চৈত্রের বিকেল পর্ব -০১

শুভ্র ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে সুন্দরী এক মেয়ের সাথে। বিষন্ন মন নিয়ে নদীর ধারে বসে রয়েছে রুহানিয়া। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ-মুখ ফুলে গেছে। সবাই বলাবলি করছে মেয়ে যেনতেন সুন্দরী নয়। অপরূপ সুন্দরী যাকে বলে; ঠিক সেই ধাঁচের সুন্দরী। রুহানিয়া শুভ্রকে প্রচণ্ড রকম পছন্দ করে। শুধু পছন্দ করে বললে ভুল হবে। অসম্ভব ভালোবাসে সে শুভ্রকে। বাড়ির বাদ-বাকি সবাই ভীষণ খুশি এই বিয়েতে। একমাত্র রুহানিয়া ছাড়া। তার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।

রুহানিয়াকে খুঁজতে খুঁজতে নদীর পাড়ে চলে এসেছে চৈত্রী। সে পেছনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘তুমি এখানে বসে আছো আপাই? ওদিকে বাড়ির সবাই হন্যে হয়ে তোমায় খুঁজছে।’

মেজাজ বিগড়ে যায় রুহানিয়ার। সে ঝাঁঝাল স্বরে চৈত্রীকে ধমক দিয়ে বলে,’কেন? আমায় কী দরকার? বিয়ে তো আর আমার সাথে হচ্ছে না। আমি থাকলেই কী আর না থাকলেই কী?’

ধমক খেয়ে চৈত্রী প্রথমে একটু ভড়কালেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়। রুহানিয়া তার মেজ কাকার মেয়ে। অসম্ভব গুণের অধিকারী, সেই সঙ্গে খুব ভালো ছাত্রী সে। একদম ব্রাইট স্টুডেন্ট। সবার সঙ্গে কোমল কণ্ঠে কথা বলে। এমনকি চৈত্রীকে সে বাকি কাজিনদের থেকে বেশি ভালোবাসে। আদর করে। চৈত্রীরা যখনই শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে আসে তখন তাকে রুহানিয়ার সাথে রাতে থাকতে হয়। এতে চৈত্রীরও ভীষণ ভালো লাগে। মজার মজার গল্প শোনায়। সেই রুহানিয়া আপা যে তার সঙ্গেই এত খারাপ ব্যবহার করছে এটা সত্যিই বিস্ময়কর! এর মানে গণ্ডগোল কিছু একটা আছে। সে ভয়ে ভয়ে রুহানিয়ার পাশে বসল।

ফুলে-ফেঁপে ওঠা মুখটার দিকে তাকিয়ে ত্রস্তকণ্ঠে জানতে চায়,’তুমি কাঁদছ?’

‘হ্যাঁ, কাঁদছি। তাতে তোর কী? বাড়ি যা।’

চৈত্রী গেল না। সে বসেই রইল। খুব সাহস সঞ্চয় করে রুহানিয়ার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘আমায় বলো না আপাই, কী হয়েছে?’

চৈত্রীকে একটা কড়া করে ধমক দিতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল রুহানিয়া। তার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে চৈত্রীর সামনে নিজেকে আর দুর্বল প্রমাণ করতে চাচ্ছিল না। দু’হাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘তুই ছোটো মানুষ। বুঝবি না এতকিছু। চল বাড়িতে চল। আর শোন, খবরদার বাড়ির কাউকে কিছু বলবি না।’

চৈত্রী বলতে চাইল,’তুমি ভুল বলছ আপাই। আমি মোটেও ছোটো নই। সামনের মাস থেকে আমিও কলেজে যাব। কলেজে পড়া একটা মেয়ে কি পিচ্চি বাচ্চা হয় কখনো?’

তবে কথাগুলো আর বলা হয়ে উঠল না। পথিমধ্যে একটা চমৎকার বিষয় আবিষ্কার করল চৈত্রী। একটু আগে কান্নাকাটি করা রুহানিয়া এখন খিলখিল করে হাসছে। না, হাসির কোনো কারণ নেই। পথে ওদের মধ্যে আর কোনো কথাই হয়নি। বাড়ির সামনে এসে অযথাই রুহানিয়া এমন শব্দ করে হাসছে। এর আসলে কারণটা কী? চৈত্রীর বোধগম্য হলো না। যদিচ সে ঘটনার মাথামুণ্ড কোনো কিছুই স্পষ্ট অবলোকন করতে পারেনি; তথাপি রুহানিয়াকে হাসতে দেখে তার ভীষণ ভালো লাগছে।

বাড়িতে ফিরে দেখল হৈচৈ কাণ্ড। মা, কাকিরা, মামিরা সবাই রান্নাবান্না নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। দুপুরের মধ্যেই শুভ্রর শহুরে বন্ধুরা সবাই দলবেঁধে গ্রামে আসবে। ওদের খাওয়ার বন্দোবস্ত-ই করছিল সবাই। এছাড়া গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানও আজ হবে। তাদের তো ব্যস্ততার শেষ নেই।

ছোটো মামি রুহানিয়া আর চৈত্রীকে একসাথে দেখে বললেন,’এইযে মহারানি দুজন! কোথায় ঘুরাঘুরি হচ্ছে শুনি? শুভ্রর বন্ধুরা এই এলো বলে। যা গিয়ে ওদের জন্য ঘরদোরগুলো একটু পরিপাটি কর। পরিষ্কার কর। ভাইয়ের বিয়েতে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে হবে?’

কথাগুলো এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলেননি মামি। শেষের কথাগুলো ভাঁড়ার ঘরে যেতে যেতে বলেছেন। রুহানিয়া ‘চল’ বলে মেহমানদের জন্য বরাদ্দকৃত রুম গোছানোর জন্য চলে গেল। চৈত্রী ভ্রু কুঁচকে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র ভাইয়ের বন্ধুরা আসবে এজন্য সে কেন রুম গোছাতে যাবে? তার এত ঠেকা কীসের? ওদের কি হাত-পা নেই নাকি! একদল বাচ্চাকাচ্চা দৌঁড়ে উঠানে এসে জড়ো হলো। ওরা দৌঁড়াদৌঁড়ি করে খেলছে। চৈত্রীর ভালো লাগল না। তার যদি কাজ করতে হয়, তাহলে এই পিচ্চিগুলোরও করতে হবে। সে এক হাত কোমরে রেখে একটু ভাব নিয়ে দাঁড়াল। অন্য হাত উঁচু করে বাচ্চাদের ইশারা করল। ভাবখানা এমন যেন, এখনই জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুর গুণধর নাতনি চৈত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবে।

দুঃখের বিষয় হলো বাচ্চারা ওর ইশারা খেয়াল-ই করল না। সে এবার গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকল,

‘এই আণ্ডা-বাচ্চার দল! এদিকে আয়।’

ওরা একে-অপরের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলো। সাদা শার্ট আর হাফ প্যান্ট পড়ুয়া ছোটো মামার ছেলে দু’হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে বলল,

‘কী হয়েছে সুইটহার্ট? ডাকো কেন?’

চৈত্রী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। ছয় বছর বয়সী ওর মামাতো ভাই সমুদ্র। ভাবসাব দেখলে মনে হবে বাংলাদেশের সুপারস্টার শাকিব খান। সে একটা রামধমক দিয়ে বলল,

‘মারব টেনে এক চড় বেয়া’দব! ইঁচড়েপাকা হয়ে গেছিস না? মামাকে দেবো বিচার?’

সমুদ্র মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,’পাপা জানে আমি তোমায় পছন্দ করি।’

পাশ থেকে ফুপির মেয়ে টুম্পা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’সেকি রে! তুই না বলেছিলি তোর স্কুলের ক্লাসমেট মিতাকে পছন্দ করিস?’

সমুদ্র বলল,’হ্যাঁ, করি তো। স্কুলের ইংলিশ মিসকেও আমি পছন্দ করি। কিন্তু সবাইকে তো আর বিয়ে করব না। পাপাকে বলেছি, বড়ো হয়ে আমি সুইটহার্টকে বিয়ে করব।’

সমুদ্রের কথা শুনে চৈত্রীর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। সমুদ্রের নামটা কে রেখেছে ঠিক মনে পড়ছে না। তবে যে রেখেছে একদম ঠিক নাম রেখেছে। সমুদ্রের বৈশিষ্ট্যের সাথে নামকরণ একদম পার্ফেক্ট। সমুদ্রের মতোই ওর মনটাও বিশাল।

সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’চল নেংটি ইঁদুর, আমাকে কাজে সাহায্য করবি।’

‘সে আমি সাহায্য করতেই পারি। তবে তুমি আমায় নেংটি ইঁদুর কেন ডাকছ? আমি কি নেংটু? এই দেখো আমার প্যান্ট আছে।’

‘আর দেখা লাগবে না। চল এখন। এই আণ্ডাবাচ্চা তোরাও আয়।’

একদল বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চৈত্রী ভেতরে যায়। ওদেরকে দেখে রুহানিয়া বলে,’ওদেরকে আবার এনেছিস কেন?’

‘আমরা কাজ করব আর ওরা কি বসে বসে হাওয়া খাবে? ওদের দিয়েও কাজ করাব।’

রুহানিয়া বোধ হয় মৃদু হাসল। বলল,’এইটুকু বাচ্চারা আবার কী কাজ করবে?’

‘ওদেরকে তুমি এইটুকু বলছ? একেকটা ভাজা ভুট্টা!’

সমুদ্র কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,’সুইটহার্ট ভাজা ভুট্টা না, খই হবে। অথবা পপকর্ন বলতে পারো। কারণ ভাজলে সেটা তো আর ভুট্টা থাকে না। খই হয়ে যায়।’

চৈত্রী ওর চুল টেনে ধরে বলে,’খুব কথা শিখে গেছিস? যা রুম ঝাড়ু দে। সবগুলো রুম তুই ঝাড়ু দিবি।’

এরপর বাকিদের বলল,’বালিশগুলো গুছা যা। তোদের আম্মুরা কীভাবে গুছিয়ে রাখে দেখেছিস না? ঠিক ঐভাবে গুছাবি।’

বাচ্চারা সব কাজে লেগে পড়েছে। সে একটা চেয়ারে বসে কাজের তদারকি করছে। না চাইতেও রুহানিয়া ওদের কাণ্ড দেখে হেসে ওঠে।

সবার আগে রুম গোছানো হয় লাবনীর। সে দৌঁড়ে আসে চৈত্রীর কাছে। ‘কিরে? কাজ শেষ?’ জানতে চাইল চৈত্রী।

লাবনী মাথা নাড়িয়ে বলল,’হুম আপু শেষ। আমি এখন চলে যাই?’

‘দাঁড়া। খালামনির কাছে শুনলাম তুই নাকি খুব হাসতে পারিস? আচ্ছা এখন একটু হাস তো।’

লাবনী ঘাড় ঘুরিয়ে রুহানিয়ার দিকে তাকাল। রুহানিয়া চোখ পাকিয়ে বলল,’উঁহু! খবরদার, এখানে কোনো হাসাহাসি চলবে না।’

তার বারণ টিকল না। তার আগেই লাবনী ঘর কাঁপিয়ে হাসা শুরু করেছে। এমনভাবে শব্দ করে হাসছে যে ওর অবস্থা দেখে বাকিদেরও হেসে কুটিকুটি হওয়ার মতো অবস্থা। এমনকি চৈত্রী নিজেও হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়েছে। কেবলমাত্র রুহানিয়া-ই নির্বিকাড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। বাচ্চারা সব হাসতে হাসতে বাইরে চলে গেছে। চৈত্রী পেট ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’লাবনী তো আসলেই খুব হাসতে পারে আপাই!’

রুহানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল,’হ্যাঁ, খুব হাসতে পারে। হাসতে হাসতে বিছানা আরও বেশি এলোমেলো করে গেছে সবাই মিলে।’

হাসি মিলিয়ে গেল চৈত্রীর। সত্যি সত্যিই তো বিছানার দফারফা অবস্থা। ছোটো চাচি রুহানিয়ার নাম ধরে ডাকছে। সে বের হওয়ার আগে বলে গেল,

‘এখন সব গুছা তুই একা একা।’

চৈত্রীর ঠোঁট উলটে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। আণ্ডাবাচ্চাদের একবার শুধু হাতের কাছে পাই, দেখাব মজা! বিড়বিড় করতে করতে একা একাই ঘর গুছাতে লাগল সে।
ঘর গুছানো যখন প্রায় শেষের দিকে সেই সময়ে সমুদ্র দরজার সামনে এসে বলল,

‘হেই সুইটহার্ট! শুভ্র ভাইয়ার বন্ধুরা সবাই এসে পড়েছে। সবাই হেভি হ্যান্ডসাম জানো? তুমি কিন্তু ওদের সামনে যেও না। ভুলে যেও না, পাপা কিন্তু বলেছে তুমি আমার বউ হবে।’

চৈত্রী বালিশ হাতে তেড়ে যায় সমুদ্রকে মারতে। দরজার বাইরে যাওয়ার আগেই হৃষ্টপুষ্ট পেশিবহুল এক শরীরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়তে গিয়েও সে দরজা আঁকড়ে ধরে। তবুও সে টাল সামলাতে পারছিল না। তখন ছেলেটি বালিশসহ তার হাত টেনে ধরে। এ যাত্রায় বড়ো বাঁচা বেঁচে যায় চৈত্রী।

‘পিচ্চি বাচ্চা মানুষ! একটু দেখেশুনে চলবে তো!’

চৈত্রী চলেই যাচ্ছিল ছেলেটির কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

‘আপনি নিজে দেখেশুনে চলতে পারেন না?’

ছেলেটি হা করে তাকিয়ে আছে। বলা বাহুল্য চৈত্রীর ভিত্তিহীন রাগে সে বেশ হকচকিয়ে গেছে। শুভ্র সে সময়ে পেছন থেকে এসে ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘কিরে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর নাকি জরুরী চাপ এসেছে?’

ছেলেটি এবার শুভ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলে,’আস্তে!’

শুভ্র ভেতরে উঁকি দিতে দিতে বলে,’কেন কী হয়েছে? ও তুই চৈত্রীকে লজ্জা পাচ্ছিস? ধুর! ও ছোটো মানুষ। ওর সামনে লজ্জা কীসের?’

বাকি বন্ধুদের একজনের ডাক পড়ায় শুভ্র চৈত্রীকে বলল,’ও-কে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দে।’

চৈত্রী ছেলেটির হাত থেকে বালিশটা ঝড়ের গতিতে কেড়ে নিয়ে বলল,’বাম পাশের রুমে গিয়ে ডানে যাবেন। তাহলেই ওয়াশরুম পেয়ে যাবেন।’

এরপর সে বালিশটা যথাস্থানে রেখে বাইরে বেরিয়ে যায়।
_______
বিকেলে হলুদের বন্দোবস্ত করে সব বন্ধুরা মিলে একত্রে উঠানে চেয়ারে বসে আছে। সবাই শুভ্রকে নিয়ে হাসি-তামাশা করছে। বন্ধুদের মধ্যে শুভ্র-ই প্রথম বিয়ে করছে। বাকিরা এখনো কেউ বিয়ে করেনি।

ছোটো মামি পিঠার প্লেট চৈত্রীর হাতে দিয়ে বলল,’এগুলো ওদেরকে দিয়ে আয়।’

চৈত্রী গম্ভীর হয়ে বলল,’দুঃখিত মামি। পারব না।’

তিনি অবাক হয়ে বললেন,’কেন?’

উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি রুহানিয়াকে বললেন প্লেট নিয়ে যেতে। যেহেতু বাড়ির কেউ জানে না তার মনের ভেতর কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাই সে নিজেকে যতটা পারছে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। সে চৈত্রীর মতো করে চট করেই মামির মুখের ওপর না করতে পারল না। ভারী দীর্ঘশ্বাস গোপন করে দু’হাতে দুটো পিঠার প্লেট নিয়ে এগিয়ে গেল। শুভ্র ও-কে দেখে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,

‘ও আমার মেজ কাকার মেয়ে। রুহানিয়া। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সাইকোলজি নিয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে।

আর রুহানিয়া, ও হচ্ছে কাব্য, ও তিতাস, ও দেব, রামিম, জিহাদ আর শিহাব।’ এভাবে একে একে নাম বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল।

রুহানিয়া ভদ্রতাসূচক হেসে সালাম দিয়ে সেই স্থান প্রস্থান করেছে। দূর থেকে ওদের পরিচয়পর্ব দেখছিল ও শুনছিল চৈত্রী। সে বিড়বিড় করে বলল,

‘ওহ আচ্ছা এই খাম্বাটার নাম তাহলে কাব্য।’

পিঠা খেতে খেতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দিশা। রুহানিয়া আপুর ছোটো বোন। এবার কলেজে পড়ে। চৈত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,’খাম্বা কে রে?’

চৈত্রী ভ্রুঁ কুচকে দুপুরের ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বলল। দিশা হাসতে হাসতে বলল,’সুন্দর নাম দিয়েছিস তো!’

‘হু! দেখিস না খাম্বার মতোই শরীর।’

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো সন্ধ্যার দিকে। রুহানিয়া বাদে সবাই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। অজুহাত হিসেবে রুহানিয়া বলেছে, তার হঠাৎ করেই ভীষণ মাথা ধরেছে। এই অবস্থায় সে গায়ে হলুদে থাকতে পারবে না। তাই কেউ আর তাকে জোড়াজুড়িও করেনি।

হলুদ ছোঁয়ানো শেষে শুভ্রর বন্ধুরা গান গাইবে বলল জানালো। বড়ো মামি তখন ফট করে বলে ফেললেন,’আমার ছেলে শিমুল কিন্তু খুব ভালো গান করে।’

চৈত্রীর ইচ্ছে করছিল বড়ো মামিকে টেনে নিয়ে এসে মুখে স্কচটেপ লাগাতে। কেননা সে বোকাসোকা ধরণের মানুষ। কী বলতে যে কী বলে ফেলে নিজেও বুঝতে উঠতে পারে না। এইযে এখনই সে উলটা-পালটা একটা কথা বলে ফেলবে চৈত্রী শিওর। হলোও তাই। তিনি শিমুলকে ডেকে বললেন,

‘বাবা সবাইকে একটা গান শোনাও তো।’

সবাই একসাথে হৈহৈ করে উঠল,’হ্যাঁ, জুনিয়র শিল্পী দিয়েই তাহলে গান শুরু হোক।’ বলল কাব্য।

শিমুলটা হয়েছে আরো বোকা। বোকা মানব একটা! কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার ব্যাপক শেয়ানাগিরি। সে তার মায়ের দিকে বোকা চাহনী দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কোন গানটা গাইব মা?’

‘একটা দেশাত্মবোধক গান গা।’

হায়রে কপাল! গায়ে হলুদে নাকি দেশের গান। শুভ্র ভাই বিয়ে করবে নাকি নতুন করে দেশ স্বাধীন করবে ভেবে পাচ্ছে না চৈত্রী। কাব্য আরও উৎসাহ দিয়ে বলল,

‘ঠিক, ঠিক। দেশের মানুষ, দেশের গান দিয়েই সবকিছু শুরু করা উচিত।’

শিমুল উৎসাহিত হয়ে গান শুরু করল,

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত
বঙ্গবন্ধু বেঁচে নাই…’

চৈত্রী সঙ্গে সঙ্গে শিমুলের মুখের হাত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’গাধা! তোর গান শুনলে বঙ্গবন্ধুর পূণরায় ম’র’তে ইচ্ছে করত! বেঁচে নাই না, ওটা ম’রে নাই হবে।’

উপস্থিত সবাই একত্রে হাসছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মামি নিজেও ওদের হাসিতে যোগ দিয়েছে। নাহ্! চৈত্রীর আর কিছু বলার নেই। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চুপ করে রইল। শুভ্র ভাইয়ের বন্ধুদের গানের গলা বেশ ভালো। সবাই মিলে একত্রে যখন গান গাইছিল, শুনতে বেশ ভালো লাগছিল। তবে গান বেশিদূর এগোলো না। এর আগেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। কী আশ্চর্য! আকাশে তো মেঘ-ই ছিল না এতক্ষণ। হঠাৎ করে এমন বৃষ্টি হচ্ছে কেন? সবাই দৌঁড়াদৌঁড়ি করে ভেতরে যাচ্ছিল। ঐ সময়ে ঘটে আরেক বিপদ। উঠানে স্লিপ খেয়ে পড়ে যায় চৈত্রী। সবাই যে যার মতো চলে যাচ্ছে। কেউ চৈত্রীকে খেয়াল করছে না। বুক ফেটে কান্না আসছে চৈত্রীর। পায়ে বেশ ব্যথাও পেয়েছে। কাদাতে হলুদ শাড়ির একদম যা তা অবস্থা হয়েছে। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে দেখল বৃষ্টিভেজা একজন যুবক তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কপালের ওপর পড়ে থাকা চুল বেয়ে চুপচুপ করে পানি পড়ছে। মৃদুমন্দ আলোতে চৈত্রী দেখতে পেল ছেলেটি কাব্য।

কাব্য চৈত্রীর দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’আরে মিস বাচ্চাপার্টি! পড়ে গেছ? ওঠো ওঠো।’

চৈত্রী কাব্যর হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। ‘হেঁটে যেতে পারবে?’ জানতে চাইল কাব্য।

চৈত্রী অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। অবস্থা বেগতিক। হাঁটতে কষ্ট হবে। শুভ্র তখন দৌঁড়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,

‘এখনো ভিজছিস কেন তোরা? ভেতরে চল।’

চৈত্রী কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,’পায়ে ব্যথা ভাইয়া। কোলে নাও।’

শুভ্র-ই চৈত্রীকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে এমনভাবে কাব্যর দিকে তাকায়, যেন চোখের দৃষ্টি দিয়েই ভষ্ম করে ফেলবে। কাব্য ভ্রুঁ কুচকে তাকায়। এই মেয়েটা এমন কেন?
.
পরেরদিন সকালে মন খারাপ করে উঠানে চেয়ার নিয়ে বসে ছিল চৈত্রী। তার পায়ের ব্যথা ভালো হয়নি। সবার মতো হৈ-হুল্লোড় করে শুভ্র ভাইয়ের বিয়ে উপভোগ করা হবে না তার। তাকেও হয়তো রুহানিয়ার মতো ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। বিরহে সে বসে বসে বিরিয়ানি খাচ্ছিল। এরমধ্যে যতবার সে কাব্যকে দেখেছে ততবার খেয়াল করেছে, কাব্য তাকে দেখলেই কেমন মিটিমিটি হাসছে। বিষয়টা প্রথমদিকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে আর পারল না। সে গম্ভীর দৃষ্টিতে কাব্যর দিকে তাকিয়ে থাকে। কাব্য তখন ব্যস্ত ছিল। ব্যস্ত তো সবাই-ই। কারও নজর অন্যদিকে না থাকলেও চৈত্রীর চাহনী কাব্যর দৃষ্টি এড়ায় না। সে মিটিমিটি হাসতে হাসতে এগিয়ে যায়।

একটা চেয়ার টেনে চৈত্রীর মুখোমুখি বসে বলে,’কী ব্যাপার মিস বাচ্চাপার্টি? ওমন করে তাকিয়ে আছো কেন? রাতের খাবারটা কেমন ছিল হু?’

‘কোন খাবার?’

‘ঐযে স্লিপ! হা হা হা।’

কী ধুরুন্ধর লোক! পড়ে গেছে বলে সেটা নিয়ে এখন মজা উড়াচ্ছে। চৈত্রী অবশ্য একটুও রাগল না। ইনোসেন্টের মতো করে বলল,’মন খারাপ লাগছে।’

‘সে কি! কেন?’

‘আমার বোধ হয় বরযাত্রীর সাথে যাওয়া হবে না।’ পা দেখিয়ে বলল চৈত্রী। একটু থেমে আবার বলল,

‘একটা কাজ করে দেবেন?’

‘কী?’

‘ঐযে মুরগির ছোটো বাচ্চাটা দেখতে পাচ্ছেন? একা একদিকে দাঁড়িয়ে আছে। ও-কে আমার কাছে এনে দিন। আমি তো হাঁটতে পারছি না। না হলে আমিই নিয়ে আসতাম।’

‘আমি এনে দিচ্ছি সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি মুরগির বাচ্চা দিয়ে কী করবে?’

‘হাতের তালুতে দাঁড় করিয়ে দেখব। ছোটোবেলায় মন খারাপ হলে মা খাঁচা থেকে মুরগির বাচ্চা বের করে হাতের তালুতে দিত।’

কাব্য হেসে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’

কাব্য মুরগির বাচ্চা আনতে যাচ্ছে আর চৈত্রী অপেক্ষা করছে সার্কাস দেখার জন্য। যেই না কাব্য মুরগির বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে আসছিল, ওমনি মা মুরগি দৌঁড়ে উড়ে এসে কাব্যর মাথায় উঠে গেল। ইচ্ছেমতো মাথায় ঠোকর দিচ্ছে। কাব্য কোনোমতেই মুরগিকে সরাতে পারছিল না। এদিকে ব্যথায় তার জীবন যায় যায় অবস্থা! চৈত্রী খিলখিল করে হাসছে। কাব্যর চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে আসে। চৈত্রীর মা বললেন,

‘একি! কী হচ্ছে!’

কাব্য মুরগিকে সরাতে না পেরে বাধ্য হয়ে বাচ্চাটিকে নিচে রেখে সামনে থাকা পুকুরে ঝাপ দেয়। চৈত্রী হাসতে হাসতে তার মাকে বলে,

‘মুরগি আদর হচ্ছে মা। মেয়ে বিয়ে দিলে তার বরকে যেমন জামাই আদর করা হয়। শুভ্র ভাইয়ার বন্ধুকে করা হচ্ছে মুরগি আদর।’

চলবে…

#চৈত্রের_বিকেল
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here