হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে পর্ব ১২+১৩

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব:১২ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
১৯.রাতের শেষ প্রহরে মৌনির গগণবিদীর্ন চিৎকারে রিদান তড়িঘড়ি করে মৌনিকে যে রুমে আটকে রাখা হয়েছিলো সেই রুমে চলে যায়। মৌনি অদ্ভুদভাবে ঘরের সব আসবাবপত্র ভাঙচুর করে চলছে। বাহিরে চলছে প্রবল বজ্রপাত। এটাই স্বাভাবিক। বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি আর বজ্রপাত হলো প্রকৃতির মুখ্য বিষয়।কিন্ত মৌনি অনেকটা ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও পারছেনা। রিদানকে আসতে দেখে মৌনি অস্থির হয়ে বললো……..
—খবরদার! আমার কাছে আসবেন না। আমি আর ক-কোনো ইনজেকশন দেবো না।
,
রিদান বুঝতে পারলো যে মৌনি সেই রাতের ঘটনাটা এখনও ভুলতে পারেনি। তবে মৌনির এতটা অস্বাভাবিকতা দেখে রিদানের মনে সন্দেহ জাগে। বাবার কথা শুনে মৌনির স্মৃতি ভুলানোর জন্য একটা ডোজ দিয়েছিলো সে । কিন্ত মৌনির আচরণ দেখে মনে হচ্ছেনা যে এটি শুধু কোনো মেমোরি লসের ডোজ। এদিকে মৌনির শ্বাস ক্রমাগত ওঠানামা করছে। রিদানের প্রতিটা আঘাতের কথা মনে পড়লেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে ওর। যতই হোক ! এই পাষাণ মানুষটার সংস্পর্শে কখনোই ও আসবে না।
রিদান তীক্ষ্ণ চোখে মৌনির দিকে তাকায়। এই মেয়েটাকে নিয়ন্ত্রনে আনতে হবে যেভাবেই হোক। যদিও এসব সাইকোলজির ব্যাপারে রিদানের ধারনা কম তবে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার মতো চমৎকার একটা ক্ষমতা আছে। শীতল কন্ঠে এবার সে মৌনিকে বললো………
—তুমি স্থির হয়ে বসো মৌনি।
রিদান এক পা এগিয়ে আসতেই মৌনি টেবিলের পাশ থেকে কাচের বোতলটা নিয়ে নেয়।চিৎকার করে ও বললো…….
—আমি একবার বলেছি না ; আমার কাছে আসবেন না। নইলে আমি কিন্ত আঘাত করতে বাধ্য হবো।
রিদানের চোয়ালে শক্ত হয়ে উঠেছে মৌনির কথা শুনে। কিন্ত রাগের বসে মৌনির ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠাটা নিতান্ত বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে রিদান আবার বলে ওঠলো…….
—আমি কোনো ডোজ দিবো না মৌনি। So don’t be panic, stay clam..
.
—ন-না। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না। আপনি যাবেন কি না !
মৌনি রিদানকে আক্রমণ করতে গেলেই রিদান গান বের করে সাথে সাথে মৌনির ডান হাতে একটা শ্যুট করলো। রিদান শ্যুট করতে চায়নি। কিন্ত অনেকটা বাধ্য হয়েই করতে হয়েছে। মৌনি কোনোক্রমেই শান্ত হচ্ছিলো না। হাতে আঘাত পেয়ে মৌনি সাথে সাথে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। ব্যাথায় সে ছটফট করে চলছে। রিদান নিস্তেজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৌনিকে এমনভাবে শ্যুট করেছে সে যাতে ওর জীবন-মরণ নিয়ে টানাটানি না করতে হয়। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রম করার পর মৌনি চোখ বন্ধ করে ফেলে। হাত থেকে এতক্ষণ অনেক রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে।
রিদান সেদিকে পরোয়া না করে উচ্চস্বরে কাউকে ডাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
.
—মৃধা ! তাড়াতাড়ি আয়।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ধীরগতিতে একটি মেয়ে ঘরে প্রবেশ করল রুমটিতে। পড়নে নীল গড়নের একটি কুর্তি। গায়ে পাতলা একটি ওড়না জড়ানো। কালো মসৃন চুলগুলো কাটা ব্যান্ড দিয়ে আটকে রাখলেও অবাধ্য কিছু চুল মেয়েটার শ্যামলা গড়নের মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে। মায়াবী চোখদুটো লুকিয়ে আছে চশমার পেছনে। মেয়েটি ইতস্তত করে বললো…….
—কি হয়েছে দাভাই !
—মেয়েটাকে ঠিকমতো খাটে শুয়িয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করে দে।
মৃধা মৌনির দিকে তাকাতেই একপ্রকার আতঁকে ওঠে। হাত দিয়ে অনেক রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। চুলগুলো এলোমেলো অবস্থায় মুখের ওপর পড়ে থাকার কারনে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এই মেয়েটার জন্য ওর বেশ মায়া হলেও রিদানের মুখের ওপর কথা বলার সাহস মৃধার নেই।
—দ-দাভাই !ম-মেয়েটার এ অবস্থা কেনো?
—ওর হাতে আমি শুট করেছি তাই। এত বেশি কথার তো আমি প্রয়োজন দেখছি না। তোকে যেই জন্য আনা হয়েছে সেই কাজটাই ঠিকমতো কর্। আমি গেলাম।
.
মৃধা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকলো রিদানের দিকে। রিদান ওর মামাতো ভাই হলেও মৃধার মনে হয়না এই পৃথিবীতে রিদানের মতো এত হৃদয়হীন মানুষ ও দেখেছে কি-না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃধা মেয়েটার দিকে এগোয়। মেয়েটার গালে থাপ্পড়ের দাগ আর নাকে শুকনো রক্ত জমে থাকতে দেখে মৃধার বুঝতে বাকি রইলো না যে এই আঘাতগুলো রিদানই দিয়েছে। মৃধা নমনীয় কন্ঠে বললো…….
—আমি যদি পারতাম না আপু , আমি নিজে তোমাকে এই নরক থেকে পালাতে সাহায্য করতাম। কিন্ত আমার সেই ক্ষমতাটি নেই।
.
.
———————-
বাইরে বজ্রপাতের পরিমাণ কিছুটা কমে গিয়ে এখন শুরু হয়েছে টিমটিমে বৃষ্টি। আধার-আলোর খেলায় চট্টগ্রামের এই পরিবেশটা যেন সতেজ হয়ে ওঠেছে। হ্যাঁ। রিদান মৌনিকে নিয়ে চট্টগ্রামেই আছে। আজ বিকেলেই ঢাকা যাওয়ার কথা ছিলো কিন্ত বিশেষ একটা কারনে এখনও সে যায়নি। মাথায় রিদানের শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে মৌনির অস্বাভাবিক সেই কাজকর্মগুলো। হঠাৎ ফোনের রিং বেজে ওঠতেই রিদানের ধ্যান ভাঙ্গে। এত রাতে আননোন নাম্বার স্ক্রিনে ভেসে ওঠতে দেখে মনে জেগে উঠলো প্রবল সন্দেহ। কলটা সাথে সাথেই রিদান রিসিভ করে । অপরপাশে কোনো সাড়াশব্দ নেই।
—হ্যালো? কে ?
—মৌনির আপন কেউ !
ভ্রু কুচকে ফেলে রিদান। আগন্তুকের কাছে মৌনি নামটি শুনে সন্দেহ যেন ধাপে ধাপে বেড়ে উঠেছে।জিভটা হালকা ভিজয়ে রিদান বললো…….
—কে মৌনি? আমি কোনো মৌনিকে চিনি না।
অপরপাশে থাকা ব্যাক্তিটি সশব্দে হেসে ওঠলো। ব্যঙ্গ সুরে বলে…..
—ওহ। কাম অন মিঃ রিদান শেখ ! আপনাকে তো অনেক প্রখর বুদ্ধির মনে করতাম। তবে অপরাধের ভীড়ে আপনার চতুরতাটা মনে হয় হারিয়ে যাচ্ছে। আমি যেহেতু মৌনির নাম বললাম তাহলে তো আপনার বুঝে নেয়ার কথা যে আপনাদের সব কালোকাজের কথা আমার জানা।
—মানে?
—মানে হলো এটা যে…………….আপনারা কিভাবে জাল সার্টিফিকেট বানিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন ওটার প্রুফ মৌনির কাছে না আমার কাছে। আর ওই প্রুফের 50% যেটা প্রফেসর এনায়েতউল্লাহকে পাঠানো হয়েছিলো সেটা আমরা চক্রান্ত করে আপনার বাবার স্টকের পেনড্রাইভের সাথে অদল-বদল করে প্রুফের পেনড্রাইভটা রেখেছি। ভাবতে পারছেন ব্যপারটা কত ভয়ঙ্কর !
আপনার বাবা যখন প্রেস মিডিয়ার সামনে স্টকের ডেটাবেজের বদলে আপনাদের কালো কাজের ভিডিওগুলো অজান্তে দেখিয়ে যাবে আপনাদের লাইফ তো শেষ।
.
চোয়ালে শক্ত হয়ে গিয়েছে রিদানের। চিৎকার করে বলে ওঠলো……..
—কে তুমি? এসব করে লাভটা কি হবে?
—আমার লাভের কথা বাদ দেন ; আগে আপনার ক্ষতির কথা চিন্তা করুন মিঃ।
—আমার হাতে তুমি যদি এট এনি চান্স পড়ো ; একেবারে শেষ করে ফেলবো।
—আমাকে ধরলেও শেষ করার মতো ক্ষমতা আপনার নেই। আগে নিজেকে বাঁচান।
আর হ্যাঁ। এখন আপনার বাবা মিঃ জহির শেখকে হাজার কল দিলেও কিছু হবে না। আগেই জানিয়ে দিলাম। যান যান , তাড়াতাড়ি ঢাকায় গিয়ে তাকে তথ্য ফাঁস করা থেকে আটকান

রিদান বিতৃষ্ণার স্বরে বললো………
—You’re totally crazy man ! নিজেই আমাদের বিপদে ফেললে আবার নিজেই সতর্ক বার্তা দিলে। পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে আসছো তুমি?
অপরপাশে আগন্তুকটি আবারও হেসে দিলো। রিদানের কাছে ওই ব্যক্তিটাকে বেশ খাপছাড়া টাইপ মনে হচ্ছে।
—আমি পাগল কিনা জানিনা তবে আপনাদের সবাইকেই পাগল করে ছাড়বো মিঃ রিদান শেখ ।
অপরপাশ থেকে টুট করে ফোন কেটে যায়। রিদান এবার কি করবে বুঝতে পারছে না। ঢাকায় ওর বাবা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা গার্ডের সাথে কন্ট্যাক করার চেষ্টা করলো কিন্ত ফলাফল শুণ্য। যতদ্রুত সম্ভব ঢাকায় যেতে হবে তবে তার আগে এই অপরিচিত ছেলেটার খোঁজ নেওয়ার জন্য লোক লাগিয়ে দিলো সে। আগামীকালের মধ্যেই একে ধরতে হবে।
.
.
.
২০.
চেয়ারে পায়ের ওপর পা তোলে নিভ্র বসে আছে। এদিকে যেই লোকগুলো নিভ্রকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছিলো সবগুলোর অবস্থা খারাপ। একটা লোকের ফোন অনবরত বেজই চলছে এটা দেখে নিভ্র বাকা হেসে ফোনটা তুললো। তখনই ঝাঁঝালো কন্ঠে অপরপাশে কেউ বললো……
—কি-রে ! গতরাতে আমায় ফোন করা ওই ছেলেটারে ধরতে পেরেছিস? শেষ করে দিবি ওকে।
—হ্যাঁ। ধরতে পেরেছে। তবে আমায় শেষ করার মতো অবস্থা ওদের একটারও নেই। সবক’টায় মাটিতে চিৎ হয়ে আছে।
থমকে গেলো রিদান। কন্ঠটা ওর লোকের না। তবে কি ওই ছেলেটা……….?
—কি করছো ওদের সাথে?
রিদান ঠান্ডা কন্ঠে নিভ্রকে বললো। যদিও নিভ্রর পরিচয় এখনও রিদান জানেনা।
—ট্রাস্ট মি মিঃ রিদান ! একটার গায়েও আমি আঁচড় দেইনি। ওরা নিজেই নিজেকে আঘাত করেছে।
—What rubbish !
নিভ্র এবার হেসে ওঠে। অনেক হয়েছে খেলা এবার সব সত্য উদঘাটন করতে হবে।
—Well done মিঃরিদান শেখ ! আপনার বোকামির জন্যই মৌনিকে আপনি আবার হারাতে চলছেন। আপনার কি মনে হয় আপনি আমার লোকেশন ট্রেস করে লোক দিয়ে আমায় কিডন্যাপ করিয়েছেন?মোটেও না। বরং আমি নিজেই কিডন্যাপ হয়েছি।
.
রিদান অবাক হয়ে যায়।
—মানে?
—গতরাতে আমি মিথ্যা বলেছিলাম আপনাকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য। আর আমি জানি যে এত সহজে আপনি আমায় ছাড়বেন না। তাই আমায় ধরার জন্য আপনি লোক লাগিয়ে দিয়েছিলেন আর ৮ ঘন্টার মধ্যেই আমি আপনার কবলে। আর আপনার লোকদের প্রত্যেককে আমি হিপনোটাইজড করে অজ্ঞান করে দিয়েছি। So মৌনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার রাস্তা ফাঁকা।
.
ছেলেটার প্রত্যেকটা কথা শুনে রিদান হকচকিয়ে যায়। ছেলেটাযে এত চতুর একটা পরিকল্পনা করে বসবে রিদান তা আন্দাজও করতে পারেনি। মৌনিকে চট্টগ্রামে গার্ডের আন্ডারে ফেলে আসার কাজটাই অনেক বড় ভুল ছিলো।
.
.
———————————–
মৌনির শরীর খুব দুর্বল । কিন্ত দুর্বল চোখে সে নিভ্রর অবয়ব আবছাভাবে দেখতে পেরেই একটু অবাক হয়ে যায়। সে-কি তবে স্বপ্ন দেখছে। তাই বারবার চোখ বন্ধ করলো আরখুললো মৌনি। কিন্ত না ; নিভ্রর অবয়বই সে বারবারই দেখে। তবে কি নিভ্র এসে পড়েছে। মৌনি পিটপিট করে চোখ খুললো…….
নিভ্রকে দেখতেই অস্পষ্টস্বরে মৌনি বললো……………
—নিভ্র।
.
নিভ্র নির্লিপ্তভাবে মৌনিকে বুকে জরিয়ে রেখেছে। অপরপাশেই মিষ্টি হাসি দিয়ে দাঁড়ানো মৃধা। নিভ্র চোখের ইশারায় মৃধাকে ধন্যবাদ জানায়।মৌনিকে ফিরে পেতে মৃধাও একটা বড় অবদান রেখেছে। মৃধা এবার বললো……….
—ডঃ নিভ্র । আপুকে নিয়ে এখান থেকে চলে যান দ্রুত।এখানকার সবকিছু আমি ব্যবস্থা করবো।
নিভ্র তাই তড়িঘড়ি করে মৌনিকে কোলে তুলে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এখন যতদ্রুত সম্ভব আগে চট্টগ্রাম ছাড়তে হবে। বাড়ির বাইরেই কালো জীপ নিয়ে নিভ্রর বন্ধুরা দাঁড়ানো। সোহান খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠরো………
—আলহামদুলিল্লাহ ! মৌনি তাহলে ফিরে এসেছে।
—মানতে হবে নিভ্র ! তোর এই চতুর খেলায় রিদানও ফেসে গেলো।(তুর্য)
—এখন কোথায় যাবি?(নিশু)
—একটা বাসে উঠবো।
—বাসে উঠিস না। রিদান ওদের লোকদের আগে বাস বা ট্রেন চেক করতেই পাঠাবে? (লিজা)
—ঠিক বলেছিস । কিন্ত……..
—ট্রাকে যেতে পারবি?
তুর্যর দিকে সবাই এবার তাকায়।
—এখন মোটামুটি সন্ধ্যা। তাছাড়া রাতে কোনো মালবাহী ট্রাকে চড়ে বসলে কিছুই হবে না। চলবে তো?
তুর্যর কথাটি সবারই ভালো লাগলো। এদিকে মৌনি অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। নিশু মৌনির এ অবস্থা দেখে বললো………
—এখন জীপ নিয়ে অন্যদিকে যাই। মৌনির অবস্থা ভালো না-রে নিভ্র।
নিভ্র মলিন চোখে মৌনির দিকে তাকায়। গোটা দুদিনে মেয়েটার ওপর যে অনেক ধকল গিয়েছে তা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ভালোবাসা অনুভূতিটাই অন্যরকম। যত দুঃসাহসী কাজ করতে প্রয়োজন হয় সবই মানুষ করে। মৌনিকে আবারও স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসবে নিভ্র ; এই পণটা নিভ্র মনে স্থির করে রাখলো।
.#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ১৩ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
২১.নিভ্রর কাঁধে মাথা দিয়ে মৌনি ঘুমিয়ে পড়েছে। এই ঘুমটা মৌনির কাছে বেশ প্রশান্তির যা ওর মুখমন্ডল দেখেই যেন স্পষ্ট বোঝা যাবে। এই ভরসন্ধ্যার সময় জীপ গাড়িটি এগিয়ে চলছে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের দিকে।আর ড্রাইভ করছে সোহান। নিভ্রর একবার ইচ্ছে করেছিলো যে সে ড্রাইভ করুক কিন্ত মৌনির জন্য তা পারলোনা। মৌনি নিভ্রর বাহু জরিয়ে কাঁধে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে। যদিও চেহারাটা বেশ দুর্বল। নিভ্র কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে মৌনির মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। হাওয়ার তালে মৌনির চুলগুলো বারবার উড়ে আসছে নিভ্রর মুখে। মৌনির চুলে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ আছে। ঘ্রাণটা কোনো কৃত্তিম শ্যাম্পু বা কন্ডিশনারের না ; প্রাকৃতিক একটা ঘ্রাণ যেটা নিভ্র সবসময় মৌনির আশেপাশে থাকলেই অনুভব করতে পারে।
জীপে বারবার উথাল-পাতাল ঝাঁকুনির ফুলে মৌনি একসময় নিভ্রর বুকে মাথা রাখলো। নিভ্র তা দেখে একগাল হাসে। নিভ্রর বুকে বারবার মিশে যাচ্ছে মৌনির উষ্ণ নিঃশ্বাস। দেখে নিতান্তই কোনো এক কিশোরী মনে হবে মৌনিকে। আর ওর এই বিষয়টাকেই তো বড্ড ভালোবাসে নিভ্র। একেবারেই সরল , মনে কোনো দাগ নেই। নিভ্র এবার চারিদিকে তাকায়।
দু ধারের সারি সারি গাছপালার মাঝে কনক্রিটের ঢালু পথ দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশের লাল আভা প্রায় নিস্তেজ। নিভ্র সোহানের উদ্দেশ্যে এবার বললো……….
.
—সোহান! হাইওয়ের ডানপাশের মহামায়া লেকের দিকে জীপটা নিবি কিন্ত।
বাকিরা উৎসুক চোখে নিভ্রর দিকে তাকায়।যেদিকে দুজনের তাড়াহুড়ো করে ঢাকা যাওয়ার কথা সেখানে হুট করে নিভ্রর কি হলো?
—মানে? মহামায়া লেকের ওদিক গিয়ে কি করবি? (নিশু)
এই হাইওয়েতে দূর দূর কোথাও কোনো খাবার হোটেল নেই।মহামায়া লেকের পথেই দু’তিনে পাওয়া যাবে। তাছাড়া মৌনির জন্য কিছুটা রিফ্রেসমেন্ট দরকার। তাই আমি ভেবেই বলছি ওদিকটাতে চল্।
.
নিভ্রর কথাতো সোহান জীপটা ডানদিকের পথে ঢুকিয়ে দেয়। পথটা বেশ অন্ধকার। জীপের হেডলাইটের আলোর ওপর অনুমান করেই সোহান ড্রাইভ করছে। পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট রূপ ধারন করেছে। নিভ্র এবার মৌনির দিকে মনোনিবেশ করলো। অন্ধকারের মধ্যেও মৌনিকে স্পষ্ট সে অনুভব করতে পারছে চোখের আন্দাজে। হঠাৎ নিভ্রর কি খেয়াল হলো সে জানেনা। অন্ধকার পথে সবার চোখের আড়ালেই মৌনির কপালে গভীরভাবে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো সে। মাঝেমাঝে নিভ্রর মনে আজগুবি সব ভাবনা চেপে বসে। এ ভাবনাটিও সে একই তালিকায় ফেলে দিয়েছিলো। নাহলে এমন কাজ করার মতো কোনো পরিকল্পনাই নিভ্র সজ্ঞানে থাকতে করতোনা।
সরু পথের এককোণে খাবারের দোকান পেতেই সোহান জীপ থামিয়ে দেয়। এখানে মানুষের গুটিকয়েক আনাগোণা রেয়েছে বিধায় এখানে আলোর মিহি সন্ধান আছে। মৌনির গালে আলতো করে হাত দিয়ে নিভ্র ওকে ডাকে।
নিভ্রর কন্ঠ মৌনির শ্রবণপর্দা স্পর্শ করতেই ও পিটপিট করে চোখ খুলে। নিভ্র একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে মৃদু আলো থাকাতে নিভ্রর কালচে বাদামী চোখদুটো মারাত্নক লাগছে। মৌনি আস্তে করে নিভ্রর বুক থেকে সরে উঠে বসে। নিভ্র তা দেখে বললো……..
—এখন হাত-মুখ ধুয়ে একটু খাওয়াদাওয়া করে নেও। দুর্বলতাটা হালকা হলেও কেটে যাবে।
.
নিভ্রর কথামতো মৌনি জীপ থেকে নেমে রেস্তোরাটির দিকে এগিয়ে গেলো। একেবারেই সাদামাটা ধরনের। একজোড়া বৃদ্ধ দম্পতি সবকিছু পরিচালনা করছে। মৌনি বাহিরে হাত-মুখ ধুয়ে ভিতরে চেয়ার পেতে বসে পড়লো। সোহান-নিশু-তুর্য-লিজা সবাইকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। এমনকি নিভ্রকেও। মৌনি সবার থেকে চোখ ফিরিয়ে চুপচাপ বসে থাকলো। কারও মধ্যে কোনো প্রকার কোনো কথা নেই। একসময় নীরবতা কাটিয়ে নিভ্র সবাইকে বললো……
—কি খাবে সবাই?
—অনেক কিছু। পেটের ভেতর ক্ষুধার্ত বাঘ ম্যারাথন দৌড় দিচ্ছে। (তুর্য)
—Bamboo chicken চলবে? এখানকার বেস্ট খাবার। সাথে ভাত , ডাল , ভর্তা তো আছেই।
—চলবে মানে? পুরা দৌড়াবে। চট্টগ্রামের মানুষ Bamboo chicken খাবে না ; তা কি আদৌ সম্ভব । এটাই খাবো? (সোহান)
—মৌনি? তুমি এটাই খাবে নাকি অন্য কিছু খাবে?
.
নিভ্রর ডাক শুনে ও একপলক নিভ্রর দিকে তাকায়। তারপর মাথা নিচু করে বললো ,
—আপনারা যা খাবেন সেটাই।
নিভ্র মৌনিকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না। মেয়েটা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি এটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেই বৃদ্ধ লোকটিকে খাবার অর্ডার দিয়ে নিভ্র মৌনির পাশে বসে পড়ে। মৌনির মধ্যে কোনোরূপ কোনো ভাবান্তর নেই।
—এখনও ভয় পাচ্ছো?
নিভ্রর নির্লিপ্ত কন্ঠ। মৌনির এবার কোনো কিছু না বলে নিভ্রর কাঁধে মাথা রেখে দিলো। এই ছেলেটিই এখন ওর একমাত্র ভরসাযোগ্য স্থান যাে মনপ্রাণ উজাড় করে মৌনি ভালোবাসে। দুজনকে একান্ত সময় দেওয়ার জন্য তুর্য-নিশু সবাই অন্যদিকে গিয়েছে। মৌনি এবার ক্ষীণ কন্ঠে বললো…….
—জানেন। রিদান আমায় অনেক torture করলেও আমি মুখ বুঝে সহ্য করে ছিলাম। কষ্ট হতো অনেক কিন্ত এর থেকেও আরও বেশি কষ্ট লাগতো এটা ভাবলে যে আপনি আমার সাথে নেই। বিশ্বাস করুন দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। গভীর রাতে যখন রুম অন্ধকার করে রিদান চলে যেতো আপনার মুখ বারবার নূর হয়ে আমার সামনে আসতো। দুদিন আপনার কাছে ছিলাম না বিধায় আমার এ অবস্থা ; একটাবার ভাবুন তো আপনি না থাকলে আমার কি হবে?
.
মৌনি বড্ড আবেগী । ছোট ছোট কথাতেই মেয়েটা আবেগে সিক্ত হয়ে পড়ে। নিভ্র কোনো উত্তর না দিয়ে মৌনির ডান হাটি আঁকড়ে ধরে থাকলো। মৌনি তখনও নিভ্রর কাঁধে মাথা এলিয়ে রেখেছে। নিভ্র এবার বললো…………
.
—আমি কেনো তোমার থেকে দূরে চলে যাবো মৌনি? এরকম কিছুই হবে না।
—আমি বিশ্বাস করি না।
—জানতে পারি , কেন?
মৌনি এবার ঠোঁট উল্টে বলে ওঠলো……….
—আমার ভয় হয়। আপনি এত সুন্দর। সব দিক দিয়েই আল্লাহ যেন আপনাকে ভরে ভরে দিয়েছে।আপনার পার্সোনালিটি যে কোনো সুন্দরী মেয়েকেই আকৃষ্ট করবে। আর আমি আপনার পুরো উল্টা । আপনি ডক্টর তো আমি জার্নালিজমের স্টুডেন্ট। আপনার জীবন কেটেছে ডাক্তারির সেই কঠিন পড়া দিয়ে আর আমার সমাজবিজ্ঞান নিয়ে। আমি নিজেকে ছোট করে দেখছি তেমন না কিন্ত আমি আপনার সম্পূর্ণই ভিন্ন। আপনি চাইলে আপনার মতো মেয়ে অনায়াসেই পেয়ে যাবেন তাহলে এর নিশ্চয়তা কি যে আপনি আমায় ছেড়ে যাবেন না?
.
মৌনির আকুল অনুভূতি। মৌনির কথা শুনে নিভ্র মুখে দুষ্টু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। মেয়েটা আসলেই বড্ড সরলমনের। নাহলে এমন কথা এত সহজে কেউ বলতে পারতো না। নিভ্র এবার মৌনির কানে মিহি কন্ঠে বললো………..
.
—ডক্টর হলেই ডক্টরকে ভালোবাসতে হবে এমন খাপছাড়া কথা তুমি ভাবলে কিভাবে? এমন কোনো নিয়ম আছে ; আগে জানতাম না তো !
মৌনি নিশ্চুপ।
—আর কি যেন বললো…………আমি তোমায় ছাড়বো না এর নিশ্চয়তা কি? তাহলে শোনো। এই নিভ্র শুধুমাত্র তার মৌনিপরীকেই ভালোবাসে। মৌনিপরী যেভাবে আমার বুকে ঘুমিয়ে থাকে অন্য কোনো মেয়ের সে সাহস হয়নি। মৌনিপরী যখন কাতর কন্ঠে বলে , ”আই ওয়ান্ট টু কিস ইউর লিপস নিভ্র ভাই” ! অন্য কেউ কখনো নিঃসংকোচভাবে আমায় এ কথা বলেনি। আমি যতই কোনো সুন্দর মেয়েকে আকৃষ্ট করিনা কেন ; কোনো মেয়েই আমার মৌনিপরীর মতো আমায় ”ভয়ঙ্কর সুন্দর” বলেনি। ”নিভ্রভাই” ডাকার মধ্যেও অন্যরকম যে একটা মাতাল করা অনুভূতি থাকে ; মৌনিপরী সে নামে না ডাকলে হয়তো আমি তা অনুভব করতে পারতাম না। আরও কিছু জানতে চাও?
.
—না।
মৌনি লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে প্রতিউত্তর দিলো। এই ছেলের প্রতিটা কন্ঠেই মৌনি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। হৃদয়ে খেলা করে কিছু নামহীন কথা।
.
.
.
————————————–
খাওয়াদাওয়ার কার্যক্রম শেষ করে সবাই এবার জীপে উঠে বসলো। মৌনি নিভ্র থেকে এবার কিছুটা দুরত্ব নিয়ে বসেছে। আগে নিভ্রর বুকে মাথা রাখলে মৌনির মনে কোনো অনুভূতি কাজ করতো না যেদিকে ওর সবচেয়ে বেশি অপ্রস্তুত হওয়ার কথা। আর এখন দুজনের মধ্যে ভালোলাগার কিছু প্রেমখেলা চলছে আর নিভ্রর বুকে সবার সামনে মাথা রাখলে মৌনি যেন লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। মানবজগত আসলে ভারী অদ্ভুত !
.
—নিভ্র ! এবার কি প্ল্যান?(নিশু)
—একটা ট্রাকে উঠবো।
—সেটাতো বুঝলামই । কিন্ত যাবি কোথায়? ঢাকা?
—নাহ ! কুমিল্লা।
কুমিল্লা নাম শুনতেই মৌনি অবাক হয়ে যায়। মৌনিদের বাড়ি তো কুমিল্লায়। নিভ্রর মনে মনে তবে কি পরিকল্পনা করছে?মৌনি এবার বললো………
—কুমিল্লায় কেন?
—তোমায় তোমাদের বাড়িতে রেখে আসবো।
—মানে?
নিভ্রর কথার আগামাথা মৌনি কিছুই বুঝতে পারছে না। মনের মধ্যে আবারও আজগুবি চিন্তা কাজ করতে থাকলো। নিভ্র এবার তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ দেখতে পারছে সে। নিভ্র এবার বলে ওঠলো……..
—আমায় বিশ্বাস করো তো মৌনি?
—হুমম।
—তাহলে?এত ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি যার জন্যই তোমার বাড়িতে যাওয়া।
.
মৌনি আর কিছু বললো না। নিভ্রকে সে প্রচন্ড বিশ্বাস করে।
জীপটা এবার হাইওয়েতে ওঠার পর সোহান থামিয়ে দিলো। একটা ট্রাক পেলেই নিভ্র মৌনি তাতে উঠে পড়বে।বেশ কিছুক্ষণ পর এসে পড়লো সেই কাঙ্খিত সময়টা। একটা ট্রাক আসছে। নিভ্র ট্রাকটা থামিয়ে কমিল্লায় যাবার কথা বললেই চালক রাজি হয়ে যায়।
অতঃপর দুজনেই ট্রাকের পেছনে গিয়ে উঠলো। সোহান-লিজা-নিশু-তুর্য সবাই অন্যমনস্কভাবে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।বিগত কয়েকদিনে নিভ্রর বন্ধুরা মৌনিকে খুবই আপন করে নিয়েছিলো। তাদের ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ যদি মৌনিকেই তাড়া করে তবে নিভ্রর কি অবস্থা?
.
সময় আর মানুষ কখনও স্থায়ী থাকে না। জীবনের পাল্লাক্রমে এরা হারিয়ে যায়। নিভ্র মৌনির এই প্রেমানুভূতিতে হয়তো ওদের অধ্যায় শেষ হয়ে চলেছে। এবার শুধু অপেক্ষা আগামী মুহূর্তের ; যেখানে দুজনের একটি পরিপূর্ণ সমাপ্তি থাকবে।
—তুমি কখনও ট্রাকে চড়েছো মৌনি?
—না। এই প্রথম চড়লাম।
—উপভোগ করো সময়টা। হয়তো এই সময়টা আর কখনও নাও আসতে পারে।
নিভ্রর এসব ছোটোখাটো কথাতেই মারাত্নক অভিজ্ঞতার পাল্লা আছে। নিভ্রর কথামতো মৌনিও আপনমনে উপভোগ করার চেষ্টা করলো সময়টিকে।
.
.
.
~চলবে~
পর্বটি কেমন লেগেছে তা দুটো বাক্যে জানানোর জন্য অনুরোধ রইলো।
.
.#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here