হয়তো তোরই জন্য পর্ব ২৫ + শেষ

#হয়তো_তোরই_জন্য
#পার্ট_২৫_ও_অন্তিম_পর্ব
#নিশাত_জাহান_নিশি

জায়ান নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে তাহাফকে আধকোলে করে গেইটের দিকে দৌঁড়ে গেলো।

জায়ান দৌঁড়াচ্ছে আর পিছু ফিরে জাবেদকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,

—-“ভাইয়া জলদি হসপিটালে চল। তাহাফ ভাইয়াকে ইমেডিয়েট হসপিটালে এডমিট করাতে হবে। না হয় বড় সড় এক্টা বিপদ হয়ে যাবে।”

জাবেদ, তমাল আর আকাশ দৌঁড়ে গেলো জায়ানের কাছে। জাবেদ জলদি করে গার্ডেনে পার্ক করা রাখা গাড়িটায় বসে পড়ল। জায়ান খুব সাবধানে তাহাফকে গাড়ির ব্যাক সিটে শুইয়ে দিলো। তমা কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে এসে গাড়ির ব্যাক সিটে বসে পড়ল। জায়ান ও ব্যাক সিটে বসে তাহাফের মাথাটা ওর হাঁটুতে রাখল। জানালার কাঁচটা খুলে জায়ান বেশ তাড়াহুড়ো করে তমালকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—–“তোরা আরেকটা গাড়ি করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে হসপিটালে চলে আয়।”

তমাল মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। জাবেদ আর দেরি না করে গাড়ি ছেড়ে দিলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। তমা কাঁদতে কাঁদতে জায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“তাহাফ ভাইয়া বাঁচবে তো জায়ান?”

জায়ান বেশ শান্ত সুরে তমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

—–“বাঁচবে তমু। যে করেই হোক তাহাফ ভাইয়াকে বাঁচাতে হবে। এভাবে এক্টা তাজা প্রাণকে শেষ হতে দেওয়া যাবে না। তুই কান্না থামা। শান্ত হ। আর আল্লাহ্কে ডাক।”

তমা কিছুটা শান্ত হয়ে তাহাফের পা গুলো ওর হাঁটুর উপর মেলে দিলো। জায়ান, জাবেদ,তমা তিনজনই আল্লাহ্কে ডাকছে। জাবেদ বেশ স্পীডে ড্রাইভ করছে। কারণ, তাহাফের অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিট পর ওরা যমুনা হসপিটালের সামনে
পৌঁছে গেলো। জায়ান আর জাবেদ গাড়ি থেকে নেমেই তাহাফকে কোলে করে হসপিটালের ভিতর ঢুকে গেলো। তাহাফের রক্তাক্ত শরীর দেখে ওয়ার্ড বয়রা দৌঁড়ে স্ট্রেচার নিয়ে এলো। জায়ান আর জাবেদ মিলে তাহাফকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো। ডক্টরের কেবিনে ঢুকে তমা ডক্টরকে টেনে হেছড়ে তাহাফের কাছে নিয়ে এলো। তাহাফকে দেখা মাএই ডক্টর ওয়ার্ড বয় গুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—–“পেশেন্টকে জলদি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাও। আমি ডক্টর নুরুজ্জামান কে নিয়ে আসছি।”

ওয়ার্ড বয় গুলো খুব জোরে জোরে স্ট্রেচার টেনে তাহাফকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলো। জায়ান ডক্টরের হাত ধরে বেশ আকুতি মিনতি করে বলল,,,,,,,

—–“প্লিজ ডক্টর তাহাফ ভাইয়াকে সুস্থ করে দিন। আপনি আপনার বেস্ট দিয়ে চেষ্টা করুন।”

ডক্টর জায়ানের হাতে হাত রেখে শান্তনা দিয়ে বললেন,,,,,,,,

—-“চিন্তা করো না ইয়াং ম্যান। আমি আমার বেস্ট দিবো।”

কথাগুলো বলেই ডক্টর হন্তদন্ত হয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেলো। ডক্টরের পিছু পিছু আরেকজন ইয়াং ছেলে ডক্টর ও অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেলো। এর মাঝেই জায়ান আর তমার পুরো পরিবার এসে হসপিটালে হাজির হয়ে গেলো। তাহাফের আম্মু বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করছে। তাহাফের আব্বু শোকে পাথর হয়ে গেছে। তমার আম্মু হেচকি তুলে কাঁদছে। তমার আব্বু তাহাফের আব্বুকে টাইট করে ধরে রেখেছে। উনি বেসামাল হয়ে বার বার পড়ে যাচ্ছে। জায়ানকে দেখা মাএ তাহাফের আম্মু দৌঁড়ে এসে জায়ানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,,,,,,,,,

—–“আমার ছেলেটা যদি বেঁচে ফিরে তবে তুমি ওকে ক্ষমা করে দিও জায়ান। আমি জানি ওর সব কুকর্মের প্রমান তোমার কাছে আছে। এরপর ও বলছি তুমি আমার ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিও। আমার ছেলে তার পাপের উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। ছেলেটা কোনো রকমে বেঁচে ফিরলে আমি ওকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। সবার নাগালের বাইরে। এতে সবারই মঙ্গল হবে। আমার ছেলেটা ও এসব মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবে।”

জায়ান মিসেস তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,,,,,,,

—-“আমি অনেকক্ষন আগেই তাহাফ ভাইয়াকে ক্ষমা করে দিয়েছি জেঠিমনি। তাহাফ ভাইয়া উনার কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। তবে আইন উনাকে ক্ষমা করবে কিনা জানি না। তবে আমি চেষ্টা করব উনার শাস্তির পরিমান কমাতে। তুমি কান্না বন্ধ করে শান্ত হয়ে বস। আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে।”

জায়ান মিসেস তারিনকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনের বেঞ্চি গুলোতে বসে পড়ল। এক এক করে সবাই চেয়ার গুলোতে বসে অপারেশন থিয়েটারের দরজা খোলার অপেক্ষা করছে। তমা ও জায়ানের পাশে বসে মিসেস তারিনকে শান্তনা দিচ্ছে।

প্রায় দুই ঘন্টা পর,,,,,,,

অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতিটা নিভে গেলো। তাহাফের আব্বু দৌঁড়ে বসা থেকে উঠে ও.টির দরজার সামনে দাঁড়ালো। পিছু পিছু জায়ান আর জাবেদ ও উঠে দাঁড়ালো। ডক্টর ও.টি থেকে বের হয়ে তাহাফের আব্বুর মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাহাফের আব্বু কান্নাজড়িত কন্ঠে ডক্টরের হাত ধরে বলল,,,,,,,

—–“আমার ছেলেটা ঠিক আছে তো ডক্টর?”

ডক্টর মলিন হেসে তাহাফের আব্বুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,,,,

—–“আল্লাহ্ র রহমতে আপনার ছেলে সুস্থ আছে। বাট মাথায় বেশ প্রবলেম দেখা দিয়েছে। মাথার কিছু কিছু সেল ব্লক হয়ে গেছে। যার কারণে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। আই থিংক প্রপার টিটমেন্টে দুই, এক বছরের মধ্যে ঠিক হয়ে যেতে পারে। আমার কাছে একজন ডক্টর আছে। সবে মাএ কয়েকদিন হলো আমাদের হসপিটালে জয়েন করেছে। আপনি চাইলে আমি ওর সাথে কথা বলতে পারি। আজ থেকেই মিস জেনিয়া আপনার ছেলের ট্রিটমেন্ট শুরু করবে।”

হুট করে তাহাফের আম্মু দৌঁড়ে এসে ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,,

—–“আমরা রাজি ডক্টর। আজ থেকেই আপনি ঐ ডক্টরকে বলুন আমার ছেলের ট্রিটমেন্ট শুরু করতে।”

উপস্থিত সবাই তাহাফের আম্মুর কথায় সায় জানালো। সবার সায় পেয়ে ডক্টর পাশের কেবিন থেকে ডক্টর জেনিয়াকে ডেকে আনল। জায়ান আর তমা ডক্টর জেনিয়াকে দেখা মাএই থ হয়ে গেলো। ডক্টর জেনিয়া আর কেউ নয় রনকের বোন জেনিয়া। যে জেনিয়া জায়ানের জন্য এক্টা সময় পাগল ছিলো। জেনিয়া মুচকি হেসে জায়ানের দিকে তাকালো। জেনিয়াকে ডক্টর সব ডিটেলসে বুঝিয়ে দিলো। জেনিয়া ও সাথে সায় জানালো। জায়ান কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে জেনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—–“জেনিয়া তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। আমি জানি তুমি তাহাফ ভাইয়াকে খুব জলদি ঠিক করে তুলবে।”

জেনিয়া এক গাল হেসে বলল,,,,,,

—-“আমি আমার বেস্ট দিবো জায়ান। তোমার রিলেটিভ যেহেতু সো আমাকে তো বেস্ট দিতেই হবে।”

কথাগুলো বলেই জেনিয়া মুচকি হেসে তমার দিকে তাকিয়ে ও.টি তে ঢুকে গেলো। তাহাফের নেতিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে জেনিয়ার কেমন খারাপ লাগা অনুভব হলো। তাহাফকে দেখা মাএই জেনিয়ার মনে অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হলো। ডক্টরের পারমিশন নিয়ে এক এক করে তাহাফের পরিবারের সবাই তাহাফকে দেখে চলে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তাহাফের আব্বু, আম্মু। সবাইকে বাধ্য হয়ে বাড়ি যেতে হলো। কারণ জায়ান আর তমার বিয়ে পড়ানো এখনো বাকি আছে।

সন্ধ্যা সাতটা,,,,,,,

তিন কবুলের মাধ্যমে জায়ান আর তমার বিয়ে হয়ে গেলো। কারো মনে তেমন শান্তি নেই। সবার মনটা বেশ খারাপ তাহাফকে নিয়ে। জায়ান তমাকে নিয়ে ওর বাড়িতে চলে এসেছে। বাড়িতে পৌঁছেই জায়ান আর তমা নিজেদের রুমে ঢুকে শাড়ী, পান্জ্ঞাবী চেইঞ্চ করে নতুন শাড়ী আর পান্জাবী পড়ে হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেলো। রুম থেকে বের হয়ে দুজন গাড়ি নিয়ে প্রায় বিশ মিনিট পর হসপিটালে পৌঁছে গেলো। তাহাফকে এক্টা আলাদা কেবিনে শিফট করা হয়েছে। তাহাফের সেন্স ফিরেছে। তবে সে আপাতত মানসিক ভারসাম্যহীন। সোজা হয়ে বসে আছে। কোনো দিকেই বোধ বুদ্ধি নেই। কেবিনের এক্টা কোণায় চেয়ার পেতে বসে আছে তাহাফের আব্বু, আম্মু। আর জেনিয়া তাহাফের পাশে বসে তাহাফের সাথে হেসে হেসে অনেক ধরনের কথা বলছে। তাহাফ এক দৃষ্টিতে জেনিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুই বলছে না। এর মাঝেই তমা আর জায়ান গিয়ে তাহাফের পাশে বসল। তাহাফ কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না। তমা তাহাফের মুখটা ঘুড়িয়ে তাহাফের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

—-“ভাইয়া দেখো আমি এসেছি তোমায় দেখতে। প্লিজ আমার দিকে তাকাও। আমার সাথে কথা বলো।”

তাহাফ তমার দিকে একবার তাকিয়ে মাথাটা নিচু করে ফেলল। জেনিয়া মলিন হেসে জায়ান আর তমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,,

—–“উনাকে উনার মতো ছেড়ে দিন। আই থিংক অনেকটা সময় লাগবে উনার ঠিক হতে। আমি শেষ পর্যন্ত উনার পাশে থাকব।”

জায়ান আর তমা মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়াল। প্রায় দুই ঘন্টা হসপিটালে থেকে তমা আর জায়ান তাহাফের আব্বু, আম্মুকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলো। জেনিয়া ঠায় তাহাফের পাশে বসে আছে।

বাড়িতে পৌঁছেই তমা আর জায়ান রাতের ডিনার সেরে নিজেদের রুমে চলে গেলো। তমা মনটা খারাপ করে জানালার গ্রীল ধরে এক দৃষ্টিতে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। জায়ান পিছন থেকে তমাকে জড়িয়ে ধরে তমার ঘাঁড়ে গলা ডুবিয়ে বলল,,,,,,,,

—–“ভালোবাসি তমু। খুব খুব খুব ভালোবাসি।”

তমা মলিন হেসে বলল,,,,,,,

—-“আমি ও ভালোবাসি জায়ান। খুব খুব খুব ভালোবাসি।”

জায়ান ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,,,,,,

—–“তমু….আজ আমি তোকে সম্পূর্নভাবে নিজের করে পেতে চাই। প্লিজ আজ আমাকে বাঁধা দিস না।”

জায়ানের কথাগুলো শুনে তমার শরীরে কেমন শিহরন বয়ে গেলো। তমা চোখ গুলো বন্ধ করে রেখেছে। জায়ান হেচকা টান দিয়ে তমাকে ওর দিকে ঘুড়িয়ে নিলো। তমা মুখটা নিচু করে রেখেছে। জায়ান তমার থুতনীটা উপরে তুলে তমার ঠোঁটের দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জায়ান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তমার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল। তমা জায়ানের শার্ট আঁকড়ে ধরল। জায়ান বেশ উওেজিত হয়ে তমাকে আধকোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। জায়ান ও তমার শরীরের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিলো। আস্তে আস্তে ওদের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। আজ রাতে জায়ান তমাকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজের করে নিয়েছে। স্বামী, স্ত্রীর পবিএ ভালোবাসায় নিজেদের মাতিয়ে তুলেছে।

এভাবেই নিস্বার্থ ভালোবাসা,খুনসুটি, তাহাফকে নিয়ে থাকা সবার মধ্যকার অস্থিরতা সব মিলিয়ে কেটে গেলো প্রায় দুই বছর। তমা বেশ খুশি ওর সাংসারিক জীবনে। জায়ানের ভালোবাসা যেনো দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছে। তমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস গুলোতে ও জায়ানের বেশ নজর। এক বছরের এক্টা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে হয়েছে তমা আর জায়ানের। জায়ান ওর মেয়ের নাম রেখেছে “রুবাইয়া আহমেদ তাইফা”। তাহাফের নামের সাথে মিল রেখে জায়ান ওর মেয়ের নাম রেখেছে। আজ তাইফার এক বছর পূর্ণ হলো। তাই বাড়িতে বড় সড় করে এক্টা বার্থডে পার্টি এরেন্জ্ঞ করা হয়েছে। পুরো বাড়িতে রমরমা ভাব। চারদিকে শূধু আলো আর রোশনাই। সবাই বেশ খুশি। তমার পরিবার তাহাফের পরিবার এসে হাজির জায়ানের বাড়িতে। সবার চোখে, মুখে হাসি খুশি উপচে পড়ছে। অবশ্য এর আরেকটা কারণ আছে। আজ তাহাফ জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে বাড়িতে ফিরবে। তাহাফ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। জেনিয়ার ট্রিটমেন্টে এক বছর আগেই তাহাফ সুস্থ হয়ে উঠেছে। নারী পাচার চক্রের সাথে জড়িত থাকার কারণে তাহাফের এক বছরের জেল হয়েছে। জেনিয়া এরপরে ও তাহাফের পাশে ছিলো। এই দুই বছরে তাহাফের সাথে জেনিয়ার এক্টা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। জেনিয়ার কেয়ারিং, সব সময় ঢাল হয়ে তাহাফের পাশে থাকা এই সবকিছু তাহাফকে মুগ্ধ করে তুলেছে। তাহাফের আম্মু, আব্বু রনকের সাথে কথা বলে তাহাফ আর জেনিয়ার বিয়ের ডেইট ও ফিক্সড করে নিয়েছে। এবার শুধু তাহাফের ফেরার পালা। জাবেদ আর লিমা গুছিয়ে সংসার করছে। ছয় মাস হলো জাবেদ আর লিমার বিয়ের। তমা আর লিমা একই বাড়িতে জা হয়ে আছে। তমাল ওর বউকে নিয়ে হানিমুনে গেছে। এরেন্জ্ঞ ম্যারেজ হয়েছে তমালের। তমাল ওয়াইফ শিলা দেখতে বেশ সুন্দুরী আর গুনী ও।

রাত আটটা,,,,,,

জায়ান ওর মেয়েকে লাল রং এক্টা বার্বি ড্রেস পড়িয়ে পুরো বাড়ি গোল গোল করে ঘুড়ছে। জায়ান ওর মেয়েকে এক মুহূর্তের জন্যে ও কোল ছাড়া করতে চায় না। সারাক্ষন শুধু মুখে লেগে থাকে তাইফা তাইফা। তাইফা ও বাবা ছাড়া কিছু বুঝে না। সারাক্ষন বাবার বুকের সাথে মিশে থাকে। তমা লাল রং এর এক্টা শাড়ি পড়ে হাত খোঁপা করে মুখটা ফুলিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জায়ান ওর মেয়েকে নিয়ে রুমে ঢুকেই দেখল তমা কেমন মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে। জায়ান তমার পিছনে দাঁড়িয়ে তাইফার দিকে তাকিয়ে আহ্লাদি কন্ঠে বলল,,,,,,

—-“দেখেছ তাইফা মা, তোমার মামনী এখনো কেমন ছোটো রয়ে গেছে। কিছু এক্টা খুঁজে না পেলেই ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলে না হয় মুখটা ভাড় করে রাখে। শেষ মেষ আমাকেই জিনিসটা খুঁজে দিতে হয়।”

তমা আয়না দিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে জায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। জায়ান হু হা করে হেসে কাবার্ডের উপর থেকে বেলি ফুলের মালাটা নিয়ে তমার খোঁপায় গুজছে আর মিটিমিটি হাসছে। তমা পিছু ফিরে জায়ানের কোল থেকে তাইফাকে কেড়ে নিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। জায়ান মুখটা ফুলিয়ে তমার খোঁপায় বেলী ফুল এঁটে দিচ্ছে। তমা তাইফার গালে চুমো খাচ্চে আর জায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,,,

—–“তাহাফ ভাইয়া আর জেনিয়ার জন্য এনগেইজমেন্ট রিং এনেছ তো?”

জায়ান তমার খোঁপায় ফুল এঁটে দিয়ে তাইফাকে তমার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাইফার কপালে চুমো খেয়ে বলল,,,,,,

—-“রিং আমার পান্জ্ঞাবীর পকেটেই আছে। তোকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তাড়াতাড়ি নিচে চল। তাহাফ ভাইয়া আর জেনিয়া চলে এলো বলে।”

তমা খোঁপায় হাত দিয়ে পিছু ঘুরে জায়ানের দিকে তাকালো। জায়ানের এতক্ষনে তমার দিকে চোখ পড়ল। এক দৃষ্টিতে জায়ান তমার দিকে তাকিয়ে আছে। তমা কিছুটা লজ্জা পেয়ে যেই না জায়ানকে ক্রস করে দরজার দিকে পা রাখবে অমনি জায়ান তমার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে তমাকে ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। তমা জায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। জায়ান ওর মেয়েকে এক হাতে কোলে নিয়ে তমাকে আরেক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শান্ত কন্ঠে বলল,,,,,,,

—-“আমার পরিবার। বেশ খুশি আমি আমার মেয়ে আর আমার বউকে নিয়ে। আল্লাহ্ র কাছে অসংখ্য শুকরিয়া। এই ভাবেই আমি আমার মেয়ে আর বউকে সারাজীবন ভালোবেসে যাবো। তমু…. #হয়তো_তোরই_জন্য আমার এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া।”

তমা মুচকি হেসে জায়ানের বুকে মাথা রেখে বলল,,,,,,

—-“আমি ও আল্লাহ্ র কাছে অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করছি। আমি আমার বিবাহিত জীবনে বেশ খুশি। এভাবেই মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে সুখে, শান্তিতে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। আমার ও মনে হয়, #হয়তো_তোরই_জন্য আমার এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া।”

এর মাঝেই নিচ থেকে ডাক পড়ল তাহাফ এসেছে তাহাফ এসেছে বলে। তমা আর জায়ান হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে সোজা নিচে চলে গেলো। তাহাফ আর জেনিয়া হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহাফের আম্মু, আব্বু দৌঁড়ে গিয়ে তাহাফকে জড়িয়ে ধরল। তমার আম্মু, আব্বু ও তাহাফকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। তমা আর জায়ান দৌঁড়ে গিয়ে তাহাফের পাশে দাঁড়ালো। তাহাফ ওর আম্মু, আব্বুকে ছেড়ে তমা আর জায়ানের মুখোমুখি দঁড়িয়ে মুখটা কালো করে বলল,,,,,,,

—-“আমাকে মাফ করে দে তোরা। আমি আমার ভুলের যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছি। অনেক অন্যায় করেছি তোদের সাথে আমি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। জেনিয়া এসে আমার অন্ধকার লাইফটাকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। আমি এখন আমার জীবনে অনেক খুশি। বাকিটা ও জীবন ও এভাবে হাসি খুশিতে কাটিয়ে দিতে চাই।”

জায়ান তাহাফের হাতে হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,,,,,,,,

—-“যা হওয়ার হয়ে গেছে তাহাফ ভাইয়া। আমরা সব ভুলে গেছি। তুমি ও এসব ভুলে যাও। আজ তোমার জন্য এক্টা বিশাল সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।”

কথাগুলো বলেই জায়ান তাইফাকে তমার কোলে তুলে দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে উপস্থিত পরিবারের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

—–“আজ তাইফার জন্মদিনের কেক কাটার পর তাহাফ ভাইয়া আর জেনিয়া ভাবীর এনগেইজমেন্ট হবে। সবাই রাজি তো আমার সিদ্ধান্তে?”

পরিবারের সবাই হাত তুলে জায়ানের সিদ্ধান্তে মত প্রকাশ করল। তাহাফ আর জেনিয়া বেশ অবাক হয়ে জায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে ওরা দুজনই মনে মনে বেশ খুশি। তাহাফের আম্মু, আব্বু তো চরম খুশি। তাহাফের চোখ এতক্ষনে তাইফার দিকে পড়ল। তাইফা একদম তমার মতো হয়েছে। গোলগাল, নাদুস নুদুস দেখতে। তাহাফ হাসিমুখে তাইফাকে কোলে নিয়ে তাইফার বার্থ ডে কেকের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,,,

—–“চলো চলো আমরা তাইফা মনির বার্থডে কেকে কাটি।”

সবাই হাসি মুখে তাহাফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জায়ান আর তমা তাহাফের দুই পাশে দাঁড়িয়েছে। পিচ্চি তাইফা মনি তাহাফের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। তাহাফ আদরে আদরে তাইফা মনিকে ভরিয়ে দিচ্ছে। এক্টা প্লাস্টিকের ছুরি এনে জায়ান তাইফার হাতে ধরিয়ে দিলো। তাইফা ছুরিটা কিছুক্ষন নাড়িয়ে চাড়িয়ে মুখের ভিতর পুড়তে নিলেই তাহাফ হু হা করে হেসে তাইফার হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে তমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,,,,,,

—–“নে, তুই আর জায়ান মিলে কেকটা কেটে নে।”

জায়ান আর তমা মুচকি হেসে ছুরিটা হাতে নিয়ে কেক কেটে নিলো। সবাই তাইফা মনিকে উইশ করছে। তাইফা মনি সবার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেবল হাসছে। কেকে কাটা শেষে জায়ান আর তমা তাইফার মুখে এক্টু এক্টু করে কেকের ক্রীম পুড়ে দিচ্ছে। তাইফা বেশ মজা মজা করে খাচ্ছে, আর চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটিয়ে তুলছে। সবাই তাইফার কান্ড দেখে হাসছে। জায়ান কেকে কেটে এক এক করে সবাইকে কেক খাইয়ে দিলো। তাইফা এবার কান্না জুড়ে দিলো জায়ানের কোলে যাবে বলে। তমা কপাল চাপড়াচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—-“মেয়েটা আমার মতো দেখতে বাট হয়েছে পুরো বাবা পাগলী। সারাক্ষন বাবার বুকে ফেবিকলের মতো চিপকে থাকে। আর বা বা বা বা করে।”

তমার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হাসতে হাসতে কাত হয়ে যাচ্ছে। জায়ান তাইফাকে কোলে নিয়ে তমার মাথায় গাড্ডা মেরে বলল,,,,,,,

—-“তোর খুব হিংসে হয় তাই না? আমার মেয়ে বাবা পাগলী হয়েছে বলে?”

তমা মুখটা বাঁকা করে বলল,,,,,

—-“বয়ে গেছে আমার হিংসে করতে।”

জায়ান এক গাল হেসে তাইফাকে তমার গালের কাছে এনে বেশ আহ্লাদি সুরে তাইফাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,,

—–“তাইফুমনি তোমার মাম্মার গালে এক্টা কিসি দিয়ে দাও। তোমার মাম্মা বেশ রাগ করেছে তোমার সাথে।”

তাইফা ও বাবার কথা শুনে আস্তে করে এক্টা কিসি দিয়ে দিলো তমার গালে। তমা খিলখিল করে হেসে তাইফার গালে অসংখ্য চুমো খাচ্ছে। জায়ান হাসি মুখে দাঁড়িয়ে সব দেখছে।

বার্থডে পর্ব শেষে এবার এলো এনগেইজমেন্ট পর্ব। তাহাফ আর জেনিয়ার হাতে জায়ান দুটো এনগেইজমেন্ট রিং ধরিয়ে দিলো। তাহাফ জেনিয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে জেনিয়ার হাতে রিং পড়িয়ে দিলো। জেনিয়াও কিছুটা লজ্জা পেয়ে তাহাফের হাতে রিং পড়িয়ে দিলো। সবাই করতালি দিয়ে তাহাফ আর জেনিয়াকে স্বাগতম জানাচ্ছে। সবাই বেশ খুশি। বিশেষ করে তাহাফের আম্মু, আব্বু। একজন ফটোগ্রাফারকে ডেকে এনে জায়ান অনেকগুলো ফ্যামিলি ফটো তুলে নিলো। যেখানে দুই পরিবারের সবাই হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহাফ আর জেনিয়ার ও অনেক সিংগেল ছবি তোলা হয়েছে। জাবেদ আর লিমা ও সিংগেল ছবি তুলেছে। আকাশ আর জয়া আসতে পারে নি। কারণ ওদের ছেলের হুট করেই নিউমোনিয়া দেখা দিয়েছে। তাই ওরা মিসিং।

পরিশেষে জায়ান, তমা আর ওদের মেয়ে তাইফা মিলে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। এভাবেই অনেকগুলো ঘৃনার সম্পর্ক থেকে আজ অনেকগুলো ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হলো। তাহাফ থেকে শুরু করে তমা, জায়ান, জাবেদ, আকাশ, জয়া, শাফিন সবাই ওদের জীবনে বেশ খুশি। শাফিন ও এক বছর আগে ছাড়া পেয়ে ওর বউকে নিয়ে সুখে সংসার করছে। আবার ও প্রমানিত হলো, “কেবল ভালোবাসা দিয়েই হিংসে আর ঘৃনাকে জয় করা যায়।”

#সমাপ্ত

(গল্পটায় যে পরিমান রেসপন্স আশা করেছিলাম ঐ পরিমান রেসপন্স পাই নি। হয়তো গল্পটা পাঠকদের ভালো লাগে নি। যাই হোক, আজ অন্তত দুই, এক লাইন গঠনমূলক মন্তব্য করে যাবেন। আর ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here