হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -০৮

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_০৮
#আনিশা_নিঝুম

মঈনুল আচমকা সায়েদের বুকে ছুড়ি দিয়ে ছিদ্র করে দেয়। আচমকা হওয়ায় মোহনা চমকে যায়৷ মঈনুলের কাছে তড়িঘড়ি করে যেয়ে বলে,’মারলে কেনো এতো তাড়াতাড়ি?’

মঈনুল তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,’কেন তোর জ্বলেছে বুঝি? যতই হোক তোর প্রেমিককে মারলাম! জ্বলবেই।’

মোহনার মুখে আঁধার নেমে এলো, আমতা আমতা করে বলল,’এমন কিছুই না।’

অনন্তা মাথা ঘুরে তাকালো সায়েদের দিকে। সায়েদের মুখ থেকে স্রোতের ন্যায় রক্ত জড়ছে। অনন্তার রূহ কম্পণ দিয়ে উঠলো, স্তব্ধ হয়ে কেঁদে উঠলো অনন্তা। এতোকিছুর পরও স্ত্রীর কান্না দেখে সায়েদ হাসলো, মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে অনন্তাকে বলল,’আমার কষ্ট দেখলে কাঁদো কেনো তুমি? মিষ্টি লাগে তোমায় খুব।’

সায়েদের কথায় হতভম্ব হয়ে তাকালো অনন্তা। মোহনার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস! সায়েদকে সে পেয়েও তার ভালোবাসা পায়নি আর অনন্তা সেখানে সায়েদের এক আকাশ সমান ভালোবাসা পেয়ে বসে আছে? এটাই কি তবে নিয়তি? মঈনুল বিরক্তি চোখে তাকাল সায়েদের দিকে বলল,’ব্যাটা মরতে মরতেও ন্যাকামো করছে।’

সায়েদ ততক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে আছে। অনন্তা কান্না থামালো, ততক্ষনাৎ পাশ থেকে ছুড়ি নিয়ে তার মেয়েকে উদ্দেশ্যে করে চিৎকার দিয়ে বলল,’নিজের বাবা-মার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে, মা! আজ থেকে তুই আর কারো মুখে এই ডাক শুনবি না! আমার শেষ কথাটা রাখিস এই জানো য়ার দের তাদের প্রাপ্য শাস্তি দিস।’

বলেই নিজের বুকে খঞ্জর চালিয়ে দিলো অনন্তা। গড়গড় করে রক্ত বমি করে দিলো সে,মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মূহুর্তেই। অনন্তা কাজটা এতোই দ্রুত করেছে যে মঈনুল আর মোহনা তাকে আটকাতে পারেনি,মূহুর্তেই তারা স্তব্ধ হয়ে যায়। অনন্তা সায়েদের দিকে তাকালো সায়েদের ঠোঁটজুড়ে সেই মূহুর্তে হাসির রেখা দেখা গেলো! নিজের প্রিয়তমার সাথে মরেও একটা সুখ আছে! যে সুখ সবার কপালে থাকে না। সায়েদ নিঃশব্দে অনন্তার হাতটা স্পর্শ করলো। অনন্তা চেপে ধরলো সায়েদের হাত। সায়েদ অনন্তার চোখে চোখ রেখে উষ্ণ কণ্ঠে বলল,’ভালোবাসি তোনায় অনন্ত!’

অনন্তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো,তবুও মুখে মৃদু হাসি রেখে বলল,’আমিও ভালোবাসি।’

ততক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে নিলো দুজনেই! এতক্ষণ যেনো তারা মৃত্যুর প্রহরই গুনছিলো তাদের! একসাথে পথচলাটা শুরু হয়েছিলো একে অপরের নরম হাতখানা ধরে আর তা শেষ হলো একে অপরের রক্তাক্ত হাতখানা ধরে! নিয়তি নিষ্ঠুরতার মাঝেও এক ভালোবাসা জুড়ে দিয়েছে।

মোহনা চোখ বন্ধ করে নিলো। নিজের মনের একপাক্ষিক সুপ্ত কষ্টটা লুকিয়ে রাখলো হয়তো, মন্থর গলায় মঈনুলকে বলল,’এই মেয়েটার কি করবে এখন? ওকেও মেরে ফেলবে?’

‘ওর জন্য সায়েদের বহুত সম্পত্তি আছে! তা আগে আমাদের নিজের নামে করে নিতে হবে ততদিন ওকে আমাদেরই পালতে হবে।’

মঈনুলের লোভ দেখে আর কিছু বলতে ইচ্ছা করলো না মোহনার, সে শুধু বলল,’রাফাত বাসায় একা আছে, আমি যাচ্ছি। এখানে একটু পরেই হয়তো পুলিশ আসবে।’

মঈনুল আর মোহনা বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। অন্ধকার ফ্ল্যাটজুড়ে শুধু রইলো সেই অসহায় শিশুটি! যে কিনা নিজের চোখের সামনে পিতা মাতার নির্মম মৃত্যু দেখেছে! তার মতো অভাগা পৃথিবী আর দুটো নেই! হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের লাশের কাছে গেলো। রক্তাক্ত মুখখানা স্পর্শ করলো দু/তিনবার। তারপর গেলো বাবার কাছে, বাবার ফর্সা লম্বাটে মুখ খানা স্পর্শ করে, চুমু খেলো গালে। তাদের দুইজনের হাতের মাঝে অজস্রবার চুমু খেলো, তাদের দুইজনের হাত দুটি সরিয়ে অবশিষ্ট জায়গা ঘুচিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো তাদের মাঝখানে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আমি একটা হ্যাপি ফ্যামিলির মেয়ে!’

মেয়েটা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে নিলো।

কারো স্পর্শে চোখ খুললো মেয়েটি। ফ্ল্যাট ভর্তি পুলিশ আর অন্যান্য মানুষদের দেখে খানিক ভয় পেয়ে গেলো। দূর থেকে মোহনা আর মঈনুলকেও বিধ্বস্ত অবস্থায় লক্ষ্য করলো। মেয়েটি ভাবলো তারা মনেহয় ধরা খেয়েছে কিন্তু না তারা দুইজন যখন মেয়েটির কাছে এসে বলল,’আজ থেকে তুমি আমাদের সাথে থাকবে মা, আমরা কোনোদিন তোমায় মা-বাবার অভাব বুঝতে দিবো না।’

মোহনা হাটু ভেঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা হতভম্ব! মোহনা মেয়েটাকে বুকের মাঝে চেপে ধরলো, গাল বেয়ে তার ঝরসে অজস্র জল! শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’পুলিশদের খবরদার ভুলেও কিছুর ইঙ্গিত দিবে না। পুলিশরা যদি আমাদেরও সন্দেহ করে তাহলে সেদিনই তোমার জীবনের শেষ দিন! আর চুপচাপ আমাদের সাথে চলো এখন।’

মেয়েটি বুঝলো এইসবই মোহনার অভিনয় ছিলো। কান্নাটাও অভিনয়, তাকে জড়িয়ে ধরাটাও অভিনয়, তাকে পালার সিদ্ধান্তটাও তাদের অভিনয়ই! দুনিয়ার মানষগুলো কেনো এতো নাটকবাজ? এই দুইজনকে সে ছাড়বে না! নিজের বাবা মার মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে! একদিন তাদের সে করবে নিঃস্ব! যেমনি ভাবে আজ তারা তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে! তার জীবিত থাকার আসল কারণটাই কেড়ে নিয়েছে। তাদের সে কোনোদিনও সুখে বাঁচতে দিবে না! কোনোদিনও না! ক্রোধে চোখদুটো লাল হয়ে গেলো মেয়েটি!

৯.

সব বলে থামলাম আমি! পরিবেশ স্তব্ধ, ঘরজুড়ে পিনপিন নিরবতা। আমার দিকে অবাকতায় তাকিয়ে আছে ত্রিধার।

আমায় তিনি অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,’স্নিগ্ধতা?’

‘হু?’ শান্তস্বরে জবাব দিলাম আমি।

ত্রিধার আমাকে থমথমে গলায় বললেন,’মেয়েটি কে জানো?’

‘কিভাবে জানবো?’

ত্রিধার শান্ত চোখে তাকালেন, আমি সুক্ষ্ম দৃষ্টিপাত মেলে তাকালাম তার দিকে। তিনি বললেন,’সেই অসহায়, অভাগা মেয়েটি তুমি স্নিগ্ধতা!’

ত্রিধারের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আমার সাথে এতো নিষ্ঠুরতা হয়েছে আর আমার মনে নেই কেনো? কেনো বারবার এই কাহিনি স্বপ্নের মাধ্যমে আসতো? কেনো আমার মনে ছিলো না? নাহ! এটা আমি হতেই পারি না! আমি হলে অবশ্যই এটা আমার মনে থাকতো।

আমি ত্রিধারকে অস্বীকার করে বললাম,’মেয়েটা যদি আমি হতাম তাহলে এই কাহিনি আমার মনে নেই কেনো?’

ত্রিধার তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,’কারণ তোমায় প্রতিদিন ড্রাগ’স দেওয়া হতো। আমার সহকর্মী মুমিন আজ তাদের ঢাকার বাসায় গিয়েছিলো। সেখানে ও তল্লাশী নিয়ে জানতে পারে তোমার খাবারের সাথে লুকিয়ে ড্রাগ’স মেশানো হতো আর সেই ড্রাগ’সের কারণেই ধীরে ধীরে তোমার মেমোরি লস হচ্ছিলো কিন্তু পুরোপুরি ভাবে তারা সেটা করতে পারে নি। মুমিনের উদ্দেশ্যে ছিলো মেজর মঈনুল রশীদ আর তার স্ত্রীকে হাতেনাতে ধরতে পারে কিন্তু তার আগেই তারা গা ঢাকা দিয়েছে। খবর নিয়ে জানতে পেরেছে তারা চট্টগ্রামের কোথাও লুকিয়ে আছে তবে বেশিক্ষণ পারবে না লুকিয়ে থাকতে। তারা পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকুক না কেনো তাদের খুঁজে বের করা হবে আর তাদের নিজ থেকে আমি যন্ত্রণা দিয়ে মারবো!’

‘একজন আর্মি ক্যাপ্টেন হয়ে তাদের আইনের হাতে ছেড়ে দিবেন না?’

‘আইন তাদের কি শাস্তি দিবে? বড়জোড় ফাঁসি হবে তবে সেটা যন্ত্রণাদায়ক হবেনা। তারা যেই কষ্ট দিয়ে মেরেছে তোমার বাবা-মাকে তারচেয়েও বেশি কষ্ট দিয়ে মারবো আমি। তারাও বুঝুক মৃত্যুর যন্ত্রণা কি? অনেকদিনই বাঁচলো এইবার শাস্তি ভোগ করে তবেই মরবে।’

ত্রিধারের কথায় আশ্বস্ত হলাম আমি! তার সাথে প্রতিক্ষণ থাকবো বলে জানালাম। ত্রিধার যেনো আমার কথায় খুশি হলো। আমি আচমকা মাথায় একটা প্রশ্ন আসতেই ত্রিধারকে জিজ্ঞেস করলাম,’রাফাতের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে ত্রিধার?’

আমার প্রশ্নে ত্রিধারের ভ্রুকুঁচকে গেলো, তিনি বললেন,’হঠাৎ রাফাতের কথা তুললে কেনো?’

‘না মানে যদি সে এইসবে জড়িত থাকে?’

‘রাফাত নিখোঁজ! ও কোথায় গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে কে জানে? আস্তা ভীতুর ডিম! ওকে পেলে আইনের হাতে তুলে দিবো। আইনই ওকে ওর শাস্তি দিবে।’

ত্রিধারের কথায় হাসলাম। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হওয়ার কথা ছিলো আমার কিন্তু হলো না! হয়তো সে বিশ্বাসঘাতকের সন্তান বলেই তার জন্য কোনো সহানূভূতি মনে জন্ম নেয়নি! বা এর অন্য কারণও থাকতে পারে!

#চলবে?

| পর্বটি কেমন হয়েছে জানাবেন, ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here