হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে পর্ব ২৯+৩০

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ২৯+৩০
#কায়ানাত_আফরিন

মৌনির অস্থিরতায় ক্রমশ অন্যরকম হয়ে উঠেছে এই নীরব পরিবেশ। হ্যাঁ! সেটা রিদানকে দেখেই। একপলক মৌনি ভুলেই গিয়েছিলো যে এখানে নিভ্রও আছে । তাই রিদানকে দেখে ওর দেওয়া সেই আঘাতগুলোর কথা মনে পড়তেই নিঃশ্বাস ক্রমশ ঘন হয়ে আসে মৌনির। আবারও তাই কাঁপাকাঁপা গলায় মৌনি বলে উঠলো,

–”আ-আ-আপনি ক-কেনো এ-এসেছেন?”

মৌনি পিছিয়ে যাচ্ছে একপা একপা করে। নিভ্রর দিকে তাকিয়ে করুন দৃষ্টিতে বললো,

–”আপনি কিছু বলুন না ! আ-আমি উনার সাথে যাবো না। কিছু বলছেন না কেন?”

শেষের কথাটা মৌনি একপ্রকার উচ্চস্বরে বলে উঠলেও নিভ্র নির্বিকার। রিদানের প্রতি মৌনির যেই ভয়টা আছে যেভাবেই হোক সেটা কমাতে হবে। তা না হলে এই ভয়টা কখনোই কাটবে না। রিদান আস্তে আস্তে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। পেছন পেছন মৃধাও। মৌনিকে এতটা ভীত হয়ে থাকতে দেখে একটু মায়া লাগলো মৃধার। মেয়েটার ভয় পাওয়াটা জায়েয আছে।

মৌনি এবার গিয়ে নিভ্রর হাত খামচে ধরলো। চোখ দুটো আক্রোশে লাল হয়ে গিয়েছে। চোখের পানিগুলো টলমল করছে। এই বুঝি রিদান আগের মতো ওর হাতে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরলো। মৌনি একবার নিভ্রর দিকে তাকাচ্ছে তো একবার রিদান আর মৃধার দিকে। এবার নিভ্রকে বললো ,

–”প্লিজ ও-ওদেরকে ফ-ফিরে যেতে ব-বলুন না ! কেন আবার আমার লাইফে ফ-ফিরে আসছে।”

–”হুশশ ! শান্ত হও।”

–”আরে কিভাবে শান্ত হবো আমি?”

এবার চিৎকার করে বললো মৌনি। মৌনির এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার রিদান মৃধাকে বিভ্রান্ত করে তুললেও নিভ্রর কোনো হেলদোল নেই। নিভ্র এবার শক্ত করে মৌনির হাত চেপে সোফায় বসিয়ে দিলো। তারপর কোমল কন্ঠে বললো ,

–”রি-রিদান কি হ্যাঁ?বাঘ না ভাল্লুক? এত ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। আজ তুমি শান্ত হয়ে বসো। রিদান তোমার কিচ্ছু করবে না। একবার কথা বলেই তো দেখো।”

নিভ্রর কথায় একপ্রকার আশ্বাস ছিলো। যার জন্য মৌনি শান্ত হয়ে যায়। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করছে। নিভ্র এবার সরে এলো মৌনির কাছ থেকে। ইশারায় রিদানকে ইঙ্গিত দিলো। রিদানের বুকে এবার কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। নিজেকে এই মুহূর্তে যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করলো সে। মৌনি এখন শান্ত থাকলেও মনের ভেতর চলছে উথাল-পাতাল ঝড়। রিদান এবার শান্ত পায়ে মৌনির নিকট হাটু গেড়ে বসে পড়লো। চোখের দৃষ্টি নিচের দিকে। মৌনি বেশ অবাক হয়েছে হঠাৎ রিদানের এরূপ আচরণে। এতক্ষণ উত্তেজিত এই বসারঘরে চলছে অন্যরকম এক নিস্তব্ধতা। যার কোনো ভাষা নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিদান। নীরবতা কাটিয়ে সে আচমকা বলে উঠলো ,

–” I’m sorry মৌনি !”

মৌনির মনে বয়ে যাওয়া ঝড় রিদানের একটা বাক্যের জন্য যেন মিলিয়ে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো রিদানের দিকে। রিদান একপলকের জন্যও মৌনির দিকে চোখ তুলে তাকায় নেই। ফর্সা মুখটাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অনুতপ্তের ছাপ। মৌনির কাছে কিছুক্ষণ সবকিছু কেমন যেনো ধোঁয়াশা মনে হলো কিন্ত রিদানের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মৃধা আর মৃধার ঠিক বিপরীত পাশে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ানো নিভ্রকে দেখে তো মনে হচ্ছে যে রিদান আসলেই সিরিয়াস।

রিদান আবার বললো,

–”আমি জানি যে আমি যা করেছি তা হয়তো ক্ষমার যোগ্য না। বাবাকে এসব ঝামেলা থেকে বাঁচানোর জন্য ভালো মন্দ এসব কিছু একটা মুহূর্তের জন্যও আমি ভাবিনি। একটাবারও ভাবিনি যে আমার বাবা ভুল ছিলো আর তুমি সঠিক। শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিলো যে আমার বাবার পথের কাটা তুমি তাই তোমায় জোরপূর্বক ইনজেকশনের ডোজ দিয়েছি। তোমায় টর্চার করেছি আর হাতে সিগারেট………….(আর কিছু বলে না)কিন্ত আমি শুধরে নিতে চাই লেই ভুলগুলো। এই অন্ধকার অধ্যায় পেরিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে চাই। ”

–মৌনি নিশ্চুপ।

–”আমি জানিনা তুমি আমায় ক্ষমা করবে কি-না কিন্ত তোমায় সরি বলা আমার প্রয়োজন ছিলো। তারপর আর কখনোই তোমার লাইফে আমি আসবো না। চলে যাবো অনেক দূরে।”

মৌনি এখনও স্তব্ধ হয়ে আছে। মৃধা তাই বললো,

–”আপু দাভাই কে কি একটা সুযোগ দেবে? আমি নিশ্চয়তা দেবো সে কখনোই তোমার লাইফে আর আসবে না।”

–”তার কোনো প্রয়োজন নেই।”
মৌনির দ্বিধাজনিত কন্ঠ। নিভ্র এবার ওদের কথার মাঝে এগিয়ে আসলো। মৌনিকে বললো,

–”প্রয়োজন নেই মানে?”

–”এর মানে এটা যে আমি উনাকে মাফ করে দিয়েছি। তবে মৃধার কোনো নিশ্চয়তা দিতে হবেনা। রি-রিদান?”

–”বলো?”
রিদানের প্রতিউত্তর।

–”আমি আপনাকে মাফ করলাম। আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন এটা অনেক কিছু। আমি জানিনা কে আপনার পরিবর্তনে এতটা ভূমিকা রাখলো তবে এটাই বলবো যে যে-ই আপনার জীবনে এতটা পরিবর্তন এনেছে কখনোই তাকে ছেড়ে যাবেন না। নতুনভাবে শুরু করুন আপনার জীবন।”

রিদান এবার মৃধার দিকে তাকালো। এই মেয়েটাই তার জীবনে বড় একটা পরিবর্তন এনেছে। রিদান ইশারায় সম্মতি জানালো মৌনিকে।
মৌনির আনন্দ লাগছে। হ্যাঁ খুব আনন্দ লাগছে। রিদানের রাতারাতি পরিবর্তনটা মানা ওর জন্য বেশ কষ্টের হলো এতটুকু আজ বুঝতে পারলো যে , পরিস্থিতি আর মানুষ হুট করে একজনকে বদলে দিতে পারে। মৃধা এবার এগিয়ে আসলো মৌনির দিকে। তারপর নরম কন্ঠে বললো,

–”আপু ! হয়তো আমাদের পরিচয়ের সময়টা খুব সীমিত । জানিনা আজকের পর কি তোমার সাথে আমাদের দেখা হবে কি-না। এটাও জানিনা যে আমাদের মনে রাখবে কি না কিন্ত তোমাকে আমরা মনে রাখবো। একটা অনুরোধ রাখবে?”

–”বলো?”

মৃধা একপলক নিভ্রর দিকে তাকায়। নিভ্র অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একটা প্রশান্তির হাসি। মৃধা তারপর মৌনিকে বলে উঠলো ,

–”নিভ্র ভাইয়া কে সবসময় ভালোবেসে যাবে। কখনোই ভাইয়ার ওপর রাগ-অভিমান রাখবে না। হয়তো সে তোমাকে প্রকাশ্যে তার অনুভূতিগুলো নাও বলতে পারে কিন্ত এটা সত্য যে নিভ্র ভাইয়ার মতো তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। আর তুমিও যে নিভ্র ভাইয়াকে ভালোবাসো এটা আমি মানি। তাই আমি সবসময় চাইবো তোমাদের একটা সুন্দর পরিণতি হোক।
ভালো থেকো। আজ আমরা এখান থেকে চলে যাবো। অনেক দূরে।”

একথা বলেই মৃধা আর রিদান চলে যায়। মৌনি এখনও সোফায় বসে আছে। চোখটা হঠাৎ ভিজে অনুভব করতেই বেশ অবাক হলো মৌনি। এটা কি সুখের কান্না নাকি ওদের চলে যাওয়ার দুঃখের?
নিভ্র এবার মৌনির কাছে হাটুগেড়ে বসে। নিজের হাত দিয়ে আগলে ধরের মৌনির দুই হাত। কোমল কন্ঠে বলে ওঠলো ,

–”তুমি খুশি তো মৌনিপরী? তোমার এখন আর কোনো ভয় নেই। পুরোনো সব কিছু ভুলে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করবে। মনে করবে ওগুলো সব তোমার তিক্ত অধ্যায়।”

মৌনি নীরব।

–”এখন এসব কিছু ভুলে আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হও। নিজেকে যোগ্যতাসম্পন্ন করে তোলো যাতে তুমি মানুষদের নয় , মানুষ যেনো তোমাকে গুরুত্ব দিতে পারে। পারবে তো?”

–”হুম ! ”

–”নিজেকে এই সমাজে একবার প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে কেউ তোমায় বাঁধা দিবে না। তখন আমি কেন , হাজারটা নিভ্র তোমার প্রমে হাবুডুবু খাবে।”

–”আমারতো হাজারটা নিভ্রর প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন আমার সামনে যেই নিভ্র বসে আছে। মৌনিপরীর নিভ্র !”

নিভ্র ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো মৌনির বাচ্চামো কথায়। অনুভূতির বেড়াজাল দুজনকে আবদ্ধ করে ফেলেছে। হয়তো সবকিছুর শুরু হচ্ছে আবার নতুনভাবে।
.
.
.
৩৯.
শহরের আকাবাকা গলিতে চলছে আলো আধারের খেলা। গাছপালার সমারোহ কম হলেও উচু উচু আবাসিক ভবনের পাল্লায় এই ঢাকা শহরকে অচেনা নগর মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে রিক্সার অবাধে বিচরণ। রাস্তার কোল ঘেষে তৈরি করা ফুটপাতে হেটে চলছে রিদান আর মৃধা। দুজনের মধ্যে রেয়েছে স্বাভাবিক দুরত্ব। রাস্তার হলদেটে আলোতে রিদানের কাছে মৃধাকে বেশ মায়াবী লাগলো। শ্যামবর্ণের সাথে এধরনের আলোর মিশ্রনে মৃধাকে মনে হচ্ছে অপ্সরী।

রিদান এবার মৃধাকে বললো,
–”জানিস মৃধা আজকের মতো এতটা খুশি আমি শেষ কবে হয়েছিলাম মনে নেই আমার।”

–”কেন?”

–”ভালোবাসা আর সহানুভূতির ভীড়ে আলাদা একটা আনন্দ আছে যেই আনন্দটা হয়তো অতীতে আমার ভাগ্যে ছিলো না।”

–”এখন আছে বুঝি?”

–”আছেতো !”

–”কিভাবে?”

রিদান এবার মৃধার হাত আঁকড়ে ধরলো।মৃধা হঠাৎ রিদানের স্পর্শে কেমন যেন উদাসীন হয়ে গিয়েছে। তাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকলো মৃধা রিদানের দিকে। রিদান বললো,

–” হাতটি ধরে। এই হাতের মালিকের ভালোবাসার কাঙাল হয়ে গেছি রে!”

–”সে যদি নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়?”

বিদ্রুপ কন্ঠে বললো মৃধা। রিদান তাই মৃধার হাত আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে বললো,
–”আমি তাকে যেতে দিবো নাকি। এত এত ভালোবাসবো যে আমায় ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনাও করতে পারবে না।”

লজ্জায় মিলিয়ে যায় মৃধা। মেয়েটার এই রূপ দেখে রিদানের ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত একটা হাসি ফুটে উঠলো।তাই মৃধাকে বললো,

–”তুই লজ্জা কেনো পেলি মৃধা? আমি কি তোকে বলেছি? আমি তোএই হাতজোড়ার মালিকের জন্য বলেছি।”

–”দাভাই এটা কিন্ত বেশি ফাজলামি হয়ে যাচ্ছে।”

–”আবার দাভাই বললে তোর মুখ আমি সিলি করে দেবো। তখন মুখে উম উম ছাড়া কিছুই করতে পারবি না।আজ থেকে দাভাই ডাকা শেষ । রিদান বলে ডাকবি।”

–”আমি পারবো না।”

–”কেন পারবি না? অভ্যেস কর !”
রিদান কড়া গলায় বললো।

–”তোমাকে আমি ছোটবেলা থেকে দাভাই বলে ডেকেছি। হুট করে এঅভ্যাস চেন্জ করা যায় নাকি !”

–”হুট করে তুই যদি আমায় চেন্জ করতে পারিস তবে তুই নিজে কেন পারবি না?”

মৃধা নীরব। রাস্তার ঠান্ডা হাওয়া নিশি পরিবেশটাকে আরও শীতল করে তুলছে। মৃধার হাত আবদ্ধ রিদানের হাতে। রিদান আবার অস্ফুটস্বরে বললো,
–”একবার ডাক না !”

রিদানের এই আবেদনটা অগ্রাহ্য করতে পারলো না মৃধা।মিহি গলায় তাই বলে উঠলো,

–”র-রিদান !”

আর কোনো কথা হয়না দুজনের মাঝে। আজ সারারাত এই শহরের আনাচে কানাচে বিচরণ করে যাবে এই সুন্দর প্রেমজোড়াটি।
.
.
.
৪০.
সময়ও যেন বয়ে গেলো পাল তোলা নৌকার মতো। হাওয়ার তালে পাল তুলে কোন গন্তব্যে যে চলে গেলো ; তার কোনো ঠিকানা নেই। সেইদিন রিদান আর মৃধা চলে গেলো তো গেলোই ; মৌনির জীবনে আর ফিরে এলো না। ফলে মৌনি নিজেকে নিয়ে শুরু করে নতুন একটি যুদ্ধ। নিয়মিত মেডিটেশন , মেডিক্যাল কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলো মৌনি। সেটাও যেন নিত্যনতুন এক অবরোধ। নিজের মন আর মস্তিষ্কের সাথে লম্বা একটা সময় যুদ্ধ চালিয়েছে সে। এই সময়টাতে নিভ্র ছিলো ওর পাশে ছায়ার মতো। ঘটনাচক্রে মৌনি কয়েকবার নিভ্রকে আঘাত করে বসলেও নিভ্র একটা টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। একপর্যায়ে স্বাভাবিক হয়ে এলো মৌনি। নিভ্রর কথামতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে নেমে পড়লো ব্যস্ততার খেলায়।

এভাবেই কেটে যায় দুটো বসন্ত। এই সময়ে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। মৌনি অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার্সের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। একটা নিউজ মিডিয়ায় ছোট্ট একজন এসিস্টেন্ট এর জব করছে। যদিও সেলারি খুব একটা বেশি না তবে নিভ্রর কথামতো ও ধারনা করলো যে এটা হয়তো ওর অভিজ্ঞতা বাড়াবে। পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হবে না। আর নিভ্রও প্রমোশনের জন্য ইন্ডিয়ায় যেতে হয়েছিলো ছয় মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য। আর এখন সে ঢাকার একটা স্বনামধন্য হসপিটালের সাইক্রেটিস্ট ডিপার্টমেন্টে ডক্টর হিসেবে নিযুক্ত আছে। নিজেকে নিভ্রর মতো প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় মৌনি এখন অনেকটাই সফল। চারিদিকে কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূত হয়। এখন শুধু সময় ওদের প্রেম নামক সম্পর্কটিকে বিবাহ নামক বন্ধনে আবদধ করা।

ঢাকার সায়েদাবাদে এখন মানুষের পর্যাপ্ত ভীড়। বাসের হাকাহাকি আর মানুষের কোলাহলে ঠিকমতো দাঁড়ানো যাচ্ছে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে মৌনি। রাত্রির হাতের ছোট একটি ব্যাগে নিজের আর মৌনির কাপড়-চোপড় জোরপূর্বক গুছিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যে হওয়াতে আলোর লীলাখেলাটা অন্যরকম সুন্দর করে দিচ্ছে বাস কাউন্টারটি। তবুও মৌনি পরোয়া না করে বললো,

–”তোর পকেটে টাকার গাছ উঠেছে রাত্রি যে হুট করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে কাউন্টারে আসলি ! আর আমরা যাবো কোথায়? রোদু কে নিয়ে আসবি না?”

–”এত প্রশ্ন করস কেন? ওয়েট কর সবগুলা একসাথে আসবো।”

–”সবগুলা একসাথে মানে?আর কে কে?”

–”রাত্রি এইতো পেয়ে গিয়েছি সবাইকে।”
রোদেলার কন্ঠ শুনে পিছনে ফিরলো রাত্রি আর মৌনি। মৌনি যেন এবার অবাকের চরম চূড়ায় পৌছে গিয়েছে। নিভ্র দাঁড়িয়ে আছে। সাথে তুর্য , সোহান , নিশু আর লিজা আপুও। মৌনির মাথায় সবকিছু কেমন যেন জট হয়ে আসছে। পরিস্থিতিটা কেমন যেন মেনে উঠতে পারছে না। আমতা আমতা করে বললো,

–”ত-তোমরা? এখানে?”

–”আমিই সবাইকে আসতে বলেছি।” [নিভ্র]

–”কিন্ত কেনো?”

–”আমরা একজায়গায় যাবো।”

–”আরে কোথায় যাবো?”

–”কক্সবাজার !”
নিভ্রর নিঃসংকোচ কন্ঠ। মৌনির মাথার ফিউজ এবার যেনো উড়ে গেলো। মানে , কি , কিভাবে? মৌনি ক্ষীপ্ত গলায় নিভ্রকে বললো,

–”আরে পাগল হয়েছেন আপনি ? আব্বু-আম্মুকে না বলে কিভাবে যাবো আপনার সাথে?জিনিসটা ভালো দেখায় না।”

–”আমি কি একবারও বলেছি যে আমরা বিয়ের আগে হানিমুন করতে যাবো? তাইতো আমার ফ্রেন্ড আর তোমার ফেন্ডদেরও ডাকলাম। একসাথে ফেন্ডস ট্যুরে যাচ্ছি আমরা। সিম্পল !”
নিভ্রর কথায় মৌনি চুপসে গেলো। এই ছেলে পুরা প্রি প্ল্যান করে রেডি হয়ে আসছে।বাস ছাড়ার জন্য উদ্যত হতেই নিভ্র মৌনির হাত চেপে উঠে গেলো বাসে। ওদের পিছু পিছু বাকিরাও বাসে উঠে পড়লো। মৌনি আর নিভ্র পাশাপাশি এক সিটে বসেছে। সামনের সিটে লিজা আর নিশু আর পেছনের সিটে রাত্রি আর রোদেলা বসেছে। তারই পিছে বসেছে সোহান আর তুর্য।

সোহান কপাল চাপড়িয়ে বললো,
–”হায় হায় তুর্য ! এই জীবন রেখে কি লাভ?ব্যাটা নিভ্র ঠিকই ওর মৌনিপরীর সাথে ইন্জয় করবে আর আমার পোড়া কপাল এখনও তোর সাথে পড়ে থাকলো। ”

–”বিয়ে করে ফেলেন সোহান ভাইয়া আপনার প্রাণপ্রিয় বন্ধু তুর্য ভাইয়াকে! আপনাদের কিন্ত দারুন মানাবে। ”
বিদ্রুপ কন্ঠে বলে ফেললো রাত্রি।

–”দেখ তুর্য ! আজকার সুন্দরী সুন্দরী মেয়েগুলাও আমাদের ক্ষেপায়!”[সোহান]

–”থাক রাত্রি! এদের আর ক্ষেপাতে হবে না। মনে রাখিস , কপাল কিন্ত আমাদেরও খারাপ। আজ পর্যন্ত একটা ছেলে জুটাতে পারলাম না। সবার কপাল কি মৌনির মতো? এভাবে নিজের প্রেমিক পুরুষের বাহু জরিয়ে সারারাত গল্প করবে!”[রোদেলা]

–”সেই কপাল আর নাই গো শালিকা।আগে তোমাদের এই বান্ধবীটা পুরাই রসমালাই ছিলো ! এখন বোম্বাই মরিচ হয়ে গিয়েছে।ধরলেই মরিচের মতো ঝলসে দেয় আর আগে তো আমারে মালাইয়ের কৌটা মনে করে………….”
এটা বলেই নিভ্র ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে। বাকিরা সবাইও মিটমিটিয়ে হাসছে। মৌনি নিভ্রর বাহুতে কয়েকটা কিল ঘুষি মেরে বলে উঠলো,

–”আজাইরা কথা না বললে ভালোলাগে না?”

–”আজাইরা বললাম কই। আগে না তুমি বলতে যে (কানের কাছে এগিয়ে) আমি তোমার মালাইয়ের কৌটা আর এই মালাইয়ের কাছে কোনো হিংস্র বিড়াল কে ঘেষতে দিবে না। ভুলে গিয়েছো নাকি?”

মৌনি লজ্জায় পড়ে গিয়েছে।

–”একবার তো আমার ঠোঁট কামড়ে বিক্ষত করে ফেলেছিলে আর চুলগুলোর কথা তো আর নাই বললাম। সব ভুলে গেলে নাকি।”

–”আমরা কক্সবাজার কেনো যাবো?”
প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে উঠলো মৌনি। চেহারায় লাজরাঙা আভা দেখে নিভ্র মুচকি হাসে। নিভ্রকে আজ সাদা টিশার্টে চমৎকার লাগছে। মৌনি আড়চোখে নিভ্রকে একপলক দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নাহলে নিভ্র আবারও লজ্জায় ফেলে দিবে। নিভ্র মৌনির কানের লতিতে ঠোঁট ছুইয়ে বললো,

–”ইটস সারপ্রাইজ !”

সন্ধ্যে নেমে রা হয়েছে। অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে সব।সবকিছু হয়ে আসছে গাঢ় অন্ধকার। সেই হাছানিতে হারিয়ে যাচ্ছে মৌনি আর নিভ্রও। কুয়াশার আবছা আবরণে বাস এগিয়ে চলছে নিজস্বগতিতে। নিভ্রর সুবাস ওকে যেন ঘিরে ধরে রেখেছে। মৌনির অনুভব হলো নিভ্র হয়তো অন্তরে অন্তরে কিছু একটা বলছে। এটা বলছে যে,

–”সুখের আবেশে আষ্টেপৃস্টে জরিয়ে রাখবো তোমায়। হদয় আর সিন্ধুর মতো। সেই অনুভবটা তোমায় আবার ঘায়েল করবে না তো?”
হেসে ফেলে মৌনি। আজকাল ওর কল্পনাটা বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে।

~চলবে
গল্পের অন্তিম ঘনিয়ে এসেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here