হয়ত পর্ব ৩১

#হয়ত
পর্ব:- ৩১
.
-‘ দেখেছ তোমার মেয়েকে? কী পড়েছে ও এসব। পনেরো হাজার টাকার ড্রেস কিনে দিয়েছি সকালে। এসব ডাউন মার্কেট হ্যাবিট থাকলে তো চলা খুব মুশকিল।’
ফরিদ সাহেব বিরক্তমাখা চাহনিতে তাপৌষির দিকে ফিরলেন। এই মেয়েটার কারণে আর কত কথা শুনতে হবে তাকে? তবে তাপৌষিকে দেখে ফরিদ সাহেবের ঠোঁট দুটো আপনা আপনি ফাঁক হয়ে গেল। এ কী অবস্থা তাপৌষির? দাঁতে দাঁত চেপে শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘ শুভ্রা এগুলা কী করেছ? মাথার চুলগুলা এমন রঙ করিয়েছ কেন? আমি তোমাকে মানা করেছিলাম না?’
-‘ ওহ ফরিদ, জাস্ট লুক এট হার। কী গ্ল্যামারাস লাগছে দেখ! ওর নতুন আবতারে ওকে হিরোইনের চেয়ে কম লাগছে না। কিন্তু এই শাড়িটা পড়ে নিজের স্টাইলের চব্বিশটা বাজিয়ে দিয়েছে।’
ফরিদ সাহেব এবার তাপৌষির শাড়ির দিকে তাকালেন। এই শাড়িটা তনিমার। প্রথম চাকরিতে জয়েন এর পর প্রথম বেতন পেয়েই শাড়িটা কিনে এনেছিলেন ফরিদ সাহেব। তনিমা কী খুশিটাই না হয়েছিল! বুক চিড়ে দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়ে আসলো।
-‘ এই শাড়িটা তনিমার। প্রথম বেতনের টাকায় কিনে দিয়েছিলাম সেই কবে। অথচ দেখ শাড়িটা এখনো নতুন লাগছে। আসলেই তনিমা যত্ন করে সব কিছু আগলে রাখতে পারত।’
-‘ এহ! স্বামী আগলিয়ে রাখতে পারেনি। ঢং এসব।’
-‘ শুভ্রা..’
-‘ কিডিং ফরিদ। যাও তোমার গেস্ট এসেছে। ওয়েলকাম করো।’
-‘ তুমিও চলো।’
-‘ আসছি। তুমি যাও আগে।’
কথাটা বলে শুভ্রা তাপৌষির দিকে ক্রুর চোখে তাকাল। পারলে এখনই ও তাপৌষির থেকে এই শাড়িটা খুলে আগুনে পুড়িয়ে দিবে।
.
তাপৌষি শুভ্রার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ওর পরিকল্পনা সফল হয়েছে। শুভ্রা তনিমা নামটা মুছতে চেয়েছে আর তাপৌষি এখন তনিমা নামের মানুষকে নিজের মধ্যে ধারণ করছে। খেলা কেবল শুরু। ও এদের কাউকে ” তনিমা বেগম” কে ভুলতে দিবে না। প্রতিটা মুহূর্ত এরা নিজেদের পাপকে স্মরণ করবে।
———-
গত দিনের মতো আজও বর্ষণ দেরি করে বাড়ি ফিরেছে। তবে আজ বাড়ি ফিরেই ডাইনিং এ দিশা, রৌদ আর তনয়া বেগম কে দেখতে পেল। এতো রাতে সবাই জেগে বসে আছে কেন- প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
-‘ কী ব্যাপার? জেগে আছো কেন সবাই?’
তনিমা বেগম ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। আজ মনে হয় সারাদিনে কিছু খায়নি। রৌদ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তনয়া বেগম রৌদকে থামিয়ে দিলেন।
-‘ বর্ষণ হাত মুখ ধুয়ে খেতে এসো।’
-‘ মা আমি খাবো.. ‘
-‘ আমি কিছু বলেছি। যাও। কথা আছে।’
বর্ষণ একবার রৌদ ও দিশার দিকে তাকাল। ওরা দুজন গম্ভীর মুখে বসে আছে। বর্ষণ বুঝতে পারছে কোন বড় কিছু ঘটেছে।
.
ভাতের দ্বিতীয় লোকমা মুখে তোলার সময় বর্ষণ শুনতে পেল,
-‘ অথৈর বাবা এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে। তিনি আপতত তোমাদের বিয়ে পরিয়ে রাখতে চাচ্ছেন।’
-‘ তুমি কী বলেছ?’
-‘ কী আর বলবো। বলেছি দেখি।’
-‘ আমরা কয়েক বছরের সময় চেয়েছিলাম। উনি সময় দিতে রাজিও হয়েছিলেন। এখন কী হলো? স্ট্রেঞ্জ।’
-‘ উনি বলেছেন মেয়ে পরে উঠিয়ে নিলেও হবে। শুধু বিয়েটা এখন করিয়ে রাখতে চাচ্ছেন।’
বর্ষণ কিছু বলছে না। ওর মাথা জ্যাম লেগে আছে। কী থেকে কী হয়ে গেল মাত্র কয়েকটা দিনে।
-‘ মা তুমি যাও। ঘুমিয়ে পড়ো। খাবার গরম করে আমি তুলে রাখব।’
দিশার কথায় তনয়া বেগম মাথা নাড়ান। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে যান নিজ ঘরের দিকে।
.
-‘ বিয়েটা কেন করছ ভাইয়া?’
বর্ষণ রৌদের কথার জবাব দেয়না। ও এখন মাছের কাঁটা বাছতে ব্যস্ত। রাতের বেলা এই মাছ খাওয়া আসলেই বিরক্তিকর।
নাছোড়বান্দা রৌদ আবার প্রশ্ন করে,
-‘ আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে। শুনতে পাওনি?’
-‘ শুনতে পাবো না কেন? আজীবন কী কুমার হয়ে থাকবো। বিয়ে করতে হবে না?’
দিশা দুই ভাইয়ের কথোপকথন শুনে এবার নিজে মুখ খুলল,
-‘ তিনটে মানুষের জীবন নষ্ট হবে ভাইয়া।’
-‘ হবে না।’
-‘ কেন অবুঝ হচ্ছো?
-‘ অবুঝের কী হলো?’
রৌদের রাগ উঠছে বর্ষণের এমন কেয়ারলেস ব্যবহারে। এমন ভাবে বর্ষন কথা বলছে যেন ওর মাঝে কোন অনুভূতি অবশিষ্ট নেই।
স্বাভাবিকের থেকে আওয়াজ একটু উপরে তুলেই ও বর্ষণকে বলল,
-‘ তুমি জানো অথৈ তাপৌষিকে খুব বিচ্ছিরি ভাবে অপমান করেছে? নিজের প্রতিপত্তি জাহির করেছে। তাপৌষিকে বাধ্য করেছে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে। ‘
বর্ষণ অবাক চোখে রৌদকে দেখছে। কই এসব কথা তো তাপৌষি চিঠিতে লিখেনি! হাফ গ্লাস পানি খেয়ে ও আবার ভাত খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
.
আজ রৌদ আর দিশার মনে হচ্ছে ওর ভাইয়াটা কোন চাবি দেওয়া পুতুল। এই যে কথা বলছে মেপে মেপে, মুখ থেকে হাসি উধাও, খাচ্ছে নিজের মতো। অথচ এর আগে প্রতিবার বর্ষণ নিজে খাওয়ার সময় রৌদ ও দিশার মুখে খাবার তুলে দিয়েছে।
.
বর্ষন বেসিনে হাত ধুয়ে নিজের ঘরের গেল। মানিব্যাগ থেকে তাপৌষির চিঠিটা বের করে হাতে নিল। বিছানায় শুয়ে দুই হাত দিয়ে চিঠিটা বুকের উপর চেপে ধরলো। তারপর সিলিং এর দিকে চেয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলল।
‘ এতো ভালো না হলেও পারতে তাপৌষি।’
——–
তাপৌষি সবে চোখটা বন্ধ করেছে। বড্ড ঘুম পেয়েছে ওর। তবে শুভ্রার চিৎকারে ওর ঘুম ছুটে গেছে। বাধ্য হয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
শুভ্রা নিজের স্লিভলেস নাইটি পড়ে সোফার উপর বসে আছে। দুই হাত দিয়ে মাথা ধরে রেখেছে। আর একটু পরপর চেঁচাচ্ছে,
“ওহ মাগো! মাথাটা ব্যথায় ফেটে গেলো।”
তাপৌষির কেন যেন মনে হচ্ছে এখানে সার্কাস হচ্ছে। ওর খারাপ লাগছে না শুভ্রার কষ্টে। তবে এটা তো অন্যায়। ওর মা তো শিখিয়েছে অপরের কষ্ট সব সময় অনুভব করতে হয়।
.
নীলাভ্র এসে শুভ্রাকে মাথার ব্যথার ঔষধ খেতে দিয়েছে।
শুভ্রা সেটা খেয়ে একটু শান্ত হয়েছে।
তবে আহ! আহ! বলে গোঙাচ্ছে।
-‘ চোখটা একটু বন্ধ করে সোফায় হেলান দাও শুভ্রা। ঘরে যাবে? ঘুম আসছে?’
-‘ ভালো কথা মনে করিয়েছ। তোমার ঘুমের ঔষধটা একটু এনে দাও। ঘুম আসছে না, ফরিদ।’
-‘ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ খাবে?’
-‘ আহ! কথা বলো না। প্লিজ এনে দাও।’
-‘ তুমি ঘরে যেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকো দেখবে ঘুম চলে আসছে।’
-‘ নীলাভ্র যাও তো ড্যাডের স্ট্যাডি টেবিলের ড্রয়ার থেকে ঔষধের বক্সটা নিয়ে আসো।’
-‘ শুভ্রা..’
-‘ আহ! কথা বলতে মানা করেছি।’
.
নীলাভ্র বক্স এনে ফরিদ সাহেবের হাতে দিল। ফরিদ সাহেব উফ! উচ্চারণ করলেন। তার ভালো লাগছে না এসব। সারাদিন অনেক পেরেশানি গেছে মাথার উপর দিয়ে।
-‘ শুভ্রা তুমি চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে থাকো। আমি ঔষধ খাইয়ে দিচ্ছি।’
-‘ ওহ সো সুইট অফ ইউ।’
তাপৌষি স্পষ্ট দেখলো ফরিদ সাহেব বক্স থেকে একটা লোসেকটিল এর ট্যাবলেট ছিড়ে শুভ্রাকে খাইয়ে দিলেন। এটা তো ঘুমের ঔষধ না।
নীলাভ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল তবে ফরিদ সাহেব ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে ইশারায় চুপ করতে বললেন।
-‘ যাও শুভ্রা, এবার ঘরে যেয়ে ঘুম দাও। আমি আসছি। আর নীলাভ্র, তাপৌষি তোমারাও নিজ নিজ ঘরে যাও।
—–
আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে তাপৌষি। ও শুধু রুটি, পরোটা, ডিম ভাজি, ভাত রান্না করতে পারে। তবে ওর রুটি সব সময় গোল হয়। কখনো ট্যারাবাকা রুটি ও বানায় নি।
তাপৌষি সব ভেবেই পরোটা, ডিম ভাজি করেছে।
-‘ তাপৌষি সকাল সকাল শাড়ি পড়েছ যে?’
-‘ বাবা খুব সুন্দর লাগছে না? মায়ের শাড়ি। তোমার মনে আছে গত বছর ঈদুল ফিতরে তুমি মা’কে এটা কিনে দিয়েছিলে?’
-‘ হ্যাঁ। বাহ! আজ কি তুমি রান্না করেছ?’
-‘ সব না। শুধু পরোটা আর ডিম ভেজেছি। বাকি সব বুয়া করেছেন। মা খুব মজা করে পরোটা বানাত তাইনা?’
শুভ্রার মনে হচ্ছে তাপৌষি ইচ্ছা করে তনিমার কথা ফরিদকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রার সামনে নিজেকে তনিমা হিসেবে প্রেজেন্ট করছে। পারলে এখনই ও তাপোষিকে খুন করে ফেলত।
তবে মুখে হালকা হাসির ভাব এনে মনে মনে নিজেকে বলল, “ভুল মানুষের সাথে পাংগা নিলে তাপৌষি। পস্তাতে হবে।”
-‘ আপনাকে কি পরোটা দিব?’
-‘ না এসব ওয়েলি খাবার আমি খাবো না। আর নীলাভ্রর সামনেও প্লিজ এসব দিও না।’
তাপৌষি নির্বিকার ভাবে বলল,
-‘ আচ্ছা।’
.
-‘ মম এখন কেমন লাগছে তোমার? বেটার ফিল করছো?’
-‘ হ্যাঁ। দেখলি বলেছিলাম না ঘুমের ঔষধ খেতে হবে? রাতে ভালো ঘুম হয়েছে। ভাগ্যিস জোর করে ঔষধটা খেয়েছিলাম।’
শুভ্রার কথা শুনে তাপোষি ফিক করে হেসে দেয়। ফরিদ সাহেব, নীলাভ্রও মিটমিটি হাসছে।
-‘ হোয়াই আর ইউ লাফিং?’
-‘ এমনি।’
-‘ জুস খাবেন?’
-‘ না। ‘
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here