হয়ত পর্ব ৩০

#হয়ত
পর্ব:- ৩০
.
বর্ষণ একটু এগেই বাসায় ফিরেছে। অনেক রাত হয়ে গেছে আজ। তনয়া বেগম খাবার নিয়ে বসেছিলেন। তবে বর্ষণ খাবে না বলেছে। তনয়া বেগম বাধ্য হয়ে খাবার গরম করে শুতে যান।
.
আজ বর্ষণের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ। তাপৌষির সাথে যাতে আর দেখা না হয় সেজন্য খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছিল সে। তবে সারাদিন মন ছিল বিচলিত। মৎস ভবন থেকে একটু এগিয়ে এশিয়ান টাচ (কাল্পনিক) নামক বিল্ডিং এর দুই তলা ও রেস্টুরেন্টের জন্য ভাড়া নিয়েছে। আজকে ডেকোরেশনের কাজ চলছিল। ডেকোরেশনের জন্য যাদের ডাকা হয়েছিল তাদের উপর বর্ষণ অযথাই রাগ দেখায়। নিজেই পূর্ব কর্ণারের জন্য Quilled wall art এর Girl blowing butterfly wall art করতে বলেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভুলে গেছিল। লোকগুলোকে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে ক্ষমাও চেয়ে আসে। তবে ভুল তো ভুলই।
.
নিজ ঘরে প্রবেশ করে বর্ষণ চমকে যায়। ঘরের মাঝ বরাবর ঝুলছে তাপৌষিকে কিনে দেওয়া সেই একজোড়া White Wrapped Balloon Lamp.
তাপৌষি এটা নিয়ে যায় নি সাথে?
বেলুনের লাইটের তারে ঝুলছে লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা একটা কাগজ। বর্ষণ ফিতা খুলে কাগজ হাতে নেয়। “চিঠি”…. তাপৌষি ওকে চিঠি লিখেছে?
বর্ষণ দ্রুত বিছানায় বসে পড়ে। চোখ একবার বন্ধ করে পড়তে শুরু করে প্রেয়সীর হাতে লিখা চিঠি।

বর্ষণ,
কী বলে আপনাকে সম্বোধন করবো তা বুঝতে পারছিলাম না। তাই নাম ধরেই লিখা শুরু করলাম। পরীক্ষার খাতায় আগে অনেক চিঠি লিখেছি। তবে আপনার কাছে লিখতে যেয়ে মনের মাঝে এক ভিন্ন অনুভূতির স্বাদ পাচ্ছি।
বর্ষণ, এই কাগজের ভাজ যখন আপনি খুলবেন তখন আমি আপনার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করব। ‘বরেন্দ্র অঞ্চল’এ যেখানে আমার জন্ম, আমার বেড়ে উঠা। আচ্ছা আমাদের কী বিচ্ছেদ হয়েছে? আমি না বুঝতে পারছি না। প্রেমের, বিয়ের সম্পর্কে বিচ্ছেদ হয়। আমাদের মাঝে কি এমন কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল?
হয়ত উত্তর হবে হ্যাঁ অথবা না।
আমার চলে আসায় একটু হলেও হাফ ছেড়েছেন তাইনা? পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছিলেন সব সময় আমার থেকে। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন নিজের অনুভূতি থেকে। এখন আমিও পালিয়ে বেড়াচ্ছি আপনার থেকে।
আমি তো ঠিক আপনার মতো করেই আপনাকে ভালোবেসেছি। আমার ভালোবাসায় কখনো কোন ক্রূর চিন্তা ছিল না।
আচ্ছা ভালোবাসা বড় না দায়িত্ব বড়? আমি জানি আপনি হলে বলতেন দায়িত্ব বড়। এই যে অথৈ আপু কে বিয়ের প্রধান কারণই তো আপনার দায়িত্ব।
জানেন সন্ধ্যায় আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলতে দেখা যায়। তবে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখায় সন্ধ্যাতারাকে। আপনি হলেন সেই ‘সন্ধ্যাতারা’। আমার মতো একজন সাধারণ মেয়ের কখনোই আপনাকে পাবার স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। তবে ভুল ক্রমে সেই স্বপ্ন আমি দেখে ফেলেছি। মাফ করবেন।
অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে এলাম তাইনা?
আপনি হয়ত ভাবছেন এই মেয়েটা আবার চিঠি লিখছে কেন? আসলে আপনাকে আমি সকাল থেকে দেখতে পাইনি। কিছু কথা ছিল, বলা হয়নি।
বর্ষণ আমি জানি আপনার জ্ঞানের নিকট আমার জ্ঞান অতিশয় ক্ষুদ্র। তবে সেই ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকেই বলছি, নিজেকে কখনো অন্যায়কারী মনে করবেন না। আপনি কখনোই অন্যায় করেননি। অন্যায় তো আমি করেছি। বামন হয়ে চাঁদ ধরতে গিয়েছি। কিন্তু সেই চাঁদের আলো যে আমার সহ্য ক্ষমতার অনেক উপরে তা বুঝতে দেরি করে ফেলেছি।
আমি জানি সম্পর্কের সঠিক অবস্থান পরিমাপ করতে আপনি খুব ভালো মতোই জানেন। অথৈ আপু যে ভবিষ্যৎ জীবনে খুব সুখী হবে তা বলতে দ্বিধা নেই।
একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে। জীবনে কখনো চলার পথের কোন এক প্রান্তে তাপৌষি নামক এই মেয়েটিকে কী কখনো মনে পড়বে আপনার?
আমি আবার আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছি। ক্ষমা করবেন।
শেষ বিদায়ে আপনাকে দেখতে পাইনি। খারাপ লাগছিল। তবে আমি মানিয়ে নিতে শিখে গেছি।
আমাকে নিয়ে ভাববেন না। ভালোবাসা আমাকে দুর্বল করবে না। আমার জন্য আপনার এই সামান্য ভালোবাসাই আমার এগিয়ে চলার পথের শক্তি।
ইতি
তাপৌষি
[পুনশ্চ :- দুঃখের সাথে বলছি, আপনার কিনে দেওয়া এই ল্যাম্প আমি সাথে নিতে পারলাম না। আপনার সাথে কাটানো স্মৃতিই আমার কাছে মহামূল্যবান এবং সেই সাথে মহাবেদনার। এই ল্যাম্প নামক জড়বস্তু আমাকে আপনার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিবে। বেদনার ঘা আর খোঁচাতে চাইনা।]”
.
বর্ষণের চোখ ভিজে এসেছে। দুই তিন ফোঁটা অশ্রু সাদা কাগজে তাপৌষির লিখার উপর পড়েছে। চিঠির শেষ লাইন পড়ে বর্ষণের মুখে দিয়ে শুধু একটি শব্দ উচ্চারিত হলো..’তাপৌষি’।
চিঠিটা সুন্দর করে ভাজ করে মানিব্যাগে রাখলো বর্ষণ। তারপর বিছানার উপর সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। নয়ন নিবদ্ধ সিলিং এ ঘুরতে থাকা ফ্যানের উপর।
.
” ভালোবাসতে এলি, কী গুণ আছে তোর?
কষ্ট সইতে পারিস? অবহেলা? অযত্ন?
অথবা নামহীন শোক?
যদি কিছু নেই,
তবে
চোখের জলেই অভিষেক হোক।” … (রুদ্র গোস্বামী)
.
‘তাপৌষিইইইইইইইইইইই……বড্ড দেরি করে ফেললে। বড্ড দেরি।’
.
-‘ কোথায় যাচ্ছ তাপৌষি?’
-‘ বাইরে।’
-‘ এখন তুমি বাইরে যাবা না।’
-‘ কেন? এখন কী বাইরে যাওয়ার জন্য আপনার পারমিশন লাগবে?’
-‘ যদি বলি হ্যাঁ?’
-‘ আমি যদি পারমিশন না নেই?’
-‘ কেন আমাকে রাগাতে চাচ্ছ? যাই হোক, তুমি একটু পর আমার সাথে বের হবে।’
-‘ কেন?’
-‘ তোমার না জানলেও চলবে।’
তাপৌষির রাগ লাগছে শুভ্রার উপর। এই মহিলা পেয়েছি কী? কে হয় উনি তাপৌষিকে আটকানোর? তাপৌষিকে কী এখন উনার ইচ্ছা মতো চলতে হবে?’
.
গাড়ি এসে থেমেছে “থিম ওমর প্লাজা” র সামনে। রাজশাহীর একমাত্র শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুবিশাল শপিংমল। কয়েক বছর আগেও রাজশাহীর মানুষ কেনাকাটার মার্কেট বলতে বুঝত “সাহেব বাজার” অথবা “বড় নিউমার্কেট “। আর এখন? মানুষ আধুনিক হয়েছে।
.
শুভ্রা আজ মনে মনে হয়ত পরিকল্পনা করে এসেছে তাপৌষিকে সে নিজের মতো অত্যাধুনিক বানাবে। তাইতো বেছে বেছে সব স্লিভলেস শর্ট গাউন দেখছে।
-‘ তাপৌষি এটা তোমায় মানাবে।’
-‘ আমি এই ছোট জামা পড়িনা।’
-‘ ওহ ডার্লিং, প্লিজ চেঞ্জ ইওর ডাউন মার্কেট হ্যাবিট। এইটা খুব সুন্দর। ককটেল ড্রেস।’
-‘ বললাম তো হাটুর উপর কোন জামা আমি পায়জামা ছাড়া পড়িনা।’
-‘ উফ। ‘
কাম ডাউন শুভ্রা।
শুভ্রা কিছুক্ষণ ব্রিথ ইন অ্যান্ড ব্রিথ আউট করলো। তারপর তাপৌষির সামনে একটা ব্ল্যাক কালারের ব্যাকলেস লং গাউন তুলে ধরলো।
-‘ হাউ ইজ ইট? আই থিংক দিস ইজ রক। যাও ট্রাইল দিয়ে এসো।’
-‘ আমি এটা পড়বো না। পিঠ খোলা।’
-‘ তো?’
শুভ্রা তাপৌষির হাত চেপে ধরে আছে। তাপৌষির ব্যথা লাগছে।
তাপৌষির মনে হচ্ছে রাজশাহীতে পা দিয়ে ও বিরাট কোন ভুল করে ফেলেছে। আচ্ছা কোথাও কী চলে যেতে পারতো না? দূর অজানা কোন জায়গায়?
.
আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানুষ টিকে তাপৌষি চিনতে পারছে না। বিউটি পার্লারে এনে শুভ্রা ওকে একটা গিনিপিগ বানিয়ে দিয়েছে। চুলে লেয়ার কাট দিয়ে ব্রাউন কালার করা হয়েছে। মাঝে জায়গায় জায়গায় হাইলাইট করা। জোড়া ভ্রুকে প্লাগ করে সুন্দর করার প্রয়াস। তবে তাপৌষির কাছে এই নতুনত্ব গুলো বিচ্ছিরি লাগছে। এটা তাপৌষি নয়। তাপৌষির চেহারায় তনিমা বেগমের রূপ ফুটে উঠে। আয়নার প্রতিবিম্বে তাপৌষি তনিমা বেগমকে দেখতে পাচ্ছে না। ওর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। এই সাজ ও চায়না। আগের তাপৌষিকে ফেরত পেতে চায়।
.
শুভ্রা তাপৌষিকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিল। আহ, কলিজায় শান্তি লাগছে! তাপৌষিকে দেখতে আগের চেয়ে সুন্দর লাগছে। তবে তনিমা তনিমা ভাব এই মেয়ের মুখে একদমই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই তাপৌষি শুভ্রার সৃষ্টি। শুভ্রা যা বলবে এখন থেকে তাপৌষিও তাই করবে। ফরিদ কে হাতে রাখার জন্য তাপৌষিকে শুভ্রার নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।
.
নীলাভ্রর বার্থডে পার্টি রাজশাহীর একটি নামীদামী কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত হয়েছে। শুভ্রা নিজের হাই সোসাইটির অনেক মানুষকে দাওয়াত দিয়েছে। অনুষ্ঠানে এসেছে নীলাভ্রর বিশাল ফ্রেন্ড সার্কেল। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় এরা প্রত্যকে নীলাভ্র বলতে ছিল অজ্ঞান। অবশ্য এই ফেম পেতে নীলাভ্রর কম ঘাম ঝরাতে হয়নি। কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়েছে ওর এমন চাটুকার বন্ধু পেতে। এই বন্ধু সার্কেলের সবাই নীলাভ্রর প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনে। এদের মধ্যে আবার কয়েকজন মেয়েও আছে। তাপৌষি প্রথম দেখাই বুঝতে পেরেছে এই গ্রুপের প্রত্যকে খুব অসংগতিপূর্ন জীবন যাপন লীড করে। প্রত্যকের হাতেই উচ্চমাত্রার এলকোহল। অথচ অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয়নি।
-‘ মামা এই কাটপিস টা কে রে?’
নীলাভ্র তাপৌষির দিকে একবার ঘুরে তাকাল। তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাতে থাকা গ্লাসের পানীয়তে চুমুক দিয়ে বলল,
-‘ বুইড়ার আগের বউয়ের মেয়ে।’
-‘ দেখতে তো সেই। পুরাই এমা ওয়াটসন।’
-‘ আছে ঠিকঠাক।’
-‘ কিন্তু মামা তুমি তো পঁচে গেলা।’
-‘ মানে?’
-‘ বুইড়ার তো মেয়ে আছে। সম্পত্তিতে তো ভাগ বইসা গেলো।’
-‘ এহ! বললেই হলো। এগুলা সব আমার নানার। সব কিছুতে একা আমার অধিকার।’
-‘ বুইড়া দিলে। আপতত , বুইড়ার মেয়ে আছে এটা মাথায় রাইখো।’
এবার ওদের মাঝে উগ্র পোশাক পরহিতা একটা মেয়ে নড়েচড়ে বসল। বেবি পিংক কালারের চুল গুলাকে কানের পিছে গুঁজল। গলায় একটা ট্যাটু দৃশ্যমান হলো। জামার গলা খুব বড়। মেয়েটার নাম “রাবেয়া”। তবে রাবেয়া নামটা তার কাছে খুব ক্ষ্যাত লাগে। তাই নিজের নামকে সে শর্টে “রেব” বলে। এই অল্প বয়সেও তার দুটো ডির্ভোস হয়ে গেছে। বর্তমানে একজন পঁয়তাল্লিশ বছরের নামকরা উকিলের সাথে লিভ টুগেদারে আছে। ঢাকায় সেটেল। বাবা দেশের বাইরে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে সুখে আছেন। মা নিজের তৃতীয় বিয়ের কিছুদিন আগে সমাপ্তি টেনেছেন।
রেব একটু ঠেশ মারা গলায় বলল,
-‘ কী রে সায়েম? ডোন্ট কল হিম বুইড়া। লুক হি ইজ কোয়াইট আমেজিং। এই বয়সেও দেখতে কী জোস! পুরাই হলিউড হিরো। যাই বল নীলাভ্র, তোর মায়ের সাথে তোর নতুন বাপকে মানিয়েছে দারুন।’
তবে নীলাভ্র এখন ওর বন্ধু মহলের কারও কথায় কর্ণপাত করছে না। ওর মাথায় এখন একটাই চিন্তা। সায়েমের কথা ওর মস্তিষ্কে প্রবল ভাবে আঘাত হেনেছে। দুই পয়সার মেয়ে তাপৌষি। কোন কারণ ছাড়াই সম্পত্তির ভাগ পেয়ে যাবে? অসম্ভব। কিছু তো করতেই হবে। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে জল ঘোলা হতে সময় লাগবে না।
.
.
চলবে…
(যারা#হয়ত
পর্ব:- ৩০
.
বর্ষণ একটু এগেই বাসায় ফিরেছে। অনেক রাত হয়ে গেছে আজ। তনয়া বেগম খাবার নিয়ে বসেছিলেন। তবে বর্ষণ খাবে না বলেছে। তনয়া বেগম বাধ্য হয়ে খাবার গরম করে শুতে যান।
.
আজ বর্ষণের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ। তাপৌষির সাথে যাতে আর দেখা না হয় সেজন্য খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছিল সে। তবে সারাদিন মন ছিল বিচলিত। মৎস ভবন থেকে একটু এগিয়ে এশিয়ান টাচ (কাল্পনিক) নামক বিল্ডিং এর দুই তলা ও রেস্টুরেন্টের জন্য ভাড়া নিয়েছে। আজকে ডেকোরেশনের কাজ চলছিল। ডেকোরেশনের জন্য যাদের ডাকা হয়েছিল তাদের উপর বর্ষণ অযথাই রাগ দেখায়। নিজেই পূর্ব কর্ণারের জন্য Quilled wall art এর Girl blowing butterfly wall art করতে বলেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভুলে গেছিল। লোকগুলোকে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে ক্ষমাও চেয়ে আসে। তবে ভুল তো ভুলই।
.
নিজ ঘরে প্রবেশ করে বর্ষণ চমকে যায়। ঘরের মাঝ বরাবর ঝুলছে তাপৌষিকে কিনে দেওয়া সেই একজোড়া White Wrapped Balloon Lamp.
তাপৌষি এটা নিয়ে যায় নি সাথে?
বেলুনের লাইটের তারে ঝুলছে লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা একটা কাগজ। বর্ষণ ফিতা খুলে কাগজ হাতে নেয়। “চিঠি”…. তাপৌষি ওকে চিঠি লিখেছে?
বর্ষণ দ্রুত বিছানায় বসে পড়ে। চোখ একবার বন্ধ করে পড়তে শুরু করে প্রেয়সীর হাতে লিখা চিঠি।

বর্ষণ,
কী বলে আপনাকে সম্বোধন করবো তা বুঝতে পারছিলাম না। তাই নাম ধরেই লিখা শুরু করলাম। পরীক্ষার খাতায় আগে অনেক চিঠি লিখেছি। তবে আপনার কাছে লিখতে যেয়ে মনের মাঝে এক ভিন্ন অনুভূতির স্বাদ পাচ্ছি।
বর্ষণ, এই কাগজের ভাজ যখন আপনি খুলবেন তখন আমি আপনার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করব। ‘বরেন্দ্র অঞ্চল’এ যেখানে আমার জন্ম, আমার বেড়ে উঠা। আচ্ছা আমাদের কী বিচ্ছেদ হয়েছে? আমি না বুঝতে পারছি না। প্রেমের, বিয়ের সম্পর্কে বিচ্ছেদ হয়। আমাদের মাঝে কি এমন কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল?
হয়ত উত্তর হবে হ্যাঁ অথবা না।
আমার চলে আসায় একটু হলেও হাফ ছেড়েছেন তাইনা? পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছিলেন সব সময় আমার থেকে। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন নিজের অনুভূতি থেকে। এখন আমিও পালিয়ে বেড়াচ্ছি আপনার থেকে।
আমি তো ঠিক আপনার মতো করেই আপনাকে ভালোবেসেছি। আমার ভালোবাসায় কখনো কোন ক্রূর চিন্তা ছিল না।
আচ্ছা ভালোবাসা বড় না দায়িত্ব বড়? আমি জানি আপনি হলে বলতেন দায়িত্ব বড়। এই যে অথৈ আপু কে বিয়ের প্রধান কারণই তো আপনার দায়িত্ব।
জানেন সন্ধ্যায় আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলতে দেখা যায়। তবে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখায় সন্ধ্যাতারাকে। আপনি হলেন সেই ‘সন্ধ্যাতারা’। আমার মতো একজন সাধারণ মেয়ের কখনোই আপনাকে পাবার স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। তবে ভুল ক্রমে সেই স্বপ্ন আমি দেখে ফেলেছি। মাফ করবেন।
অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে এলাম তাইনা?
আপনি হয়ত ভাবছেন এই মেয়েটা আবার চিঠি লিখছে কেন? আসলে আপনাকে আমি সকাল থেকে দেখতে পাইনি। কিছু কথা ছিল, বলা হয়নি।
বর্ষণ আমি জানি আপনার জ্ঞানের নিকট আমার জ্ঞান অতিশয় ক্ষুদ্র। তবে সেই ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকেই বলছি, নিজেকে কখনো অন্যায়কারী মনে করবেন না। আপনি কখনোই অন্যায় করেননি। অন্যায় তো আমি করেছি। বামন হয়ে চাঁদ ধরতে গিয়েছি। কিন্তু সেই চাঁদের আলো যে আমার সহ্য ক্ষমতার অনেক উপরে তা বুঝতে দেরি করে ফেলেছি।
আমি জানি সম্পর্কের সঠিক অবস্থান পরিমাপ করতে আপনি খুব ভালো মতোই জানেন। অথৈ আপু যে ভবিষ্যৎ জীবনে খুব সুখী হবে তা বলতে দ্বিধা নেই।
একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে। জীবনে কখনো চলার পথের কোন এক প্রান্তে তাপৌষি নামক এই মেয়েটিকে কী কখনো মনে পড়বে আপনার?
আমি আবার আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছি। ক্ষমা করবেন।
শেষ বিদায়ে আপনাকে দেখতে পাইনি। খারাপ লাগছিল। তবে আমি মানিয়ে নিতে শিখে গেছি।
আমাকে নিয়ে ভাববেন না। ভালোবাসা আমাকে দুর্বল করবে না। আমার জন্য আপনার এই সামান্য ভালোবাসাই আমার এগিয়ে চলার পথের শক্তি।
ইতি
তাপৌষি
[পুনশ্চ :- দুঃখের সাথে বলছি, আপনার কিনে দেওয়া এই ল্যাম্প আমি সাথে নিতে পারলাম না। আপনার সাথে কাটানো স্মৃতিই আমার কাছে মহামূল্যবান এবং সেই সাথে মহাবেদনার। এই ল্যাম্প নামক জড়বস্তু আমাকে আপনার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিবে। বেদনার ঘা আর খোঁচাতে চাইনা।]”
.
বর্ষণের চোখ ভিজে এসেছে। দুই তিন ফোঁটা অশ্রু সাদা কাগজে তাপৌষির লিখার উপর পড়েছে। চিঠির শেষ লাইন পড়ে বর্ষণের মুখে দিয়ে শুধু একটি শব্দ উচ্চারিত হলো..’তাপৌষি’।
চিঠিটা সুন্দর করে ভাজ করে মানিব্যাগে রাখলো বর্ষণ। তারপর বিছানার উপর সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। নয়ন নিবদ্ধ সিলিং এ ঘুরতে থাকা ফ্যানের উপর।
.
” ভালোবাসতে এলি, কী গুণ আছে তোর?
কষ্ট সইতে পারিস? অবহেলা? অযত্ন?
অথবা নামহীন শোক?
যদি কিছু নেই,
তবে
চোখের জলেই অভিষেক হোক।” … (রুদ্র গোস্বামী)
.
‘তাপৌষিইইইইইইইইইইই……বড্ড দেরি করে ফেললে। বড্ড দেরি।’
.
-‘ কোথায় যাচ্ছ তাপৌষি?’
-‘ বাইরে।’
-‘ এখন তুমি বাইরে যাবা না।’
-‘ কেন? এখন কী বাইরে যাওয়ার জন্য আপনার পারমিশন লাগবে?’
-‘ যদি বলি হ্যাঁ?’
-‘ আমি যদি পারমিশন না নেই?’
-‘ কেন আমাকে রাগাতে চাচ্ছ? যাই হোক, তুমি একটু পর আমার সাথে বের হবে।’
-‘ কেন?’
-‘ তোমার না জানলেও চলবে।’
তাপৌষির রাগ লাগছে শুভ্রার উপর। এই মহিলা পেয়েছি কী? কে হয় উনি তাপৌষিকে আটকানোর? তাপৌষিকে কী এখন উনার ইচ্ছা মতো চলতে হবে?’
.
গাড়ি এসে থেমেছে “থিম ওমর প্লাজা” র সামনে। রাজশাহীর একমাত্র শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুবিশাল শপিংমল। কয়েক বছর আগেও রাজশাহীর মানুষ কেনাকাটার মার্কেট বলতে বুঝত “সাহেব বাজার” অথবা “বড় নিউমার্কেট “। আর এখন? মানুষ আধুনিক হয়েছে।
.
শুভ্রা আজ মনে মনে হয়ত পরিকল্পনা করে এসেছে তাপৌষিকে সে নিজের মতো অত্যাধুনিক বানাবে। তাইতো বেছে বেছে সব স্লিভলেস শর্ট গাউন দেখছে।
-‘ তাপৌষি এটা তোমায় মানাবে।’
-‘ আমি এই ছোট জামা পড়িনা।’
-‘ ওহ ডার্লিং, প্লিজ চেঞ্জ ইওর ডাউন মার্কেট হ্যাবিট। এইটা খুব সুন্দর। ককটেল ড্রেস।’
-‘ বললাম তো হাটুর উপর কোন জামা আমি পায়জামা ছাড়া পড়িনা।’
-‘ উফ। ‘
কাম ডাউন শুভ্রা।
শুভ্রা কিছুক্ষণ ব্রিথ ইন অ্যান্ড ব্রিথ আউট করলো। তারপর তাপৌষির সামনে একটা ব্ল্যাক কালারের ব্যাকলেস লং গাউন তুলে ধরলো।
-‘ হাউ ইজ ইট? আই থিংক দিস ইজ রক। যাও ট্রাইল দিয়ে এসো।’
-‘ আমি এটা পড়বো না। পিঠ খোলা।’
-‘ তো?’
শুভ্রা তাপৌষির হাত চেপে ধরে আছে। তাপৌষির ব্যথা লাগছে।
তাপৌষির মনে হচ্ছে রাজশাহীতে পা দিয়ে ও বিরাট কোন ভুল করে ফেলেছে। আচ্ছা কোথাও কী চলে যেতে পারতো না? দূর অজানা কোন জায়গায়?
.
আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানুষ টিকে তাপৌষি চিনতে পারছে না। বিউটি পার্লারে এনে শুভ্রা ওকে একটা গিনিপিগ বানিয়ে দিয়েছে। চুলে লেয়ার কাট দিয়ে ব্রাউন কালার করা হয়েছে। মাঝে জায়গায় জায়গায় হাইলাইট করা। জোড়া ভ্রুকে প্লাগ করে সুন্দর করার প্রয়াস। তবে তাপৌষির কাছে এই নতুনত্ব গুলো বিচ্ছিরি লাগছে। এটা তাপৌষি নয়। তাপৌষির চেহারায় তনিমা বেগমের রূপ ফুটে উঠে। আয়নার প্রতিবিম্বে তাপৌষি তনিমা বেগমকে দেখতে পাচ্ছে না। ওর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। এই সাজ ও চায়না। আগের তাপৌষিকে ফেরত পেতে চায়।
.
শুভ্রা তাপৌষিকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিল। আহ, কলিজায় শান্তি লাগছে! তাপৌষিকে দেখতে আগের চেয়ে সুন্দর লাগছে। তবে তনিমা তনিমা ভাব এই মেয়ের মুখে একদমই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই তাপৌষি শুভ্রার সৃষ্টি। শুভ্রা যা বলবে এখন থেকে তাপৌষিও তাই করবে। ফরিদ কে হাতে রাখার জন্য তাপৌষিকে শুভ্রার নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।
.
নীলাভ্রর বার্থডে পার্টি রাজশাহীর একটি নামীদামী কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত হয়েছে। শুভ্রা নিজের হাই সোসাইটির অনেক মানুষকে দাওয়াত দিয়েছে। অনুষ্ঠানে এসেছে নীলাভ্রর বিশাল ফ্রেন্ড সার্কেল। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় এরা প্রত্যকে নীলাভ্র বলতে ছিল অজ্ঞান। অবশ্য এই ফেম পেতে নীলাভ্রর কম ঘাম ঝরাতে হয়নি। কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়েছে ওর এমন চাটুকার বন্ধু পেতে। এই বন্ধু সার্কেলের সবাই নীলাভ্রর প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনে। এদের মধ্যে আবার কয়েকজন মেয়েও আছে। তাপৌষি প্রথম দেখাই বুঝতে পেরেছে এই গ্রুপের প্রত্যকে খুব অসংগতিপূর্ন জীবন যাপন লীড করে। প্রত্যকের হাতেই উচ্চমাত্রার এলকোহল। অথচ অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয়নি।
-‘ মামা এই কাটপিস টা কে রে?’
নীলাভ্র তাপৌষির দিকে একবার ঘুরে তাকাল। তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাতে থাকা গ্লাসের পানীয়তে চুমুক দিয়ে বলল,
-‘ বুইড়ার আগের বউয়ের মেয়ে।’
-‘ দেখতে তো সেই। পুরাই এমা ওয়াটসন।’
-‘ আছে ঠিকঠাক।’
-‘ কিন্তু মামা তুমি তো পঁচে গেলা।’
-‘ মানে?’
-‘ বুইড়ার তো মেয়ে আছে। সম্পত্তিতে তো ভাগ বইসা গেলো।’
-‘ এহ! বললেই হলো। এগুলা সব আমার নানার। সব কিছুতে একা আমার অধিকার।’
-‘ বুইড়া দিলে। আপতত , বুইড়ার মেয়ে আছে এটা মাথায় রাইখো।’
এবার ওদের মাঝে উগ্র পোশাক পরহিতা একটা মেয়ে নড়েচড়ে বসল। বেবি পিংক কালারের চুল গুলাকে কানের পিছে গুঁজল। গলায় একটা ট্যাটু দৃশ্যমান হলো। জামার গলা খুব বড়। মেয়েটার নাম “রাবেয়া”। তবে রাবেয়া নামটা তার কাছে খুব ক্ষ্যাত লাগে। তাই নিজের নামকে সে শর্টে “রেব” বলে। এই অল্প বয়সেও তার দুটো ডির্ভোস হয়ে গেছে। বর্তমানে একজন পঁয়তাল্লিশ বছরের নামকরা উকিলের সাথে লিভ টুগেদারে আছে। ঢাকায় সেটেল। বাবা দেশের বাইরে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে সুখে আছেন। মা নিজের তৃতীয় বিয়ের কিছুদিন আগে সমাপ্তি টেনেছেন।
রেব একটু ঠেশ মারা গলায় বলল,
-‘ কী রে সায়েম? ডোন্ট কল হিম বুইড়া। লুক হি ইজ কোয়াইট আমেজিং। এই বয়সেও দেখতে কী জোস! পুরাই হলিউড হিরো। যাই বল নীলাভ্র, তোর মায়ের সাথে তোর নতুন বাপকে মানিয়েছে দারুন।’
তবে নীলাভ্র এখন ওর বন্ধু মহলের কারও কথায় কর্ণপাত করছে না। ওর মাথায় এখন একটাই চিন্তা। সায়েমের কথা ওর মস্তিষ্কে প্রবল ভাবে আঘাত হেনেছে। দুই পয়সার মেয়ে তাপৌষি। কোন কারণ ছাড়াই সম্পত্তির ভাগ পেয়ে যাবে? অসম্ভব। কিছু তো করতেই হবে। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে জল ঘোলা হতে সময় লাগবে না।
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here