চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা পর্ব ১

মিতাভাই বিষ খেয়েছে, খবরটা আমি যখন পেলাম তখন মাত্রই আমি কলেজ থেকে ফিরেছি।

দুপুর দুটো বাজে। অনেকটা দূর কলেজ আমাদের বাড়ি থেকে। সকাল সাতটায় বাসা থেকে বেরোতে হয়। তখন কিছু খাওয়ার রুচি থাকেনা। অফপিরিয়ডে কমনরুমে বসে দুটো আলুর সিঙ্গারা খেয়েছিলাম। খিদেয় তলপেটে ব্যথা করছে। কলেজে ইউনিফর্ম আছে আমাদের। এশ কালারের এপ্রন, মেয়েরা যারা বোরখা পরে তারা এশ কালারের বোরখা বানিয়ে নেয় এপ্রনের বদলে। আমি বোরখাওয়ালি। শুধু পর্দানশিন হওয়ার জন্য বোরখা পরি না আমি, বোরখা অনেকটা ইউজার ফ্রেন্ডলি। নতুন নতুন জামা কেনা লাগে না, চুলসেট করার ঝামেলা থাকে না। সময় বাঁচে অনেক।
বোরখাটা খুলেই, ফুলস্পিডে ফ্যান চালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছি।
প্রতিদিন কলেজ থেকে ফিরে হাত-পা না ধুয়েই বিছানায় খানিকটা সময় গড়াগড়ি করি আমি। তখনই পিউ আপা এলো খবরটা নিয়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল ‘ছুটি, ও ছুটি মিতাভাই হাসপাতালে।’

ধ্বক করে উঠল আমার বুকের ভেতরটা। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম ‘কী বলছ আপা?’

‘হ্যাঁ।’

‘কে বলল তোমাকে?’

‘আমি তো কলেজ যাইনি। কনকের হলুদে যাব বলে। সকালে দেখলাম বড়চাচার বাসায় কান্নাকাটি। তখনই তো এ্যাম্বুলেন্স এলো, হাসপাতালে নিয়ে গেলো।’

‘কখনকার ঘটনা আপু? মিতাভাই কেমন আছে?’

‘জানিনা। বাবা গেছে তো এ্যাম্বুলেন্সেই। মা আর ছোটচাচি যাবে।’

‘আমিও যাব।’ কেঁদে ফেললাম আমি।

‘তাহলে আমিও যাব। কিন্তু আমাদেরকে কি নেবে?’ পিউ আপুকে চিন্তিত দেখাল। ‘আচ্ছা মিতাভাই এটা কেন করল রে? জানিস কিছু? প্রasha
রেমের কোনো ব্যাপার?’

আমি কান্নার ভেতরও ঢোঁক গিলে নিলাম। আমি তো জানি কী ব্যাপার! কথায় বলে যার কপাল পোড়ে সেই সবার আগে গন্ধ পায়! আমার কপালতো আরও আমার নাকের ডগাতেই পুড়ছিল। সাথে সাথে আমিও পুড়ছিলাম একটু একটু করে পুরোটাই। এইতো সবে পোড়া মনে বসন্ত বাতাস বইতে শুরু করেছিল আর পুরো দুনিয়াতেই আগুন লেগে গেলো আমার?

আমাদের বাড়িটা পুরোনো বিরাট দালান ভেঙে নতুন ফ্ল্যাটবাসা করা হয়েছে। পাঁচতলা। তিনতলায় আমরা থাকি। দোতলায় বড়চাচা আর চারতলায় মেজচাচা। নিচতলায় স্কুল ভাড়া দেওয়া। মেজচাচার অর্ধেক আর পাঁচতলার পুরোটা ভাড়া দেওয়া। বড়চাচার দুইছেলে, ছোট আমার বাবা, আমরা দুইবোন আর মেজচাচার একটা মেয়ে। বড়চাচার বড়ছেলে সবার বড় মিফতাহুল ইসলাম। এই মিফতাহুল শর্ট করে মিতা হয়ে গেলো কবে কে জানে? আমি ছোটবেলা থেকেই মিতাভাই বলেই ডাকছি। সবাই মিতাভাই ডাকে। পাড়ার ছেলেরা, মুদি দোকানদার, ক্যাবলওয়ালা এমনকি আমার বাবাকেও দেখি মাঝেমাঝেই ‘মিতাভাই কই’ বলে ডেকে ওঠে। ছেলেবুড়ো সবার তিনি মিতাভাই।

এতো জনপ্রিয় তিনি কেন হলেন বুঝিনা আমি; তিনি খান কম, লোকের সাথে মেশেন কম, কথা বলেন কম, বোঝেন আরও কম! কাজিন আমরা, একবাড়িতেই থাকি অথচ বছরে তিনি আমার সাথে কটা কথা বলেন তা আমি আঙুল গুণে বলতে পারব।

যখন নাইনে পড়ি তখন থেকেই আমার কী হলো কে জানে, মিতাভাই মিতাভাই করে আমার প্রাণ আনচান করতে থাকে। সবার ছোট হলে কী হবে, ইঁচড়ে পাকা আমি। আমি অংকে আটাশ পেয়ে ফেল করি, মা মিতাভাইকে বলে দেন ছুটিতে বাড়ি আসলে আমাকে যেন অংকটা দেখিয়ে দেয়। মিতাভাই আসেনা। আমি যাই নিচের তলায়। বুকের উপর অংকবই নিয়ে মিতাভাইর টেবিলে গিয়ে বসি, ডাইনিং থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। মিতাভাই তাকায় না। বকে। ‘কীরে ছুটি? অংকে কেউ আটাশ পায়? গাধারাই শুধু অংক পারে না। করবি কী জানিস, সুত্রগুলো মুখস্ত করবি না। সুত্রগুলো কোথা থেকে এলো, কিভাবে এলো সেটা শিখবি। এই দেখ এ প্লাস বি হোলস্কয়ার ইজ ইকুয়াল টু এ স্কয়ার প্লাস টু এ বি প্লাস বি স্কয়ার – এভাবে পড়লে কিনতু ভুলে যাবি। কিন্তু তুই যদি জানিস এ প্লাস বি হোলস্কয়ার মানে এ যোগ বি পুরোটার স্কয়ার মানে এ প্লাস বি গুণ এ প্লাস বি। তাহলে কী হলো? এ গুণ এ সমান দুটো এ মানে হলো স্কয়ার… মনে থাকবে? এভাবে পড়লে গণিতে ভালো লাগবে। প্রেম করতে ইচ্ছে করবে অংকের সাথে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এপ্লাইড ম্যাথমেটিকস এর মাস্টার্স এর ছাত্র মিফতাহুল ইসলাম আমাকে গণিতের উপর লেকচারই দেয় এক ঘন্টা। আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখি তার দিকে। ‘এ আর বি মিলে কী হবে কে জানে, আপনি আর আমি মিলে গেলে দারুণ একটা জিনিস হবে, মিতাভাই।’ নিজেকে নিজে ফিসফিস করে বলি। মিতাভাই শোনেনা, মিতাভাই দেখেনা, সে শুধু কলম নিয়ে খাতায় কতকগুলো সার্কেল আঁকে। আঁকতেই থাকে। আমি তাকিয়ে থাকি। কী সুন্দর ফ্রিহ্যান্ড বৃত্ত আঁকে মিতাভাই। একটার উপর একটা আঁকতেই থাকে। যতক্ষণ কথা বলে ততক্ষণই আঁকে। মেপে দেখা যাবে সবদিকে পরিধি সমান। আমিতো পেন্সিল কম্পাসেও এতো সুন্দর বৃত্ত আঁকতে পারিনা। আমি মুগ্ধ হই। মিতাভাই যাই করে তাতেই আমি মুগ্ধ হই। যখন বকে তাতেও আমি মুগ্ধ হই। আসলেই বকাই তো উচিত আমাকে। এতো সহজ অংক। তাতে কেউ আটাশ পায়? খাতটা বুকে করে উপরে আসি আমি। কলমটা জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। যতন করে আলমারিতে তুলে রাখি।
আমি আরও বেশি করে মিতাভাইর প্রেমে পড়ি। তাকে দেখে জ্বর জ্বর লাগে আমার। সবসময় শীত শীত করে। বেহায়াপনা করতে ইচ্ছে করে। মিতাভাইর বিছানায় এলোমেলো পড়ে থাকা লেপের ভিতর তাকে নিয়ে ডুব দিতে ইচ্ছে করে।

ইশ কী সুন্দর করে কথা বলে মিতাভাই। কথা বলতে বলতে আঙুল দিয়ে নাকের পাশটা চুলকে নেয়, কলারটা ঝাড়া দেয়। অংক দূরে থাক আমি মানুষটার প্রেমে পড়তে থাকি।

পরের পরীক্ষায় অংকখাতায় আমি গোল্লা পাই! কী হবে অংক করে? আমার কোন অংকই তো মেলে না। আমি তো সুত্র পারিনা। বেসিকই তো ভুল আমার। সব ভুল আমার।

প্রেমে আমার যখন প্রবল জ্বর, জ্বরে আমি যখন বেহুঁশ তখন আমার জ্ঞান ফেরে আমাদের সামনের বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা কনক আপাকে দেখে। কনক আপা একটা মেমপুতুল। মোমের মতো গলে যাবে এমন স্কিন টেক্সচার। এমন রূপসী কেন হতে হলে তাকে? আর ঠিক মিতাভাই’র জানালার সামনের বারান্দায় এসে রোদ পোহাতে তাকে কে বলে দিলো? ছাদের উপর বিকেলের বাতাসে শুকনো চুল উড়িয়ে না দিলে কি তার ভালো লাগে না? আর মিতাভাই? সপ্তাহের মাথায় বাড়িতে আসা মিতাভাই কেন এখন বাড়ির থেকেই ক্লাস করে? ছাদের সিঁড়িতে কাঠের নাকি সিমেন্টের রেলিঙ দেওয়া আগে কি জানত সে? এখন জানতে চাও, দিব্যি বলে দেবে ছাদের টবের অপরাজিতায় কয়টা নীল ফুল এসেছে, কয়টা চডুই বিকেলের আলোয় ফুড়ুৎ করে! চোখের সামনেই মিতাভাই আর কনক আপার প্রেমটা আমি ঘটতে দেখছিলাম। চোখে চোখে কথা হয়, চোখ যে মনের কথা বলে – মাখো মাখো এই প্রেম আমাকে ভেঙেচুরে দিতো। তবু আমি মিতাভাইতে মুগ্ধ ছিলাম। তার প্রেমও আমাকে মুগ্ধ করত। ইশ এমন করে কেউ প্রেমিকার দিকে তাকায় বুঝি?

আমার জানালাটাও মিতাভাই’র জানালার বরাবর উপরে চারতলায়। আমার উল্টোদিকের দোতলায় কনক আপার জানালা, ব্যালকনি। কনক আপা বারান্দায় বসে চাল বাছে, দেখেই আমি নিচে দৌঁড় দেই। একদৌঁড়ে মিতাভাইর ঘর। ঠিক জানালার সামনে তার পড়ার টেবিল, চেয়ারে বসে চুপচাপ সে। আমি সব বুঝে যাই। বুকের মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার কষ্টটুকু নিয়ে আমি ঘরে আসি। কনক আপাকে যখন ব্যালকনিতে পাইনা, জানালায় নেই আমি তখন ছাদে যাই। একজন এই ছাদে, আরেকজন ওই ছাদে। ওরা দুজন দুজনকে দেখে, আমি ওদেরকে দেখি, মিতাভাই’র চোখে প্রেম দেখি আমি। আমি মুগ্ধ হই। মুগ্ধতা চোখে এঁটে আমি কাঁদতে বসি। গরমের দিনে পাখা বন্ধ করে ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে কাঁদি, শীতের দিনে ফ্যান ছেড়ে লেপের নিচে কাঁপতে কাঁপতে কাঁদি। পিউ আপা বলে ‘কাঁদিস কেন ছুটি?’

আমি কাঁদতে কাঁদতে কাঁদি।

পিউ আপা আবার বলে ‘তুই কাঁদিস কেন? কোথায় কষ্ট তোর?’

‘আমার কোনো কষ্ট নেই আপা।’ বলেই আপাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কাঁদি আমি। ‘আপারে, আমার অনেক কষ্ট।’

পিউ আপা আর কনক আপা একসাথে এইচ এস সি দিলেন। রেজাল্ট আসলে দেখা গেলো পিউ আপা এ প্লাস পেয়েছে কিন্তু কনক আপা বি গ্রেড পেয়ে পাশ করেছে টেনেটুনে। মিতাভাই মন খারাপ করেন। কথা না বলা মিতাভাই উদাস হয়ে বলেন ‘আর একটু চেষ্টা করলেই এ গ্রেডটা অন্তত আসত, তাই না রে?’ কথাটা সবাইকে বললেও কার কথা বলছে মিতাভাই, অন্য কেউ বোঝে না। আমি শুধু বুঝি। কপাল তো শুধু আমারই পুড়েছে। সে পোড়া কপাল নিয়ে আমি মিতাভাই’র মন খারাপ হওয়া দেখি। তার মন খারাপও আমাকে মুগ্ধ করে। ইশ, আমি অংকে শুণ্য পেলেতো মিতাভাই মন খারাপ করল না!

কনক আপারও খুব মন খারাপ হলো। দুইদিন বারান্দায় কাপড় মেললেন না। ছাদের টমেটো গাছে পানি দিতে এলেন না! মিতাভাই উদ্ভ্রান্ত হলেন, তার সাথে আমিও। তার ছটফটানি দেখেও আমি মুগ্ধ হই। আমিও অপরাজিতা গাছগুলোকে পানি খাওয়াব না, ভিজে তোয়ালে মেলে দেব না। আমার জন্য কি উদ্ভ্রান্ত হবেন, মিতাভাই?

আমি মুগ্ধ মিতাভাইতে, এবার আমাতে মুগ্ধ করার চেষ্টা করলাম তাকে। কীসে বেশি খুশি হবে সে, কী ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি? বই। মিতাভাই পড়তে ভালোবাসে। অংক ভালোবাসে। কনক আপাকে ভালোবাসে। আমিও নতুন করে বইখাতাকে জড়িয়ে ধরলাম। অংক কষতে গিয়ে মিতাভাই’র সমান করে ছাঁটা চুলগুলোকে মনে করে মুগ্ধ হলাম। কনক আপার হাসির মায়ায় জড়িয়ে গেলাম। আর কিছু হোক না হোক আমার রেজাল্টবুকে নম্বর বাড়ছিল। টেস্টে ম্যাথ আর হায়ার ম্যাথে লেটার পেলাম। মা খুশি হয়ে মিতাভাইর পছন্দের তেহেরি রান্না করল। আমিও নিজের রেজাল্টে আবার মিতাভাইতে মুগ্ধ হলাম! হটপট ভরা তেহেরি নিয়ে, না খেয়ে আমি অপেক্ষা করলাম কখন ফিরবে মিতাভাই? সেদিন মিতাভাই ফিরলেন না। পরেরদিন ইউনিভার্সিটিতে তার ইন্টারভিউ ছিলো, টপার হওয়াতে ওখানেই ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করছেন তিনি। অপেক্ষা করতেও আমার ভালো লাগে। মিতাভাইতে মুগ্ধ আমি অপেক্ষা করি, কবে মিতাভাই আমাতে মুগ্ধ হবে?

এস এস সিতে সবাইকে অবাক করে সবকয়টায় লেটার নিয়ে এ প্লাস পেলাম। মিতাভাই শুধু মাথা তুলে বললেন ‘বেশ।’ আমি মন খারাপ করলাম না। অপেক্ষা করলাম একদিন মিতাভাই ঠিক মুগ্ধ হবে। এসে বলবে ‘সত্যি ছুটি? তুই এতোভালো করলি?’

আমার অপেক্ষা কি এমনভাবে শেষ হবে? আমি যে চাতকপাখির মতো অপেক্ষায় আছি, কবে একটুখানি মুগ্ধতা দেখব মিতাভাইর চোখে, আমার জন্য!

কনক আপার বিয়ে কাল, আজ গায়ে হলুদ। পাত্র বিরাট ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী খুব সাধারণ কথা, সে শিল্পপতি। সেও মুগ্ধ কনক আপাতে। কোটি কোটি টাকা তার। টাকার জোরে মিতাভাইর মুগ্ধতা ফিকে পড়ে গেলো। কনক আপার বিয়ের খবরে আমি মিতাভাইর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মুখের রঙ পাল্টাল না। শুধু চোখটা ক্লান্ত হলো। সেই ক্লান্ত, ভারি, উদাস চোখের দিকে তাকিয়েও আমি মুগ্ধ হলাম। আমিতো শুধু মুগ্ধ হতে চাই, আর তো কিছু চাইনা। তাকে পেতে চাওয়া, একটু ছুঁয়ে থাকার চাওয়া আমার জন্য অনেক বড় প্রত্যশা। আমি বড় সাধারণ মেয়ে। তার মতো দেখতে ভালো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের মতো বিষয়ের প্রভাষক, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো আর ভদ্র ছেলেটাকে আমার মতো গোলগাল আলু দেখতে, কিছু না পারা মেয়েটা কি নিজের করে চাইতে পারে কখনো? অত ভয়ংকর চাওয়া কি আমি চাইতে পারি?

পিউ আপা আমাকে ধাক্কা দিলো। কেঁদে ফেলে বলল, ‘ছুটি, মিতাভাই বাঁচবে না মনে হয়।’

চলবে…

#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ১
(কপি করা যাবে না।)

Afsana Asha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here