হৃদয়ে লুকোনো প্রেম পর্ব -০১

ভালোবাসার মানুষটির বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে স্তব্দ হয়ে দাঁড়ায়ে আছে অরিদ্ধি। তার সামনের সোফায় বসে তার মুখ পানে চেয়ে মুচকি হাসছে তার ভালোবাসার মানুষটি। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা বিয়ের কার্ড টার দিকে দৃষ্টি দেয়।সাদার মধ্যে সোনালী রঙের ডিজাইন করা। বেশ গর্জিয়াস লুক।
কার্ডটা খুলে দেখার সাহস পাচ্ছে না সে।বিষ্ময় নিয়ে ড্রইং রুমে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে আছে।

রিদ্ধি ইয়াশের বিয়ের কার্ডের ডিজাইন পছন্দ হয়েছে তো?

অরিদ্ধী খালামনির দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল।সে যেনো জ্ঞান শূন্য।আশে পাশের কারো কথাই তার কানে যাচ্ছে না।

অরিদ্ধি কার্ডটা খালামনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে কলেজের জন্য বের হয়ে গেল। কাউকে কিছুই বললো না।

মেয়েটা কিছু না বলে চলে গেল কেন?

আসলে আপা ওর দেরি হয়ে যাচ্ছিলো।তাই তাড়াহুড়ো করে কিছু না বলেই চলে গেল। আসলে দেখবা ইয়াশের বিয়ে নিয়ে কত যে হইহুল্লোড় করবে।রিদ্ধি তো আমাকে পাগল করে ফেলছিল অনেক দিন বিয়ের দাওয়াত খেতে পাচ্ছে না দেখে।
বলেই হাসলেন মিসেস সিফা।

ইয়াশ সোফায় বসে অবাক হয়ে অরিদ্ধির মুখের মিলিয়ে যাওয়া হাসির কথা ভাবছে।ইয়াশের বিয়ের কার্ড হাতে পেতেই মেয়েটা কেমন চুপসে গেছে। হঠাৎ করে ওর আবার কী হলো বুঝতে পারছে না ইয়াশ।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অরিদ্ধি। বুকের বা পাশে কেমন যেন একটা চিন চিন ব্যাথা করছে।এই রকম একটা অশান্তির ছোঁয়া সে কখনো পায়নি।এই যে বুকের মাঝে বয়ে যাওয়া ঝড় এটা কী প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার শোকে বইছে?
কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার বাড়িতে ও ফিরতে ইচ্ছে করছে না। সকাল থেকে কত আশা নিয়ে ছিল তার একতরফা ভালোবাসার মানুষটি আসবে আজ।কত গুলো দিন পর চোখের সামনে ঘুর ঘুর করতে দেখবে তার ইয়াশ নামক ভালোবাসা কে। সকাল থেকেই মনটা ফুরফুরে ছিল। এক নিমিষেই সব ভালো লাগা হারিয়ে গিয়ে খারাপ লাগায় পরিনত হলো।

মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে রিকশায় উঠে বসে অরিদ্ধি। কলেজ গেইটের সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কলেজের ভেতরে চলে যায়।ক্লাসে এসে একেবারে শেষে গিয়ে বসে থাকে। অথচ এই অরিদ্ধি ক্লাসে আসলেই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিতো।অরিদ্ধিকে এমন মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে তার বেস্ট ফ্রেন্ড রিমি এগিয়ে গিয়ে অরিদ্ধির হাত ধরে টেনে বলে,
কী হয়েছে তোর?
কিছু না।

মিথ্যা বলছিস কেন?
আন্টি বা আঙ্কেল বকা দিয়েছে?

আব্বু আমাকে কখনো বকেছে?

না তা বকেনি। তাহলে কি হয়েছে বল?

কিছু হয়নি বললাম তো।

অরিদ্ধি আমার কাছে লুকানোর কী আছে?

কিছু হয়নি আমার বলেছি না একবার।এত জোর করছিস কেন?যা এখান থেকে।আমাকে একটু একা থাকতে দে।
একটু পরেই স্যার আসবে অরিদ্ধি।মুড ঠিক কর। বলেই রিমি চলে গেল।
অরিদ্ধির বেশ কান্না পাচ্ছে।
ইয়াশ ভাইয়া তুমি কেন আমাকে ভালোবাসো না? আমি তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমার সাথে আমি অন্য কাউকে সহ্য করতে পারবো না।মরেই যাবো আমি।
.
কলেজে মন খারাপ করেই কাটে অরিদ্ধির। সবাই শুধু জিজ্ঞেস করে গেছে যে,
কী হয়েছে?আর সবাই কে অরিদ্ধি একটাই উত্তর দিয়ে গেছে।
কিছু না। এমনিতেই ভালো লাগছে না।

বাড়িতে ফিরে মনটা আরো এক দফা খারাপ হয়ে গেল অরিদ্ধির।যখন দেখলো তারই রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইয়াশ তার হবু বউয়ের সাথে প্রেমে লিপ্ত। তাদের প্রেমালাপ এর কথোপকথন গুলো কানে যেতেই ধপ করে নিভে গেল অরিদ্ধি।ঝড়ে যেমন করে জলন্ত প্রদীপ নিভে যায় ঠিক তেমনি করে নিভে গেল অরিদ্ধি।

কলেজ ড্রেস না খুলেই ছাদে ছুটে যায় অরিদ্ধি। মানুষ টা আমাকে মেরে ফেলা অব্দি শান্তি পাবে না হয়তো। ছাদের চিলে কোঠার পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে হাঁটতে মুখ গুঁজে কান্না করে দেয় অরিদ্ধি।

মিসেস সিফার জোরাজুরিতে থেকে যেতে বাধ্য হয় ইয়াশ এবং তার মা।
বিয়ের এত কাজ বাকি এখন কী বেড়ানোর সময় সিফা?

আমি তো বেড়ানোর কথা বলছি না। বিকেলের দিকে চলে যেও।
দুপুরের খাবারের বেশ রমরমা আয়োজন করেছেন মিসেস সিফা। সবাই খাবার টেবিলে বসলে ইয়াশের মা মিসেস শেফালী বলে উঠলেন,

ইয়াশ কোথায় গেল?আর রিদ্ধি কলেজ থেকে ফিরে আবার কোথায় চলে গেল? খাবে না ওরা?
এমন সময় অরিদ্ধি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। মিসেস সিফা অরিদ্ধি কে দেখে বললেন,

রিদ্ধি ইয়াশ কোথায় একটু দেখতো।ওকে একটু ডেকে দে। খাবার খাবে সবার সাথে। তুই ও গোসল করে খেতে আয়।

অরিদ্ধি মায়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে রুমে চলে গেল।ইয়াশের সামনে গেলেই এখন চোখ থেকে গড় গড় করে পানি বের হয়ে আসবে। তবু ও মন কে শক্ত করে ব্যালকনিতে গেল অরিদ্ধি।

ইয়াশ তখনো ফোনে কথা বলে যাচ্ছে।অরিদ্ধি শান্ত গলায় ডাকলো,
ইয়াশ ভাইয়া,,,,

ইয়াশ অরিদ্ধির দিকে ফিরে তাকালো। তার পর ফোনে বললো,
ইমা আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি। বলেই কল কেটে দিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে অরিদ্ধির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
বল কি বলবি রিদ্ধি?

অরিদ্ধি মাথা নিচু করে বললো,
মা তোমাকে খেতে ডাকছে।

ওহ আচ্ছা। তুই কখন আসলি?আর আমি তোর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম দেখে কিছু মনে করিস না।

আরে না না।কী যে বলো না ভাইয়া।
ইয়াশ মুচকি হেসে চলে যেতে নিলে অরিদ্ধি পেছন থেকে ডেকে বললো,,
বিয়ে কত তারিখে তোমার?

ইয়াশ পেছনে ফিরে তাকিয়ে বললো,
বিয়ের কার্ডে দেওয়া আছে সব কিছু দেখে নিস। বলেই ইয়াশ চলে গেল।

অরিদ্ধি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাভার্ড থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।এক ঘন্টার একটা গোসল লাগবে। অশান্তি গুলোকে কিছু টা দূর করতে।
.
.
পড়ন্ত বিকেলে ছাদের দোলনায় আনমনে বসে দোল খাচ্ছে অরিদ্ধি।চুল গুলো এখনও ভেজা। অবশ্য ভেজা থাকারি কথা। মাত্র ৪০ মিনিট আগে গোসল শেষ করে বের হয়ে ছাদে চলে আসে। ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসার সময় বসার ঘর থেকে মা চিল্লিয়ে জিজ্ঞেস করে ছিলেন,
খেয়েছে কিনা?
অরিদ্ধি ছোট করে উত্তর দিয়েছিল,
খিদে নেই।

মন ভর্তি অশান্তি নিয়ে কী পেট ভর্তি করে খাবার খাওয়া যায়?গলা দিয়ে নামতে চায় না তো। সবাই তো আর অন্তর্জামি না। মনের ভেতরর কথা গুলো চুপটি করে বুঝে নিবে।

ছাদের উপর থেকে নিচের চিল্লাচিল্লি শুনতে পাচ্ছে অরিদ্ধি।ইয়াশরা চলে যাচ্ছে।নিচ থেকে খালামনি ডাকছেন।রিদ্ধি মা,,,,

রিদ্ধি চরম বেয়াদবি করলো আজ।নামলো না। ছাদের দোলনায় চুপ করে বসে রইলো আকাশের দিকে তাকিয়ে।সে ইয়াশের বড় বোন ঐশি আপুর কাছ থেকে শুনেছিল, পড়ন্ত বিকেলের লাল, নীল হলুদ রঙা আকাশ ইয়াশের ভীষণ প্রিয়।সে আগে ভাবতো এই আকাশ কে এত প্রিয় করে কেন মানুষ?

আজ যেনো সেই প্রশ্নের উত্তর টা নিজে থেকেই এসে ধরা দিলো। জীবনে অনেক মানুষ আসবে যাবে ঠিক মেঘেদের মতো।আর নিজেকে স্থির থাকতে হবে ঠিক আকাশের মতো।
.
.
চার দিকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। মসজিদের মাইক থেকে কী সুন্দর ধ্বনি ভেসে আসছে।শহর জুড়ে কর্কশ গলায় কাকের কা কা শব্দের বিরক্তিকর ডাক। পরিযায়ী পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। মিসেস সিফা বেশ রেগে আছেন।এই ভর সন্ধ্যায় মেয়েটা এখন ও ছাদ থেকে নেমে আসেনি।

খালামনি এত করে ডেকে ছিল একটু শোনার সময় ও হয়নি এই মেয়ের।দিন দিন এত অসভ্য হচ্ছে। মিসেস সিফা দ্রুত সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন।অরিদ্ধি কে বেশ বকতে বকতে চললেন।

দোলনায় বসে থাকা অরিদ্ধির কাছে যেতেই চুপ হয়ে গেলেন মিসেস সিফা। মেয়েটা বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে।মেয়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখে মায়া হলো তার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকলেন,
রিদ্ধি মা উঠ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।আজান দিচ্ছে চার দিকে।এই সময় ছাদে এই ভাবে ঘুমানো উচিত না।

অরিদ্ধি নড়ে চড়ে উঠলো। চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে উঠে বসলো।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
সরি আম্মু। আমি বুঝতে পারিনি এখানে ঘুমিয়ে পড়বো। সরি।

কিছু হয়নি মা।নিচে চল।অরিদ্ধি চোখ কচলে চুলে খোঁপা করে মায়ের পেছনে পেছনে নিচে চলে গেল। কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি সে।

মিসেস সিফা আর কিছু বললেন না মেয়েকে। ঘুমিয়ে পড়ার কারণে হয়তো খালামনির সাথে দেখা করতে পারেনি।

রাতে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অরিদ্ধি।ফ্যানের বাতাসে চুল গুলো উড়ছে।চোখে মুখে এসে জমা হলেও আজ বিরক্ত হচ্ছে না অরিদ্ধি।
শুধু চোখ বন্ধ করে ভাবছে,
সে আমার হবে না।
সে অন্য কারো হবে।

চলবে,,,,,

#হৃদয়ে_লুকোনো_প্রেম♥️
#সূচনা_পর্ব🍀
#আরাদ্ধা_মেহেনাজ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here