুনেছি আপনার বিরিয়ানি অনেক ফেভারিট, আমি নিজের হাতে রান্না করে এনেছি খাবেন আপনি?
— রিয়েলি, আই লাভ বিরিয়ানি। সকালে কেন বললে না?
— স্যার সাহস পাইনি।
— আরে তাড়াতাড়ি দাও,বিরিয়ানির কথা শুনে ক্ষুধা লেগে গেছে।
— হুম দিচ্ছি স্যার।
আহিলের আচরণে নয়না অলরেডি আকাশে ওড়া শুরু করেছে।ও মনে মনে ভাবছে, ওর করা প্ল্যান এতদিনে কাজে দিয়েছে। এখন শেলিকে গিয়ে দেখাবে, আহিলকে ও নিজের করে নিয়েছে।
.
.
.
.
.
.
বিকেলবেলা ঘুমিয়ে ছিলাম তখনই সিনহা আংকেল আসেন।আংকেলকে বসিয়ে ওনার জন্য নাস্তা রেডি করে নিয়ে এলাম। তারপর চলে গেলাম ছাদে।
— হ্যাঁ মা এবার বলো কি কথা বলার জন্য এতো উদ্বিগ্ন তুমি?
— আংকেল আমি আহিলের সম্পর্কে কিছু জানতে চাই আপনার কাছ থেকে কেননা আপনি ছাড়া ওর পরিচিত কাউকে আমি চিনিনা।
— আচ্ছা বলো কি জানতে চাও?
— আহিলের মা বাবা-মা কিভাবে মারা গেছেন?
আংকেল আমার কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইলেন।আমি আবার জিজ্ঞেস করাতে বলা শুরু করল,,
— প্রানো মা,তুমি আহিলের স্ত্রী তোমার সবকিছু জানার অধিকার আছে। আর আহিল আমার ছেলেরই মতো, ছোট থেকে আমিই ওর সব দায়িত্ব পালন করে আসছি কারন ওর বাবা আর আমি খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। আসলে আহিলের বাবা মারা গেছে ঠিকই কিন্তু ওর মা এখন কি অবস্থায় আছে সেটা আমি বলতে পারবো না।
— কেন পারবেন না?
এরপর আংকেল আমাকে একে একে সব কথা খুলে বলেন।। আমি আংকেলের প্রত্যেকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আর আহিলের বলা কালকের গল্পের সাথে মিলাচ্ছিলাম।আহিল নিজের মনে এতো কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে আর আজকের এই আহিলের পেছনে ওর মা দায়ী।আহিল হয়তো এমন হিংস্র হতো না যদি এমন কিছু না ঘটতো।
— আহিল খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল আর সবার সাথে খুব মিশুক প্রকৃতির ছিল। কিন্তু ওর মা চলে যাওয়ার পরে ওর বাবা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে আর একসময় সুইসাইড করে। আর তখন থেকে মেয়েদের প্রতি ওর একটা ঘৃনা কাজ করত।ওর ভেতর একটা হিংস্রতা রয়েছে আমি জানি। সেই ছেলে বিয়ে করবে আমি জানতাম না। ওকে আমি ডাক্তারও দেখিয়েছিলাম।
— ডাক্তার কি বলেছিল?
— ডাক্তার বলেছিল,যদি এমন কেউ ওর জীবনে আসে যে কি না শুধুমাত্র ওকেই ভালবাসবে আর এটা বোঝাতে সক্ষম হবে যে,সবাই একরকম হয় না। ওকে ছেড়ে কখনো যাবে না। তাহলে হয়তো আস্তে আস্তে ইম্প্রুভ হবে ওর অবস্থার।আসলে ওর মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে যে ও যাকে ভালবাসবে,যদি সে ওকে ছেড়ে চলে যায় ওর বাবার মতো যদি ও নিজেও ধোঁকা খায়? এই ভয়টা তাড়াতে হবে ওর মন থেকে।
— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আংকেল। কিন্তু আহিল এখন কোথায় আছে?
— আহিল হয়তো কোন এতিমখানায় আছে এখন। আজ ওর বাবার মৃত্যবার্ষিকী।ও সবসময় এই দিনটা ওই এতিম বাচ্চাদের সাথেই কাটায়।আচ্ছা, মা আমি এখন যাই।
আমরা বাহির থেকে একটা মানুষ দেখে কখনোই তাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কষ্টটা বুঝতে পারি না। প্রত্যেকেরই বদলে যাওয়ার পেছনে কোন না কোন কারণ অবশ্যই থাকে। আহিলের বাবাকে ওর মায়ের দেয়া ধোকায় আজ আহিলের জীবনের এমন অবস্থা, ওর হিংস্রতার পেছনের কারণও এটাই।হয়তো আহিল ভয় পায় তার প্রিয় মানুষকে হারানোর। তবে আজ থেকে আমি চেষ্টা করবো আহিলের মন থেকে এই ভয়টা দূর করতে। সেখানে যেন একটা সাধারণ মানুষের মতো ভালবাসা থাকে কোন #হিংস্রতায়_ভালবাসা না
আজ অনেকদিন পরে আহিলের মনের মতো করে সাজলাম। ওর পছন্দের কালো শাড়ি,কালো কাচের চুড়ি। হালকা মেকাপ আর গাঢ় লিপস্টিক আর চোখে কাজল। সেজেগুজে আহিলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আহিলকে আজ চমকে দেব, কিন্তু এই আহিল টা এখনো কেন আসছে না? ঘড়িতে প্রায় ১২ টা বাজতে চলল।
চলবে……..
ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ।