হৃদমাঝারে পর্ব -১২

#হৃদমাঝারে – [১২]

১০,
কেটে গেছে আরো দুইদিন। মেহরিমা নার্সিংহোম থেকে তার নানুভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরে যায়। সবাই এটা নিয়ে প্রশ্ন করলে মেহরিমা প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।এনআর নার্সিংহোমের যত ঔষুদ আছে সব নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। আর তার নানুভাইয়ের জন্যে বাহিরের অন্য এক ফার্মেসী থেকে ঔষুদ দিয়ে বলল,

– মামা, তুমি নানুভাইকে এখন থেকে এই ঔষুদগুলো দিবে।দেখবে নানুভাই খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ মামা, তোমাকে একটা কথা দিতে হবে।

– কি কথা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মেহরিমার মামা।

মেহরিমা একটা আমতা আমতা করে বলল,
– না মানে, না মানে, আসলে আমি যে ঔষুদগুলো বদলে দিয়েছি সেটা তুমি কাউকে বলবে না।

– মানে!

– পরে আমি তোমাকে সবটা বলবো। এখন আমার হাতে সময় নেই মামা। আমাকে বের হতে হবে। উঠে দাঁড়ায় মেহরিমা।

– কোথায় যাবি তুই এই অবেলায়?

– পুলিশস্টেশনে।

মেহরিমার কথা শুনে ওর মামা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। ততক্ষণ মেহরিমা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। দরজার সামনে অর্ণার মুখোমুখি হতেই মেহরিমা অর্ণার কাঁধেও হাত রেখে বলল, নানুভাইয়ের খেয়াল রাখিস। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

নিজের রুমে এসে বিছানায় লেপটপ নিয়ে বসলো মেহরিমা। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বিছানার উপর রেখে দিলো। মোবাইলে থাকা ভিডিওটা লেপটপে নিজের নামে একটা ফাইল তৈরী করে সেটাতে রেখে দিলো।

পুলিশস্টেশনে সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিমা। এখানে আসার আগে সে আকাশকে কল করে বলে দিয়েছে পুলিশস্টেশনে আসতে আর এখন সে এখানে দাঁড়িয়ে আকাশের জন্যেই অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর মেহরিমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্কিনে দেখতে পেলো একটা অচেনা নাম্বার। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও কলটা রিসিভ করলো মেহরিমা। কানের কাছে মোবাইটা ধরতেই ওপাশ থেকে কর্কশ গলায় বলে উঠলো,

– কোথায় তুমি মেহরিমা? কলেজে আসছো না কেন? তুমি জানো দুদিন ধরে তোমার খোঁজ না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।

ফোনের ওপাশে থাকা লোকটাকে চিনতে না পেরে বলে উঠলো,
– কে আপনি? আর আমাকে খুঁজে আপনি পাগল হচ্ছেন মানে কি? হু আর ইউ?

– ফারহান। ফারহান সাদিক আমি। মেহরিমা কোথায় তুমি? তুমি জানো কোথায় কোথায় খুঁজেছি তোমাকে, তোমার কোন ধারনা আছে?

ফারহানের কথা শুনে মেহরিমা স্মিত হাসলো। তারপর বলল,
– কেন খুঁজছেন আমাকে?

– তুমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারো না মেহু। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফারহান।

– আমি আমার বাড়িতে এসেছি। আসলে হঠাৎ নানুভাই অসুস্থ হয়ে পরেছে তো তাই।

– ওহ। এখান ঠিক আছে তোমার নানুভাই।

– আগের থেকে বেটার।

– কবে ফিরবে?

– খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো। আচ্ছা আমি এখন রাখছি কেমন। পরে তোমার সাথে কথা বলবো। তারপর ফারহানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় মেহরিমা।

কিছুক্ষণ পর আকাশ আসে পুলিশস্টেশনের সামনে। আকাশ আসতেই দুজনে এক সাথে ভিতরে যায়। থানার ভিতরে ডুকেই ওরা সোজা চলে যায় ও সি সাহেবের রুমে। তারপর তাদের মাঝে কথা হয়। মেহরিমা ওসি সাহেবকে ভিডিওটা দেখাতেই তিনি চমকে উঠে। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,

– তুমি, তুমি এই ভিডিওটা কোথায় পেলে?

– এনআর নার্সিংহোমে।

মেহরিমার জবাব শুনে থানার ওসি কিছুটা আতকে উঠে। আর বলে,
– এই মেয়ে তুমি এনআর নার্সিংহোমে পৌঁছালে কি করে। মেহরিমা আর আকাশ দুজনেই তার দিকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি আবার বলে উঠে,
না মানে বলছিলাম যে, ওখানে তো অনেক রিক্স তুমি কি করে সেখানে গেলে।

– ওনাকে অনেক রিক্স সেটা আপনি কি করে জানলেন? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আকাশ।

– দেখুন মিস্টার,,

– আকাশ, আকাশ আমার নাম।

– হ্যাঁ, মিস্টার আকাশ। বলছিলাম যে যারা এই ধরনের কাজ করে তারা খুব ডেঞ্জারাস হয় এই আর কি।

– আপনি হয়তো জানেন না ডক্টর ইমরান খান আমার বায়োলজিক্যাল বাবা। হ্যাঁ ডক্টর ইমরান খানের মেয়ে আমি। তাই আমি এনআর নার্সিংহোমের প্রতিটা কোনে আমি পৌঁছাতে পারি।

মেহরিমার কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠে,ওসি সাহেব। তারপর বলে,

– ঠিক আছে তুমি ভিডিওটা এখানে রেখে যাও আমি দেখছি।

– দেখছি মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি? আকাশ কিছুটা রেগে উঠে। নিজের ওষ্ঠদ্বয় দাত দিয়ে চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করে বলে, দেখুন আমরা এখানে ডক্টর ইমরান খানের বিরুদ্ধ কমপ্লেন করতে এসেছি। ওনার নার্সিংহোমে এরকম বেআইনি কারবার হয়। তাছাড়া ডক্টর ইমরান খানের আরো অনেক কুকৃত্রি আছে যেগুলোর প্রমান আমাদের কাছে নেই। আপনার খুজে বের করুন। আর অপরাধীকে তার কৃতকর্মের শাস্তি দিন।

আকাশ আর মেহরিমার কথা শুনে ওসি সাহেব কিছুটা ঘাবড়ে যাবে। তবে কি করার, কমপ্লেইন করতে এসেছে সেটা তো করতেই হবে।

ডিনার শেষ বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মেহরিমার মনে পরে ফারহানের কথা। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে ফারহানের নাম্বারটা দেখে নেয়। একগাল হেসে নাম্বারটা মোবাইলে সেইভ করে নেয়। তারপর ডায়াল করে ফারহানের নাম্বারে। রিং হতেই ফারহান কল রিসিভ করে বলে,

– এতক্ষণে মনে পড়লো তাহলে!

– হুম। তা আপনি বুঝি আমার কলের অপেক্ষা করছিলেন।

– হ্যাঁ, করছিলাম -ই তো। আচ্ছা মেহরিমা, আমি কিন্তু আমার এ্যনসারটা এখনো পেলাম না।

– কোন এ্যনসার। ভ্রু কুঁচকায় মেহরিমা।

– সত্যিই বুঝতে পারছো না তুমি?

– না বুঝতে পারছিনা। আপনি বলুন তো কিসের এ্যানসার?

– ভা-ভালোবাসো আমায়?

কোন জবাব দেয় না মেহরিমা। স্মিত হেসে বলে,
– না, ভালোবাসি না আপনাকে।

– সত্যি বলছো?

– হুম, সত্যিই বলছি।

– তাহলে এত রাতে কল কেন করেছো।

– আমার ভুল হয়ে গেছে। এত রাতে আপনাকে কল করা, আমার ভুল হয়ে গেছে। রাখছি। বলেই কল কেটে দেয় মেহরিমা। কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে স্কিনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। তারপর বলে উঠে, ভালোবাসি তো আপনাকে, খুব ভালোবাসি।

মোবাইলটা পাশে রেখে ঘুমিয়ে পরে মেহরিমা। পরেরদিন সকালে রাজুর ফোনে ঘুম ভাঙে মেহরিমার। ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করে বলে,

– কিরে রাজু, এত সাতসকালে কেন কল করেছিস?

– এখানো সকাল। একটু শক্ত গলায় বলে রাজু। ঘড়ি দিকে তাকিয়ে দেখ কটা বাজে।

– সেটা জেনে আমার লাভ নাই রে। কেন কল করেছিস সেটা বল।

– কাল বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস আছে সেটা কি তুই ভুলে গেছিস মেহু।

– ওহ হো। মাথায় হাত রাখে মেহরিমা। আমি একদম ভুলে গেছিরে। আসলে এখানে এসে এত বাজে ভাবে ফেসে গেছি না সব গোলমাল হয়ে গেছে আমার।

– কি হয়েছে রে মেহু। তুই ঠিক আছিস তো।কি- কি গোলমাল হয়েছে? উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে রাজু।

– আমি একদম ঠিক আছি। তুই কোন চিন্তা করিস না। রাখছি কেমন। এই বলে কল কেটে দেয় মেহরিমা। মোবাইলটা বিছানার উপর রেখে হাতের নোখ কামড়াতে থাকে আর ভাবতে থাকে এখন তার কি করা উচিৎ। এদিকে নিজের বাবার নামে পুলিশে কমপ্লেন করেছে আর অপর দিকে তার ক্লাস। দুটোই তার জন্যে ইম্পরট্যান্ট। ডক্টর ইমরান খানের মুখোশ খুলতেই হবে। তা না হলে আরো কত অসহায় নিরহের প্রাণ যাবে তার কে জানে। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর ওর মাথায় একটা নামই আসে, আকাশ। সাথে সাথে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে মেহরিমার। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আকাশের নাম্বারে কল দেয় মেহরিমা। তারপর ওকে বলে,

– হ্যাঁ আকাশ। আমার সাথে একটু দেখা করতে পারে।
ওপাশের কথা শুনে দুঠোট প্রসারিত করে হাসে মেহরিমা তারপর ঠিক আছে বলে কল কেটে দেয়। মোবাইলটা বিছানায় রাখতেই সেটা আবারও বেজে উঠলো। বেশ বিরক্তি নিয়ে মোবাইলের দিকে তাদকাতেই মুখটা চুপসে যায় মেহরিমা। স্কিনে জ্বলমল করছে বাবা নামটা। কাপাকাপা হাতে মোবাইলটা ধরতে গিয়েও হাত নামিয়ে নেয় মেহরিমা। কি বলবে ও। কি বা বলার আছে। যে ওকে এই পৃথীবিতে এনেছে তার নামেই ও পুলিশে কমপ্লেন করেছে। আচ্ছা বাবা যদি জিগ্যেস করে তাহলে কি জবাব দিবো। ভাবতেই কেপে উঠে মেহেরিমা। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে মোবাইলের দিকে।

চলবে,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here