প্রেমময় বিষ পর্ব ৩+৪

#প্রেমময়_বিষ
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_৩

____

বিকেলের আকাশ দেখতে দেখতে,, হাতে কফি নিয়ে জমজমাট আড্ডায় মেতে আছি আমরা সবাই।

“তখন টিয়ার রুম থেকে ফিরে এসে দিয়েছিলাম এক ঘুম।অতঃপর এক ঘুমে একদম বিকেল বেলা উঠে ফ্রেশ হয়ে সোজা কিয়ারা আপুর রুমে চলে গেছিলাম।এরপর সবাইকে ডেকে একসাথে ছাদে চলে এলাম আড্ডা দিতে।কিছুক্ষন আগে যুথি সবার জন্য কফি নিয়ে এসে সেও আমাদের সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ল”

হঠাৎ করে কিয়ারা আপু আমাকে আর টায়রাকে বলতে লাগলো,

— আচ্ছা শোন তখন যে একটা ছেলেকে দেখলাম ওটা কে ছিল রে?

আমি বুঝতে পারি আপু কার কথা বলছে।তাও একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বলতে লাগলাম,

— কোন ছেলে আপু?

— ওই তো সেই লম্বা, হ্যান্ডসাম ছেলেটা যে দৌড়ে এসে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলো।

আমি বললাম,

— ওটা তো রায়ায ভাইয়া, টায়রার বড় ভাই।

আমার কথা শুনে আপু আহ্লাদে আটখানা হলে বলতে লাগলেন,

— রায়ায ভাইয়া খুব হ্যান্ডসামরে বেলা।কি সুন্দর বডি বানিয়েছে।তার ওপর কি লম্বা।একদম আমার মনের মত।

কিয়ারা আপুর কথাগুলো শুনে গা টা একদম জ্বলে উঠলো।নিজের রাগকে দমন করে বলতে লাগলাম,

— কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি ভাইয়াকে এর আগে দেখো নি না চিনো না?

আপু বলতে লাগলেন,

— চিনি না তা নয়,,আমিতো ভাইয়াকে দেখেছি সেই কবে এরপর তো আর আসা হয়নি।তাছাড়া ভাইয়ার মাঝে ও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।কি সুন্দর পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়ায় তার ওপর শরীর স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে।দেখিস না কেমন সিক্স প্যাক বানিয়েছে।তাছাড়া মুখে এমন চাপদাড়ি রাখায় ভালো করে চিনতে পারিনি।

আপুর মুখে ওনার এমন প্রশংসা মূলক বর্ণনা শুনে আমার আর সহ্য হলো না।তাই রেগে ওখান থেকে উঠে সোজা নিজের রুমে চলে এলাম।

বেলার এমন কিছু না বলে হঠাৎ উঠে যাওয়ায় সবাই একটু অবাক হয়। আর টায়রা সাথে সাথে বেলার পিছে দৌড় লাগায়। রুমেএসে ফুঁসতে লাগলাম আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,

— ভাইয়া শুধু আমার, ওনার দিকে করো নজর আমার সহ্য হবে না।যেই করেই হোক ওনাকে নিজের করেই ছাড়ব আমি।

তখনই টায়রা এসে আমাকে ডাকতে লাগলো।আর বলতে লাগল,

— কি হয়েছে তোর? হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে উঠে এলি যে? কিছু হয়েছে?

— কিছু হয় নি, তুই যা এখন আমার কিছু ভালো লাগছে না -অগ্যতা টায়রা চলে গেল।

কিছুক্ষন পরেই ডাক পড়ল নিচে যাওয়ার জন্য।তাই নিজেকে শান্ত করে নিচে গেলাম,, গিয়ে দেখি ড্রইংরুমে হরেক রকমের নাস্তা সাজানো।আর এক এক করে সবাই এসে ড্রইংরুমে বসে যাচ্ছে।তাই আমি আর দেরি না করে বসে পড়লাম টায়রার পাশে।কিছুক্ষন পর রায়ায ভাইয়া আর আদিব ভাইয়া ও এসে হাজির হলো।আর আদিব ভাইয়া এসে সোজা আমার পাশে বসে পড়লেন।এতে আমি অনেকটা চমকে ওনার দিকে তাকালাম তাকিয়ে দেখি উনি নিজের মতো করে খাচ্ছে। অতঃপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখি জায়গা না থাকায় উনি এখানে বসেছেন।

হঠাৎ করে রায়ায ভাইয়ার দিকে চোখ গেল,,, দেখতে পেলাম ভাইয়া কেমন লাল লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ভাইয়ার এমন চাহনি দেখে ভাবতে লাগলাম,,,আমি আবার কি করলাম?

কিন্তু আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে ভাইয়া নিজের রুমে চলে গেল। ভাইয়ার কান্ড দেখে আমরা সবাই হতবাক।তাই বড়মা ভাইয়ার পিছুপিছু গেলেন।

রাজিয়া বেগম গিয়ে দেখেন রায়ায মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে,, তিনি নিজের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

— কি হয়েছে আমার বাবাটার? চলে এলে যে? কিছু মুখে ও নিলে না।আমার বাবাটার কি কিছু হয়েছে? কিছু হয়ে থাকলে মাকে বল.

রয়ায মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,

— কিছু হয়নি মা, এমনি মাথাটা একটু ধরেছে তাই চলে এসেছি।

— আচ্ছা আয় আমি তোর মাথাটা টিপে দিচ্ছি।দেখবি ভালো লাগবে।

কথাটা বলার সাথে সাথে রায়ায নিজের মাকে সোফায় বসিয়ে নিজে মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিল।

রাজিয়া বেগম নিজের ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগল,

— কিছুই তো খেলি না, আমি বরং তোর জন্য কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি। কি খাবি বল বাবা?

— কিছুই খাবো না মা, ভালো লাগছে না কিছুই,, একটু হাত বুলিয়ে দাও মাথায়।

কিছুক্ষন রায়াযের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর,,ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিচে নেমে এলেন।

রাজিয়া বেগমেকে দেখে জহির সাহেব স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,

— কি হয়েছে রায়াযের? এভাবে চলে গেল কেন?

— ওর নাকি একটু মাথা ব্যাথা করছিল তাই একটু রেস্ট নেবে বলে নিজের রুমে চলে গেছে।

– ও আচ্চা

অতঃপর সন্ধ্যার নাস্তা করে যে যার রুমে চলে গেলেন।

উনার কি হলো তা ভাবতে ভাবতে উনার রুমের ভেতর একবার উঁকি দিলাম,,দেখলাম উনি কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে।

যেই আমি চলে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম, তখনই একটা গম্ভীর কন্ঠনালি শুনতে পেলাম,

— তোকে এতবার নিষেধ করার পর আবারও নিজের মুখটা তুলে আমার রুমের সামনে চলে এসেছিস?

কথাটা বলেই উনি শোয়া থেকে উঠে একদম আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন আর সাথে সাথে আমার হাতের বাহু চেপে ধরলেন।

এত জোরেই উনি আমার হাত চেপে ধরেন যে সাথে সাথে আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে নিরবে চোখের জল বিসর্জন করতে থাকি।

উনি হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয় আর বলতে থাকে,

— যত পারিস আমার থেকে দূরে দূরে থাকবি। যা তোর নিজের জন্য মঙ্গলজনক। নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনিস না, কথাটা নিজের মাথায় সেট করে নে।তোকে খুন করতে আমার হাত মোটেও কাঁপবে না।

কথাগুলো বলেই উনি কোথায় যেন চলে গেলেন,,আর আমি নিজের রুমে চলে আসলাম আর নিজের মনে মনে ভাবতে লাগলাম- আর কখনোই ওনার সামনে যাবো না।

____

রাতের খারাবের জন্য ডাক পড়ায় নিচে গেলাম, নিচে গিয়ে চারপাশ চোখ বোলাতে লাগলাম।ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পেলাম না।কিন্তু ভাইয়ার করা কাজ আর তার বলা কথাগুলো মনে পরতেই নিজেকে সামলে নেই। সবাই নিচে এসে হাজির কিন্তু ভাইয়ার দেখা নেই তাই বড়মা টায়রাকে বলল,

— যা তো টায়রা, রায়াযকে ডেকে নিয়ে আয়।

টায়রা উঠতে যাবে, এমন সময় যুথি বলল,

— রায়ায ভাইজান তো বাড়িতে নাই।আমি সেই সন্ধ্যাবেলা উনারে বাড়ি থেইকা বের হইতে দেখছি।

তাই আর বড়মা দেরি না করে ভাইয়াকে ফোন লাগল।কিন্তু ভাইয়া ধরছে না।পূনরায় যেই ফোন দিতে যাবে তখনই ভাইয়া এসে হাজির।ভাইয়াকে দেখে বড়মা দৌড়ে উনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন,

— কিরে কোথায় গিয়েছিলি? আর ফোন ধরলি না যে,, তুই ঠিক আছিস তো? তোর না মাথা ব্যাথা ছিল? এই মাথা ব্যথা নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি?

বড়মার এমন অস্থিরতা দেখে ভাইয়া মুচকি হাসলেন।আর বড়মাকে বলতে লাগলেন,

— মা আমি ঠিক আছি, তুমি এত চিন্তা কেন করছো বলতো?আর আমার মাথা ব্যথা আর নেই তাছাড়া বাড়ির সামনে এসে তোমার ফোন পাওয়াতে আর ফোন ধরি নি মা।এবার শান্ত হও।

তাদের মা ছেলের কথার মধ্যে আমার মা আর চাচী চলে গেল নিজেদের মলোড্রামা প্রেজেন্ট করতে গিয়েই শুরু করে দিল,

— কিরে বাবু কোথায় গিয়েছিলি? কিছু কি হয়েছে? আমরা সবই তো খুব টেনশনে পড়ে গেছিলাম রে-মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো আমার মা বলল।

এরই মাঝে চাচী শুরু করলেন,

— এভাবে না বলে অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি বাবু? আর এমন করবি না।

তাদের এমন আহ্লাদ দেখে ভাইয়া হেসে দিয়ে বলতে লাগলেন,

— ঠিক আছে আর কখনো যাবো না।এবার আমি ফ্রেশ হয়ে আসি কেমন?

ভাইয়া ফ্রেশ হয়ে এসে চেয়ার টেনে আদিব ভাইয়ার পাশে বসে পড়লেন। অতঃপর যে যার মতো ডিনার করে উঠে যায়।কিন্তু বাচ্চা পার্টি গুলো আমার সাথে ড্রয়িংরুমে এসে বসে।

আমি টায়রাকে অস্তে করে বলতে লাগলাম,

— শোন টায়রা আমার কাছে না একটা মজাদার প্ল্যান আছে।

এরই মাঝে কিয়ারা আপু আর আদিব ভাইয়া ও এসে ড্রইংরুমে বসে পরে।আর কিয়ারা আপু বলতে থাকে,

— কিরে তোরা দুইটা কি ফিসফিস করছিস?

— বেলা বলছে ওর কাছে নাকি কিসের প্ল্যান আছে,,
তাই শুনছিলাম।

— কিরে বেলা কোন প্ল্যানের কথা বলছিস?

— আপু বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে,তখন আমরা সবাই বসে একসাথে হরর মুভি দেখবো। কেমন হবে? সাথে থাকবে মজার মজার স্ন্যাক্স।

তখনই আদিব ভাইয়ার গলা শুনতে পেলাম

— প্ল্যানটা দারুন, কিন্তু কার রুমে বসে দেখতে চাইছো? কারণ ড্রইংরুমে বসে দেখলে তো সবাই টের পেয়ে যাবে।

তাইতো এটা তো আর ভেবে দেখি নি।তখনই কিয়ারা আপু বলতে লাগলো,

— আমরা বরং রায়ায ভাইয়ার রুমে গিয়ে দেখি।

কিয়ারা আপুর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো। উনার আজকাল রায়ায ভাইয়ার উপর একটু বেশি ইন্টারেস্ট।কিন্তু পরমুহুর্তে ভাবলাম – আমাকে তো রুমে ঢুকতেই দেয় না দেখি এবার কি করে আটকায়?

তখনই আদিব ভাইয়া বললেন,

— কথা মন্দ নয়, ওর রুমটা বেশ বড় আর ওর রুমের টিভিটাও বেশ বড়।এটা ভালো হয়, কিন্তু ও রাজি হবে কিনা যে জানে?

— ভাইয়া তুই বুঝিয়ে সুজিয়ে বল। নিশ্চয়ই তোকে মানা করবে না।

— ঠিক আছে দেখছি।

কথাটা বলেই ভাইয়া ওনার রুমে চলে গেল।

একটুপর আদিব ভাইয়া এসে বলতে লাগলো,

— অনেক কষ্ট ওকে ম্যানেজ করেছি,, ওর মোটেও চিল্লাচিল্লি পছন্দ নয়।তাই তোরা মুখ বন্ধ রেখে যদি মুভি দেখতে পারিস তাহলেই ওর রুমে জায়গা হবে নয়তো না।

— ঠিক আছে আমরা কোনো চিল্লাচিল্লি করবো না। এখন তো সবে মাত্র ১০.৪৫ বাজে।এই ফাঁকে আমরা কিছু খাবার বানিয়ে নিয়ে আসি।

কথাটা বলেই আমরা মেয়েরা সকলে রান্না ঘরে চলে আসলাম এরপর যুথির সাহায্য নিয়ে আমরা সবাই মিলে হাতে হাত লাগিয়ে চিকেন ফ্রাই, নুডলস আর কফি আর পপকর্ন বানিয়ে নিলাম আর কিছু চিপসের প্যাকেট নিলাম।

____

এখন রাত ঠিক বারো টা। সকলের মাঝে খুব টান টান উত্তেজনা।কারণ চোখের সামনে এখন হরর সিন চলছে।আমার পাশেই আদিব ভাইয়া বসেছে।আর ওপর পাশে টায়রা। ভাইয়ার পাশে কিয়ারা আপু আর আপুর পাশেই যুথি।আর টিনা মিনা আমাদের সামনে।আর রায়ায ভাইয়া গিয়ে সোফায় বসে মোবাইল টিপছে।তার এসবে ইন্টারেস্ট নেই তাই সে এখানে আমাদের সাথেও নেই।আমরা সবাই নিচে বসে মুভি দেখছি।কারণ এভাবেই দেখতে নাকি মজা লাগে।

হঠাৎ করে একটা ভুত সামনে এসে দিল এক চিৎকার ভূতের সাথে কিয়ারা আপু দিল আরো জোড়ে চিৎকার।সাথে সাথে আমি ভয় পেয়ে এক চিৎকার দিয়ে একদম আদিব ভাইয়ার কোলে ওঠে গেলাম।আমাকে দেখে কিয়ারা আপু ভাইয়ার আরেক কোলে বসে পড়লো।আর বলতে লাগল,

— ভাইয়ারে আমি তোর কোলে বসেই দেখি।আমার,,

আপু আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই রায়ায ভাইয়া আমাকে আদিব ভাইয়ার কোল থেকে টেনে তুলে দিল এক থাপ্পর। ভাইয়া এমন কিছু করবে যা যেন কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ভাইয়া চিল্লিয়ে বলতে লাগল,

— তুই ওর কোলে কেন বসতে গেলি? তুই কি এখনও বাবু? ফিটার খাস?

আদিব ভাইয়া রায়ায ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,

— আহা! রখয়ায এমন করছিস কেনো? ও তো ছোট মানুষ।ভয় পেয়ে এমন করেছে। তাছাড়া কিয়ারাও ভয় পেয়ে আমার কোলে চড়ে গেছে।তাহলে তুই কেনো ওকে মারতে গেলি বল তো? আর এত রিয়েক্টই বা কেন করছিস।

রায়ায ভাইয়া আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আদিব ভাইয়াকে বলতে লাগল,

— ও বাচ্চা! ওকে তোর কোন দিক দিয়ে বাচ্চা মনে হয়? বরং বলা যায় ও তোর আমার থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে। তাছাড়া কিয়ারা আর ও এক হলো নাকি? আসলে ওর মনে যে কি চলছে এটা শুধু ওই বলতে পারবে।

— তুই এসব কি বলছিস রায়ায?

— তোরা এখন যা আমার কিছুই ভালো লাগছে না।কোন মুভি-টুভি দেখতে হবে না।আর যাওয়ার সময় তোদের এই খুঁকিটাকে ও নিয়ে যাস – আমার দিকে তাকিয়ে।

এতক্ষন আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। তাই কিয়ারা আপু আমাকে টেনে নিয়ে গেল।আমাকে ড্রয়িংরুমে এনে বসিয়ে দিল আর বলতে লাগল,

— কিরে বেলা ভাইয়া তোর সাথে এমন ব্যবহার করল কেন? তুই কি কিছু করেছিস?

আমি চুপ করে আছি কিছু বলছি না তখনইহাঁটু মুড়ে আদিব ভাইয়া আমার সামনে এসে বসে দুই হাতে আমার গাল স্পর্শ করলেন।সাথে সাথে আমি কেঁদে উঠলাম।আমার কান্না দেখে ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।আর আমি নিজের মন মত কাঁদতে লাগলাম।কিছুক্ষন কাঁদার পর আদিব ভাইয়া আমার চোখের জলটুকু মুছে দিয়ে বলতে লাগলেন,

— বেলা তুমি তো কত স্ট্রং বলো? তাহলে তুমি এভাবে বাচ্চাদের মত কাঁদছো কেন বলতো? জানো তোমাকে দেখতে কত পঁচা লাগছে।তাই ঝটপট চোখের পানি মুছে নাও কেমন?

চলবে ইনশাল্লাহ,,প্রেমময়_বিষ
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_৪

____

এখন প্রায় গভীর রাত।কিন্তু আমি না ঘুমিয়ে কেঁদেই চলছি সেই কখন থেকে।

“তখন আদিব ভাইয়া আমাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয় ঘুমানোর জন্য।বাকিরাও যে যার রুমে চলে যায়”

কিন্তু আমি আর ঘুমাচ্ছি কই? সেই তখন থেকে কেঁদেই চলছি।সেদিন কলেজে আমাকে এতগুলো মানুষের সামনে ভাইয়া আমাকে মারলো,,তাতে সমস্যা ছিল না অতটা।কারণ তারা কেউ তো আর আমাকে চিনত না।কিন্তু এভাবে আদিব ভাইয়া আর কিয়ারা আপুর সামনে আমাকে অপমান করা মোটেই ঠিক হয়নি ওনার।আমি ওনাকে ভালোবাসি বলে উনি যাই খুশি তাই করবে নাকি আমার সাথে?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।

____

দেরি করে রাতে ঘুমানোর জন্য বাড়ির ছোটরা একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠল।এদিকে নাস্তর সময় হয়ে এসেছে কিন্তু বেলার কোনো দেখা নেই।তাই রুমি বেগম গেলেন মেয়েকে ডাকতে।

বেলার রুমে ঢুকে উনি মেয়ের মলিন মুখ দেখে থমকে গেলেন, আর অস্তে অস্তে করে মেয়েকে ডাকতে লাগলেন,

— বেলা এই বেলা, তাড়াতাড়ি ওঠ।সেই কখন সকাল হয়েছে।এখন যে বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে।নাস্তার সময় ও হয়ে এসেছে।তাড়াতাড়ি ওঠ।

বেলা হালকা করে চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকাল,
তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে শুয়ে বলতে লাগল,

— মা একটু ঘুমাতে দাও।আমি নাস্তা পরে করে নিব।এখন তুমি যাও।

— মার খাবি কিন্তু বলে দিলাম।তাড়াতাড়ি উঠে পড় ওঠ বলছি,,

অগ্যতা মায়ের জোরাজুরিতে উঠতেই হলো।

রুমি বেগম যেতে যেতে বলতে লাগলেন,
— তাড়াতাড়ি আয়,আজকে নাস্তায় নানা রকমের হালুয়ার সাথে পরোটা আছে কিন্তু।

মায়ের কথা শুনে আমার জিভে জল চলে আসল।তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলাম নাস্তা করতে।

নিচে গিয়ে দেখি সবাই উপস্থিত।শুধু আদিব ভাইয়া আর রায়ায ভাইয়া ছাড়া।

হঠাৎ করে আমার সিড়ির দিকে চোখ গেল আর দেখতে পেলাম রায়ায ভাইয়া নিচে নামছে।তার ঠিক পিছনে আদিব ভাইয়া,,সাথে সাথে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।রায়ায ভাইয়াকে এখন বড্ড অসহ্য লাগছে।খুব রাগ উঠছে ওনার ওপর।তাই আর ভুলেও উনার দিকে ফিরে তাকালাম না।তারই মাঝে আদিব ভাইয়া আমার পাশে এসে বসে পড়লেন। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে আবার নিজের মত বসে রইলাম।তখনই আদিব ভাইয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,

— এখন কি অবস্থা তোমার বেলা? রাতে ঠিক মত ঘুম হয়েছিল তো?

ভাইয়ার কথা শুনে আমি ‘হ্যা’ বোধক মাথা নাড়ালাম। ভাইয়াও মুচকি হেসে আর কিছু বললেন না।

~ এরই মাঝে মা, বড়মা, চাচী আর ফুপি খাবার এনে টেবিলে রাখলেন।আর যুথি রান্নাঘর থেকে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে।পরোটা আর হালুয়া দেখে আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না। সবার আগেই নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।এক এক করে সকলে খেয়ে-দেয়ে ওঠে যার যার কাজে চলে গেল।আর মা, বড়মা, চাচী আর, ফুপি খেতে বসল এখন।আমি সোজা নিজের রুমে চলে এলাম।কারণ এখনই আমাকে রেডি হতে হবে স্কুলে যাওয়ার জন্য।

নিচে নেমে দেখতে পেলাম আদিব ভাইয়া আর রায়ায ভাইয়া ড্রইংরুমে বসে কি নিয়ে যেন আলাপ আলোচনা করছে।কিন্তু এদিকে আমি চিন্তায় শেষ! কারণ আজকে ও যদি রায়ায ভাই আমাকে না নিয়ে চলে যায় তাহলে মা আজকে আমার গলায় ছুরি ধরবে এটা সিওর আর কি কারণ তাও বের করে ছাড়বে।এইরে! মা যদি এসব জানতে পারে তাহলে আমাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে।

আমি যখন আমার ভাবনায় মগ্ন ঠিক তখনই খুব জোড়ে টায়রার চিৎকার করার আওয়াজ শুনতে পেলাম।আর সাথে সাথে সবাই দৌড়ে ওর রুমে চলে এলাম।একটু পর বাড়িয়ে সকলে এসে হাজির হলেন।বড়মা টায়রাকে ডাকতে লাগলেন,

— কি হয়েছে তোর? তখন এভাবে চিৎকার করছিলি কেন?

টায়রা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,

— আমি ওয়াশরুমের ভিতর পড়ে গেছি মা,,,কিন্তু এখন আর উঠতে পারছি না।তার ওপর পা অনেক ব্যাথা করছে – টায়রা কথাটা বলেই জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।

টায়রার কান্না শুনে রায়ায ভাই অনেকটা বিচলিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,

— বোন আমার, একটু কষ্ট করে দরজাটা খোলার চেষ্টা কর।

— ভাইয়া আমার পক্ষে দরজা খোলা সম্ভব হচ্ছে না।অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু উঠতে পারছি না- কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলতে লাগল টায়রা।

— আচ্ছা দাঁড়া আমি তাহলে দরজা ভাঙার চেষ্টা করছি।

— না ভাইয়া দরজা ভাঙতে হবে না।আমি উঠার চেষ্টা করছি।

বেশ কিছুক্ষন পর টায়রা দরজা খুলে দিয়ে সেখানেই বসে পড়ল।তখনই রায়ায ভাই এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিলেন আর আদিব ভাইয়াকে বলতে লাগলেন,

— আদিব তাড়াতাড়ি আমার পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডাক্তার আঙ্কেলকে ফোন দিয়ে বল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বাড়িতে যেন চলে আসে – কথাটা বলে ভাইয়া টায়রার পা টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন।আর আদিব ভাইয়া ডাক্তারকে ফোন দিয়ে আসতে বলে ফোনটা আবার রায়ায ভাইয়াকে ফেরত দিয়ে দিলেন।

টায়রার জন্য খুব খারাপ লাগছে।ইশরে! মেয়েটা খুব ব্যথা পেয়েছে।তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে।কিন্তু একটা বিষয় ভেবে ভালো লাগছে,, যাক আজ আর আমাকে স্কুলে যেতে হবে না ভেবেই খুশি খুশি লাগছে।কিন্তু আমার খুশিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দাদি বলতে লাগলেন,

— কিরে ছ্যামড়ি স্কুলে না গিয়া এহানে কি করস? যা যা তাড়াতাড়ি স্কুলে যা।

দাদির কথা শুনে আমি বলতে লাগলাম,

— কিন্তু দাদি টায়রার এই অবস্থা।

মাঝখান দিয়ে মা বলতে লাগল,

— পা টায়রার গিয়েছে, তোর তো আর যায়নি।তাড়াতাড়ি স্কুলে যা।

কি আর করা মন খারাপ করে নিচে নামতে লাগলাম।একটু আগে আদিব ভাইয়া আর রায়ায ভাইয়াকে নিচে নামতে দেখেছি।কোথায় গেছে যে জানে?কিন্তু নিচে এসে দুজনকেই এখানে পেয়ে গেলাম।তাই আমি দৌড়ে গিয়ে আদিব ভাইয়াকে কিছু বলতে যাবো অমনি নিজের পায়ের সাথে পা লেগে পড়তে নিলাম,, ঠিক তখনই আদিব ভাইয়া আমাকে ধরে ফেললেন।কিন্তু ব্যালেন্স রাখতে না পারায় দুজনেই একদম গিয়ে পড়লাম সোজা নিচে।

ভাইয়ার ফেস দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব ব্যাথা পেয়েছে।তাই আমি তাড়াতাড়ি করে উঠতে নিলে একটা বলিষ্ঠ হাত আমাকে একটানে তুলে নিলেন।হাতের মালিক কে? তা দেখতে নিলেই রায়ায ভাইয়াকে দেখে আমি চমকে উঠলাম।

ভাইয়া আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলেন,

— তোর কি বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই।না আছে বয়সের কোনো মান্য। ছেলে দেখলেই গায়ে পড়তে ইচ্ছা করে তোর তাই না।

— তুই এসব কি বলছিস রায়ায?তুই তো দেখলি ও কেমন পায়ে পা লেগে পড়ে যাচ্ছিল। ও কি ইচ্ছে করে পড়েছে নাকি?

— ও ইচ্ছে করেই পরেছে।ওকে তো আর তুই চিনিস না।ছেলে দেখলেই গায়ে পড়তে মন চায় ওর।

কথাগুলো শুনে চোখ বন্ধ করে নিলাম আর নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম।তখনই আদিব ভাইয়া রায়ায ভাইয়াকে থাকিয়ে দিলেন,

— হয়েছে এবার থাম তুই।

কথাগুলো বলে আদিব ভাইয়া আমার কাছে এসে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন, আর বলতে লাগলেন,

— কিছু বলতে এসেছো বেলা?

রায়ায ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি চোখ মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।তাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আদিব ভাইয়াকে বলতে লাগলাম,

— আসলে ভাইয়া টায়রা তো পা ভেঙে বসে আছে।কিন্তু তাই বলে আমি তো আর স্কুল যাওয়া থেকে নিস্তার পাবো না।তাই বলতে এসেছিলাম,, আপনার যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমাকে একটু স্কুলে দিয়ে আসবেন।

— সমস্যা নেই, চলো তোমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসি।

— আলবাদ সমস্যা আছে।আদিব কি তোর মত খায় আর ঘুমায় যে তোর জন্য ওর মূল্যবান সময় গুলো নষ্ট করবে।আর প্রতিদিন তো আমিই তোকে স্কুলে নিয়ে যাই।আজ ন্যাকামো করে আদিবকে কেন বলছিস?

— আহা! রায়ায তুই থাকবি? হয়তো তুই টায়রাকে নিয়ে ব্যস্ত বলে তোকে বলে নি। চলো বেলা আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।

— কোথায় যাওয়ার দরকার নেই তোর।ডক্টর আসলে ওনাকে জাস্ট রিসিভ করিস।আর একে তো আমি দেখছি।

কথাটা বলেই রায়ায ভাইয়া আমাকে টানতে টানতে বাহিরে নিয়ে এলেন।কিন্তু ওনার সাথে যাওয়ার আমার মোটেও ইচ্ছে নেই।তাই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলাম,

— আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।

আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই উনি আমাকে টেনে গাড়িতে তুলে খুব জোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। এমন বিকট শব্দে আমি কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলাম।তাই ভয়ে আর কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম।

____

স্কুলে এসে উনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।সারারাস্তা দুজন একটা টু শব্দ টুকুও করি নি।আমি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ভিতরে চলে গেলাম।কিন্তু গেটের সামনে যেতে না যেতেই রবিন আমার পথ আটকে ধরলেন।

” রবিন হচ্ছে আমার এক ক্লাস সিনিয়ন।বেশ কিছুদিন যাবত আমাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে এই ছেলেটা। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।তার এক কথা – আমি তোমাকে ভালোবাসি বেলা।আমার ভালোবাসা গ্রহণ করে নাও।কিন্তু আমি এতদিন যাবত তাকে বুঝিয়েই যাচ্ছি যে আমার দ্বারা এসব হবে না কিন্তু কে শুনে কার কথা? প্রতিদিন এসে আমার পথ আটকাবেই আর আমার মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে”

আজকে আর সইতে না পেরে কিছু কথা শুনিয়ে দিলাম,

— সমস্যা কি আপনার? কথা কি কানে যায় না আপনার।নেক্সট আপনাকে আমার সামনে যেন আর না দেখি।নয়তো আপনার খবর করে ছাড়বো ‌আমি।

কথাটা বলে আমি জায়গা প্রস্থান করতে নিলাম তখনই এই ছেলে আমার ওড়না ধরে দিল একটান। রাগে আমার গা জ্বলে উঠল্ এবার তাই আর সইতে না পেরে দিলাম এক চড়।চড় খাওয়ায় সাথে সাথে গালে হাত দিয়ে ব্যাটা মাথা নিচু করে নিল।আর আমি বলতে লাগলাম,

— লজ্জা করল না ? এভাবে একটা মেয়ের ওড়না টেনে ধরতে।নেক্সট টাইম আর কখনোই আমার সামনে আসবেন না।

কথাগুলো বলেই আমি নিজের ক্লাস রুমে চলে আসলাম।

চলবে ইনশাল্লাহ,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here