হৃদয়ের দহন পর্ব -০২+৩

#গল্পঃ হৃদয়ের-দহন
#Mst Shefa Moni
#পর্বঃদুই+তিন

সানভী বাইকটা স্টার্ট করে লুকিং গ্লাসে তাকাতেই দেখলো এক পরমা সুন্দরী মেয়ে মাথা নিচু করে তাদের বাসায় প্রবেশ করছে! পরনে তার হালকা আসমানী রংয়ের একটা শাড়ি। মাথায় আঁচল তুলে দেওয়া। হাতে একটা সাদা কাগজ। মেয়েটিকে যতক্ষণ পর্যন্ত লুকিং গ্লাসে দেখা যায় সানভী ততক্ষণ পর্যন্তই তাকিয়ে দেখলো।

তবে মেয়েটিকে যে সে এতো নিখুঁত ভাবে দেখছে সেটা কিন্তু সে বুঝতে পারছেনা। কারন সে এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

মেয়েটি যখন একদম সানভীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো তখন সানভী ইচ্ছা করেই জোরে একটা হর্ন দিলো। আর অমনি মেয়েটির হাত থেকে কাগজটি পরে গেলো! সে যখনি নিচু হয়ে কাগজটি উঠাতে গেলো তখন তার মাথা থেকে আঁচল পরে গেলো! আর সানভী চোখ ভরে তাকে দেখে নিলো! সে এমন অপরুপা সুন্দরী মেয়েকে আগে কখনো দেখেনি!

মেয়েটি কাগজ তুলে নিয়ে আবার মাথা নিচু করে সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগলো। কিন্তু কয়েক পা এগুতেই সে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে ঘুরে সানভীর দিকে তাকালো! খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়েই আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো! মেয়েটির অমন তীক্ষ্ম চাহনিতেও সানভীর নেশা ধরে গেলো! সে পুরোই ক্রাশ খেয়ে গেলো!

সানভীর ইচ্ছে করছিলো কোর্টে না গিয়ে মেয়েটির পিছু পিছু বাসায় প্রবেশ করতে। কিন্ত তাতে মেয়েটির কাছে তার ওয়েট কমে যাবে ভেবে সোজা কোর্টের অভিমুখে রওনা দিলো!

সাহানা বেগম তখন ডাইনিং রুমের সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন। এমন সময় নীলাকে দেখে উনি যেনো আকাশ থেকে পরলেন। নীলা ওনার অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরে বললো-
–“ভয় পেওনা বড়মা! আজ আমি কোন আবদার নিয়ে আসিনি! শুধু ওনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি!”
সাহানা বেগম নীলার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন! কয়েক সেকেন্ড পর আমতা আমতা করে বললেন-
–“আমি খুব করে চেয়েছিলাম মা, সারাজীবন তোকে নিজের কাছে আগলে রাখতে! কিন্তু সে তো খাঁটি সোনা চিনতে জানলো না!”

নীলা কোন কথা না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো। সাহানা বেগম সানভীকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বললেন।
মায়ের ফোন পেয়েই সাথে সাথে সে বাসায় রওনা দিলো। যদি বাসায় গিয়ে ঐ মেয়েটিকে আবার দেখতে পায় সেই আশায়!

কিছুক্ষণ পর সানভী বাসায় আসলো। এবং তার মনোবাসনাও পূর্ণ হলো। সে মেয়েটিকে সোফায় বসে থাকা অবস্থায় দেখতে পেলো। মেয়েটিকে দেখা মাত্রই তার মনে ব্যান্ড বাজতে লাগলো! যদি কোন ভাবে পটিয়ে পাটিয়ে নেওয়া যায় মনে মনে তার ছক কষতে লাগলো!

–“সানভী বউমা তোর সাথে কিছু কথা বলতে এসেছে!”
সাহানা বেগমের কথায় সানভীর চমক ফিরলো! সে আশ্চর্যের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়ে বললো-
–“বউমা?”
সানভীর মুখে বউমা কথা শুনে সাহানা বেগম ভাবলেন হয়তো বউমা বলাতে সে রাগ করেছে! তাই তিনি বিষয়টা সহয করার জন্য বললেন-
–“নীলা তোর সাথে কিছু কথা বলতে এসেছে!”
সানভীর কাছে এতোক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো। সে বুঝতে পারলো এই মেয়েটায় তার স্ত্রী ছিলো! কিন্তু সে অবাক হয়ে গেলো এই ভেবে যে সেদিনের সেই ছোট্ট বালিকাটি আজ এতো বড় হয়ে গেছে। এতো রুপসী হয়ে গেছে!!
কতোটা অবহেলায় আর অযত্নে তার বাল্যকাল কেটেছিলো যে অমন চাঁদের মতো সুন্দর মুখ খানি কালো মেঘের আবরণে ঢেকে গিয়েছিলো। সানভী মনে মনে বেশ অনুতপ্ত হলো!

নীলাকে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যেতে দেখে সানভীর ভ্রম কেটে গেলো। সে নীলার পিছু পিছু ছাদে উঠতে লাগলো!

এদিকে নীলার ভেতরে দ্বিধা দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। সে কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে মনে মনে সেসব আউরে নিতে লাগলো! সে ছাদের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালো! সানভীও ধীর পায়ে ওর পিছু পিছু গিয়ে ওর থেকে সামান্য দূরে গিয়ে দদাঁড়ালো। সানভীর ভেতরেও খুব অস্বস্তিবোধ কাজ করছে। কারন সে প্রতিটা পদে পদে বুঝতে পারছে সে নীলাকে কতোটা অবহেলা করেছে!

নীলা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে স্বাভাবিক ভাবে বলতে শুরু করলো-
–“আসলে আমি তো আপনার মতো অতো বেশি পড়াশোনা করিনি! তাই বুঝতে পারছিনা কোনটা বলা ঠিক হবে আর কোনটা বলা ভুল হবে। তবে আপনি তো অনেক শিক্ষিত মানুষ। আমার ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন!”
সানভী কোন কথা বললো না। শুধু চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো!

নীলা সানভীর দিকে তাকিয়ে বললো-
–“আমি খুব গরীব ঘরের মেয়ে আর দেখতে অসুন্দর বলে আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাতে আমার কোন রাগ নেই। কারন আপনাকে পাওয়ার মতো যোগ্যতা সত্যিই আমার নেই। কিন্ত আপনি কি চাইলে আমার উপর একটু সহানুভূতিশীল হতে পারতেন না? আপনাদের বাসায় খেয়ে পরে কতো কুকুর বেড়াল বড় হচ্ছে। আমি তো সেভাবেই দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে থাকতাম। কখনো ভুল করেও আপনার কাছে স্বামীর অধিকার চাইতে যেতাম না! যে মেয়েটার নিজের বলতে কিছুই নেই তার কাছে আপনার এতো কিসের অহংকার? অহংকার তো তার সামনে করা সাজে, যার কাছে অহংকার করলে পাল্টা তারও অহংকার দেখানোর সামর্থ্য থাকে!”

শেষ কথা গুলো বলতে গিয়ে নীলার কন্ঠ আটকে যেতে লাগলো। ঠিক কান্নার পূর্ব মহুর্তে যেমন সবার কন্ঠ আটকে যেতে লাগে তেমন।

সানভী লজ্জায় কোন কথা বলতে পারলোনা! কিন্তু তবু অহংকারের ভারে জর্জরিত হয়ে নীলার কথায় ভ্রু জোড়া কুঁচকে রাখলো!
নীলা এবার সানভীর দিকে না তাকিয়েই বললো-
–“অনেক কিছু বলার ছিলো! কিন্তু থাক! যেখানে কোন সম্পর্ক নেই সেখানে যতো কম কথা বলা যায় ততোই ভালো! আমি ডিভোর্স পেপারে সাক্ষর করে এনেছি।”

কথাটা বলেই সে কাঁপা কাঁপা হাতে সানভীর দিকে কাগজ টা এগিয়ে দিলো। সানভীর মন চাচ্ছিলো কাগজ টা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। নীলাকে চিৎকার করে বলতে, যে সে এই ডিভোর্স মানেনা। সে যা করেছে তা সব ভুল করেছে! কিন্তু না! সে কিছুই বলতে পারলো না ! তার অহংকারের জোরে। ইগোর জোরে।
–“কাগজ টা নিন!”
সানভী হাত বাড়িয়ে কাগজ টা নেওয়ার সময় একপলক নীলার দিকে তাকালো। সে দেখলো নীলার চোখ রক্তজবার ন্যায় লাল হয়ে আছে! চোখ ভর্তি পানি টলমল করছে!

নীলা ভেবেছিলো সানভী হয়তো ওকে দেখে সবকিছু ভুলে যাবে। আবার সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে! কিন্তু না। সানভীর মুখে অনুতপ্তের ছাপ ফুটে উঠলেও মুখ ফুটে তা বের হলো না।

সানভী বুঝতে পারছে, নীলা ওকে এখনো চায়! কিন্তু সে নিজের ইগো আর অহংকারের জোরে একটা সরি বলার সাহস টুকুও পাচ্ছে না!

সানভীকে চুপ থাকতে দেখে নীলা নিজ থেকে আর কোন কথা না বলে চলে যেতে লাগলো! কিন্তু কয়েক পা ফেলতেই সে থেমে গেলো! নীলাকে থেমে যেতে দেখে সানভীর বুকে যেনো আশার সঞ্চার হলো। সে মনে মনে চাইলো নীলা ঘুরে এসে ওকে বলুক, সে ডিভোর্স দিতে রাজি না। তারপর সানভী আর কোন ঝামেলা করবেনা। সাথে সাথে ওকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে!

সানভী মনে মনে এই সব জল্পনা কল্পনা করতেই দেখলো নীলা ওর খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে! ওর চোখে পানি টলমল করছে! একটু ছোঁয়া পেলেই যেনো শ্রাবণের মেঘধারার মতো ঝরে পরবে!
নীলা মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
–“আমি কি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?”
কথাটা বলার সাথে সাথেই নীলার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো। সানভী একটু এগিয়ে যেতেই নীলা ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-
–“আমি ভেবেছিলাম আমার চেহারা খারাপ ছিলো জন্য আপনি আমায় পছন্দ করেন না। স্ত্রী হিসেবে মানেন না। সে জন্য আমি কতো যত্নে নিজেকে একটু একটু করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছি! কিন্তু না! আমার ধারনা ভুল ছিলো! আমি আপনার যোগ্যই না!”
এবার সানভীর মুখ ফুটলো। সে ধীর গলায় বললো-
–“এসব নিয়ে কথা বাড়িয়ে আমায় আর ছোট করিওনা প্লিজ!”
নীলা সানভীর গলা থেকে এক হাত নামিয়ে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললো-
–“আপনি জানের আমি আপনার কথা রোজ কতোবার ভাবতাম?”
–“কতোবার?”
–“যতোবার আমি নিঃশ্বাস নিতাম ঠিক ততোবার! কিন্তু আফসোস্! সেই তিন বছরের মধ্যে আপনার হাতে এক সেকেন্ডও সময় হয়নি আমার জন্য!”

কথাটা বলেই সে সানভীকে ছেড়ে দিলো। সানভী মনে মনে অবাক হয়ে গেলো। যে মেয়েটাকে সে দিনের পর দিন ইগনোর করে গেছে সেই মেয়েই কিনা তাকে দিনের পর দিন একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছে! নিজেকে সে অনেক ভাগ্যবান মনে করলো! কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।

এটাই সানভীর বড় প্রবলেম। আত্ম-অহংকারে একদম গাছের মগডালে উঠে বসে থাকবে! মুখ ফুঠে কিছু বলবেনা। কিন্তু ভেতর ভেতর কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পাওয়ার জন্য কুঁড়ে কুঁড়ে মরবে! অস্বাভাবিক কোন আচরন করবেনা ঠিকই কিন্তু নিজের জেদ পুরন করতে গিয়ে অনেক দুঃসাধ্য কাজও সহয সাধ্যে করে ফেলবে!

তার এসব চুপচাপ নিরবতা নীলার কাছে ভীষন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। সে মহুর্তের মধ্যেই সানভীর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো-
–“ভয় নেই! আমি যদি গলে-পচে মাটির সাথে মিশেও যাই তবু কখনো আপনার কাছে স্বামীর অধিকার চাইতে আসবোনা! কক্ষনো না! ভালো থাকবেন!”

কথাটা বলেই সে খুব দ্রুত পায়ে চলে যেতে লাগলো! সানভীর উত্তরের অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য আজ তার শেষ হয়ে গেছে। নিচে যেতেই সাহানা বেগম নীলার হাতটা খপ করে ধরে বললেন-
–“তুই আমায় কথা দে মা! রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা কিছু করবিনা?”
নীলা কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
–“হুম! তুমি আমায় নিয়ে একদম চিন্তা করবে না বড় মা! দেখবে একদিন আমি ঠিকই নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছি!”

নীলা আর বিন্দু মাত্র দেরী না করে চলে যেতে লাগলো! সানভী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো নীলা খুব দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে! ওর মাথায় কোন কিছু কাজ করলো। সোজা রুমে গিয়ে সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলো!

নীলা ট্যাক্সি করে ওর বান্ধবী জেসিকার বাসায় চলে গেলো। জেসিকা ওর ছোট বেলার বান্ধবী। সে অনেক ধনী ঘরের মেয়ে। পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। নীলা ওর কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে বললো! সব শুনে সে একগাল হেসে বললো-
–“এ আবার কি সমস্যা! আমার সাথেই খাবি-দাবি, থাকবি! নো প্রবলেম! আর তোকে আমি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের সব কাজ শিখিয়ে দিবো। তুই তো হাতের কাজে অনেক এক্সপার্ট। খুব সহজেই সব কিছু আয়ত্ত করতে পারবি! সেলারিও অনেক বেশি!”
নীলা কৃতজ্ঞতায় মুখ লাল করে বললো-
–“আমি কখনোই ভাবিনি জেসি তুই আমায় এত্তো ভালোবাসিস! লাভ ইউ!”
–“হুম! পরে জানি আমায় আবার ভুলে যাসনা তাহলেই হবে!”
নীলা খুশিতে কান্না করে ফেললো! সে জেসিকাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
–“তোর এই উপকার আমি সারাজীবন মনে রাখবো!”

দুইদিন পরের ঘটনা! সানভী অলরেডি নীলার ঠিকানা কালেক্ট করে ফেলেছে! শুধু এতোটুকুই নয়! নীলার পেছনে ওর ফ্রেন্ড সিয়াম কে ডিটেক্টিভ হিসেবে লাগিয়ে রেখেছে। নীলা কখন কোথায় যায় কি করে সব কিছু সিয়াম ফলো করে ওকে বলে দেই। এই কাজের জন অবশ্য সিয়ামকে সে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে!

দুপুরে গোসল সেরে সানভী মাত্র খেতে বসেছে, এরই মধ্যে সিয়ামের ফোন আসলো! সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সিয়াম বললো-
–“দোস্ত! ভাবীর সাথে যে মালটা আছে না! সে তো হেভি চাল জানে দেখছি! ভাবীকে নিয়ে শপিংমলে এসেছে। সাথে একটা ছেলেকেও এনেছে! তুই কি আসবি?”
–“লোকেশন অন কর আমি এখনি রওনা দিচ্ছি!”
সানভীর আর খাওয়া হলো না! সে হাত ধুয়ে রুমে গিয়ে ড্রেস চেন্জ করেই রওনা দিলো! ওর মাথা এখন হ্যাং হয়ে গেছে!

নীলা আর জেসিকার সাথে যে ছেলেটি ছিলো সে মূলত মেয়েলি টাইপের। আই মিন থার্ড জেন্ডার যাকে বলে আরকি! সে জেসিকার এসিস্ট্যান্ট। সিয়াম ছেলেটাকে ভালোভাবে না দেখেই সানভীকে ঐসব বলে দিয়েছ! এখন জানার পর সে পরে গেছে মহাবিপদে। না জানি সানভী ওকে কি বলে!

নীলা ড্রেস চয়েস করতে করতে হঠাৎই খেয়াল করলো সানভী লিফট থেকে নেমে থার্ড ফ্লোরে আসছে। নীলারাও থার্ড ফ্লোরেই আছে। সানভীকে দেখেই সে থমকে দাঁড়ালো। সে ভাবতে লাগলো সানভী এখানে কি করতে আসছে!

সানভী ধূসর রঙের একটা শার্ট আর আর জিন্স প্যান্ট পরেছে। শার্টের বোতাম কয়েকটা খোলা রেখেছে! ভেতরের সাদা রঙের গেঞ্জিটা দেখা যাচ্ছে। চোখে সানগ্লাস। এক হাতে বাইকের চাবি আর এক হাতে ফোন!

কয়েক পা না যেতেই সানভীও নীলাকে দেখে ফেললো। নীলা বেগুনী রঙের একটা ওয়েটল্যাস শাড়ি পরেছে। নীলাকে খুঁজে নিতে ওর একটুও অসুবিধা হলোনা! খুব বেশি সময় ও লাগলো না!

সানভী দ্রুত পায়ে নীলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সানগ্লাস টা খুলে হাতে নিলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো তাদের সাথে কোন ছেলে নেই। যেটা আছে সেটা হাফ লেডিস! কিন্তু তবু সানভীর মাথায় চরচর করে রক্ত উঠতে লাগলো। সাথে সাথে ওর চোখে মুখে রাগের ছাপ ফুটে উঠলো। জেসিকা কি জানি বলতে চেয়েও বলার সাহস পেলো। সিয়াম শুধু ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলতে লাগলো।

সানভীর মাথায় রাগ উঠেছে নীলার পেটের কিছু অংশ বের হয়ে থাকতে দেখে! সে আড়চোখে নীলার পেটের দিকে কয়েকবার তাকালো! যাতে নীলা শাড়ি টা ঠিক করে নেয়। কিন্তু নীলা ওর চোখের ভাষা বুঝেও কোন কেয়ার করলো না! সে জেসিকাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যেতে লাগলো! এতে সানভী রাগের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো! সে নীলার বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো-
–“সমস্যা কি তোমার? ইদানীং খুব সাহস হয়েছে দেখছি! কান খুলে শুনে রাখো! এমন কিছু করো না যাতে আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে যায়!”
সানভীর কথায় নীলা প্রচন্ড রেগে গেলো! সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-
–“আমায় নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন রাইট আপনার নেই। হাত ছাড়ুন!”
নীলার কথা শুনে সানভী রাগে আগুন হয়ে গেলো। সে নীলার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো-
–“আমায় কিন্তু বেশি রাগিয়ে দিওনা! না হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে!”
নীলা সানভীর চেয়েও দ্বিগুণ বেশি রেগে গেলো। সে এক ঝটকায় সানভীর হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা খুলে নিলো! সাথে সাথে এক হাত দিয়ে সানভির মাথার পেছনের চুলগুলো শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো! তারপর তীক্ষ্ম চাহনিতে সানভীর চোখে চোখ রেখে বললো-
–“তোকে খুব বেশি রাগিয়ে দিলে তুই আমার কি করবে হ্যাঁ?”
সানভী কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই নীলা ওর ঠোঁটে গভীরভাবে একটা কিস্ করলো।

সানভী তো চারদিকে একপলক তাকিয়ে পুরাই হা করে দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে নীলা বিন্দু মাত্র কাল বিলম্ব না করে জেসিকাকে নিয়ে চলে যেতে লাগলো। সিয়াম ঢোক গিলতে গিলতে বললো-
–“এইটা কি হলো রে মামা? তোর ঠোঁটের তো পুরাই ঘন্টা বাজিয়ে দিয়ে গেলো!!!”
সানভী ওর হাত দিয়ে ঠোঁট দুটো মুছে নিয়ে চলে যেতে লাগলো। সিয়ামের সাথে কোন কথা বললো না!

নীলা বাসায় যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নিলো, সে কিছুদিনের মধ্যেই একটা ছেলের সাথে রিলেশন করে সানভীকে উচিত শিক্ষা দিবে! এদিকে সানভীও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, সে অন্য একটা মেয়ের সাথে টাইম পাস করে নীলাকে উচিত শিক্ষা দিবে!

চলবে…..
👇👇👇👇👇👇
#গল্পঃহৃদয়ের দহন
#Mst Shefa Moni
#পর্বঃতিন

সানভীর ধারনা সে নীলার রুপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে গেছে। তার প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছে। তাই সে প্রথমেই একটা সুন্দরী জিএফ খুঁজতে লাগলো! এবং খুব তাড়াতাড়ি পেয়েও গেলো! ওর ফুফাতো বোন রিশা। যেমন ধনীর দুলালী তেমনি হায়ার এডুকেটেড। দেখতে নীলার চেয়েও সুন্দরী! সানভীর মনের মধ্যে ব্যান্ড বাজতে লাগলো! কারন সে এবার নীলাকে আচ্ছা তরে শিক্ষা দিতে পারবে!

কিন্তু নীলা সেসবের কিছুই করলো। সে ভাবতে লাগলো সানভীর সাথে টক্কর দিতে যাওটা তার বোকামী হবে! এমনিতেই তার বয়স কম, তার উপরে আবার বাবা মা কেউ নেই। মাথার উপরে কোন ছাতা নেই! নিজের দেখভাল নিজেকেই করতে হয়! এতো সমস্যার মধ্যে সানভীর সাথে টক্কর দিতে গিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার কি দরকার! বরং সে চুপচাপ নিরব হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো! সানভী যদি ওকে ভালোবাসে তাহলে ওর চুপচাপ নিরবতায় সানভীকে উচিত শিক্ষা দিবে!

10-08-2016–
জেসিকাদের বাসা রাজশাহীর কাজলাতে। রাজশাহী রেলওয়ের দিকে ওদের নিজস্ব ফ্যাশন হাউজ আছে। নীলা সেখানে গিয়ে নিয়মিত কাজ শিখতে লাগলো। আর বাড়তি ঘুরাঘুরি একদম বন্ধ করে দিলো।
তাই সিয়ামেরও রুটিন মতোবেক ডিউটি পরে গেলো। রোজ কাজলা থেকে রেলগেট, রেলগেট থেকে কাজলা! বাড়তি কোন দৌড়াদৌড়ি নেই। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে সে!

কিন্তু সানভীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে লাগলো। কারন সে যে রিশার সাথে রিলেশন করছে সেটা নীলাকে সরাসরি দেখাতে পারছেনা! সেই অধৈর্যতা তাকে তিলে তিলে মারছে!
তবে সানভীকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলোনা!

17-08-2016–
জেসিকা তার এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করার জন্য নীলাকে সাথে করে নিয়ে গেলো নিউ মার্কেটের এক রেস্টুরেন্টে। ওর বয়ফ্রেন্ড তূর্য আগে থেকেই সেখানে বসে ওয়েট করছিলো। তাই সে রেস্টুরেন্টে গিয়েই তূর্যের সাথে আলাপচারিতা শুরু করে দিলো। আর নীলা চুপচাপ মাথা নিচু করে সেগুলো শুনতে লাগলো।
জেসিকার উচ্চতা খুব কম হওয়ায় তূর্যের ফ্যামিলি ওকে পুত্রবধূ হিসেব পছন্দ করেনি। যে কারনে তূর্য ওর সাথে ব্রেকাপ করেছিলো! কিন্তু এখন সে আবার জেসির কাছে ব্যাক করতে চায়।
জেসির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই কম। সাড়ে তিন ফিটের মতো। নীলার সাথে তার বন্ধুত্ব হওয়ার পেছনে অবশ্য এই কারনটা প্লাস পয়েন্ট বলা যেতে পারে।

নীলাদের বাসা ছিলো রাজশাহীর তালাইমারীতে। সেই সূত্রে দুজনের বাসা প্রায় পাশাপাশি হয়ে যায়। বিকেল করে রুয়েটের স্কুল চত্বরে নীলা অন্য সব ছোট বাচ্চাদের সাথে জড়ো হতো খেলাধুলার জন্য। আর জেসিকা সেখানে সবার নেতৃত্ব দিতো। যদিও সে তাদের সবার চেয়ে বয়সে সাত-আট বছরের মতো বড় ছিলো তবু উচ্চতায় সে তাদের কাতারে তাদের সমতুল্য হয়ে যেতো। তার আচরনেও কিছুটা শিশু সুলভতা ছিলো!


প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট পর নীলা সানভীর কন্ঠের মতো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তীক্ষ্ম চাহনিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো! কর্নারের দিকে চোখ পরতেই দেখলো সত্যি সত্যিই সানভী একটা মেয়ের সাথে বসে কথা বলছে! মেয়েটাকে চিনতে ওর খুব বেশি সময় লাগলো না। কয়েক সেকেন্ড পরই সানভীর সাথে ওর চোখাচোখিও হয়ে গেলো!! কিন্তু সানভীকে তবু ভাবলেশহীন দেখালো!

দৃশ্যটা দেখার পর থেকে নীলার বুকের ভেতর মোচর দিতে লাগলো। মাথাটাও ঝিমঝিম করতে লাগলো। সে বাম হাতের উপর মাথাটার ভর দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো।

সানভী আড়চোখে নীলাকে প্রথম থেকেই দেখছিলো! সে নীলার এক্সপ্রেশন দেখে খুশি হওয়ার বদলে কিছুটা বিষন্ন হয়ে গেলো। কারন সে ভেবেছিলো নীলা ওকে দেখে হয়তো রেগে যাবে। কিন্তু না! সে নীলার মুখে কোন প্রকার রাগের ছাপ দেখতে পেলোনা। বরং তার চোখে মুখে এক প্রকার মর্মাহত হয়ে পরার ছাপ দেখতে পেলো!

সানভী আরো খেয়াল করলো নীলার চেহারায় আগের মতো আর সেই সৌন্দর্যটা নেই। এই কয়েক দিনেই মলিন হয়ে গেছে। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পরে গেছে। সানভীকে একধ্যানে নীলার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিশা বললো-
–“সানভী তুমি কি এখনো ঐ আন-কালচারাল ক্ষ্যাত মেয়েটার পিছে পরে আছো?”
রিশার কথা শুনে সানভীর চমক কেটে গেলো! সে নীলার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কিন্তু রিশার কথার কোন রেসপন্স করলোনা। এতে রিশা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো-
–“মামী নির্ঘাত সেকেলের মানুষ। তাই অমন নিচু ফ্যামিলির একটা মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের মতো ইয়ং জেনারেশনের ছেলে মেয়েরা কখনো ঐসব একসেপ্ট করবেনা! তুমি যেটা করেছো সেটা একদম ঠিক করেছো বেবি। এন্ড ইউ নো, আমি তোমায় ছোটবেলা থেকে কত্তোটা লাভ করি! আর ঐ ক্ষ্যাত মেয়েটার থেকে আমি সবদিক থেকে অনেক উচ্চে আছি! ইউ নো দ্যাট রাইট?”

সানভী এবারো রিশার কথার কোন রেসপন্স করলোনা। সে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো! ওর চোখের সামনেই এখন নীলার থেকেও সুন্দরী, হায়ার এডুকেটেড, ধনীর দুলালী মেয়ে রিশা বসে আছে! তবু সেদিকে ওর কোন মনোযোগ নেই। সে মেসেজে সিয়ামের সাথে চ্যাট করছে! সিয়াম নীলাদের পেছনের টেবিলে বসে আছে! নীলা কখন কি বলছে, তূর্য কতোবার নীলার দিকে তাকাচ্ছে এই সব কিছু সে সানভীকে মেসেজ করে বলছে! আর সানভী সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে!

কিছুক্ষণ পর তূর্য ওয়াশরুমে যেতেই সিয়াম আর সানভী ওর পিছে চলে গেলো। তূর্য ওয়াশ রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই সানভী তূর্যের হাত ধরে বললো-
–“এই দেখি আপনার হাতটা দেখান!”
তূর্য অবাক হয়ে বললো-
–“কেনো ভাই কি হইছে? আমি কি করলাম?”
সিয়াম তূর্যের শার্টের কলার ধরে বললো-
–“ঐ ঢাকাইয়া মাল? আমগোর লগে ভেটকি করস? হাত দেখা কইতাচি!”
সানভী তূর্যের হাতের তালু দুই বার স্পর্শ করেই বললো-
–“ঐ ভাই আপনার হাত আঠা আঠা লাগে ক্যান?”
তূর্য ঘটনার আগা মাথা কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো প্রশ্ন করলো-
–“আরে ভাই কি হইছে সে টা তো বলবেন নাকি?”
সানভী সিয়ামকে রেগে গিয়ে বললো-
–“ঐ শালা তুই তো বলছিলি এই মালটা জেসির তাইলে কেমনে কি?”
–“হ মামা প্রথম তো দেখলাম জেসির সাথেই কথা বললো। মাগার শেষের দিকে গিয়া বার বার ভাবীর দিকে তাকাচ্ছিলো!”
সানভীর মাথা আরো গরম হয়ে গেলো। সে তূর্যের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো-
–“সুন্দরী মেয়ে দেখলেই কি জিভ দিয়ে লাল পরে? তোকে তো……

সানভীর কথা শেষ না হতেই সেখানে জেসিকা আর নীলা উপস্থিত হয়
চলবে কি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here