হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -০৬

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০৬ (অতিরিক্ত পর্ব-২)
#আনিশা_নিঝুম

৬.
সূর্যের প্রখর তাপ, তারচেয়েও বেশি গরম ত্রিধারের মাথা। সদ্য গেট পেরিয়ে ইটের তৈরি দোতা’লা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে দাঁড়ালো।

ত্রিধার চিৎকার করে ডাকলো আশফিকে। আশফি তখন কপালে ডান হাত ঠেকিয়ে নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলো। ত্রিধারের চিৎকারমাখা কণ্ঠ শুনে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত করে বের হলো পূর্ণা। ত্রিধারকে দেখে ভয়ে মুখখানা পূর্ণার চুপসে গেলো

ততক্ষনাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন আশফি। বিরক্তিমাখা সুরে বললেন,’কি হয়েছে ক্যাপ্টেন আফশান?’

বলে পূর্ণার চুপসানো মুখের দিকে বিরক্তির চোখে তাকালেন আশফি। ত্রিধার পূর্ণার দিকে তাকিয়ে নিজের আশফির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,’মেজর সায়েদ আনাসের মৃত্যুর সাথে কারা কারা জড়িত ছিলো? আপনিও তো একজন মেজর, তার সাথে তো আপনারো বন্ধুত্বপূর্ণ একটি সম্পর্ক ছিলো নিশ্চয়ই তার মৃত্যুর পিছনের রহস্য ধারণা আছে আপনার?’

আশফি নিজের স্ত্রীর চুপসানো মুখশ্রীর দিকে তাকালেন একবার। পূর্ণা ভয়ার্ত চোখে একবার ত্রিধারের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার স্বামীর দিকে। আশফি আচমকা ত্রিধারের বাহু ধরে বলে,’এতো বছর পর কেন তাদের মৃত্যুর রহস্য নিয়ে পরেছো তুমি ক্যাপ্টেন আফশান?যারা সায়েদ আর অনন্তাকে মেরেছে তারা জানতে পারলে তোমাকেও মে রে দিবে। তখন কি হবে ভেবেছো?’

আশফির হাতদুটো নিজের বাহু থেকে সরিয়ে নিলো ত্রিধার। তাচ্ছিল্য হেসে বলেন,’আমি কারো জন্য এই রহস্য উন্মোচনের জন্য পড়ি নি, আমি আমার স্ত্রীর মা বাবার খুনিদের মারতে এই মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করবো।’

আশফি ও পূর্ণা পিলে চমকে উঠে ত্রিধারের কথায়। একইসাথে তারা বলে উঠে,’স্ত্রী? তুমি বিয়ে করেছো আফশান? তাও আবার সায়েদ আর অনন্তার মেয়েকে? ওই মেয়ে এখনো বেঁচে আছে?’

তাদের কণ্ঠস্বর শুনে ত্রিধার আঁচ করলো তারা ভীতিগ্রস্ত! পূর্ণার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। এর কারণ বুঝলো না ত্রিধার তাদের এই নিয়ে প্রশ্নও করলো না! থাক না কি দরকার ভীতুদের আরো ভয় দেখানোর?

‘দেখে মনে হচ্ছে আপনারা দুজনের একজনও আশাই করেন নি স্নিগ্ধতা সায়েদ আনাস এখনো জীবিত! বাই এনি চান্স স্নিগ্ধতার বাবা মার মৃত্যুর পিছে আপনাদের হাত নেই তো?’

আশফি কেশে উঠলেন, পূর্ণা দৌড়ে যেয়ে স্বামীর পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। ত্রিধারকে ধমকে বলে উঠল,’ক্যাপ্টেন আফশান আমরা তোমার বড়! আমাদের সন্দেহ করছো কোন সাহসে? যদি এমন হতোই আমরা তোমার স্ত্রীর মাতা পিতার খুনি তবে কবেই গা ঢাকা দিতাম! অনন্তা ভাবী আর সায়েদ ভাইয়ের মৃত্যুর পনেরো বছর হয়ে গিয়েছে তোমার এতো অতীত নিয়ে ঘাটানোর কি প্রয়োজন?’

ত্রিধার হাসলো,বলল,’এই মূহুর্তে আপনার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আফশান ফায়াজ ওরফে ত্রিধার না, সে স্নিগ্ধতা সায়েদ আনাসের স্বামী! যে স্বামী কিনা নিজের স্ত্রীকে সুখে রাখতে চায়! আপনার স্বামী আশফির মতো নই আমি মেরুদণ্ডহীন!’

আশফি রেগে তাকালো ত্রিধারের দিকে,গম্ভির কণ্ঠে বলে উঠলেন,’ক্যাপ্টেন আফশান এটা ভদ্রলোকের বাসা! এভাবে চিল্লাপাল্লা না করে শান্তিতে বসে কথা বলো।’

‘তারমানে ইনডিরেক্টলি, ডিরেক্টলি যাই বলেন মেজর সায়েদ আর মিসেস সায়েদের মৃত্যুর পিছে আপনাদের হাত আছে?’

বলে শুকনো ঢোক গিললো ত্রিধার। মন প্রাণে চাচ্ছে তারা যাতে বলুক নাহ! এতে তাদের কোনো হাত নেই! যদি মুমিনের বলা কথাটা সত্য হয়ে যায় তবে সে তার স্নিগ্ধতাকে মুখ দেখাতে পারবে না! কি জবাব দিবে স্নিগ্ধতাকে সে? কিভাবে জানাবে স্নিগ্ধতাকে এই নির্মম সত্য? স্নিগ্ধতাকে হারানোর ভয় ত্রিধারের মনে জমেছে। আশফি ত্রিধারকে বলেন,’এতে আমাদের হাত নেই, তোমাকে আমি সব বলছি, তুমি বসো।’

ত্রিধার শুনলো আশফির কথা। মন্থর পায়ে সোফায় বসতে নিলে তার ফোন বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো পলাশী ফোন দিয়েছে। ফোন কান নিতেই পলাশী যা বলল তাতে ত্রিধার আশফির কথা না শুনেই হন্তদন্ত করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। ত্রিধারের যেতেই আশফি আর পূর্ণা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন তা ত্রিধারের চোখের আড়াল হয়ে গেলো।

৭.

সেই ভয়ংকর স্বপ্নটি দেখে লাফিয়ে চোখ খুলে উঠলাম আমি। মাথা চেপে ধরলাম! কি নৃশংস সেই হত্যা! আমার সাথে এই হত্যার কি সংযোগ? কেনো সেই মানব মানবীর আত্মচিৎকার এখনো আমার কানে ভাসে। কেনো সেই ছোট শিশুটির কান্নামাখা মুখ দেখলে বুক ধক করে উঠে? কি রহস্য এই স্বপ্নের?

পলাশী আপু আমাকে চেপে ধরলেন,বললেন,’স্নিগ্ধ, কি হয়েছে? অজ্ঞান হয়েছিস কেনো?’

‘পলাশী আপু,ভীষণ বাজে স্বপ্ন দেখেছি আমি।’

‘কি স্বপ্ন?’

পলাশী আপুকে আমি বলবো তার আগেই হন্তদন্ত করে ঘরে প্রবেশ করলো ত্রিধার। ত্রিধারকে দেখে আমি বলে উঠলাম,’আপনি না ট্রেনিং এ ছিলেন? এখানে কি করছেন?’

ত্রিধার আমাকে জবাব না দিয়ে পলাশী আপুর দিকে তাকালেন। পলাশী আপু মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ত্রিধার আমার পাশে জায়গা করে বসলেন। আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গভীর চুম্বন দিয়ে বললেন,’স্নিগ্ধতা! এইভাবে অজ্ঞান হলে কেনো?’

‘জানি না।’ বললাম আমি।

ত্রিধার বললেন,’পলাশীকে কোন স্বপ্নের কথা বলছিলে? আমাকে বলবে?’

‘আপনাকে কেনো বলবো আমি?’

‘হতে পারে আমি এই স্বপ্নের রহস্য খুঁজে বের করতে পারবো। তোমার সাথে এই স্বপ্নের কীসের সংযোগ তা একমাত্র আমিই বের করতে পারবো।’

বলে হাসলেন। ত্রিধারকে আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো। তাকে বলেও হয়তো একটু শান্তি পাবো আমি। সে এই স্বপ্নের রহস্য খুঁজে বের করবে আর কি চাই আমার? প্রতিদিন এই একি ভয়ানক, তিক্ত স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত! এই স্বপ্ন যেনো আমাকে কিছু জানাতে চায়, স্বপ্ন দিয়ে বুঝাতে চায় কয়েক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের কষ্ট, মরণ যন্ত্রণা। সেই ৫/৬ বছরী শিশুটির কান্নামাখা মুখশ্রী, স্বামী স্ত্রীর আত্মচিৎকার যেনো আমাকে কিছু জানাতে চায়! আমি বোকা! বুঝি না কিচ্ছু! স্বপ্ন ভাঙলেই মাথা চেপে ধরি, মাইগ্রেনের তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে থাকি। কিন্তু আজ এই স্বপ্নের রহস্য উন্মোচন করতেই হবে! নয়তো আমি শান্তি পাবো না।

___________________

‘মোহনা তোমার এই অপদার্থ ছেলেটা পুরো ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমাদের। একে তো মাটিতে পু তে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।’

মঈনুল রশীদ অগ্নিদৃষ্টি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন কথাটা ছেলের উদ্দেশ্যে। রাফাত অপরাধীর ন্যায় মুখ কাচুমুচু করে বলে,’তাদের সত্যি না বললে আমাকে মেরে ফেলতো।’

‘মিথ্যাও তো বলতে পারতি তুই।’

‘আফশান ফায়াজ অনেক ধূর্ত একটা ছেলে, আব্বা। তুমি জানো না ওই ছেলের পরিকল্পনা কতোটা সুক্ষ্ম দেখলে তো কিভাবে পরিকল্পনা করে স্নিগ্ধতাকে বিয়ে করে নিলো। পলাশী আপু তোমার সন্তান হয়েও সে এইসবে সাহায্য করেছে।’

মঈনুল রশীদ সামনে থাকা কাঁচের গ্লাস হাতে নিয়ে তা ছুঁড়ে মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। রেগে চিৎকার করে বলে উঠেন,’পলাশীকে এখনি ধরে আন! ওকে আমি মে রেই ফেলবো। আমার খেয়ে আমার পরে আমার পিঠেই ছুড়ি মারে!’

মঈনুল রশীদের আদেশ পেয়ে দেহরক্ষীরা চলে গেলো পলাশীর উদ্দেশ্যে। মোহনা রশীদ স্বামীকে কি বলবেন ভেবে পেলেন না,তিনি চাইলেও কিছু বলতে পারছেন না!

মঈনুল রশীদ আচমকা এসে মোহনার গলা চেপে বললেন,’সত্যি করে বলতো মোহনা, পলাশী কি ভুল করে হলেও সায়েদের সন্তান? সায়েদ না তোর প্রাক্তন প্রেমিক ছিলো? তার সন্তানই কি জন্ম দিয়ে আমার নামে চালিয়ে দিয়েছিস? কারণ আমার রক্ত হলে পলাশী এমন হতো না।’

স্বামীর কথায় মোহনা হতবাক,নির্বাক,অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। মানুষটা কেমন পালটে গেলো চোখের পলকেই! মোহনাকে কিছু বলতে না দেখে মঈনুল আরো শক্ত করে গলা চেপে বলেন,’আমি পলাশীকে পরে মারবো আগে তোকে মারবো। তোর প্রাক্তন প্রেমিক মরে গিয়েও শান্তি দেয় নি। চেয়েছিলাম আমার ছেলের সাথে স্নিগ্ধতার বিয়ে দিবো, এরপর তাদের যখন বাচ্চা হবে সেই বাচ্চাকে কৌশলে মেরে দিয়ে সব সম্পত্তি রাফাতের নামে লিখিয়ে স্নিগ্ধতাকে মেরে দিবো! কিন্তু তার আগেই ক্যাপ্টেন আফশান ফায়াজ পুরো পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছে। একে আমি ছাড়বো না!’

#চলবে?

| আশফি আর পূর্ণার সাথে ত্রিধারের সম্পর্কটা আপনারা আর দুই/তিন পর্বের মধ্যেই জানতে পারবেন তার আগে ধৈর্যহারা হবেন না কেউ। |

| গল্পটা আর কয়েক পর্বেই শেষ হয়ে যাবে দেখে,আমি বোনাস পর্ব দিচ্ছি আশা করি এতে আপনাদের অসুবিধা নেই। হ্যাপি রিডিং |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here