হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব -১০+১১

#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_১০
লেখনীতেঃভূমি

শীতের সকাল মানেই কুয়াশাচ্ছন্ন কোন এক শীতল সকাল।অদ্রিজা মুগ্ধ চাহনিতে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল।চারদিকটা ঝাপসা দেখাচ্ছে।দূরের গাছগাছালি গুলোও আবছা হয়ে মিশে গেছে ধূসর রংয়ের কোন এক মিশ্রনে।জানালাটা মেলে দিতেই বাইরে থেকে শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে গেল শরীর। অদ্রিজা হালকা কেঁপে উঠল।চিকন পাতলা ঠোঁটজোড়াও সেই শীতল বাতাসের স্পর্শে কেঁপে উঠল।সেই কেঁপে উঠাকে দ্বিগুণ করতেই বোধ হয় পেঁছন থেকে একজোড়া হাত আঁকড়ে ধরল তার কোমড়।পাতলা সুতি শাড়ির উপর সেই হাতজোড়ার উষ্ণ স্পর্ষ স্পষ্ট অনুভব করতে পারল সে।লোমকূপ কেঁপে উঠল সেই অনুভবের শিহরণে। মুখ ঘুরিয়ে পেছনের মানুষটার মুখ দেখার আগেই পেঁছনের লোকটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। মাথাটা নুঁইয়ে অদ্রিজার কাঁধে রেখেই ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিল তার কাঁধে। এলোমেলো ভাবে করে রাখা খোঁপাটা খুলে দিয়ে নেশাতুর ভাবে মুখ ডুবাল অদ্রিজার খোলা চুলে।অদ্রিজা নুঁইয়ে গেল অদ্ভুত শিহরনে।কিছু বলতে চেয়েও পারল না বলতে। মুখ দিয়ে যেন বের হলো না একটা অক্ষরও।লতানো শিখার মতো লতিয়ে পড়ল যেন সে লোকটার বাহুবন্ধনে।হাত জোড়া দিয়ে শক্ত করে খামচে ধরল জানালার পর্দা।রক্তিম মুচকি হাসল।অদ্রিজার শাড়ির তল দিয়ে হাতজোড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরল মসৃন পেটের ধবধবে ফর্সা ত্বক।মুচকি হেসে মৃদু কন্ঠে বলে উঠল,

‘ আজকের সকালটা কেন জানি ভিন্নরকম সুন্দর অদ্রিজা।আর কিছু মুহুর্ত পর বোধ হয় আরো সুন্দর হবে আমার জন্য এই সকালটা।আর আপনার জন্য? আপনার জন্যও কি ততটাই সুন্দর হবে অদ্রিজা?’

অদ্রিজা বুঝল না কিছুই।রক্তিমের হঠাৎ এমন আচরণেরও কোন মানে খুঁজে পেল না সে।বিয়ের রাতটা ছাড়া আর কোনদিন রক্তিম তাকে অনুমতি না নিয়ে স্পর্ষ করে নি।মাঝখানে একটা দিন কেবল জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল।অদ্রিজা মাথা ঘুরিয়ে রক্তিমের মুখটা চাইতে চাইলেও সম্ভব হলো না।রক্তিম আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে।মুখটা তার কাঁধে ভালোভাবে গুঁজে নিল। ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে উঠল,

‘ উহ!সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন তো অদ্রিজা।আমাকে একটু শান্তি খুঁজতে দিন।প্লিজ!’

অদ্রিজা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।রক্তিম যে কাল রাতেও ঘুমোয়নি তা তার কাছে স্পষ্ট।না ঘুমিয়ে কি করে থাকে?কেনই বা ঘুমোই না এই লোকটা?অদ্রিজা বুঝে উঠে না।উশখুঁশ করে বলে উঠল,

‘ এমন করছেন কেন আপনি?’

‘ বললাম তো শান্তি চাই।শুনতে পান নি?’

অদ্রিজা হতাশ হয়ে শ্বাস ফেলল।চোখ মুখ শক্ত করে জানালা দিয়ে নিরন্তর চেয়ে রইল বাইরের ঝাপসা শহরটার দিকে।রক্তিম কয়েক মিনিট নিশ্চুপ থেকে সেভাবেই রইল অদ্রিজার ঘাড়ে মুখ গুঁজে। মুচকি হেসে শীতল কন্ঠে বলল,

‘ আপনাদের কোম্পানির সবটুকু পাওনা, দেওনা আজ মিটিয়ে দেওয়া কম্প্লিট হয়ে যাবে অদ্রিজা।আপনার পাওনাটুকু কম্প্লিট হয়ে যাবে আজ।আর আপনার বাড়িটাও ফেরত পেয়ে যাবেন দিন কয়েক পর। আপনার কাজ এবার শেষ। আজকের পর আপনি চাইলে সবটা ছেড়েছুড়ে চলে যেতে পারেন অদ্রিজা।এমনিতেও এক মাস পর আপনি আপনার পথে আর আমি আমার পথে। এখন আপনি বলুন আজ নাকি একমাস পর?কবে যাবেন আমার জীবন থেকে?’

অদ্রিজা হকচকিয়ে উঠল।রক্তিমের শীতল কন্ঠে বলা কথাগুলো মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই পেঁছন ঘুরে দাঁড়াল অদ্রিজা।রক্তিমের থেকে নিজেকে সরিয়েই হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইল সে।এতটাই বোঝা সে রক্তিমের জীবনে?এই কয়দিনে রক্তিমের জীবনে এটুকু জায়গা করতে পেরেছে কিনা সে জানে না তবে এতটাও বোঝা হয়ে যাবে ভাবে নি সে।চোখজোড়া টলমল করতেই কঠোর চাহনিতে তাকিয়ে রইল অদ্রিজা।রক্তিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়াল।দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ আপনার জীবন থেকে আমি যাব না রক্তিম।একমাস পর বা একবছর পর।আমি যাচ্ছি না আপনার জীবন থেকে।বুঝতে পেরেছেন?’

রক্তিম বাঁকা হাসল।ফিচেল গলায় বলল,

‘ কেন?ভালো টালো বাসেন কি আমাকে?’

অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।রক্তিমের দিকে কঠোর চাহনিতে তাকিয়েই বলল,

‘ আপনাকে ভালোবাসা যায় না রক্তিম।ভালোবাসতে চাইলে ও আপনাকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।যে আমার অনুমতি না নিয়ে শরীর ছুঁয়েছে তাকে ভালোবাসা যায় না।যে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে দিহানের এক্সিডেন্ট করেছে।যে আমায় বারবার আঘাত করে।তাকে কি করে ভালোবাসি বলুন?তাছাড়া যে মানুষটা মনের এক গুচ্ছ আবেগ, স্বচ্ছ অনুভূতি নিয়ে খেলা করে তাকে তো কোনভাবেই ভালোবাসা যায় না রক্তিম।’

রক্তিম হেসে উঠল আওয়াজ করে।অদ্রিজা কপাল কুচকে একনজর তাকিয়েই সরে আসতে চাইল সেখান থেকে।নেহাকে ডেকেছিল সে তার মামনির সাথে দেখা করতে যাবে বলে।তখন থেকে রক্তিমের জন্য যেতে পারছিল না।এখন রক্তিমকে হাসতে দেখেই পা বাড়িয়ে চলে আসতে চাইল।কিন্তু পারল না।রক্তিম পেঁছন থেকে হাতটা শক্তভাবে ধরে রেখেই বলল,

‘ ফাঁকি দিচ্ছেন আমায়?এতটা আদর, এতটা ভালোবাসা দিয়ে পাহারা দেওয়ার পরও আপনি আমায় ফাঁকি দিয়ে ঐ মহিলার সাথে দেখা করতে যাবেন?’

অদ্রিজা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল রক্তিমের দিকে।মুখে চমৎকার হাসি ঝুলানো।এতক্ষন এই কাছাকাছি আসার অভিনয়টা তবে অদ্রিজাকে আটকানোর জন্যই ছিল।অদ্রিজা বুঝে উঠেই তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।রক্তিমের প্রতি ঘৃণাটা যেন আরো গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে উঠল।তীব্র তাচ্ছিল্য মুখে ফুটিয়েই বলে উঠল,

‘ আমার হাতটা ছাড়ুন রক্তিম।আপনি এতটা খারাপ আমি ভাবিইনি। ‘

রক্তিম হাসল।ডান ভ্রুটা উঁচু করেই বলল,

‘ আমার সম্বন্ধে অল্প একটু ও ভালো ভেবে রেখেছেনই বা কেন অদ্রিজা?’

অদ্রিজা দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল।হাতটা রক্তিমের হাত থেকে ছাড়ানোর প্রাণপন চেষ্টা করেই হাঁপিয়ে উঠল। কপালে ঘাম জমেছে বিন্দু বিন্দু।মুখ চোখে লড়াইয়ের ময়দানে সদ্য হেরে যাওয়া সৈন্যের ন্যায় এক সমুদ্র দুঃখ নিয়ে তাকাল রক্তিমের দিকে।রক্তিম তা দেখেই মুচকি হাসল।অদ্রিজাকে চমকে দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিয়েই বলল সে,

‘ যান। ছেড়ে দিলাম আপনার হাত।গো ফার্স্ট অদ্রিজা।নয়তো আপনার কাঙ্খিত ইচ্ছেটা পূরণ হবে না।এমনিতেও পূরণ হবে বলে মনে হয় না।গিয়ে হয়তো দেখবেন দরজায় তালা ঝুলানো।’

অদ্রিজা আর এক পা ও দাঁড়াল না।রক্তিমের কথার উত্তরও দিল না।দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে এসেই রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই নেহার দেখা মিলল।নেহার চোখে মুখে উপচে পড়া বিরক্তি।অদ্রিজাকে দেখেই মুখে চোখের সেই বিরক্তিটা রাগে রূপান্তরিত হলো।দাঁতে দাঁত চেপেই অদ্রিজার পিঠে কিল লাগিয়ে বলল,

‘ এতক্ষন লাগে তোর?তুই নিজেই বলেছিস সকাল সকাল আসতে। আর নিজেই হাওয়া।আমি সে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’

অদ্রিজা কিছু বলল না।রিক্সা ডেকে দ্রুত উঠে পড়ল।থমথমে মুখ চাহনি নিয়ে পাশে বসা নেহার দিকে এক পলক চাইতেই রিক্সাটা শা শা করে এগিয়ে গেল।নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে থামতেই ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে একপ্রকার দৌড়েই গেল সেই বাসাটার সামনে দুজনে।গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দাড়োয়ানকে দেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল অদ্রিজা,

‘ রুহানা চৌধুরী আছেন? কাল বাড়ি ফিরেন নি উনি?’

দাড়োয়ান ছোট ছোট চোখে তাকাল।কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল,

‘ উনি তো চইলা গেলেন মাত্র।এই বিশ- পঁচিশ মিনিট হইতেছে চইলা গেছেন উনি।’

অদ্রিজা হতাশ হলো।জোরে জোরে বার কয়েক নিঃশ্বাস নিয়েই দুর্বল কন্ঠে বলল,

‘ বাসা থেকে বেরিয়েছেন মাত্র বিশ-পঁচিশ মিনিট?কোনদিকে গিয়েছেন উনার গাড়ি।বলুন।’

লোকটা কপাল কুঁচকে তাকাল।অদ্রিজা আর নেহাকে বার কয়েক দেখে নিয়েই বলল,

‘ হু, ডানদিকের মোড় দিয়াই গেছে।তবে আপনারা তারে পাইবেন বলে মনে হয় না।এতক্ষনে মনে হয় অনেক দূর চইলা গেছে।আর আপনাদের তো গাড়িও নাই দেখতাছি।’

অদ্রিজা ছোট ছোট চোখ করে নেহার দিকে তাকাল।মৃদু গলায় বলল,

‘ শিট!দেখাটা হলো না নেহা।দেখাটা করতে পারলাম না আমরা।’

নেহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।অদ্রিজাও জোরে জোরে শ্বাস ফেলল।ধীর পায়ে কয়েক কদম গিয়েই নেহার দিকে চকচকে চোখে তাকাল অদ্রিজা।বলল,

‘ নেহা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?উত্তর দিবি তো?’

নেহা আনমনেই বলল,

‘ উত্তর জানলে উত্তর দিব না কেন আমি।বল।’

অদ্রিজা মৃদু হাসল।বলল,

‘ রক্তিম আর রুহানা চৈধুরী?উনাদের সম্পর্ক কি?কে হয় তারা একে অপরের। তুই জানিস?বল প্লিজ।’

নেহা মিনিমিনে চোখে চাইল।ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ রক্তিম ভাইয়ার মা হয় মামনি।কিন্তু অদ্ভুত বিষয় কি জানিস দ্রিজা? রক্তিম ভাইয়া তার মা বাবাকে ঘৃণা করেন।না উনার মা কে ভালোবাসেন আর না উনার বাবাকে।উনি কখনো উনার মা বাবাকে মা- বাবা বলে ডাকেন ও না। ‘

অদ্রিজা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল।নেহার কথাগুলো ঠিক হজম হলো না তার।মাথার ভেতর উশখুঁশ করতে লাগল প্রত্যেকটা কথা। নেহার মামনিই যদি রক্তিমের মা হয় তবে রিয়াদ সাহেবের স্ত্রী? উনি কে হন?উনি রক্তিমের মা নয়?অদ্রিজা কিছুই বুঝে উঠল না। অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ মানে?’

‘ মানে হলো রক্তিম ভাইয়ার আম্মু হয় মামনি।বুঝেছিস?’

অদ্রিজা সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে রইল।মাথার ভেতর সব তালগোল লেগে গেছে।কিছুই বোধগম্য হলো না।মৃদু কন্ঠেই জিজ্ঞেস করল,

‘ রিয়াদ মাহমুদ?উনার বাবা রিয়াদ মাহমুদই তো?’

নেহা বলল,

‘ হু।উনিই রক্তিম ভাইয়ার বাবা।’

অদ্রিজা এবার বিভ্রান্ত চাহনি নিয়ে এপাশ ওপাশ চাইল।মাথার চুলগুলো দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ কিসব বলছিস নেহা?রিয়াদ মাহমুদের ওয়াইফ?উনি কে তাহলে?আর উনারা যে বলেন, উনারাই রক্তিমের বাবা মা।সেসব?আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না নেহা।বুঝিয়ে বল।’

নেহা মিনমিনে চোখে চেয়েই কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই পেঁছন থেকে ভারী পুরুষালী কন্ঠ বলে উঠল,

‘ লিটল ওয়াইফ?বলে দিয়েছো সব!আমি তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি। বিশ্বাস করেছিলাম তোমায়।বলেছিলাম অদ্রিজাকে কিছু না বলতে।কিন্তু তুমি তাও বলে দিয়েছো।বিশ্বাসটা রাখলে না।’

অদ্রিজা মাথা ঘুরিয়ে চাইল। রক্তিমকে দেখেই হিমশীতল হয়ে গেল শরীরের রক্ত।শীতল চাহনি।চোখমুখে অদ্ভুত শীতল একটা ভাব জমেছে তার।সাদা ধবধবে লম্বা চওড়া শরীরের পরনে কালো রংয়ের শার্ট।হাতাগুলো কনুই পর্যন্ত গুঁটানো।ঘন কালো চুলগুলো কপালে কিছু অংশ ঝুঁকেছে।মুখের খোঁচা দাঁড়িগুলোও সুন্দর মুখটাকে আরো সুন্দর করে তুলল যেন।অদ্রিজা রক্তিমের দিকে এক নজর চেয়েই নেহার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ নেহা? তুই বল। কোন বিশ্বাস, অবিশ্বাসের কথা মনে রাখার দরকার নেই।’

রক্তিম মুচকি হাসল।অদ্রিজার দিকে একনজর তাকিয়েই নেহার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আমি তোমায় সেই ছোট্ট থেকে অনেক অনেক স্নেহ এবং ভালোবাসা দিয়েছি লিটল ওয়াইফ।তোমায় বিশ্বাস করাটা নিশ্চয় আমার ভুল নয় বলো?তুমি বিশ্বাসযোগ্য তাই বিশ্বাস করেছিলাম।এনিওয়েজ, তোমায় আমি এখনো অনেক স্নেহ করি নেহা।আশা করি তুমি এমন কিছু করবে না যার জন্য তোমার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে যাক।তাই না?’

নেহা ভড়কে গেল।কি বলবে বুঝে উঠল না।বিভ্রান্ত চাহনি নিয়ে একবার অদ্রিজা তো একবার রক্তিমের দিকে তাকাল।কিছু বলে উঠার আগেই রক্তিম অদ্রিজাকে টেনে আনল রাস্তার অপরপাশে।ফিসফিসিয়ে বাঁকা হেসেই বলল,

‘ আপনি যে ধীরে ধীরে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন বুঝতে পারছেন আপনি?টের পাচ্ছেন?ভাবুন তে?অন্যবার রুহানা চৌধুরীর সাথে দেখা করতে আপনি এতটা উৎসাহী থাকতেন কি?হঠাৎ এইবার এত উৎসাহ?কাল রাতেও যখন আপনি দেখা করতে আসলেন তখনও আপনি এতটা উৎসাহী ছিলেন কি অদ্রিজা?ছিলেন না।যখনই আমার সাথে ঐ মহিলার সম্পৃক্ততা খুঁজে পেলেন তখন থেকেই আপনি এতটা উৎসাহী হয়ে উঠলেন।এটা কি হতে পারে বলুন তো?আমার সম্পর্কে এতটা কৌতুহলই বা কেন আপনার?বলুন।’

অদ্রিজা থামকে যাওয়া চাহনি নিয়ে রক্তিমের দিকে তাকাল।মুখে অন্যরকম দুষ্টুমিমাখা হাসি ঝুলছে।তার বলা কথাগুলো যে খুব একটা ভুল তাও নয়।অদ্রিজা হাঁসফাঁস করে এদিক ওদিক তাকাল। রক্তিমের কথাগুলো যে সত্যি তা খুব একটা বুঝতে না দিয়েই বলল,

‘ ফালতু কথা বলবেন না রক্তিম।’

‘ উহ!ফালতু কিংবা ভালো যায় হোক।আমি শুধু এইটুকুই জানাতে চাইছিলাম যে, আমাকে নিয়ে কৈাতুহলটা কমিয়ে নিন অদ্রিজা।একটা মানুষকে ভালো লাগলে, কিংবা তার প্রতি ইন্টারেস্টেড হলে তবেই আমরা তার প্রতি কৌতুহলি হয়ে পড়ি।দিনশেষে ভালোবেসে ফেলি।আপনার ক্ষেত্রে যাতে সেটা না ঘটে তাই সতর্ক করলাম।’

অদ্রিজা থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।রক্তিম কথাগুলো বলেই ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল অদ্রিজার কপালের ছোট ছোট চুল গুলো।মুচকি হেসে সরে গেল সেখান থেকে।অদ্রিজা এখনও সেভাবেই তাকিয়ে রইল রক্তিমের যাওয়ার পথে।লোকটা অদ্ভুত।রক্তিম নামক মানুষটাকে বুঝে উঠা আসলেই সম্ভব কিনা সে জানে না।কখনো শীতল, তো কখনো গম্ভীর, কখনো বা হাসিখুশি, আবার কখনো রাগের ঝটলা!অদ্ভুত তো।
#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃ ভূমি

অদ্রিজা রিয়াদ সাহেবের রুমের পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে অনেক্ষন।ভদ্রলোকের পত্রিকা পড়া শেষ হয় নি।কপালে ভাজ ফেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারও নিজের রুমে গেল।বেলকনিতে রক্তিমের দিকে একবার উঁকি দিয়েই আবার বেরিয়ে আসল রুম থেকে । রিয়াদ সাহেবের রুমের সামনে এসেই উঁকি দিয়ে বিজয়ী হাসি হাসল।ভদ্রলোকের হাতে এখন পত্রিকা নেই।তার মানে পত্রিকা পড়া শেষ।অদ্রিজা আর অপেক্ষা করল না।পর্দা সরিয়েই উশখুশ করে বলে উঠল,

‘ বাবা?আসব? ‘

রিয়াদ সাহেব ক্লান্ত চাহনিতে তাকাল।চশমাটা খুলে মুঁছে নিয়ে আবারও চোখে লাগালেন।গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

‘ এসো মা।অনুমতি নেওয়ার কি দরকার।তুমি যখন তখন আসতে পারো।বাবা মানো তো আমায়?’

অদ্রিজা মেকি হাসল।পা বাড়িয়ে রিয়াদ সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই বলল,

‘ হু, অবশ্য মানি বাবা।একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘করো।’

অদ্রিজা হাঁসফাঁস করে এদিক ওদিক চাইল।কথাগুলো ঠিক কিভাবে জিজ্ঞেস করবে বুঝে উঠল না।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে মস্তিষ্কে কথাগুলো সাঁজিয়ে নিয়েই মৃদু গলায় বলে উঠল,

‘ রুহানা চৌধুরী কি আপনার স্ত্রী?উনার সাথে আপনার সম্পর্ক কি বাবা?আর রক্তিমের মা কে বাবা?রুহানা চৌধুরী নাকি বাসায় যিনি আছেন উনি?যদি রুহানা চৌধুরীই রক্তিমের মা হন তবে আপনাদের সাথে থাকেন না কেন উনি?রক্তিমেরই বা আপনাদের প্রতি এই আচরণ কেন বাবা?বলবেন আমায়?’

রিয়াদ সাহেবের মুখে মৃদু হাসিটা যেন মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল।মুখে চোখে ফুটে উঠল তীব্র গাম্ভীর্যের ভাব।সরু চাহনিতে একনজর অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই বললেন,

‘ তুমি রুহানার সম্পর্কে কি করে জানলে?কিভাবে জানলে?’

অদ্রিজা নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো।উল্টো রিয়াদ সাহেবের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েই ছোট ছোট চোখ করে চেয়ে থাকল উনার দিকে।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শুকনো ঢোক গিলতেই সেখানে উপস্থিত হলো রক্তিম।অগোছাল চুলগুলো একহাতে পেছনে ঠেলে দিয়ে শার্টের হাতা গুলো গুঁটাতে গুঁটাতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘ মিস্টার মাহমুদ?অদ্রিজার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।উনাকে উনার মায়ের বাসায় যেতে হবে।উনার মা অসুস্থ।কয়েকদিন ওখানে থেকে উনার মায়ের সেবা করলে হয়তো উনার মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হবেন। তাই না অদ্রিজা?’

অদ্রিজা মুখ চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকাল রক্তিমের দিকে।হঠাৎ মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে বুকের ভেতর জমা হলো অজানা ভয়।মিনমিনে চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,

‘ কি হয়েছে আম্মুর?কেমন আছে এখন?আপনি কিভাবে জানলেন?’

রক্তিম মুচকি হাসল।হালকা কেঁশেই বলল,

‘ আপনার ছোটবোন কল করেছিল।কল রিসিভড করার পর বলল আপনার মা অসুস্থ।যাবেন আপনার মায়ের কাছে?’

‘ হ্যাঁ,অবশ্যই যাব।’

রক্তিম সেভাবেই হাসল।বেরিয়ে আসতে আসতে বলল,

‘ চলুন।’

অদ্রিজা ও বেরিয়ে আসল।রিয়াদ সাহেবকে না বলেই রক্তিমের পিঁছু পিঁছু বেরিয়ে আসল বাসা থেকে।রক্তিম যেন তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারল।মুখে বিশ্বজয়ী হাসি। নিজের গাড়িতে না উঠেই রাস্তায় এসে সূর্যের মৃদু রোদে দাঁড়িয়ে রইল।অদ্রিজা বিরক্তি হয়েই কপাল কুঁচকে বলল,

‘ আমি মায়ের কাছো যাব রক্তিম।এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

রক্তিম মুখ নামিয়ে অদ্রিজার মুখের দিকে তাকাল। সাদা,ছোট্ট তুলতুলে মুখটা নুঁইয়ে আছে চিন্তায়।কপালে ভাজ স্পষ্ট।মৃদু হেসেই বলল রক্তিম,

‘ রিক্সায় করে নদীর পাড়ে যাব অদ্রিজা।’

অদ্রিজার বিরক্তিটা এবার দ্বিগুণ হলো।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ আপনি না গেলেও কিছু হবে না রক্তিম।আমি একাই যেতে পারব।আপনি বরং নদীর পাড়ে যান।’

কথাটা বলেই পা বাড়াতে লাগলেই রক্তিম অদ্রিজার বাম হাতটা ঝাপটে ধরল।অদ্রিজা বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রক্তিম অসহায় চোখে তাকাল।চোখজোড়ায় যেন সহস্র আকুতি মিনতি এসে ভীড় করল মুহুর্তেই।অদ্রিজা সেই আকুতি বুঝতে চাইল না।চেষ্টাও করল না বুঝার।বিরক্ত নিয়ে বলল,

‘ আমার আম্মু অসুস্থ রক্তিম।আমাকে আম্মুর কাছে যেতে হবে।হাত ছাড়ুন।’

রক্তিম হাত ছাড়ল না।রিক্সা ডেকে উঠে বসেই বলল,

‘ উঠে বসুন।আপনার মায়ের কিছুই হয়নি।উনি সুস্থ আছেন।’

অদ্রিজা চোখ বড়বড় করে তাকাল।রক্তিমের কথা শুনে হা হয়ে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম আবারও বলল,

‘ উঠুন তো।’

অদ্রিজা উঠে বসল।রক্তিমের দিকে তাকিয়েই বলল,

‘ মিথ্যে বলেছেন কেন তাহলে?’

রক্তিম ভাবলেশহীন হয়েই বলল,

‘ এমনিই।’

.

রিক্সাটা এসে থামল নির্দিষ্ট জায়গায়।সেইখান থেকে কিছুটা দূরেই নদী।রাস্তা থেকে পা ফেললেই সবুজ ভেজা ঘাস।মৃদু শীতল বাতাসে নড়েচড়ে উঠছে গাছের সবুজ পাতাগুলো।দূরে একটা গাছে লাল শিমুল ফুল গুলো গাছের সবুজ পাতাকে লুকিয়ে রেখে লাল রক্তিম সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তুলল গাছটাকে।গাছের নিচটায় সবুজ ঘাসে ঝরে পড়েছে সেই গাছেরই অনেকগুলো ঝরা শিমুল ফুল। অদ্রিজা মিষ্টি হাসল।ফুলগুলোর দিকে তাকিয়েই মৃদু গলায় বলল,”সুন্দর।”রক্তিম অদ্রিজার হাসিটা দেখে নিয়েই দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল ফুলগুলোর দিকে।মাথা ঝুকিয়ে অদ্রিজা কানের কাছে বলল,

‘সুন্দর।’

অদ্রিজা চমকে পাশ ফিরে তাকাল।নিজের কথারই পুনরাবৃত্তি দেখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে ছোট শ্বাস ফেলল।ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

‘ এখানে কেন এসেছি আমরা?’

রক্তিম উত্তর দিল না।চুপচাপ পা বাড়াল সামনের দিকে।অদ্রিজাও কিছু বুঝে না উঠে রক্তিমের পেঁছন পেঁছন পা বাড়াল।নদীর কাছাকাছি এসে সবুজ ঘাসে রক্তিমকে পা লেপ্টে বসে পড়তে দেখেই সরু চোখে তাকাল।বলে উঠল,

‘ এখানে কেন এনেছেন আমায়?আজব!’

রক্তিম ছোট ছোট চোখ করে তাকাল।পাশে দাঁড়িয়ে রমণীর কপালের চুলগুলো নদীর পাড়ের মৃদু হাওয়ায় নড়েচড়ে উঠছে।অপলক চাহনতে অদ্রিজার চোখের দিকে তাকিয়েউ বসতে বলল তাকে।লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,

‘ আমাকে নিয়ে কৌতুহলটা বদ্ধ ঘরে তালা দিয়ে দিতে বলেছিলাম আমি আপনাকে।আপনি শুনলেন না অদ্রিজা।আবারও মিস্টার মাহমুদের কাছে সেসব প্রশ্ন নিয়ে উপস্থিত হলেন নিজের কৈাতুহল মেটাতে।চলুন আপনার কৌতুহলগুলো মিটিয়ে দি। হু?’

অদ্রিজা চকচকে চোখে তাকিয়েই বলল,

‘ সত্যি?’

রক্তিম তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।বলল,

‘ বলব যখন বলেছি তখন বলবই অদ্রিজা।এটুকু বিশ্বাস রাখতেই পারেন।’

অদ্রিজা চুপ রইল।রক্তিম ছোট্ট শ্বাস ফেলেই বলতে শুরু করল,

‘ গল্পটা একটা ছোট ছেলের অদ্রিজা।তখন তার বয়স আট কি নয় হবে। প্রতিদিন বাবা মায়ের ঝগড়া, ঝামেলা এসব দেখেই সে বড় হচ্ছিল।বাবা মায়ের সরল রূপের সাথে সে পরিচিত ছিল না।বাবা সবসময় গম্ভীর হয়ে ঘুরে বেড়াত তার সামনে।বাবার সামনে আসলেই সেই ছোট্ট ফুটফুটে ছেলেটি ভয়ে কুঁকড়ে মরত। কোনদিন বাবার কাছে কোন আবদার রেখেছিল বলে মনেও পড়ে না।আর মা?ছোট্ট ছেলেটা তার মাকে আঁকড়ে তার সবটুকু সময় কাঁটাতে চাইত।বাবার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকলেও মাকে অতোটাও ভয় পেতনা সে।মাকে অনেকটা ভালোবাসত।কিন্তু সে মা তাকে সময় দিতে পারত না।মায়ের কাছে সে আবদার, বায়না রাখলে উনি বিরক্ত হতেন।ঝাঁঝালো কন্ঠে কয়েকটা কথা বলেই সরে যেতেন ছেলেটার কাছ থেকে।গেইস করুন তো, ছেলেটা কে?’

অদ্রিজা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ আপনি?আপনিই সেই ছেলেটা রক্তিম?’

রক্তিম শব্দ করে হেসে উঠল।ভেজা সবুজ ঘাসগুলোর উপর চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুঁয়ে পড়েই হাতজোড়া মাথার নিচে রাখল।সেভাবেই চোখ বন্ধ রেখে বলল,

‘ আপনি যে রুহানা চৌধুরীর পেঁছনে পড়ে আছেন?সে মহিলাটা একটা চরিত্রহীন মহিলা।খুব খারাপ মহিলা অদ্রিজা।’

অদ্রিজা চমকে উঠল।কাঁপা কন্ঠে বলল,

‘ নিজের মা সম্পর্কে কিসব বলছেন আপনি?’

রক্তিমের মধ্যে তেমন একটা ভাব উদয় হলো না।আগের মতোই চোখ বন্ধ রেখে বলল,

‘ রুহানা চৌধুরী আর রিয়াদ মাহমুদ বায়োলজিক্যালি আমার পেরেন্টস। আপনাকে যে গল্পটা শুনিয়েছি সে গল্পের বাবাটা হলো রিয়াদ মাহমুদ।আর মা হলো রুহানা চৌধুরী।ছোট্ট আট নয় বছর বয়সী ছেলেটা হলো রক্তিম মাহমুদ।রক্তিম যখন অনেক ছোট, কোমল শরীরে এদিক সেইদিক ঘুরে বেড়াত তখন থেকেই সে একা, নিঃসঙ্গ ভাবে বড় হয়েছে অদ্রিজা।দশবছর বয়সে এসে তার মা অন্য একজন লোকের সাথে পালিয়ে গেল তার অর্থ, প্রাচুর্যতার লোভে।কি ভাবছেন?তার বাবা তাকে আগলে রেখেছিল?ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়ে বড় করে তুলেছে? নাহ।তেমন কিছুই করেননি তিনি।সবাই যখন বলল, ছেলের দেখাশোনা করার জন্য আরেকটা বিয়ে করে নেওয়া উচিত? উনি আরেকটা বিয়ে করে ও নিলেন তার প্রথম স্ত্রী চলে যাওয়ার একমাসের মাথায়।ছোট্ট রক্তিম কেন জানি না তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মেনে নিতে পারে নি।কোনভাবেই পারেনি মেনে নিতে।তবে ভদ্রমহিলা রক্তিমকে অনেক আদর করত, অনরক খেয়াল ও রাখত, অনেকটা ভালোও বাসত হয়তো। কিন্তু ঐ যে, রক্তিম ছেলেটা অদ্ভুত?সে কারণেই হয়তো সে তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মেনে নিতে পারল না।দুই মাসের মাথায় নিজের নিঃসঙ্গ, একা জীবনটা নিয়ে একদিন মাঝরাতে বেরিয়ে গেল অন্ধকার রাস্তায়। শহরের অলিতে গলিতে তার মা কে খোঁজার চেষ্টা করল।কিন্তু তার মা যে অন্য একজনের হাত ধরে উন্নত দেশে পাড়ি জমিয়েছে তা হয়তো তার মস্তিষ্ক তখনো বুঝেই উঠে নি।সেইদিন রাতে আমায় অনেক খোঁজা হলো।অবশেষে পেয়েও গেল।বাসায় ফেরার পর রুমের দরজা লাগিয়ে তার বাবা তাকে অনেক কথা শোনাল।মেরেছিলও তাদের মাঝরাতে এই ভাবে খোঁজাখোঁজি নিয়ে বিরক্ত করার জন্য।রক্তিম সেইদিন কেঁদেছিল। প্রচুর কেঁদেছিল অদ্রিজা।আর কাঁদে নি।আরো কোনদিনও কান্না তার চোখে আসে নি।’

অদ্রিজা নিশ্চুপে বসে থেকে রক্তিমের বলা সবগুলো কথা শুনল।শুকনো ঢোক গিলে রক্তিমের দিকে তাকাল।এই যুবকটির মাঝে এতগুলো সুপ্ত দুঃখ আছে কোনদিন আন্দাজও করে নি সে।এতটা হাসি খুশি থাকা যুবকটির মনে এত বিষাদ কে বুঝবে?চোখ জোড়া ছল ছল করল। রক্তিমের দিকে তাকিয়েই লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ তারপর?’

রক্তিম মুচকি হাসল।চোখ মেলে অদ্রিজার মুখের দিকে তাকিয়েই বলল,

‘ তারপরের দিন রক্তিমের সবথেকে প্রিয় মানুষ, তার নানী এসেছিল। রক্তিমের গালে তখন মিস্টার মাহমুদের চড়ের পাঁচ আঙ্গুলের চাপ জ্বলজ্বল করছিল।দুই গাল সহ, হাতেও উনার আঘাতের চিহ্ণ ছিল।রক্তিমের নানী তা দেখেই অবাক হলো।সেদিনই নিয়ে আসলেন রক্তিমকে উনার সাথে। তারপর থেকে রক্তিম তার নানীর সাথেই বড় হয়েছে। এই দুনিয়ায় রক্তিমের নানী ব্যাতীত রক্তিমের আর কেউ নেই অদ্রিজা।না কোন বন্ধু, না বোন, না ভাই, আর না মা- বাবা। ‘

অদ্রিজা তপ্তশ্বাস ফেলল।ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে।রক্তিম চাপা হাসি নিয়ে উঠে বসেই বলল,

‘ আপনাকে আজ সব বলে দিয়েছি অদ্রিজা।আর কোন কৌতুহল নিশ্চয় নেই আপনার।বলুন?এরপর এসব নিয়ে আর ছুটোছুটি করবেন নাহ।মনে থাকবে?’

অদ্রিজা হঠাৎ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলাল যে সে আর এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না।রক্তিম হেসে বলল,

‘ গুডগার্ল।তাহলে এবার আপনার মায়ের কাছে চলুন।যাওয়া যাক।’

অদ্রিজা কপাল কুঁচকে তাকাল সঙ্গে সঙ্গে।বলল,

‘ আপনি তো বললেন আম্মুর কিছু হয় নি তাহলে?’

রক্তিম কিছু বলল না।উঠে আসল সেখান থেকে।অদ্রিজা রক্তিমের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো।চোখ মুখ নামিয়ে হেঁটে চলল রক্তিমের পিঁছু পিঁছু।

.

ক্লাস শেষে নেহা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় রিক্সার জন্য দাঁড়াতেই চোখে পড়ল দিহানকে। ধীর পায়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে দিহান।নেহা মুখ কাচুমাচু করে এদিক সেদিক ফিরে তাকাল।নিজের থেকে কয়েক হাত দূরে যুবকটিকে দেখেই যে অস্বস্তির উদ্ভব ঘটেছে নিজের মধ্যে তা লুকোতেই দ্রুত রিক্সা পাওয়ার প্রার্থনা করল।কিন্তু কোন খালি রিক্সা তখন চোখে পড়ল না।দিহান যখন পাশ কাঁটিয়ে চলে যাচ্ছিল তখনই অনেকটা ভয়ভীতি নিয়ে বলে উঠল সে,

‘কেমন আছিস দিহান?সেদিনের পর আর দেখা হয় নি তোর সাথে। ‘

দিহান মুচকি হেসে বলল,

‘ দিব্যি আছি। তুই?’

নেহা দিহানের দিকেই তাকিয়ে ছিল এক ধ্যানে। দিহান আবারও জিজ্ঞেস করাতে হকচকিয়ে মেকি হাসল সে।হাতে হাত কচলে বলল,

‘ হু?আমিও ভালো।কোথায় যাচ্ছিস ?ভার্সিটির ক্লাস তো শেষ।’

দিহান সরু চাহনিতে তাকাল নেহার দিকে। মৃদু হেসে বলল,

‘ কিছু নোটস নেওয়ার ছিল।দ্রিজা আসে নি আজ?’

নেহা মিষ্টি হাসল।তারপর বলল,

‘ না। আসে নি।কল করে বলেছিল আজ আসবে না।’

দিহান ছোট্ট শ্বাস ফেলল।মৃদু গলায় বলল,

‘ ওহ।’

নেহা মুচকি হাসল।সামনের যুবকটির সাথে কথা বলার এক সমুদ্র সমান ইচ্ছা থাকলেও কথোপকোতন বাড়ানোর আর কোন কথা খুঁজে পেল না সে।যুবকটিও আর কোন কথা বাড়াল না।তাকে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেল নিজস্ব গন্তব্যে।নেহা সেদিক পানে তাকিয়েই হতাশ হয়ে শ্বাস ফেলল।এই যুবকটিকে দেখলেই যে বুকের ভেতর অনুভূতি গুলো রঙ্গিন হয়ে উঠে তা কি আধো কোনদিন এই যুবকটি বুঝবে?কোনদিন সেও কি প্রকাশ করতে পারবে?জানা নেই!

.

অদ্রিজাদের বর্তমান বাসার সামনে এসেই গাড়িটা থামল।অদ্রিজা গাড়ি থেকে নেমেই রক্তিমের দিকে তাকাল।রক্তিম ও তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘ বাসায় না গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন অদ্রিজা?’

‘ আপনি যাবেন না?’

রক্তিম মুচকি হাসল।তারপর বলল,

‘ অবশ্যই যাব।’

অদ্রিজা মিষ্টি হাসল।কিন্তু সেই হাসিটা বেশিক্ষন টিকল না।বাসায় ডুকে নিজের রুম অব্দি যেতেই হাসিটা উধাও হলো মুখ থেকে।রক্তিম একটা ফাইল এগিয়ে দিয়েই বলল,

‘ আপনার সব পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে অদ্রিজা।সবটুকু কম্প্লিট!এবার আপনি মুক্ত।রাইট?’

অদ্রিজা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল।বলল,

‘ মানে?’

রক্তিম হাসল।বলল,

‘ আপনার মা কে বলে দিয়েছি আপনি এক সপ্তাহের জন্য এখানে বেড়াতে এসেছেন।এক সপ্তাহ পর্যন্ত উনি আপনাকে যেতে দিবে না ঐ বাসায়।এই এক সপ্তাহ আপনার ছুটি।এটাই বলছিলাম।’

‘ তো?’

রক্তিম নির্বিকার ভাবে বলল,

‘ কিছুই না।এই এক সপ্তাহ আপনি কোন কৌতুহলের অযুহাতে যাতে আমার কাছে ছুটে না আসেন তাই আজকে সবটা বলে দিলাম।আর,আজকে সকাল থেকেই আমি এত খুশি ছিলাম কেন বলুন তো?এই যে আজ থেকে এক সপ্তাহ আমি মুক্ত এই জন্যই।আপনি নামক অসুখটা আর সইতে পারছি না আমি অদ্রিজা।তিলে তিলে মারা যাচ্ছি আমি।’

অদ্রিজার বুকে মুহুর্তেই অনুভব হলো অন্যরকম ব্যাথা।রাগ আর কষ্টে বিষিয়ে উঠল মন।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ সবটাই আপনার প্ল্যান?তবে এই এক সপ্তাহ মুক্তি চাইছেন তো?দিলাম মুক্তি।কিন্তু এক সপ্তাহ পর এই অসুখটাই আপনাকে আষ্টেপৃষ্টে আক্রান্ত করবে রক্তিম।সামলাতে পারবেন তো এই অসুখটাকে তখন?তখন কিন্তু শত চেয়েও আপনি মুক্তি পাবেন না।’

রক্তিম হাসল।কানের কাছে ফিসফিসিয়ে,” বাই” বলে বেরিয়ে আসল।অদ্রিজা হতবাক হয়ে চেয়ে রইল রক্তিমের দিকে।

#চলবে…..

{

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here