হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -০৪

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০৪ (অতিরিক্ত পর্ব)
#আনিশা_নিঝুম

চিলেকোঠার মাঝে আলো পৌঁছানোর সুযোগ নেই। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রাফাতের। অক্সিজেন পাবার আশায় পুরো দমে নিজের হাতের শক্ত দড়ি খুলতে চেষ্টা করছে। মোটা দড়ি দিয়ে তার হাত পা এতোটাই শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে যে তার হাত পা রেখে টুপটুপ করে রক্ত মেঝেতে গড়িয়ে পড়ছে। সফেদ টাইসে আবৃত মেঝে রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। রাফাত ক্লান্ত হয়ে নিজের পিঠ ঠেকাতে যাবে তার পূর্বেই উপুড় হয়ে শব্দ করে পড়ে গেলো। পিঠে কিছু বিঁধে যাওয়ায় ব্যথায় কুঁকিয়ে শব্দ করে উঠলো!

রাফাত শব্দ পেলো, দরজা খুলে প্রবেশ করেছে কেউ! তবে কি কেউ তাকে বাঁচাতে এসেছে? নাকি তার মৃত্যু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে? রাফাত নিজের সর্বশক্তি দিয়ে উঠে বসলো। শব্দ করে কেঁদে বলল,’আমাকে বাঁচান, ভাই! আমাকে কারা জানি বন্দী করে রেখেছে। দুদিন ধরে খাবার তো দূর এক ফোটা পানিও পাচ্ছি না। এইভাবে আমি ম রে যাবো।’

রাফাতের কথা শেষ হতেই, তার চোয়াল কেউ শক্ত করে চেপে ধরলো। ব্যথায় মূর্ছে গেলো রাফাত। কর্ণপাত হলো কেউ তাকে বলছে,’তোকে মা র তেই তো এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে! মূর্খ ছেলে!’

সেই মূহুর্তে কারো হাসির শব্দ কানে এলো রাফাতের। রাফাত ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠে,’কে আপনি?’

‘তোর মৃত্যু!’

ঝংকার দিয়ে রাফাতের কানে কথাটা তুললো কেউ! ভয়ে রাফাত আটসাট বেঁধে বসে আছে। বুকে দুরুদুরু শব্দে কেউ ঢোল পেটাচ্ছে! আজ কি তবে তার মরণের দিন চলেই এলো? এতো তাড়াতাড়ি সে মর তে চায় না! তার জীবনের মাত্র শুরু! রাফাত আকুতি ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’আপনি আমার থেকে কি চান? আমি সব বলবো খালি আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন, দয়া করে।’

‘যদি বলি তোর মৃত্যু চাই?’

রাফাত কেঁপে উঠলো। লোকটি হাসলো, অন্ধকারেও তার হাসির ঝিলিক দেখতে পেলো রাফাত। কি সুন্দর তার হাসি, এই হাসির পিছে কত কুৎসিত একটি মন!

____________

রাফাতকে চিলেকোঠার পাশেই অন্য আরেকটা ছোট আকারের রুমে নেওয়া হয়েছে। রাফাত জানে না এখন তার সাথে কি হবে কিন্তু জানে, যা হবে একটুও ভালো হবে না। এখানে পালবার মতো কোনো জায়গা নেই! যে তাকে বন্দী রেখেছে সে যে কাঁচা খেলোয়াড় না সেটা রাফাত পূর্বেই বুঝে গিয়েছিলো যখন তাকে এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়।
রাফাত ভয়ে নিঃশব্দে চেয়ার চেপে ধরে বসে আছে। দরজা খুলে এক সুঠাম দেহী মানুষ এসে তার অপরপাশের চেয়ারটেনে বসলো একদম শব্দ করে এক পানির বোতল তার সামনে রাখলো। দুদিন পর পানি পেয়ে রাফাত তৃষ্ণায় ছো মেরে পানির বোতল নিয়ে মুখে দিতেই মুখ থেকে পুনরায় বের করে ফেললো। থু থু দিতে দিতে বলল,’এই পানিতে কি মিশিয়েছেন?’

‘বিষ।’ বলেই হাসলো আগন্তুক। রাফাত ভয় পেয়ে গেলো। ঘাড়কাত করে ব মি র চেষ্টা করলো। রাফাতের কান্ডে অপরপাশের মানুষ রেগে টেবিলে সজোরে বাড়ি দিতেই রাফাত থেমে গেলো।

‘তোকে যেই প্রশ্ন করবো তার সুন্দরমতো উত্তর দিবি! তবেই এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি। নয়তো এখান থেকে তোর লাশ যাবে।’

রাফাত মাথা নাড়ালো দুপাশে। জান রক্ষার্থে এখন তার তাদের সত্যি কথা বলতেই হবে।

আগন্তুক রাশভারী কণ্ঠে রাফাতকে প্রশ্ন করলো,’মেজর সায়েদ আনাস আর তার স্ত্রী অনন্তাকে কে মেরেছিলো?’

‘আমার বাবা!’

আগন্তুক অবাক হলো রাফাতের কথায়, ভ্রুকুঁচকে বলল,’তোর বাবা?’

রাফাত মাথা নাড়িয়ে বলল,’জ্বী, আমার বাবা মেজর মঈনুল রশীদ!’

মঈনুল রশীদ নামটা শোনা শোনা লাগলো আগন্তুকের। পরবর্তী প্রশ্ন করলো রাফাতকে,বললেন,’কোন উদ্দেশ্যে মেরে ছিলেন তাদের? তারা তো নির্দোষ!’

রাফাত বলল,’আমার বাবা মাদক আসক্ত,না রী লোভী বা টাকা পয়সা লোভী যাই বলেন না কেনো দুটোই ছিলেন। মেজর হলেও তার মনে ছিলো হিংসা! তিনি হিংসা করতেন সায়েদ আংকেলকে কিন্তু স্কুল জীবনে তারা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার মা মোহনা রশীদ ও অনন্তা আন্টিও অনেক ঘনিষ্ঠ বান্ধুবি ছিলেন। একদিন’

আগন্তুকের ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো, বলল,’একদিন কি? থেমেছিস কেনো?’

রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’আমার বাবা মা ষড়যন্ত্র করে তাদের নৃশংস ভাবে হ ত্যা করে। সায়েদ আংকেল আর আন্টির তখন একটা ছোট পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে ছিলো। সেই মেয়ে এই পুরো হ ত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। আপনি যদি সেই মেয়েকে খুঁজে বের করতে পারেন তবেই তাদের মৃত্যু কিভাবে হয়েছিলো জানতে পারবেন।’

‘মেয়েটি কোথায় এখন?’ আগন্তুক প্রশ্ন করলো রাফাতকে। রাফাত ভেবে বলল,’আমার বাবা মা ওখান থেকে মেয়েটাকে নিয়ে আসে সাথে করে। কারণ মেয়েটির নামে ছিলো অঢেল সম্পত্তি! ওমন সোনায় বাঁধানো মেয়েকে কিভাবে মারবেন তারা? তাই সম্পত্তি পাওয়ার লোভে তাকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিলো। এক উকিলের সাথে যোগাযোগ করে বুঝলেন ওর বাবা মানে সায়েদ আংকেল সম্পত্তিটাকে এমনভাবে দিয়ে গিয়েছেন যে চাইলেও আমার বাবা মা তা নিজের দখলে আনতে পারতো না।’

‘তারমানে মেজর সায়েদের এই সম্পত্তি তার মেয়ের নামে নয়?’

‘ঠিক বুঝেছেন। যদি কখনো তার মেয়ে বাচ্চা জন্ম দিতে যেয়ে মারা যায় তবে সেই সম্পত্তি তার বাচ্চার নামে হয়ে যেতো। আর যদি সেই বাচ্চাই মারা যায় তবে সেই সম্পত্তি তার পিতার নামে হয়ে যাবে। ঠিক এই সুযোগটাই আমার বাবা মা আমাকে দিয়ে কাজে লাগিয়েছে। সায়েদ আংকেলের মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। মেয়েটাও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে! আমাকে না পেলে মেয়েটা ম রেই যাবে।’

আগন্তুক আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে রাফাতের চেয়ার সজোরে এক লাত্থি মারতেই রাফাত চেয়ারসহ ছিটকে পড়ে গেলো। কনুইতে ব্যথা পেয়ে কুঁকিয়ে উঠলো রাফাত। আগন্তুক চিল্লিয়ে বলে উঠে,’তোরা এইভাবে ওই ফুলের মতো মেয়েটার ক্ষতি কিভাবে করতে পারলি! তোদের জন্য মেয়েটা তার পুরো পরিবার হারিয়েছে! আমি মেয়েটার জীবন এইভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি না! আমি তোদের সবকটা শেষ করে দিবো।’

আগন্তুক কথাটি বলেই রাফাতের কলার চেপে ধরে ইচ্ছামত পে টা তে থাকে। রাফাতের নাক থেকে রক্ত স্রোতের ন্যায় পড়তে থাকে। একসময় রাফাত জ্ঞান হারাতে নিলে তার চোখ আটকে যায় আগন্তুকের নেমপ্লেটটিতে, তাতে জ্বলজ্বল করছিলো,’আফশান ফায়াজ’ নামটি।

৫.

ঘড়ির কাটা দুপুর ৩:০০ টা ছুঁই ছুঁই। ত্রিধার বাড়ি ছেড়েছে পাঁচ ঘন্টা হতে চললো। তখন বলা ত্রিধারের কথাগুলো আমি মনে মনে আওড়ালাম।

‘ত্রিধার আপনি সেনাবাহিনীতে আছেন?’

ত্রিধার ভ্রুকুঁচকে বললেন,’হু, আছি তাতে কি?’

আমি ত্রিধারের কথায় নড়েচড়ে উঠলাম,বললাম,’যারা আর্মি তাদের আমার পছন্দ না, ত্রিধার।’

‘এর কোনো বিশেষ কারণ আছে, স্নিগ্ধতা?’

‘আছে, পলাশী আপুর বাবা মঈনুল আংকেল তিনি আর্মি মেজর, খুবই খারাপ একজন লোক! বিশ্বাসঘাতক তিনি, টাকার জন্য নিজের দেশের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতেও তার বুক কাঁপে না! তারচেয়েও বড় কথা তিনি….’

‘তিনি কি?’

‘না রী লোভী!’ বলতে বলতেই কণ্ঠনালী কেঁপে উঠলো আমার। নতজানু হয়ে গেলাম আমি। ত্রিধার এগিয়ে এলেন আমার কাছে আমার বাহু ঝাকিয়ে বললেন,’তোমার সাথে কিছু করেছেন উনি,স্নিগ্ধতা?’

আমি নতমস্তকে বসে রইলাম তাতে ত্রিধার রাগে ফেটে পড়লো। আমার পাশে বসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,’কোন হাত দিয়ে ছুঁয়েছেন? তিনি যে হাত দিয়ে তোমায় ছুঁয়েছেন, তার সেই হাতই আমি কেটে দিবো!’

স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে কথাটা বললেও ভয়ংকর রেগে আছেন তিনি তা স্পষ্ট বুঝা গেলো। আমি ঈষৎ কেঁপে উঠলাম। ত্রিধার আবারো বললেন,’বলো?’

‘বা হাত।’ বলে চুপ করে গেলাম আমি। ত্রিধার উঠে রেগে গজগজ করতে করতে বলেন,’আমি এখন আসছি। আর শুনো একটুপর তোমার পলাশী আপু এইখানে আসবে তোমার সাথে থাকতে। তার সাথেই আগামী দশদিন থাকবা। আমি আসছি।’

#চলবে?

|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here