হৃদমাঝারে তুমি পর্ব -১২+১৩

#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_১২

নীলুকে আর মাহিনকে এক রুমে দেখে আশেপাশের লোকজন অনেক কিছু বলছে।অনেকে অনেক খারাপ মন্তব্য করতে আছে।অনেকেই বলতে লাগল যে ‘দেখো না কি যেন করতে গিয়েছে তারপর ধরা পড়বার ভয়ে নাটক করতে শুরু করেছে’

আরফান কথাগুলো শুনে নিজের হাতটা শক্ত করে মুঠ করে রাখল।রাগটা কন্ট্রোল করতে লাগল।তবে এসবকে পাত্তা দিল না।

নীলু ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে যেটা দেখে আরফান দৌড়ে গেল।মাহিন ওর হাত ধরে ওর পাশে বসে আছে।নীলুর হাতের কাচের চুরিগুলো ভেঙে হাতে ঢুকে গিয়েছে আর সেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।যেটা মাহিনের ড্রেসেও লেগে গেছে।আরফান নীলুকে কোলে উঠালো,উঠিয়ে নিয়ে বাইরে আনলো।একটু আগেই ডক্টর জাভেদ হাসানকে ইনফর্ম করে রেখেছে।ও একেবারে নীলুকে নিয়ে গাড়িতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু উপস্থিত লোকদের ফলে পারল না।

-এতক্ষণ রং তামাশা করে এখন এখান থেকে চলে যেতে দিব না।একটা রুমের মধ্যে একটা ছেলে আর মেয়ে এতক্ষণ ছিল সেটা আর যাই হোক কোনো ভালো দিক হতে পারে না।

-হ্যাঁ হ্যাঁ কবির সাহেব আপনাদের বাড়ির ছেলের তো এমন হওয়ার কথা না।তারপরও যেহেতু করে ফেলেছে তাই এখন বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া যায় না।এর একটা বিহিত করতেই হবে

-দেখুন আপনারা বিষয়টা যা ভাবছেন তা না।মাহিনকে তো আপনারা চেনেনই ও কীভাবে এরকম করতে পারে।আর এই মেয়েটাকেও দেখুন।

কবির সাহেবের কথার মাঝেই একজন বুড়ো লোক বলে উঠল-মাহিনকে তো ভালোই দেখেছি কিন্তু বলাতো যায় না। একই রক্তের কিনা ,তাই কথাগুলো বলছি

কবির সাহেব তার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। এই কথাগুলোর উত্তর তিনি দিতে পারলেন না।মাহিন এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার বলে উঠল

-আপনারা আসলে ব্যাপারটা খারাপ ভাবে দেখছেন। আসলে ব্যাপারটা এরকম না

-তা বাবা আমরা যদি ব্যপারটা খারাপভাবে বলে থাকি তাহলে তুমি ব্যাপারটা ভালোভাবে বিশ্লেষন কর আর সত্যি ব্যাপারটা বলে দাও

মাহিন তার কথার উত্তর দিতে পারল না।চুপ করে মাথা নিচু করে আছে।তা দেখে তিনি বললেন

-দেখলেন আপনারা,দেখলেন তো কিছুই বলতে পারছে না।তারমানে আমাদের আন্দাজই ঠিক হলো।তাহলে কি বলেন আপনারা সবাই?

-হ্যাঁ এদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক।

কথাগুলো শুনে আরফানের চোখ লাল হয়ে আসছে।তবে আরফান নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে জানে।নীলুকে সোফায় বসিয়ে মাথাটা ওর কোলে নিয়ে বসে আছে। ওর অবস্থা দেখে পিয়াস নিজেই ভয় পেয়ে গেছে।নেহাল লোকটার কথা শুনে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল

-শুনুন ভদ্রভাবে কথা বলুন।সব কিছু না জেনে শুনে এভাবে ব্লেম করা উচিত না।

আরফান নেহালকে থামতে বলল।আর ওকে ডেকে বলল সবাইকে নিয়ে বাড়ি যা।যেটা শুনে নেহাল বলে উঠল

-না ভাই পিয়াস যাক। আমি থাকি তোমার সাথে
-না আজ তোর একটা বিশেষ দিন। আজকের দিনটা এভাবে নষ্ট হতে দিস না।পিহু কষ্ট পাবে
-ভাই পিহুর থেকে নীলু আগে
-তোকে যেতে বলেছি,যা(কড়া গলায় বলল )

নেহাল আরফানের রাগন্বিত রূপ দেখে চলে গেল।পিয়াস ও পিছু পিছু যেতে চেয়েছিল কিন্তু তা দেখে আরফান বলল

-তুই কোথায় যাস?
-ন্ ন্ না কোথাও না,ওদের এগিয়ে দিয়ে আসি।

নেহাল যাওয়ার আগেই ডক্টর জাভেদ এসে গেছেন।তিনি এসে আগে নীলুকে একটা ইন্জেকশান দিলেন।তারপরও হাতটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। একটু সময় পরে নীলুর হুশ ফির কিন্তু একদম জ্ঞান পায়নি।জাভেদ বললেন

-আরফান ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া বেটার হবে।কারণ এইসব কথাবার্তা শুনলে ওর মাথায় চাপ পড়তে পারে।নীলুর কাছে পিয়াসকে বসিয়ে ও উঠে দাড়ালো।মাথার পাগড়ী অনেক আগেই খুলে রেখেছিল।পাঞ্জাবীর পকেটে হাত রেখে মুচকি হেসে বলতে লাগল

-আপনারা কি যেন বলেছিলেন?যে এতক্ষণ আমার বোন রং তামাশা করেছে?আবার আবদার করছেন ওকে এখন মাহিনের সাথে বিয়ে দিতে হবে?

-আচ্ছা আপনারা কে এমন যে আপনাদের কথায় আমার বোনের বিয়ে দেওয়া হবে?

-আমরা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি।আর তোমাদের চেয়ে বয়সে বড়।তাই আমরা তোমাদের চেয়ে ভালো বুঝি

আরফান লোকটার কথা শুনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল।তার অবস্থানের পরিবর্তন করতে লাগল। এক জায়গা থেকে ছোট ছোট কদম ফেলে অন্য জায়গায় যেতে লাগল। আবার একই ব্যবস্থায় পূর্বের জায়গায় ফিরে আসল।তারপর বলল

-আসলে একটা কথা ঠিকই বলেছেন যে আপনারা আমাদের থেকে বড়।হুম কথাটা মেনে নেওয়া যায় ।কিন্তু কি বলুনতো আপনার শেষের কথাটা ঠিক না। আপনারা আমাদের থেকে ভালো বুঝেন না।কারণ যদি ভালো বুঝে থাকতেন তাহলে এটা বুঝতেন যে দরজা ভেতর থেকে না ,বাইরে থেকে আটকানো ছিল।

-এই ছেলে তোমার সাহস তো কম না।তুমি আমাকে অপমান করছো?আমিও দেখবো তুমি কেমন করে তোমার বোনের বিয়ে দাও।

-আপনাকে অপমান করছি না শুধু বুঝাচ্ছিলাম। আর রইল বিয়ের কথা।হাহ্,যেখানে কোনো ঘটনার ভীত্ত্বিই নেই সেখানে আপনাদের কথায় আমি আমার বোনকে বিয়ে দেবো?এটা সপ্নেও ভাববেন না।আর আমার বোনকে যদি বিয়ে দিতে নাও পারি না ,,,,,,,,,,,,,,,,তবেও আমার আফসোস নেই।কারণ আমি এখনো মারা যাই নি।

-ভাই নীলুর জ্ঞান ফিরেছে।এখন তাহলে চলো

পিয়াসের কথা শুনে আরফান নীলুর দিকে তাকালো।তারপর বলল- আমার বোনের এইরকম অবস্থা যে করেছে না তাকে যদি আমি খুঁজে পাই তাহলে তার অবস্থা কী হবে সেটা কেউ কল্পনা ও করতে পারবে না।

কথাগুলো বলে নীলুকে ধরে উঠালো।নীলু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো।তারপর হেঁটে যেতে লাগল বাইরের দিকে।তুলি আরফানের ধমকি শুনে কেঁপে উঠেছে।তুলির খালাও ওর ধমকে ভয় পেয়েছে।আরফান যেতে যেতেই আবার ফিরে এলো।ফিরে এসে মাহিনকে বলল

-মাহিন একটা কাজ তুমি ঠিক করো নি।তুমি জানা শর্তেও সব কিছু লুকিয়ে গেলে।তবে এটা ভেবো না আমি আসল কালপ্রিটকে ধরতে পারব না।আরফান আদিত্য তার বোনের জন্য সব করতে পারে।কারণ তার বোন তার কাছে প্রাণ ভোমরা।

আরফান চলে যাওয়ার সাথে সাথেই লোকজন চলে গেল। এখন ঘরে শুধু নিকট আত্মীয়রা আছে।মাহিনের ফুফু ওকে জিজ্ঞেস করল

-মাহিন এখন বলতো তুই ঐখানে গেলি কীভাবে?

মাহিন কিছু বললো না।তুলির নিকটে এগিয়ে গেল।তুলি চোরা চোরা চোখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে।মাহিন শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল

-কেন করলি এটা?(তুলি কিছু বলছে না দেখে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল)কেন করলি বল?

তুলির মা মাহিনকে বলল-কি করছিস কি? এভাবে কেউ বোনের সাথে কথা বলে?এমনিতেই অসুস্থ

-মা ওকে জিজ্ঞেস কর কেন এমনটা করেছে?

-আমি কি করেছি?আমিও তো সবার সাথে এখানেছিলাম।
তুলি কথাগুলো বলতেই ঠাস করে ওর গালে চড় পড়ে।মাহিনের এক চড়ে তুলির ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে যায় ।চড়ের শব্দটা এতই ভয়াবহ ছিল যে প্রতিটা মানুষ কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।তারপর মাহিন তুলিকে বলল

-তুই যদি আমার বোন না হতি তাহলে এই চড়টা আমি সবার সামনে বসে মারতাম।তোর ভাগ্য ভালো তুই আমার বোন।তা না হলে আজকে তোর খবর ছিল।

বলে মাহিন চলে গেল।তুলি রাগে ফুলছে,ঘরের আত্মীয়রা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর সমস্ত প্লান মাহিন জেনে গেছে।সব হয়েছে ঐ নীলু মেয়েটার জন্য। আজকে চেয়েছিল পিয়াস আর নীলুকে এক রুমে আটকে রেখে ওদের সম্পর্কে একটা নোংরা বিষয় ছড়াতে কিন্তু পিয়াসের বদলে যে মাহিন চলে যাবে তা ভাবেনি কখনো।সবার দিকে একবার কড়া নজর দিয়ে রুমে চলে গেল।

নীলুকে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আরফান বিদিশাকে মিহুর কাছে বসিয়ে চলে গিয়েছে।পিহু ছিল অন্য গাড়িতে।ওরা ভেতরের বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানলো না।মিহুর যখন জ্ঞান ফিরে তখন ওদের গাড়ি চলতে শুরু করেছে।পাশে তাকিয়ে দেখে বিদিশা ওর কাধে মাথা রেখে আছে।মিহুর নড়াচড়া দেখে উঠে গেল তারপর বলল

-আসলে আপু তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে যখন,তখন তোমার নেকাব আর হিজাব খুলে দিয়েছি।আমি তোমাকেই এই প্রথম দেখলাম বিয়েতে নেকাব আর হিজাব পড়তে।

মিহু কিছু বলল না।মিহুকে মনমরা থাকতে দেখে বলল
-কি আপু মিস করছ কাউকে?হুম?কুছ কুছ হোতা হে কেয়া?

-যা কিসব বলছিস।সেরকম কিছুই না।এসব কথা থামা অন্য মানুষ গুলো শুনলে কি মনে করবে?

-কি আর মনে করবে,,,,বুঝবে জামাইকে খুঁজছে।আর তাছাড়া ও দেখো এই গাড়িতে সব ছোটরা আর প্রায় মানুষই ঘুমের মধ্যে।

-কিন্তু নীলুকে দেখছিনা যে আর উনিও বা কোথায়?
-কি রে আপু একটু আগেই না বললি এরকম কিছুই না। আর এখনি উনি উনি শুরু করলি?
-আরে এরকম করিস না।
-জানিনা সঠিক।নেহাল ভাইয়া এসে বললেন যে নীলু নাকি অসুস্থ তাই আরফান ভাইয়ের আসতে দেরী হবে।আমাদের নাকি যেতে বলেছেন।আচ্ছা আমি এখন একটু ঘুমাই ডিস্টার্ব করিস না।

বিদিশার কথা শুনে মিহুর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। এমন একটা বিশেষ দিনে ওর পাশে বিশেষ ব্যক্তিটি নেই।মন খারাপেরা ওর কোলে এসে জুড়ে বসেছে।ওর মনে হয় সারা জীবনটাই ওর সাথে এমন ঘটবে।চোখে একটু একটু পানি এসে গেল।তারপর আবার নিজেই নিজেকে বললো

তুই কেমন মিহু?তার বোন অসুস্থ, তার তো সেখানেই যাওয়া উচিত?তুই এখন কীভাবে তাকে তোর পাশে এক্সপেক্ট করো?তুই আসলেই একটা স্বার্থপর।

আরফান নীলুকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে।এখানে এসে একজন ভালো ডক্টরের সাথে কথা বলেছে।তিনি নীলুর কয়েকটা টেস্ট করিয়েছেন।ভালোভাবে ওকে চেক আপ করেছেন।তারপর আরফান কে বললেন

-আচ্ছা মিস্টার আরফান, যা দেখলাম তাতে তো বোঝা যাচ্ছে ক্ষত টা অনেক আগের।তার সম্পর্কে একটু বলুন তো কীভাবে কি হলো

-আসলে ডক্টর আমার বোন মায়ের পেটে থাকতে একদিন মা মাটিতে পড়ে যায়।তার পেটে আঘাত লাগে।ফলে সময় হওয়ার আগেই আমার বোনকে জন্ম দিতে হয়।তখন ডক্টররা বলে দিয়েছিলেন যে ওর নাকি মাথায় কোথায় আঘাত লেগেছে।ঐ আঘাতটা নাকি একটা সময় বড় আকার ধারণ করতে পারে।কয়েকদিন আগেও জাভেদ আংকেল বলেছিলেন ও নাকি প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারত।

-হ্যাঁ তিনি ঠিকই বলেছেন।তবে একটা কথা কী জানেন, আপনার বোন যে শুধুই প্যারালাইজড হয়ে যাবে তা না।তার সাথে যা কিছু ঘটতে পারে।এই যেমন ধরেন তার কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিংবা ভারসাম্য ও হারাতে পারে।তাই বলছি একটু খেয়াল রাখুন যাতে করে তার ওপর চাপ না পড়ে।

আরফান নীলুর বেডের পাশে গিয়ে বসল।তারপর ওর দিকে তাকালো।মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

-তোকে কিচ্ছু হতে দেবো না।ভাইয়া তোকে কিচ্ছু হতে দেবেনা।শুধু তুই মন থেকে শক্ত থাক। আর তোর আজকের অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না,কিছুতেই না।
#হৃদমাঝারে_তুমি
#সাইয়ারা_মম
#পর্ব_১৩

নেহালদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গিয়েছে।রেবেকাসহ অন্যরা ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।পিহু গাড়ির মধ্যে নেহালের হাত জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।নেহান আস্তে আস্তে ডাক দিল

-পিহু,এই পিহু ঘুম থেকে উঠো।আমরা এসে গিয়েছি তো।ওঠো ঘুম থেকে

পিহু পিট পিট করে চোখ খুলে তাকায়।তারপর বলে
-এসে গিয়েছি?
-হুম।
-চলো তাহলে

নেহাল প্রথমে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।তারপর পাঞ্জাবী টা ঠিক করে নিজের এক হাত বাড়িয়ে দেয় পিহুর নিকটে।পিহু লাজুক হেসে নেহালের হাতটা ধরে উঠলো।তারপর এগিয়ে গেল বাড়ির সম্মুখে।তাদের এইরকম কাপল দেখে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে।

কিন্তু পেছনের গাড়ি থেকে সদ্য নামা মিহুর এই দৃশ্য দেখে মুখ ভার হয়ে গেল।না,ওদের দেখে খারাপ লাগছে তা নয়।যে মুহূর্তে একটা ভরসার হাত প্রয়োজন সেই মুহূর্তে তার কাছে এখন কেউ নেই।বিদিশা মিহুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল

-এই আপু ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?ভেতরে চল
-হুম,চল।

পিহু আর নেহাল ঘরে ঢুকতেই রেবেকা দৌড়ে আসে।এসেই পিহুকে সোফায় বসিয়ে শরবত খেতে দেয়।তারপর জিজ্ঞেস করে

-আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো পিহু?
-না,,মা।

ঠিক সেই সময়ে দরজার পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে মিহু।বিয়ের পোশাকে মাথায় হিজাব আর নেকাব দেওয়া।গাড়ি বাসার সামনে থামতেই মিহু হিজাব আর নেকাব ঠিক করেছে।মিহুকে একা দেখে সবাই একটু থমকে যায়।তারপর আশেপাশের লোকজন বলাবলি করতে থাকে

-আরফানের মনে হয় বিয়েতে মত ছিল না।
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।না হলে কি নিজের বিয়ের সময় এভাবে বৌকে ফেলে রেখে যেতে পারে।

মিহু কথাগুলো শুনে মাথা নিচু করে ফেলল।চোখে না চাইতেও পানিগুলো চলে এসেছে।রেবেকা নীলুর বিষয়ে কিছুই জানেন না।তাই তিনি নেহালের দিকে তাকালেন।নেহাল তৎক্ষনাত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মিহুর পাশে গিয়ে বলল

-আসলে আপনারা কিছুই জানেন না।আসার পথে নীলু অসুস্থ হয়ে পড়ে তাই আরফান ভাই ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।

-তারপরও বিষয় টা কেমন না।

রেবেকা তখন পিয়াসের মাকে বললেন-ভাবি ওদের দুজনকেই রুমে দিয়ে আসো।ওরা অনেক ক্লান্ত।

পিয়াসের মা রেবেকার কথা শুনে ওদের দোতলায় নিয়ে গেল।প্রথমে মিহুকে আরফানের রুমে বসিয়ে তারপর পিহুকে নেহালের রুমে দিয়ে আসল।নেহালের কাজিন সিস্টারেরা পিহু আর মিহুকে সাহায্য করল ফ্রেশ হতে।তারপর ওদের খাবারটা যে যার রুমে দিয়ে গেল।

এইদিকে নেহালকে রেবেকার কাছে পুরো ঘটনা ডিটেইলসে বলতে হয়েছে।নীলুর ঘটনা শুনে রেবেকা নেহালকে বলল

-খবর নিয়েছিলি বাড়িতে আসার পরে?
-হ্যাঁ পিয়াস কে ফোন দিয়ে ছিলাম। ও বলেছে নীলুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে।ওর সুস্থ হতে একটু টাইম লাগবে।মানে কয়েকদিন লাগতে পারে।

-ওহ্।আচ্ছা আমি কি একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করব নীলু কেমন আছে?

-তার আর কোনো দরকার নেই।আমরা নিজেদের মধ্যে এতো ফরমালিটি না দেখালেও চলবে।আমি তো খবর নিয়েছি ই।

-তারপরও আমি একবার কথা না বললে মনটাকে বোঝাতে পারছি না।

-আচ্ছা তোমার যদি মন চায় তাহলে ফোন করো।

বলে নেহাল চলে গেল।রেবেকা ফোনটা হাতে নিল।আরফানের নম্বর টা উঠিয়ে ফোন দিল ঠিক তখনই পিয়াসের মা ডাক দিল রেবেকাকে।ফোনটা রিং হওয়ার আগেই কেটে দিল।তারপর চলে গেল পিয়াসের মায়ের কাছে।

পিহুর এখন দমবন্ধ লাগছে।এত ভারী শাড়ী পড়ে থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে ।প্রথমে সে চুলগুলো খুলে ফেলল। এতক্ষণ চুলগুলো খোপা করে থাকার ফলে মাথাটা ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। এখন ভালো লাগছে।

-আহা কি শান্তি ই না লাগছে।পার্লারের মানুষ গুলোও না,,,,,এত পেঁচিয়ে কি চুল বাঁধে।যদি বাঁধতেই হয় তাহলে এমন ভাবে বাঁধবে যাতে খুলতে আর কষ্ট না হয়।

এভাবে বলতে বলতে নিজেই নিজের মেকআপ উঠাতে লাগল।চোখের লেন্স খুলতে গিয়ে এত ভোগ পোহাতে হল যে এটা চোখ না হয়ে যদি অন্য কিছু হতো তাহলে সেটা খুচিয়ে বারোটা বাজিয়ে দিত।চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল।মেকআপগুলো আর এত কষ্ট করে উঠাতে ইচ্ছা করছে না।তাই একেবারে ফেসওয়াস দিয়ে ফেসটা ধুয়ে আসছে।এসে শাড়িটা পাল্টাবে এমন সময় নেহাল পেছন থেকে পিহুকে জড়িয়ে ধরল।

-আরেহ তুমি আসলে কখন আর কীভাবে আসলে?তোমার বোনেরা আটকায় নি?

-আসলে ওরা নীলুকে ছাড়া কিছু করতে চাইছে না।তাই আজকে রেহাই পেলাম।তবে তুমি এত আনরোমান্টিক কেন? আমি আসার আগেই সাজ নষ্ট করে ফেললে।দেখি আমার দিকে ঘোরে।

বলার সাথে সাথেই একচিৎকার দিয়ে পেছনে লাফ দিল।নেহালের চিৎকারে পিহু ভয় পেয়ে গেছে।ও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল

-ক্ ক্ কি হয়েছে?তুমি এত ভয় পেলে কেন?

নেহাল বুকে হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে।তারপর পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল

-আচ্ছা তুমি কি কোনদিন মেকআপ করোনি?

-না কেন বলোতো?

-তাহলে তোমাকে সাজিয়ে দিত কে?

-তুলি আপু।কিন্তু কেন বলতো?

-কিছু না।চলো তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিই।তবে আগে চোখ বন্ধ করো।

-ওয়াও আমি খুব এক্সাইটেড। আচ্ছা এই নাও চোখ বন্ধ করলাম।বলে পিহু চোখ বন্ধ করল।

নেহাল পিহুকে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো।তারপর কানে কানে বলল
-রেডি তো?
-হ্যাঁ রেডি।চোখ খুলবো?
-হুম,,,,,,,চোখ খুলো।

পিহু খুব এক্সাইটেড হয়ে চোখ খুলল।কিন্তু চোখ খুলে দিল এক চিৎকার।নেহালকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল

-আমার সামনে থেকে ডায়নীটাকে সরাও।তাড়াতাড়ি সরাও।আমার খুব ভয় লাগছে।প্লিজ

নেহাল মুচকি হাসলো।তারপর ফিসফিসিয়ে বলল
-এই যে মিসেস নেহাল, ওটা কোনো ডায়নী নয়। ওটা আপনার নিজেরই চেহারা

পিহু কান্না থামিয়ে মাথা উঠালো।তারপর জিজ্ঞেস করল-তুমি কী বললে?

-বলেছি ওটা তোমার চেহারা

কথাটা শুনে পিহু ভালো করে আয়নার দিকে তাকালো।তারপর দেখলো মেকআপ গুলো আগে না উঠিয়ে একবারে ধুতে গিয়ে এই অবস্থা।চোখের কাজল আর স্যাডো গুলো মিলে চোখদুটোকে একদম ভুত বানিয়ে দিয়েছে।নিজের দোষ স্বীকার না করে বলল

-তুমি বাজে প্রোডাক্ট কিনে পাঠিয়েছো তাই এমন হয়েছে।এখানে আমার কোনো দোষ নাই।

নেহার বিরবিরিয়ে বলল-হ্যাঁ,,,, ঐ তো নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।

-তুমি কি বললে?হ্যাঁ?
-না কিছু বলি নাই তো।কিছু না

-আচ্ছা আমাকে দেখে তোমার কী একবারো ডায়েনী মনে হয়েছে?

-হ্যাঁ তোমাকে দেখে তো একদম ডায়েনীই লাগ্ গ্ গ্ গে

বলতেই পিহুর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল পিহু বোম দিয়ে আছে।পিহু মুখটা ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল।নেহাল মুচকি হাসল,তারপর পিহুর মুখটা ওরদিকে ঘুরিয়ে বলল

-তোমাকে যেমনটা ই লাগুক না কেন তুমি আমারই থাকবে।ডায়েনী হও বা পরী তুমি একমাত্র নেহালের।

-বিশ্বাস করি না

-আচ্ছা তাহলে প্রুভ দেখাই
বলে পিহুকে কোলে তুলে নিল।পিহু নেহালের গলা জড়িয়ে ধরল।লজ্জায় তার গাল দুটো গরম হয়ে গেল।পরিপূর্ণ পেল নেহাল আর পিহুর ভালোবাসা।

মিহুকে যে খাবারটা দিয়ে গিয়েছে সেটা না খেয়ে রেখে দিল।যতই হোক স্বামী যদি না খেয়ে থাকে সেখানে সে কিভাবে খাবার খায়? অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন আরফান এলো না তখন মিহু তার বিয়ের সাজটা উঠিয়ে ফেলল। আসার পরেই বিদিশা অর্ধেক সাজ উঠিয়ে দিয়ে গিয়েছে বাকি গুলো নিজে উঠালো।তারপর ওযু করে নামাজ পড়তে লাগল।শেষে মুনাজাতে বলল

-হে আল্লাহ্ ।হে আমার ভাগ্য নির্ধাতা।আমি জানি আপনি যা করেন সেটা ভালোর জন্যই করেন।তবে আমি আপনার কাছে একটা জিনিস ই চাই আমি যেন একটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি।আর আজকে আমি একজন মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছি।আমার কারণে যেন তার কোন বদনাম না হয়।পরিশেষে নীলুর সুস্থ তা কামনা করছি।আমিন।

আজকে যেন মিহুর অপেক্ষার প্রহর কাটছে না।আরফানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সোফাতেই ঘুমিয়ে গেল। আর এইদিকে পিয়াস কে নীলুর কাছে রেখে আরফান বাইরে গেল নীলুর জন্য মেডিসিন আনতে।দোকান থেকে যখন মেডিসিন কিনে আসার জন্য রওনা দিল তখন ফুটপাতে বসা এক গাছ বিক্রেতা বলল

-স্যার একটা বেলী ফুলের চারা আছে।নিবেন?

এখন রাত বারোটার বেশী বাজে।এইসময়ে এই লোক গাছ বিক্রি করছে দেখে আরফানের একটু খটকা লাগল।তাই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল

-এত রাতে গাছ বিক্রি করছেন কেন? এখন কেউ কিনবে এগুলো?

-স্যার একপিছ রইয়া গেছে।হেই লাইগা রাইত হইলেও বেইচা যাইতে চাইছিলাম।

-আচ্ছা তাহলে ওটাকে তো সকালে বিক্রি করলেও পারতেন। এখন বাসায় গেলেই তো পারতেন।

-স্যার কি আর কমু।আইজকা আমার বিবাহ বার্ষিকী।হেইতে বিবি কইছিল একটা কেক আনতে।কিন্তু দেহেন এই এক পিছ বেচতে না পারলে কেক কিনতে পারমু না।হেই লাইগা বেচলাম

গাছ বিক্রেতার নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে গেল।সে বলল

-আচ্ছা তাহলে গাছটা প্যাক করে দিন

গাছটা নেওয়ার পরে আরফান তাকে একটা এক হাজার টাকার নোট দিল

-স্যার ভাংতি নাই তো
-রেখে দিন,কালকে আপনার বিবিকে নিয়ে যা খুশি তাই করবেন।ঠিক আছে?
-কিন্তু
-কোনো কিন্তু নয়। আজকে আপনাদের যেমন বিবাহবার্ষিকী তেমনি আমার আজকে বিয়ে হয়েছে।মনে করবেন আমার বিয়ে উপলক্ষে আপনাদের সামান্য কিছু দিলাম

লোকটা খুশি হয়ে বলল-স্যার আপনার জন্য দোয়া রইল। এই গাছে খু সুন্দর বেলী ফুল ফোটে আর খুব ঘ্রাণ। আপনার আজকে যার লগে বিয়া হইছে সে যেন আপনার জীবনের বেলী ফুল হয়।

আরফান বেলী চারাটা নিয়ে চলে আসল। আর মনে মনে বলতে লাগল

-তার জীবনে আসলেই কী বেলী ফুল আসবে?মিহুর সাথে কী তার এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হবে?আচ্ছা এটা কি সম্ভব হবে কখনো?মিহু কি তার জীবনে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে?কি হবে তাদের ভবিষ্যত? কোন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে তাদের জীবন?

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here