হৃদয়জুড়ে বিষন্নতা পর্ব -১১

#হৃদয়জুড়ে_বিষন্নতা
#পর্বসংখ্যা_১১
#আনিশা_নিঝুম

ঘটনার দেড় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে আমার আর ত্রিধারের সম্পর্কটা স্বাভাবিক না হলেও, অস্বাভাবিকতাও নেই। আমরা দুইজনই একে অপরকে সময় দিচ্ছি, নিজেদের বুঝার চেষ্টা চালাচ্ছি, একে অপরের পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখছি। দুই সপ্তাহ হলো ত্রিধার তার ট্রেনিং এ গিয়েছেন। আমার সময় কাটে পলাশী আপুর সাথে। মেয়েটার চেহেরাও দিনদিন উজ্জ্বলতা ফিরে আসছে! এটা কি ভালোর লক্ষণ? হয়তো! পলাশী আপুর জীবনে নতুন কেউ আসুক এটা আমি খুব করে চাই! নয়ন ভাইকে মনে রেখে সে নতুন করে জীবন শুরু করুক, নতুন করে কাউকে ভালোবাসুক! পরোক্ষভাবে এই কয়েকদিনে বহুবার পলাশী আপুকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু সে বিষয়টা খুব সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে চলে। তাই আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি।

শুক্রবার,
পলাশী আপুকে সাথে নিয়ে আজ বাজার করতে বেরিয়েছে। প্রায় একমাস পর ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। একমাস ত্রিধারের ভারী নিষেধাজ্ঞা ছিলো বের হওয়া নিয়ে তার মতে বাড়ি থেকে বের হওয়া মানেই আমাদের বিপদ! তার আমাদের নিয়ে ভীষণ ভয় লাগে! তার ভয়ের কারণটা আমি আর পলাশী আপু বেশ বুঝতেই পেরেছি তাই প্রশ্ন করি না কোনো।

‘স্নিগ্ধ, তুই ভীড় ঠেলে প্রবেশ করতে পারবি না, তুই বরং এইখানেই আমার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর। আমি কিছুক্ষণের মাঝেই আসছি।’

কথাটা আমাকে পলাশী আপু উদ্দেশ্যে করে বললেন। আমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম! আসলেই আমি ভীড় সহ্য করতে পারি না। মাথা ঘুরায়! ভীড়ে মানুষের শরীরের বিশ্রী গন্ধে বমি আসে! সেই থেকে ভীড়ে যাওয়া দূরে থাক ভীড়ের নাম শুনলেও আমার গা গুলিয়ে বমি আসে। পলাশী আপু যেতেই আমি আশেপাশে হাঁটা শুরু করলাম। যা ভীড় মনে হয় না পলাশী আপু আধা ঘন্টার মধ্যে ফিরতে পারবেন তারচেয়ে একা একা দাঁড়িয়ে না থেকে আশপাশ ঘুরি। হাঁটতে হাঁটতে বিশাল এক গাছের সামনে আসলাম! গাছটার ছায়াতলে আসতেই আমার মুখমণ্ডলে রোদ্দুর প্রবেশ করলো না। বাতাসে গাছের ডাল নড়ে দু একটা পাতা আমার মাথার উপর এসে পড়লো। মাথা থেকে পাতা হাতে নিলাম আমি।

‘স্নিগ্ধ!’

আকস্মিক ডাকে ভ্রুকুঁচকে এলো আমার। সেই পরিচিত কণ্ঠ! যেই কণ্ঠের প্রেমেই পড়েছিলাম আমি! সে কি তবে ফিরে এসেছে? কেনো এসেছে? চকিত নয়নে তাকালাম তার দিকে।

রাফাত! বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার দিকে। চাদরে মোড়ানো তার সারা শরীরে,মুখমণ্ডল অর্ধভাগে ঢাকা!

রাফাত ফের শীতল কণ্ঠে বলল,’স্নিগ্ধ! শুনছো?’

আমি আড়ষ্ট কণ্ঠে জবাব দিলাম,’হু,শুনছি।’

বলেই নিচে তাকালাম। রাফাত এগিয়ে আসলো কিঞ্চিৎ, ধরা গলায় বলল,’আমাকে মাফ করে দিও।’

‘কেনো?’

‘বিশ্বাস করো, আমি পালিয়ে যাইনি, আমাকে তোমার স্বামী আফশান ফায়াজ উধাও করেছিলো। সে আমাকে বাধ্য করেছিলো তোমায় ছাড়তে।’

‘আফশান ফায়াজ?’
চকিত চোখে তাকালাম আমি। সেদিনও ত্রিধার আফশান নাকি কি যেনো বলছিলো! আমি প্রশ্ন করতেই বিষয়টাকে খুব সুন্দর করে এড়িয়ে চলে তাই অতটা ঘাটাই নি আমি।

‘হ্যাঁ! আফশান ফায়াজ! তোমার স্বামী ত্রিধারের নাম। কেনো জানো না তুমি?’

‘জানলাম।’ উত্তর দিলাম আমি।

‘আফশান রাস্কেলটা তোমায় ঠকিয়েছে!’

এই কথা শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মনে মনে আঘাত পেলেও তা প্রকাশ করলাম না! রাফাত নিশ্চয়ই আমাকে ভড়কানোর চেষ্টা করছে! আমি তো জানি ত্রিধার এমন না! ত্রিধার ভীষণ ভালো মানুষ! তিনি মরে যাবেন কিন্তু আমায় ঠকানোর কথা কোনোদিন কল্পনায়ও আনতে পারবেন না। এই মূহুর্তে রাফাতকে বিশ্বাস করা মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। আমি রাফাতকে বিশ্বাস করবো না কিছুতেই না! একবার ঠকেছি বলে বারবার ঠকবো না! কক্ষনো না। আমি রুক্ষ কণ্ঠে রাফাতকে বললাম,’রাফাত আমি কিছু শুনতে চাই না! তুমি চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। তোমাকে দেখার মতো রুচি নেই আমার।’

রাফাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,’সত্য কথা তিতো লাগে স্নিগ্ধ!’

আমি অগ্নিদৃষ্টিতে রাফাতের দিকে তাকালাম, উচ্চস্বরে বললাম,’খবরদার তোমার ওই পাপী, অপবিত্র মুখে আমার নাম নিয়ে আমার নামকেও অপবিত্র করে দিও না! তোমাকে আমি সাবধান করছি রাফাত। এই মূহুর্তে তুমি যাবে নয়তো আমি আমার বাজে রূপ প্রকাশে বাধ্য হবো।’

‘স্নিগ্ধতা, তুমি চাইলে আমি চলে যাবো এই মূহুর্তেই তবে আমার কথাটা শুনো! এই অধম তোমাকে কিছু বলতে চায়! একমাস ধরে তোমাকে সব রহস্যের সমাধান করার জন্য পায়তারা খুঁজছি কিন্তু আফশান ফায়াজের ধূর্ততার সাথে আমি নিছকই একটা কীট!’

‘কীসের রহস্য? কীসের সমাধান! রাফাত?’

‘আফশান ফায়াজ নিজের পরিচয় তোমার কাছে কেনো লুকিয়েছো জানো?’

আমি নিজেকে সামলে বললাম,’কেনো লুকিয়েছে?’

‘কারণ কয়েকদিনের মাঝেই সে তোমায় ডিভোর্স দিবে। তার মতে আমিও একজন খারাপ মানুষ! তোমাকে বিয়ে করার আসল উদ্দেশ্যে আমার থেকে বাঁচানোর। ও তোমায় ছদ্মবেশে বিয়ে করে। ছদ্মবেশেই চলাফেরা করে তোমার সাথে! ও তোমাকে বাঁচিয়ে ফেলেছে তাই কয়েকদিন পরেই তোমায় ডিভোর্স দিবে, আমাকে যখন ও আটক করে রেখেছিলো তখন একজন উকিলের সাথে কথা বলতে শুনেছিলাম। এই কথাটা তুমি বিশ্বাস করবে না জানি! কিন্তু এটাই সত্য স্নিগ্ধতা। আফশান তোমাকে বাঁচাতে বাঁচাতে পুরো তুমিটাকেই মে রে দিবে।’

রাফাতের সাথে আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি। কিছু বলার মতো নেই আমার। মুখের পুরো ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। রাফাত হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে বলে,’আফশান ফায়াজ আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আফশান টানা দুই সপ্তাহ আমাদের না খাইয়ে রেখেছিলো, এক ফোটা পানি ব্যতীত এই দুই সপ্তাহ কোনো খাবার জোটেনি।’

১৪.

মঈনুলের অবস্থা বেশ খাবার। দুই সপ্তাহের মধ্যেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছেন। শরীরের হাড্ডি বিদ্যমান! দুইদিনে এক ফোটা করে পানি পান! কিন্তু ওই পানি দিয়ে কি লাভই হবে? আফশান তাদের বাঁচিয়েও প্রতিদিন অত্যাচার করছেন। তাদের শরীরের জায়গায় জায়গায় মারের চিহ্ন বসে গিয়েছে।

‘মেজর মঈনুল এইবার আপনাকে মুক্তি দিয়ে দেই কি বলেন?’

ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলল আফশান। মঈনুল ভাবলো এইবার মনে হয় তার সাজা মাফ! তার চোখখানা খুশিতে চকচক করে উঠলো তা দেখে বক্র হাসলো আফশান। সে চেয়ারটেনে মঈনুল আর রাফাতের সামনে বসে বলে,’আজ, এই মূহুর্তেই মউক্তি দেবো আপনায় মেজর মঈনুল রশীদ।’

রশীদের মুখে হাসি। আফশানও হাসলো। রাফাত ঢোক গিলে প্রশ্ন করলো,’আমাকে মুক্তি দিবেন না?’

‘তোকেও দিবো আরো পরে।’

আশাহত হলো রাফাত। হতাশভরা দৃষ্টিতে তাকালো বাবার দিকে সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করলেন মঈনুল! তিনি বাঁচতে পারছেন তাতেই হয়েছে! মঈনুল বললেন,’দাও বাবা আমার হাতখানা খুলে দাও। বাড়িও যেতে হবে।’

আফশান প্রতুত্তরে হাসলো। উঠে এসে ছুড়ি মঈনুলের হাত খুলে দিবে তখনই ছুড়িটি গলায় চেপে ধরলো আফশান। মঈনুল ব্যথাতুর শব্দ করে উঠলেন ধারালো ছুড়ির আঘাতে। ছুড়ির জন্য গলা চামড়া ছিলে দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে,গলার সাথে জোরে চেপে ধরলো আফশান। চিল্লিয়ে উঠলো মঈনুল। আফশান ছুড়িয়ে সরিয়ে নিলো। গলা থেকে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মঈনুল।

মঈনুল নিজেকে সামলে ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলে উঠেন,’তুমি না বললে মুক্তি দিবে?’

‘বলেছিলাম তবে সেটা পৃথিবী থেকে! এখান থেকে নয়।’

আতকে উঠলো মঈনুল! ব্যথায় শব্দ করতে পারলেন না আর। আফশান আবারো এগিয়ে ছুড়ি চেপে ধরলো মঈনুলের হাতে। হাতের চামড়াতে বারবার আঘাত করলো, এক এক করে দুই হাতের দশ আঙ্গুল ভেঙ্গে ফেললো। ব্যথায় চেয়েও শব্দ করতে পারলেন না মঈনুল। চুপ থেকে ব্যথা সহ্য করে নিচ্ছেন। রাফাত সব দেখে ভয়ে চুপ আছে। কিছু বললে হয়তো এখন তাকেও আউট করে দেওয়া হবে পৃথিবী থেকে তাই কিছু না বলাই শ্রেয় হলো তার।

আফশানের হুকুমে দেহরক্ষী একটা ড্রিল মেশিন নিয়ে এসেছে। তা দেখে মঈনুল ও রাফাত দুইজনই আতকে উঠলো। ভয়ে দুইজনই থরথর কাঁপতে শুরু করলো! কি হতে যাচ্ছে তাদের সাথে? মঈনুলের কলিজার অবশিষ্ট পানিটুকু শুকিয়ে গেলো ভয়ে। ভয়ে তিনি এক লজ্জাজনক কাজ করে বসলেন! নিজের প্যান্ট ভিজিয়ে ফেললেন মঈনুল! আফশান হাসলো তা দেখে! কি ধারালো হাসি তার! এই হাসিই এক জলজ্যান্ত মানুষকে ভস্ম করে দিতে সক্ষম!

চলবে….

| এলোমেলো পর্বটি কেমন হয়েছে জানাবেন🌼 |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here