হৃদয়ের দহন পর্ব -০১

বধূর সাজে তেরো বছরের ছোট্ট বালিকাটি মাথায় বড় একটি ঘোমটা দিয়ে বসে আছে! ভয়ে সে নড়াচড়া করার মতো শক্তি টুকুও হারিয়ে ফেলেছে!
কিছুক্ষণ পর বরের বেশে সানভী রুমে প্রবেশ করলো। সে রুমের দরজা লক করতেই দেখলো মেয়েটি ঈষৎ কেঁপে উঠল। সে ধীর পায়ে বিছানার এক কোনায় গিয়ে বসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো-
–“নাম কি তোমার?”
মেয়েটি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
–“জ্বি নীলা!”

সানভী বুঝতে পারলো নীলা ওকে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। তাই সে নীলার ভয় দূর করার জন্য বললো-
–“মাথায় এতো বড় একটা ঘোমটা টেনে রেখেছো কেনো? লজ্জায়?”
নীলা আগের মতোই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
–“জ্বি না!”
–“তাহলে এমন জড়সড় হয়ে মাথায় ইয়া বড় একটা ঘোমটা টেনে বসে আছো কেনো? নরমাল ড্রেস পরে নাও!
নীলা তবু আগের মতোই বিছানার এক পার্শ্বে গুটিশুটি মেরে বসে রইলো।

নীলার আচরনে এবার সানভীর কিছুটা হাসি পেলো। কিন্তু সে হাসি চেপে রেখে বললো-
–“ভয় নেই! আমি তোমায় স্পর্শ করবোনা! তুমি নির্দ্বিধায় ড্রেস চেঞ্জ করে এসে ঘুমুতে পারো!”
সানভীর কথায় যেনো নীলা প্রান ফিরে পেলো! সে গুটি গুটি পায়ে ওয়াশ রুমে গেলো ড্রেস চেঞ্জ করতে। আর সানভী পাগড়ী টা খুলে রেখে বিছানার এক পার্শ্বে শুয়ে পরলো!

নীলার মা বহুদিন ধরে সানভীদের বাসায় কাজ করতেন! উনি খুব সৎ আর কর্মঠ মহিলা ছিলেন! এজন্য সানভীর মা সাহানা বেগম ওনাকে অনেক ভালোবাসতেন। নীলা মাঝে মাঝেই ওর মায়ের সাথে এসে এটা ওটা কাজ করতো!
খুব অল্প বয়স থেকেই নীলা প্রতেকটা কাজ নিখুঁত ভাবে করতে পারতো। যেটা সানভীর মাকে সবসময় মুগ্ধ করতো!

সব ঠিকঠাকই চলছিলো। কিন্তু হঠাৎই আজ সকালে খবর আসলো নীলার মা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেছে। সাহানা বেগম তার পরিবারের সকলকে নিয়ে নীলার মায়ের দাফন কাফনের কাজ সম্পন্ন করলেন।

শেষে চোখ পরলো নীলার উপরে! এই পৃথিবীতে নীলার আপনজন বলতে ওর মা ছাড়া আর কেউ নেই। সাহানা বেগম অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন তার একমাত্র সন্তান সানভীর সাথে নীলাকে বিয়ে করিয়ে দিবেন! তারপর নিজের পুত্রবধূ করে সারাজীবন নিজের কাজেই রাখবেন।

যেই ভাবা সেই কাজ। সানভী প্রথমে অনেক আপত্তি করলেও পরে মায়ের মন রক্ষার্থে রাজি না হয়ে আর পারলোনা। কারন কাজের মহিলার মেয়েকে বিয়ে করাটা, সে খুব সহজে মেনে নিতে পারছিলো না! যদিও তার কোথাও কোন মেয়ের সাথে রিলেশন নেই তবুও!

নীলা থ্রি পিচ পরে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলো। সানভী একবারো নীলার দিকে তাকালো না পর্যন্ত! এমনকি কোন কথাও বললো না! আর তাতেই নীলা বেশি কমফোর্ট ফিল করলো। সে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো!
তাদের মধ্যে আর কোন কথা হলো না! কিছুক্ষন পর দুইজন দুইদিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পরলো।

পরদিন সকালে নীলার ডাকে সানভীর ঘুম ভাঙলো। সে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলো নীলা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখ ডলতে ডলতে সানভী বিছানা থেকে উঠে পরলো। সে এই প্রথমবার নীলাকে খুব কাছ থেকে ভালো ভাবে দেখলো।

নীলার মাথায় ঘাড় পর্যন্ত ছোট ছোট চুল। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের বরণ। মুখ ভর্তি ছোট ছোট দাগ! শরীর টা ভীষণ শুকনো! চোখ গুলোও বসে গেছে! চেহারায় সৌন্দর্য বলতে কিছুই নেই। সানভীর বিরক্তি যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো!

শুধু মায়ের মন রক্ষার্থে নীলার সাথে কোন উল্টা পাল্টা আচরন করতে পারছে না। কিন্ত সবসময়ই নীলার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলছে!

নীলাকে কোন দিক থেকেই সানভীর সাথে মানায় না। সানভী বিশাল ঢণাঢ্য বাবা মার একমাত্র সন্তান। যেমন ট্যালেন্ট স্টুডেন্ট তেমনি সুন্দর দেখতে। ছয় ফিট লম্বা। কাঁচা স্বর্নের মতো গায়ের বরণ! ছিপছিপে শরীর। চোখ দুটো ভাসা ভাসা। ভরাট ঠোঁট। ধনুকের মতো জোর ভ্রু আর তীক্ষ্ম নাকে তার সৌন্দর্য যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।

সানভী ভিষন ম্যাচিউর একটা ছেলে। সে নীলার সাথে খুব নরমার ভাবে মিশতে লাগলো। যাতে ফ্যামিলির কেউ ওর আচরন দেখে বুঝতে না পারে যে নীলাকে তার পছন্দ নয়। কিন্তু নীলার বয়স অল্প হলেও সে ঠিকই আঁচ করতে পারলো সানভী ওকে পছন্দ করে না। তবে নীলার তাতে কিছু যায় আসে না। কারন সে দুবেলা দুমুঠো খেতে পরতে পারলেই মহাখুশি। তাছারা সানভীর মাও তাকে অনেক ভালোবাসে! এটাই তার কাছে অনেক। এর চেয়ে আর বেশি কিছু সে চায়না! আশাও করেনা!

এভাবেই কয়েকদিন কেটে গেলো। সানভী মাস্টার্স কমপ্লিট করার জন্য লন্ডনে চলে গেলো!
তিন বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন সানভী দেশে ফিরতে চাচ্ছিলো না, তখন ফ্যামিলির সবাই বুঝতে পারলো, ওর সমস্যা টা কোথায়! তার উপরে আবার লন্ডন যাওয়ার পর থেকে সানভী কখনো নীলার সাথে কথা বলেনি!

নীলা এই তিন বছরে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে! অনেকটা বড়ও হয়ে গেছে! সে আর আগের মতো নেই। অনেক সুন্দরীও হয়ে গেছে! কোমড় অব্দি ছড়ানো সোনালি চুল, দুধে আলতা গায়ের বরন, ঘন কালো ভ্রু! হরিনীর মতো টানা দুই চোখের ঢলঢল চাহনী, দীর্ঘাকৃতির হালকা পাতলা শরীর, যেনো সদ্য ফোটা ফুলের মতো নগ্ন রুপসী। ছুঁয়ে দিলেই মুড়ে যাবে!

নীলা যখন বুঝতে পারলো সানভী ওর জন্যেই বাসাতে আসছে না, তখন সে বাধ্য হয়ে সানভীকে ডিভোর্স দিতে চাইলো! কিন্তু সানভীর মা সাহানা বেগম কিছুতেই সেটা মেনে নিতে চাইলেন না। তিনি নীলাকে ওনার মায়ের বাসায় রেখে আসলেন। ওনার মা অনেক বয়স্ক মহিলা। তাকে দেখাশুনা করার জন্য একটা মেয়ে রাখা ছিলো। তিনি সেই মেয়েকে বাদ দিয়ে নীলাকে তার মায়ের দেখাশোনা করার জন্য রাখলেন। যাতে একি সাথে দুই কাজ হয়ে যায়।

নীলার বাসা থেকে চলে যাওয়ার কথা শুনে কয়েকদিন পরই সানভী দেশে ফিরে আসলো। এসেই সে নীলাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলো। আর অবশেষে পেয়েও গেলো! সে ওর মাকে জানালো, যদি ওনারা নীলাকে ডিভোর্স দিতে না দেয়, তাহলে সে লন্ডনে গিয়ে আর কখনো দেশে ফিরবে না!

শেষে অনেক ভেবে চিন্তে সাহানা বেগম তার ছেলেকে বললেন-
–“নীলাকে ডিভোর্স দেওয়ার দরকার নেই। সে কখনো তোর সামনে এমন কি এই বাসাতেও আসবে না! চলবে?” সানভী তবু ডিভোর্সের বিষয়টার জন্য সে মুখ ভার করে বসে রইলো!
সাহানা বেগম সেটা বুঝতে পেরে বললেন-
–“তুই যদি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাস তাহলে করতে পারিস! এতে নীলার কোন আপত্তি নেই! তবে সে বেচারী অনাথ মেয়ে। ডিভোর্সের কথা শুনে যদি কোন অঘটন ঘটায় সেই ভার কে নেবে?”
সানভী তবু চুপ করে রইলো! সাহানা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-
–“সে কখনো তোর কাছে স্বামীর অধিকার চাইতে আসবেনা। অমন মেয়ে সে নয়! এতটুকু আস্থা রাখতে পারিস!”
সানভী নাছোড় বান্দা। সে কোনভাবেই তার মায়ের কথাতে সায় দিলোনা!

এতে সাহানা বেগম মনে মনে অনেক কষ্ট পেলেন! তবে সেটা সানভীকে বুঝতে দিলেন না। কারন তিনি নীলাকে সারাজীবনের জন্য পুত্রবধূ করে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের অটল সিদ্ধান্তে তিনি হার মেনে গেলেন।

কয়েকদিন পরই নীলার কাছে এক দুঃসংবাদ আসলো! সানভী ওকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে! সে প্রথমে কিছুটা কষ্ট পেলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো। সানভীর দেওয়া অবহেলা সহ্য করতে করতে সে এখন অনেক বড় বড় কষ্টও হজম করতে শিখে গেছে!
নীলা ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে সানভীদের বাসায় রওনা দিলো! কারন সে আজ সানভীকে অনেক কিছু বলতে চায়। যেগুলো সে তিনটা বছর ধরে মনের মধ্যে জমা করে রেখেছে!

#হৃদয়ের-দহন
#Mst Shefa Moni
#পর্বঃএক

চলবে….

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here