#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০৭
#আনিশা_নিঝুম
৮.
রাত্রীজুড়ে স্নিগ্ধ,মনোরম প্রকৃতি, হিমেল হাওয়া বইছে চারদিকে। কিন্তু ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা,পিনপিন নিরবতা। অনন্তা মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিজের স্বামী সায়েদকে ঠেলে বলল,’সায়েদ! এখন কি হবে? আমরা মরে গেলে আমাদের মেয়ের কি হবে?’
সায়েদ নিজের হাত পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। মোটা দড়ি দিয়ে ভীষণ শক্ত করে বাঁধা তার হাত পা! এতোটাই শক্ত যে দড়ি ধীরে ধীরে চামড়া ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে ফেলছে। অনন্তাকে দেখে সায়েদ কেঁদে দিলো,বলে উঠলো,’আমি এক ব্যর্থ বাবা আর স্বামী হয়ে গেলাম, অনন্তা! চাইলেও কিছু করতে পারছি না।’
তখনই তাদের নজর গেলো তাদের ছোট মেয়ের দিকে। তাদের মেয়ের ছোট হাত পাগুলোও দড়ি দিয়ে বাঁধা। এটা দেখতেই গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেলো দুজনেরই! মা-বাবা তো! সন্তানের একটুখানি কষ্ট দেখলেও বুক ফেটে যায়।
‘সায়েদ আমাদের ক্ষতি কে করছে চাইছে?’
সায়েদের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। কিছু একটা ভেবে রাগে ফেটে পড়েন তিনি, চিৎকার করতে চেয়েও পারলেন না, খা খা কণ্ঠে বললেন,’মঈনুল চাইছে আমাদের ক্ষতি করতে।’
অনন্তা আতকে উঠলো সায়েদের কথায়। কৌতুহলপূর্ণ কণ্ঠে বলল,’মঈনুল সাহেব তো তোমার এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু! সে কেনো তোমার ক্ষতি চাবে?’
‘মঈনুল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু না! সে হলো ঠকবাজ! লোভী। মঈনুল একজন মেজর হয়ে প্রতিনিয়ত তার দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে তা আমি জানতে পেরে যাই! তাই ও আমাদের সবাইকে মারার পরিকল্পনা করছে।’
অনন্তার কোমল মন আঘাত পায় সায়েদের কথায়। যে মানুষটাকে নিজের ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিলো আজ সেই মানুষটাই তার পরিবার নিঃস্ব করতে চাইছে! মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টকর।
‘মা, বাবা আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।’ কোমল কণ্ঠে বলে উঠলো অনন্তার মেয়ে। অনন্তা মেয়ের কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারলো না। নিচু স্বরে মেয়েকে বলল,’তুমি না ব্রেভ? ব্রেভ গার্লরা কান্না করে না! তারা সময় বুঝে প্রতিবাদ করে! আজ আমাদের কিছু হয়ে গেলে বড় হয়ে তুমি আমাদের হয়ে প্রতিবাদ করবে! করবে না?’
বাচ্চাটি মাথা নাড়ালো নিঃশব্দে। এতো কষ্টের মাঝেও মেয়েকে বুঝানোর জন্য অনন্তা হাসলো। সায়েদ তখন পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তার পুরো মস্তিষ্কই চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে! আজ তাদের মরণ নিশ্চিত সে বুঝতে পারছে! এখান থেকে মুক্তির একটাই উপায় মৃত্যু!
তখনই প্রবেশ করলো মঈনুল, তার সাথে আরেকজনকে দেখে অনন্তা আর সায়েদ অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছে! সায়েদ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠে,’মোহনা! তুমি?’
অনন্তা যতটা অবাক হয়েছে মঈনুল রশীদকে দেখে তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছে মঈনুল রশীদের পাশে কলেজ জীবনের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোহনাকে দেখে। মোহনার স্বাভাবিক চেহেরা দেখে মনে হচ্ছে না সে একটু ও অনুশোচনায় ভুগছে।
নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় দুই বন্ধুকে দেখে সায়েদের গা ঘৃণায় রিরি করে উঠে। মঈনুল তা দেখে স্বশব্দে হেসে সায়েদের চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে তার দিকে মুখ করে বলে,’ঘৃণা লাগছে সায়েদ?’
‘নিজের চাইতেও বেশি!’
‘এখন আরো বেশি লাগবে যখন তোর সামনেই তোর স্ত্রীকে নির্যাতন করা হবে!’
অনন্তার কথা উঠতেই কেঁপে উঠলো সায়েদ! ভয়ার্ত চোখে তাকালো মঈনুলের দিকে। অনন্তা চুপসানো মুখে তাকালো সায়েদের দিকে। সায়েদ তখনও ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে মঈনুলের দিকে।
‘মঈনুল আংকেল! আমার বাবা মা খুব ভালো তাদের কেনো মারবেন আপনি?’
এরমাঝে বাচ্চার কণ্ঠে মঈনুল আর মোহনা বিরক্ত হয়ে তাকালো। মোহনা এগিয়ে এসে আঙ্গুল উঁচু করে শাসিয়ে বলল,’ফাজিল মেয়ে! এতো কথা বলছো কেনো তুমি? বেশি কথা বললে পিস্তল দিয়ে তোমার বাবা মার মতো মেরে ফেলবো তোমায়।’
বলেই পিস্তল তাক করলেন মেয়ের দিকে। অনন্তা মোহনাকে বলে উঠলো,’মোহনা, শত্রুতা তোমার আমাদের সাথে। ওইটুকুন মেয়ের কি দোষ বলো? ওকে মেরো না, দয়া করে! আমাদের সাথে যা ইচ্ছা করো, ওর ক্ষতি করে নিজের পাপের বোঝা বাড়িও না।’
মঈনুল চোখের ইশারায় মোহনাকে পিস্তল নামাতে বললেন। মোহনা বিরক্তিসূচক শব্দ উচ্চারণ করে পিস্তল নামালো। মঈনুল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,’তোকে আমি মারতাম না সায়েদ যদি তুই আমার বিশ্বাসঘাতকতার কথা না জানতি! তুই জানা মানে এখন পুরো বাংলাদেশ জানবে, আমার চাকরী তো যাবেই আমার ফাঁসিও হবে তাই তোকে বাঁচিয়ে রেখে আমি নিজের বিপদ আনতে চাইনা।’
‘তো মারলে আমায় মার! অনন্তার কি দোষ?’
‘তুই মরলে অনন্তা চুপ বসবে না! তোর পরে অনন্তাই আমার পথের কাঁটা হবে তাই একসাথে দুটোকেই মারবো। এরপর তোর মেয়ে পথের কাঁটা হলে ওকেও মারবো! মোট কথা আমার পথের কাঁটা যে হবে তাকেই আমি মেরে ফেলবো!’
সায়েদ আর অনন্তা ঘৃণার চোখে তাকালেন মঈনুলের দিকে। মোহনা এসে অনন্তার গলা চেপে ধরে বলে,’কলেজ জীবনে আমি সায়েদকে ভীষণ ভালোবাসতাম, সায়েদ ও বাসতো! কিন্তু তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়েও আমায় ঠকালি! সায়েদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে জেনেও ওকে বিয়ে করলি! মাঝখানে আমার জীবন বিষিয়ে দিয়ে চলে গেলি! প্রতিটাক্ষণ আমার কিভাবে কষ্টে কেটেছে তুই জানিস না! আজ সব শোধ তুলবো আমি।’
বলেই অনন্তাকে পরপর চড় লাগাতে থাকলো মোহনা। অনন্তার ফর্সা মুখশ্রীতে এতোগুলো শক্ত হাতের চড় খেয়ে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ পড়ে গিয়েছে। তাদের মেয়ে ভয়ার্ত চোখে এইসব দেখছে। চাইলেও চিৎকার দিতে পারছে না কারণ তার মুখ মোহনা কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই ওড়না দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে।
অনন্তাকে লাগাতার কিয়ৎক্ষণ চড় মেরে বড় বড় শ্বাস ফেললো মোহনা। মোহনা উঠে দাঁড়ালো, মোহনার পর মঈনুল এলো অনন্তার কাছে। তার সাথে এখন কি হবে ভাবতেই অনন্তার গলা শুকিয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর মঈনুল রশীদ আবারো সায়েদের কাছে আসলেন, ছুড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,’তোর স্ত্রী এখন এমনেও মরবে ওমনেও মরবে। তোর হিসাবটা চুকিয়ে নেই এইবার।’
সায়েদের গা রাগে,ঘৃণায় রি রি করে উঠলো। মেঝেতে পড়ে থাকা অনন্তার দিকে তাকালো। তার কোমল, মুখখানি দেখতেই বুক ধক করে উঠলো সায়েদের। নিজেকে ব্যর্থ স্বামী হিসেবে মনে হলো তার।
তাদের মেয়ে মায়ের এই অবস্থা দেখে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। অনন্তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেয়ের কাছে গেলো, কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই তার বাঁধন খুলে দিয়েছে মোহনা। নিজের মেয়েকে বক্ষঃস্থলে চেপে ধরলো অনন্তা। মায়ের চিৎকার ভেসে উঠছে ক্ষনিক পরপর তার মেয়ের কানে। কিন্তু মুখ বন্ধ থাকায় কিছুই বলতে পারছে না সে।
অনন্তা তার মেয়েকে ছেড়ে দিলো। মেঝেতে পড়ে থাকা ছুড়ি হাত নিতে যাবে তার আগেই মোহনা হিল দিয়ে অনন্তার হাত উপর দিয়ে জোরেসোরে চাপ দেয়। অনন্তা ব্যথায় চিৎকার করে উঠে,শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায়,মেঝেতে ধপ করে পড়ে যায়। সায়েদ চোখ বন্ধ করে নেয় নিজের। নিজের মৃত্যু প্রতিক্ষণ কামনা করছে সে! এইসব দেখারচেয়ে মরে গেলেই পারতো সে! তার জন্যই তার স্ত্রীর সাথে এমন হলো!
অনন্তার দিকে কেউ নজর দিলো না। আচমকা ছুড়ি দিয়ে মঈনুল সায়েদের দু কান কেটে দিলেন। অনন্তা চোখ খোলা অবস্থায় তা দেখে চেতনা হারিয়ে ফেললো। ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো সায়েদ, কিন্তু মরলো না। কান থেকে রক্ত ঝরছে, সায়েদ ব্যাথাতুর শব্দ করে বলল,’খঞ্জরটা বুকে চালিয়ে দে! মরবোও কিন্তু কষ্ট কম হবে!’
‘এটাই তো আমি চাই! যাতে তোর পরিবার কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরুক।’
‘এতোটা নিষ্ঠুর হস না মঈনুল! সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।’
মঈনুল ওষ্ঠ্য বাকিয়ে হাসলেন। যেনো সায়েদ কোনো মজার কৌতুক শুনিয়েছেন তাকে।
#চলবে?
| আপনারা ধৈর্যহারা হবেন না, এই গল্পটা নিয়ে চমৎকার প্লট ভাবা আমার। গল্পটা শেষ করতে দিন আপনারাও বুঝবেন আমি কি ভেবে রেখেছিলাম। হ্যাপি রিডিং। |