হৃদমাঝারে পর্ব -১১

#হৃদমাঝারে – [১১]

৯,
এনআর নার্সিংহোমের একটা কেবিনে বসে আছে মেহরিমা। ওর সামনেই বেডে শুয়ে আছে ওর নানুভাই। তার অপর পাশে বসে আছে অর্ণা। সকালে কলেজে যাওয়ার সময় অর্ণার কল আসে। ওর নানুভাই আবার অসুস্থ হয়ে পরেছে, কথাটা শুনার সাথে সাথে মেহরিমা সোজা চলে আসে ওর মামার বাসায়। তারপর ওর নানুভাইকে নিয়ে এনআর নার্সিংহোমে চলে আসে। ডক্টর ওনাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হাতে থাকা প্রেশকিপশন আর ঔষুদের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহরিমা লক্ষ করতেই বলে উঠে,

– আংকেল, কি হয়েছে? কোন গুরুতর সমস্যা।

ডক্টর মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর প্রেশকিপশন আর ঔষুদগুলো বেডের উপর রেখে দেয়। মেহরিমার প্রশ্ন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলে উঠে,

– কবে ফিরলে?

– এইতো আজ সকালে।

ডক্টর আর কিছু বলে না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে চলে আসে। ডক্টরের মতিগতি মেহরিমার সন্ধেহ হলো। ইনি তো কখনো এমন করেন না। তাহলে আজ কি হলো? কেন সে মেহরিমার প্রশ্ন উপেক্ষা করলো। নাকি ওর নানুভাইয়ের বড় কোন প্রবলেম হলো। মেহরিমা অর্ণার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখলে মেয়েটা কেঁদেকেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলছে। অর্ণাকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে।মেহরিমা সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়। ডক্টরের পিছু যায় সে। কিছুপথ যাওয়ার পর মেহরিমার পা থেমে যায়। ডক্টর তার নিজের কেবিনে না গিয়ে সে যাচ্ছে ডক্টর ইমরান খানের কেবিনে। ব্যাপারটা ভালো লাগে না মেহরিমার। ডক্টর চলে যায়। মেহরিমা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ইমরান খানের কেবিনে তার যাওয়াটা কি ঠিক হবে। মেহরিমাকে দেখতে পেয়ে ডক্টর ইমরান খান যদি আবার রেগে যায়। তিনি তো মেহরিমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। মনের মাঝে হাজারো দ্বিধা ধন্ধ কাটিয়ে সে পা বাড়ায় ডক্টর ইমরান খানের কেবিনের উদ্দেশ্যে। দরজার নক করবে এমন সময় ডক্টর ইমরান খানের কথায় থমকে যায় মেহরিমা।

– আপনি কি বলতে চাইছেন ডক্টর বিশ্বাস। উনি আমার শ্বাশুড়ি বলেই কি আমার হসপিটালের নিয়ম ভেঙে দিবো নাকি। এটা আমার হসপিটাল, এবং আমার নিয়মেই চলবে। বাহির থেকে কোন ঔষুদ ভিতরে আনা হবে না।

– আপনি কেন বুঝতে পারছেন না ডক্টর খান। আপনার শ্বাশুড়ির অবস্থা দিন দিন ক্রিটিক্যাল হয়ে পরছে। এখন যদি ওনাকে সঠিক ঔষুদ না দেওয়া হয় তাহলে কিছু দিনের মধ্যে ওনিও পরলোকগমন করবেন।

– ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। আমার কোম্পানির ঔষুদ-ই চলবে এখানে। কে বাচলো আর কে মরলো তাতে আমার কিছু যা আসে না।

– কিন্তু আমার যায় আসে ডক্টর খান। আমি একজন ডক্টর কসাই নই যে মানুষের প্রান নিবো।

– সেটা এনআর জয়েন করার আগে ভাবা উচিৎ ছিলো আপনার ডক্টর বিশ্বাস। এখন আমি যা বলবো আপনাকে সেটাই করতে হবে। শয়তানি হাসি হাসে ডক্টর ইমরান খান। তারপর আবার বলে, আরে ওনি তো আমার শ্বাশুড়ি! আমি আমার নিজের মা-কে পর্যন্ত ছাড়িনি। নিজের হাতে খুন করেছি ওনাকে। আমার কথা যে অমান্য করবে তাদের সকলের একটাই শাস্তুি, মৃত্যু।

ডক্টর বিশ্বাস ইমরান খানের কথা শুনে চমকে উঠে। একটা মানুষ কতটা খারাপ হয়ে সে নিজের মা-কে মারতে পারে। বাহিরে দাঁড়িয়ে সব কথাই শুনছিলো মেহরিমা। তার চোখ দিয়ে জল পরছে। এতদিন ভাবতো তার বাবা একজন রাগী মানুষ তবে একটা ভালো ডক্টর। ছোট থেকেই সে তার বাবার মতো একজন ডক্টর হতে চেয়েছে। মেহরিমার চোখের জল যেন আজ ভাধ মানছে না। অঝড় ধারায় বয়ে চলেছে। আবার ওর নানুভাইয়ের কেবিনের দিকে পা বাড়ায় মেহরিমা।

মেহরিমার নানুভাই অচেতন অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। তার একটা হাত ধরে অর্ণা পাশে বসেই ঘুমিয়ে পরেছে। মেহরিমা এখান থেকে এক ঔষুদের প্যাকেট নিয়ে চলে গেলো বাহিরে। বাহিরে ফার্মেসী থেকে একই ঔষুদ কিনে নিলো। তারপর দুটো ঔষুদ খুলে সেগুলো মিলাতে লাগলো। কিন্তু কোন পার্থক্য পেলো না। দুটো ঔষুদ-ই আলাদা আলাদা করে নাকের কাছে ধরে গন্ধটা শুকে নিলো। এবার বেশ অবাক হয় মেহরিমা। দুটো ঔষুদের আলাদা আলাদা স্মেল। মেহরিমা ঔষুদগুলো নিয়ে একটা দোকানে যায়। তারপর দুটো পাত্র কিনে নেয়। পাত্র দুটিতে পানি দিয়ে সেখানে দুটো ওষুদ ছেড়ে দেয়। একটা ঔষুদ পানিতে দেওয়ার সাথে সাথে পানির রং বদলে যায় আর ঔষদটা গলে যায়। অপরটা পানিতে মিশতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নেয় তবে দুগন্ধটা আর নেই। মাথায় হাত রেখে চিন্তা করতে থাকে মেহরিমা। তার বাবা ডক্টরের মুখোশের আড়ালে একজন ক্রিমিনাল। যে সবাই জাল ঔষুদ
দেয়। কিছুই ভাবতে পারছে না সে। মানুষকে সেবা করার নামে যে তার বাবা সবাইকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাথায় হাত রেখে ভাবছে এখন কি করা যায়। তার দৃষ্টি স্থির সামনের দুটো পাত্রের দিকে। তখনি কেউ এসে মেহরিমার কাধে হাত রাখে। নিজের কাধে কারো উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেতেই কেপে উঠে মেহরিমা। তাড়াতাড়ি পিছন দিকে তাকায়। পিছনে তাকাতেই ওর চোখমুখ খুশিতে ভরে উঠে। আকাশ, কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় মেহরিমা আর সামনে থাকা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে।

আকাশ আর মেহরিমা দুজনেই পাশাপাশি বসে আছে। দুজনের মুখে হাসি লেগে আছে। আকাশের চোখ পরে সামনে তাকা পাত্র দুটির উপর। তারপর পাত্র দুটোকে ভালো করে দেখে বলে,

– এগুলো কি মুন। ডাক্তারি পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন কি গবেষক হতে মন চাইছে নাকি?

– না রে। আসলে আমি ঔষুদ দুটো দেখছিলাম।

– মানে!

– তোকে পরে সবটা বলবো। এখন বল আংকেল আন্টি কেমন আছে? আর তোরা দেশে ফিরলি কবে?

-সবাই খুব খুব ভালো আছে। বেশ কিছুূদিন আগেই দেশে ফেরা হয়েছে।

– ওহ। মেহরিমা আরো কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। ওকে যে এখন যেতে হবে। আকাশকে শুধু বলল, সরি আকাশ। আমাকে এখন যেতে হবে। আসলে আমার একটু তাড়া আছে। তুই বাসায় আসিস তারপর আমরা সারাদিন গল্প করবো কেমন? ইনোসেন্ট মুখ মেহরিমার। আকাশ মৃদু হেসে জবাব দেয়, ঠিক আছে। আর শোন সাবধানে যাবি কেমন। মাথা নাড়ি হ্যাঁ সুচক জবাব দেয় মেহরিমা। তারপর আকাশকে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসে সোজা নার্সিংহোমে। নার্সিংহোমে ডুকতেই ডক্টর ইমরান খানের সামনে পরে মেহরিমা। ডক্টর ইমরান খান একটা স্টাফের সাথে কিছু কথা বলছিলো। মেহরিমা সেদিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। কিছুটা দূরে আসার পর মেহরিমা ভাবতে থাকে, সাধারণ একটা স্টাফের সাথে বাবার এত কিসের কথা থাকতে পারে। এই লোকটা কে? মেহরিমা আবার পিছনের দিকে ঘুরে ওদের কাছে আসে। ডক্টর ইমরান খান লোকটাকে কিছু বলে চলে গেলেন। আর লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে গেলে নার্সিংহোমের পশ্চিম প্রান্তে। মেহরিমা বেশ অবাক হলো। কারন এদিকে সচরাচর কেউ আসে না। এখানে সাধারণ এমআরআই করানো হয়। তবে সেটাও একটা কেবিনে। বাকি রুম গুলাতো বন্ধ,তাহলে কোথায় যায় লোকটা? মেহরিমা লোকটার পিছু করতে থাকে।

নার্সিংহোমের একদম পশ্চিম প্রান্তে একটা দেয়ালের কাছে এসে লোকটা এদিক ওদিক তাকায়। মেহরিমা তখন পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পরে। দেয়ালের সামনে ঝুলে থাকা পর্দাটা সড়িয়ে ভিতরে ডুকে লোকটা। লোকটা ভিতরে যেতেই মেহরিমা পর্দার আড়ালে থেকে বেড়িয়ে আসে। তারপর সেও চলে যায় ভিতরে। ভিতরে ডুকতেই সামনে আরো একটা দরজা পরে। ভাগ্যিস এখন দরজার কাছে কেউ নেই তাই অনায়াসে ভিতরে যেতে পারে মেহরিমা। ভিতরে ডুকতেই অবাক হয় সে। বড় বড় পার্সেল সাজানো এখানে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলোর ভিতরে ঔষুদ। মেহরিমা কিছু বুঝতে পারছে না। ঔষুদের পার্সেল এখানে কেন? এগুলো রাখার জন্যে ফার্মেসী আছে। সামনের দিকে এগিয়ে সবটা দেখতে থাকে সে। হঠাৎ সে এমন কিছু দেখতে পায় যেটা থেকে মেহরিমা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বের করে সবটা ভিডিও করতে থাকে।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here