প্রেমময় বিষ পর্ব ৫+৬

#প্রেমময়_বিষ
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_৫

____

কোনোদিকে খেয়াল না করে আমি প্রাণ’পণ ছুটে চলছি। এদিক দিয়ে পা কেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।কিন্তু এখন আমার এসবের দিকে খেয়াল দিলে চলবে না। দৌড়াতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমাকে যে থামলে চলবে না তাই এই ক্ষত পা নিয়েই ছুটে চল’ছি।যে করেই হোক আমাকে এই শয়তানের হাত থেকে বাঁচতেই হবে। ছুটতে ছুটতে আমি এতটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছি যে আমার আশেপাশে কি হচ্ছে কিছু’ই আমার মাথায় ঢুকছে না।হঠাৎ করেই একটা গাড়ি আমার সামনে এসে পড়ে,,এমতাবস্থায় আমার কি করা উচিত তা ঠিক মাথায় আসছে না।তাই ভয় পেয়ে মুখের সামনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।কিন্তু এতক্ষণ অব্দি কিছু না হওয়ায় চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা থেমে গেছে আর তার থেকে একজন পুরুষ নেমে আসছে।আমার পা থেকে এতটাই ব্লিডিং হচ্ছে যে,,,আমি চোখে ঝাপসা দেখছি।তাছাড়া পায়ের ক্ষত’টা এতো দৌড়াদৌড়ির ফলে এতটাই বাজে অবস্থা হয়ে গেছে যে দাঁড়িয়ে থাকতে ও বড্ড কষ্ট হচ্ছে এখন।কিন্তু অনেক হার মানলে চলবে না।তাই সামনেই দিকে এগিয়ে গেলাম যদি লোকটার কাছ থেকে কোন সাহায্য পাই।

একটু সাম’নে এগোতেই মানুষটাকে দেখে আমি চমকে যাই।একি!এটাতো রায়ায ভাইয়া।তাই আর দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি,,,

আমার এমন কান্ড দেখে ভাইয়া একটু হকচকিয়ে যায়।আর সাথে সাথে নিজের থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিতে চায়।কিন্তু আমি ছাড়ছি না জোর করে ভাইয়ার সাথে সেঁটে আছি।

বেলকে এভাবে কাঁদতে দেখে রায়ায একটু নরম হয়।তাই অস্তে অস্তে বেলকে নিজের থেকে ছড়িয়ে নিয়ে সামনে এনে দাঁড় করায়,, কিন্তু বেলা ঠিক মত দাঁড়াতে পারছে না দেখে,, একবার বেলাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে,

–কি হয়েছে বেলা? তোর এই অবস্থা কেন? আর তুই বা এমন পাগলের মত কোথা থেকে ছুটে আসছিল?আর তোকে দেখে তো বেশ ইঞ্জুরি মনে হচ্ছে। কি হয়েছে বল আমাকে?

°আমি এক এক করে ভাইয়াকে সবটা বলতে লাগলাম°

“আজকে হঠাৎ করে আমাদের ইংলিশ ম্যাম ক্লাসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ায় তাকে ধরাধরি করে সকলে হসপিটালে নিয়ে যায়।আর তাই স্যার-ম্যামরা সকলে তাকে দেখতে যাবে বলে স্কুল আজকে একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়।কিন্তু আমার কাছে কোনো মোবাইল না থাকায় বাড়িতে ফোন করে এই খবরটা জানাতে পারি না।আর ড্রাইভার তো নিজের ফিক্সড করা টাইমেই আসবে তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে আমার এক বান্ধবীর সাথে ফুচকা খেতে চলে যাই।দুই বান্ধবী মিলে যখন ফুচকা খেতে মশগুল তখন একটা ছোট ছেলে এসে আমাকে বলতে লাগে,

— আপু আপনাকে একটা ভাইয়া ঐযে ঐখানটায় ডাকছে (হাত দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে) বলেছে আপনাকে তাড়াতাড়ি যেতে।আপনাকে নাকি নিতে এসেছে।

বাচ্চাটার কথা শুনে আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম।আমার এই সময় স্কুল ছুটি হয়েছে, বাড়িতে তো কেউ জানে না।তাহলে আমাকে আবার কে নিতে আসবে?হয়তো বা আদিব ভাইয়া এসেছে,, এসব ভেবে আশাকে বিদায় দিয়ে বাচ্চাটার দেখানো জায়গাটায় চলে আসি।

কিন্তু জায়গাটা অনেক নির্জন। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভাবি হয়তো কেউ মজা করেছে। তাই ফিরে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেই।যেই ফিরে যাওয়ার জন্য সামনের দিকে পা বাড়াই,, তখনই একটা কণ্ঠ শুনতে পাই,

— কোথায় যাচ্ছো বেলা সুন্দরী? আমিতো এখানে।

রবিনের কণ্ঠ শুনে আমি অনেকটা চমকে যাই আর পিছন ফিরে তাকাই।রবিনের সাথে ওর আরো কয়েকজন বন্ধুকে দেখতে পাই।এদের সবাইকে একসাথে দেখে আমি অনেকটা ভয় পেয়ে যাই।

রবিন ধীরে ধীরে আমার কাছে এগোতে থাকে।এতে আমি আরও ভয় পেয়ে যাই আর বলতে লাগি,

— কি সমস্যা আপনার? এতো অপমানিত হয়েও আপনার লজ্জা হয়নি? আপনি আবার আমার পিছু নিচ্ছেন। এখনতো আপনি নিজের লিমিটই ক্রস করে ফেলেছেন। কি করে পারলেন আমাকে এমন একটা নির্জন জায়গায় ডেকে আনতে?

— আহঃ! সুন্দরী রাগছো কেনো? আমি কি তোমাকে এখানে মার’তে ডেকেছি নাকি বক’তে? আমিতো তোমায় আদর করতে এখানে ডেকেছি। তুমি তখন আমায় সকলের সামনে এভাবে থাপ্পর দিলে না? তাই আমিও সেই থাপ্পড়ের বিনিময়ে আদর দিতে এসেছি।

— কি যাতা বলছেন? আর একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না বলে দিচ্ছি( কথাগুলো বলতে বলতে আমি আমার ব্যাগের থেকে একটা ব্লেট আর মরিচ গুঁড়া যা সবসময় সেফটির জন্য নিজের কাছে রেখে দেই সেগুলো বের করে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিলাম)

— কাছে না আসলে তোমাকে আদর করব কি করে সুন্দরী? – কথাটা বলে রবিন একদম আমার সামনে এসে খুব জোরেই আমার হাত চেপে ধরলেন। আর সাথে সাথে আমি ওর হাতে ব্লেট দিয়ে দিলাম এক টান।

সাথে সাথে রবিন চিৎকার করে আমার হাত ছেড়ে দিল। এই সুযোগে আমি দিলাম এক দৌড়। আমাকে দৌড়াতে দেখে ও ওর বন্ধুদের বলতে লাগলেন,

— সুন্দরীকে ধর।আজকে ওর একদিন কি আমার একদিন – কথাগুলো বলে ওরা সবাই আমার পিছনে ছুটতে লাগল।

আর আমি এদিক সেদিক না দেখেই শুধু ছুটে চলছি হঠাৎ করেই আমার পা কিসের সাথে লেগে যেন কেটে যায়,, যার ফলে অনেকটা ব্যথাও পাই আর সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠি।কিন্তু পক্ষান্তরে ওদেরকে আবার আমার পিছনে আসতে দেখে ব্যথার কথা ভুলে গিয়ে পূনরা’য় দৌড় লাগাই।আর দৌড়াতে দৌড়াতে মেইন রোডে দিকে চলে আসি আর তখনই আমার সামনে একটা গাড়ি এসে পরে আর আমি ভয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি”

___

আমার কথাগুলো শুনে রায়ায ভাই আমার মাথাটা নিজের বু*কে চেপে ধরেন।আমি ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে শান্তিতে কাঁদতে থাকি।কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর ভাইয়া আমার মাথাটা নিজের বুক থেকে তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে ওঠে,

— গাড়িতে উঠে বস, আয়।

উনি আমাকে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে আমার পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।সারা রাস্তা আমরা কেউ আর কোনো রকম টু শব্দটি ও করি নি।কিন্তু আমার পক্ষে আর চুপ থাকা সম্ভব হচ্ছে না।তাই আর না পেরে যেই কিছু বলতে যাবো এমনি ভাইয়া বলতে লাগলেন,

— চুপচাপ মুখ বন্ধ করে বসে থাক।আমি তোর প্রতি কনসার্ন দেখে! মনে করিস না আমি আবার তোকে ভালোবাসি।তুই আমার পরিবারের একজন সদস্য তার সাথে একজন মেয়ে! তাই তোকে প্রোটেক্ট করা আমার দায়িত্ব।তাই দায়িত্বকে ভালোবাসা ভেবে নিস না।

ভাইয়ার কথা গুলো শুনে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। উনি শুধুই ওনার দ্বায়িত্ব পালন করছে? হাহ! দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম।

___

বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে ভাইয়া আমার পাশের দরজা খুলে দিলেন আর বলতে লাগলেন,

— হাঁটতে পারবি? এইটুকু জায়গা হেঁটে যেতে পারবি তো নাকি?

আমার পায়ে বর্তমানে অনেক ব্যাথা।কিন্তু ব্যথার চিন্তা করলে তো চলবে না।তাই ভাইয়াকে বললাম,

— সমস্যা নেই, আমি হাঁটতে পারবো।

কথাটা বলেই নামতে নিলে হুট করে ভাইয়া আমাকে কোলে তুলে নিলেন।ওনার এমন কাজে আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই।উনি শক্ত মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলছে আর আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি।

__

বাড়ির ড্রইংরুমে এসে আমায় সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল রায়ায ভাইয়া। আমি ওনার যাওয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।বাড়ির সকলে আমার এই অবস্খা দেখে দৌড়ে আমার কাছে এলো আর জিজ্ঞেস করতে লাগল কি হয়েছে আমার? এদের এতো প্রশ্ন শুনে আমার মাথা ঝিম ধরে গেছে।তখনই কথা থেকে যেন আদিব ভাইয়া ছুটে এলেন।আবিদ ভাইয়া আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার পা দেখতে লাগলেন আর কিয়ারা আপুকে বলতে লাগলেন,

— কিয়ারা তাড়াতাড়ি গিয়ে ফার্স্ট এইড নিয়ে আয়।

— যাচ্ছি ভাইয়া।

কথাটা বলেই কিয়ারা আপু ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো।আর আদিব ভাইয়া খুব যত্ন সহকারে আমার পা ক্লিন করে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে।এই মানুষটাকে আমি যতই দেখি ততই অবাক হই।মানুষটা কত ভালো? কত কেয়ারিং।আর অপরদিকে রায়ায ভাইয়া! যে কিনা আমাকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না।আজ প্রথম খুব আফসোস হচ্ছে কেন আদিব ভাইয়াকে ভালো না বেসে রায়ায নামক মানুষটার প্রেমে পড়তে গেলাম। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে একপলক উপরের দিকে তাকালাম আর তাকিয়ে দেখলাম রায়ায ভাইয়া আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে।তাই সাথে সাথে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

হঠাৎ করে মনে হলো আমি হাওয়ায় ভাসছি।তাকিয়ে দেখি আদিব ভাইয়া আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে।আমার দিকে তাকিয়ে ভাইয়া বলতে লাগলেন,

— চলো তোমাকে রুমে দিয়ে আসি, নিশ্চয়ই এই পা নিয়ে উপরে উঠতে পারবে না।

আমি আর কিছু বললাম না।শুধু মাথা নাড়ালাম।

ভাইয়া আমাকে রুমে এনে খাটে বসিয়ে দিলেন আর আমার মাথার পিছনে একটা বালিশ দিয়ে দিলেন। তখনই সবাই এসে হাজির হলেন আর দাদি এসে একপ্রকার আহাজারি শুরু করে দিলেন,

— হায়!হায়রে! এটা কি হইলো এডা? দুই মাইয়া দেহি এক লগে বিছানায় পইড়া গেল রে… কার নজর লাগলো আমার দুই নাতনির উপর।

তখনই কিয়ারা আপু দাদিকে শান্তনা দিয়ে বলতে লাগলো,

— আহঃ! নানু তুমি এভাবে আহাজারি করছো কেন বলতো। সব কিছুই খুব শীগ্রই ঠিক হয়ে যাবে তুমি দেখে নিও।

তখনই মা এসে আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগলো,

— কি হয়েছে তোর? কি করে তোর পা কাটলো? বলবি তো কিছু ? না বললে আমরা বুঝবো কি করে?

এসব কথা কাউকে বলা যাবে না,, বললেই সবাই নিশ্চয়ই অনেক চিন্তা করবে তাই আমি কথা ঘুরিয়ে বলতে লাগলাম,

— ওটা তো! কিসের সাথে লেগে জানি আমার পা কেটে গেছে হেহেহে…

মা মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করলেন না তাই পূনরায় জিজ্ঞেস করলেন,

— সত্যি বলছিস!

— হ্যা মা আর কি হবে। এখন তোমরা সবাই যাও আমি একটু রেস্ট নিব।আর টায়রার পায়ের কি অবস্থা?

— ওর পা একটু মচকে গেছে।কিছুদিন রেস্ট করলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে ডাক্তার বলে গেছে।আচ্ছা তুই এখন রেস্ট নে আমরা সবাই গেলাম।

কথাগুলো বলে সবাই বের হয়ে গেল রুম থেকে।যাওয়ার আগে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেল।যাক এবার একটা শান্তির ঘুম দিতে পারবো। তার ওপর স্কুল যাওয়া থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও নিস্তার পাবো।

___

ঘুমের মধ্যে অনুভব করছি কেউ আমার কপালে নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করছে।তাই হঠাৎ করেই নিজের চোখ খুলে ফেললাম।কিন্তু একি! আমিতো রুমের মধ্যে কাউকে দেখতে পারছি না।হয়তো সপ্ন ছিল, এই ভেবে পূনরায় আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

চলবে ইনশাল্লাহ,,#প্রেমময়_বিষ
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_৬

____

এক’ঘুমে আমি একদম পুরো’টা দিন পার করে দিলাম।একটু আগে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগেই।বেশকিছুক্ষন পর্ বড়মা আর মা আমার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো।নাস্তা গুলো দিয়ে আবার ফিরেও গেল। যাহ! এখন আমাকে অস’হায়ের মতো একা একা রুমে বসে নাস্তা করতে হবে? তখনই চোখ গেল দরজার দিকে আর দেখতে পেলাম আদিব ভাইয়া টায়রাকে ধরে ধরে আমার রুমে নিয়ে আসছে, সাথে পিছনে আছে কিয়ারা আপু আর টিনা-মিনা ।সকলকে একসাথে দেখে আমি হেব্বি খুশি হয়েছি! আদিব ভাইয়া টায়রাকে এনে আমার পাশে পা উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন।তারপর টিনা মিনা আর কিয়ারা আপু ও এসে বসে পড়ল পাশে।যাক সবাইকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।তখনই চাচি বাকি সবা’ইকে নাস্তা দিয়ে গেল।আর আদিব ভাইয়া নিচে চলে গেল।তবে যাওয়ার আগে আদিব ভাইয়াকে একবার বলেছিলেম,

— ভাইয়া আপনিও এখানে থেকে যান।

আমার কথা শুনে ভাইয়া একগাল হেসে বললেন,

— মহিলা সমাবে’শে আমি নেই বাবা! তোমরাই ইনজয় করো।

কথাটা বলে ভাইয়া প্রস্থান করলেন।আমি টায়রার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলাম,

— কিরে তুই কেন আবার কষ্ট করে আমার রুমে এলি বল তো?

— একা একা বসে থাকার চেয়ে সবাই একসাথে থাকার মজাই আলাদা বুঝেছিস।আর তাছাড়া আমার তো সেই সকালে পায়ে ব্যথা লেগেছে, কিন্তু তুই তো একটু আগেই সবে ইঞ্জুরি হয়ে এসেছিস।তার উপর নাকি এখনও কোন মেডিসিন নেসনি।তাই তোর উপর মায়া করে আমি তোর রুমে চলে এলাম।একা থেকে নিশ্চয়ই তুই বোরিং হয়ে গেছিস।

ওর এসব বেহুদা কথা শুনে আমি চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।


যে যার নাস্তা করে যার যার রুমে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাড়ালো আর টিনা মিনা আর কিয়ারা আপু মিলে ধরে টায়রাকে ওর রুমে নিয়ে গেল।আর যাওয়ার আগে কিয়ারা আপু আমার হাতে একটা ঔষধের পাতা ধরিয়ে দিয়ে গেল সাথে একগ্লাস পানি।আমি ঔষধ খেয়ে পূনরায় শুয়ে পড়লাম।এখন শুয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই বাপু।

____

সকালে চোখের উপর সূর্যের আলো পড়তেই ঘুমটা ভেঙে যায়। যাহ! রাতে ঘুমানোর আগে তো জানালায় পর্দা দিয়া হয়নি।মা শুধু জানালা দিয়ে চলে গেছে হয়তো। হা’মি দিতে দিতে উঠে বসলাম, যাই একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।পা’টাকে একবার ফ্লোরে রেখে দেখলাম ব্যাথা আছে কি’না? নাহ! ব্যাথা অনেকটা কমে গেছে। তাই বাম পা’টা উচুঁ করে হালকা হালকা কদমে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় গেলাম।আমি সচরাচর এতো সকালে ঘুম থেকে উঠি না, স্কুলে যাওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে উঠি।কিন্তু আজকে এত সকাল সকাল উঠে যে এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখতে পারবো? কল্পনা ও করতে পারি’নি।বাগানে রায়ায ভাই জগিং স্যুট পরে জগিং করছে আর তার সাথে আদিব ভাইয়া ও ঠিক একই কাজ করছে। দুজনকেই বেশ লাগছে কালো স্যুটে।রায়ায ভাইকে সব অকেশনে পাঞ্জাবিতে’ই দেখা যায় এমন কি প্রতিদিন সে ভার্সিটিতে পাঞ্জাবি পরেই গুন্ডামি করে (কথাটা ভেবেই হেসে দিলাম) কিন্তু আজকে ভাইয়াকে নতুন লুকে দেখে বড্ড প্রে’ম প্রেম পাচ্ছে।কিন্তু আমার প্রেমে পাওয়াতেই ওনার কি’বা আসে যায়! তাই চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালাম।কিছুক্ষন পর ওরা দুজন’ই বাড়ির ভিতর চলে গেল।আমি বারান্দায় বসে রইলাম।

একটুপর মা এলেন ডাকতে, কিন্তু আমাকে রুমে না পেয়ে বারান্দায় এসে পেয়ে গেলেন, আর বলতে লাগলেন,

— কিরে তুই এখানে কি করে এলি? পায়ে ব্যাথা পেয়েছিস নিশ্চয়ই?

— না মা, আমার পায়ে এখন আর ব্যথা নেই। পা হালকা তুলে হা’টলে ব্যথা অনুভব হয় না।

— আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে তুই এখন কি নিচে যাবি নাস্তার জন্য? নাকি এখানে তোর নাস্তা দিয়ে যাবো?

— চলো মা নিচে যাই, এখানে একা একা খেতে ভালো লাগে না।আর টায়রার পায়ের কি অবস্থা?

— মোটামুটি ভালোই এখন।কিছুদিন রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে।আয় তোকে আমি ধরে নিয়ে যাচ্ছি নিচে।

মা আমাকে ধরে ধরে নিচে নিয়ে এলেন, এনে আমাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে সকলে মিলে নাস্তা সাজাতে লাগলেন।একটু পর এক এক করে সকলে টেবিলে এসে হাজির হলেন,,মা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে টেবিলে বসিয়ে দিলেন।কিন্তু বেচারি টায়রা উপস্থিত হতে পারলো না।সো সেড ফর হার! আমাকে টেবিলে দেখে আব্বু বলতে লাগলেন,

— তুমি এই পা নিয়ে এখানে কেন এসেছো?নিজের রুমে নাস্তা করতে পারতে!

— রুমে একা একা ভালো লাগে না, তাই এখানে চলে এলাম।

কথাটা বলে আমি মাথা নিচু করে খেতে লাগলাম।

বেলার কথা শুনে রায়ায একপলক বেলার দিকে তাকিয়ে পূনরায় নিজের খাবারে মনোযোগ দিল।আমি আড়’চোখে বার বার উনার দিকে তাকাতে লাগলাম। হঠা’ৎ করে ওনার চোখে চো’খ পড়ে যাওয়াতে আমি সাথে সা’থে চোখ নামিয়ে নিলাম আর ভয় পেতে লাগলাম না’জানি আবার সকলের সামনেই বকা দেয়।

___

খাওয়া শেষে আমি উঠে দাঁড়ালাম।অস্তে অস্তে পা ফেলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে পড়লাম।ছোটরা সকলে ওখানেই রয়েছে আর বড়রা অফিসে চলে গেছে।আর মা-চাচিরা বসে নাস্তা করছে। একটু পর রায়ায ভাইয়া ও চলে যাবে ওনার ভার্সিটিতে। উনার আজকে আর আমাদের নেওয়ার প্যা’রা নেই।আমি গিয়ে টিনার পাশে বসলাম। তখনই কিয়ারা আপু বলে উঠলো,

— চলো আমরা সবাই মিলে লুডু খেলি।

কথাটা শুনে আমি মনে মনে একটা লাফ দিয়ে উঠলাম কিন্তু মুখে কিছু বললাম না কারণ! সামনেই রায়ায ভাইয়া বসে আছে।

কিয়ারা আপু মুখে একটু লজ্জা লজ্জা ভাব এনে বলতে লাগলেন,

— রায়ায ভাইয়া আপনি ও আমাদের সাথে খেলায় জয়েন করুন।

আপুর এমন লজ্জা’মাখা মুখ দেখে আমি চিন্তা করতে লাগলাম,, এই সামান্য একটা কথা বলতে এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?তখনই রায়ায ভাইয়া নিজের ঘড়ি দেখতে দেখতে বললেন,

— তোমরাই খেল, আমার এখন যেতে হবে।

কথাটা বলেই ভাইয়া প্রস্থান করলেন আর আমি ভাইয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিয়ারা আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি আপুর মুখটা কেমন বেলুনের মত চুপসে গেছে।রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি! আপুর মনে কি চলছে জানতেই হবে। কিয়ারা আপু পূনরায় আদিব ভাইয়াকে বলতে লাগল,

— ভাইয়া তুই আমাদের সাথে খেলবি, তোর তো এখন আর কোথায় যাওয়ার নেই। চল চল।

— আমি এসবে নেই, তোরাই খেলতে থাক।

কিয়ারা আপু এবার রেগে লাল হয়ে গেল আর বলতে লাগল,

— তুই যদি এখন আমাদের সাথে খেলতে না আসিস আমি সত্যি সত্যি এবার কেঁদে দিব।আর কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে তোর নামে বিচার দিব বলে দিলাম।

ভাইয়া আপুর কথায় হেসে দিয়ে বলতে লাগলেন
,

— কিন্তু মা’তো তোর কথা বিশ্বাস করবে না কিরু বুড়ি।

— ভাইয়া…

— ঠিক আছে চল।

কথাটা বলে আমরা সবাই টায়রার রুমে চলে আসলাম।টিনা-মিনাকে চাচি স্কুলে দিতে যাবেন তাই ওরা রেডি হতে চলে গেল।আমরা চারজন মিলে সেই তখন থেকে লুডু খেলেই যাচ্ছি কিন্তু প্রতিবারই আদিব ভাইয়া জিতে যাচ্ছে।তাই রাগ করে এবার কিয়ারা আপু নিজের রুমে চলে গেল আর আমাকে আমার রুম অব্দি পৌঁছে দিয়ে আদিব ভাইয়া কোথায় জানি চলে গেল।আমি অনেকবার ভাইয়াকে নিষেধ করেছিলাম যে, আমি একাই যেতে পাড়বো হেল্পের প্রয়োজন নেই কিন্তু কে শুনে কার কথা? সে আমাকে ধরে ধরে রুমে পৌঁছে দি’য়ে গেল।ভাইয়া মানুষ হিসেবে বড্ড ভালো, খুব আফসোস হয় রায়ায ভাইয়া কেনো আদিব ভাইয়ায় মত হলো না?

___

দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকগুলো দিন।আমি আর টায়রা এখন পুরো’পুরি সুস্থ।তাই আজকে দুজনই স্কুলে আসবো ভেবেছি।যেই ভাবা সেই কাজ,, দুজনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রায়ায ভাই চলে গেল।

আজকে রবিন আমাদের পথ আটকা’লো না। এতে বেশ অবাক হয়েছি।একটু পর আশা এসে আমার আর টায়রার পাশে বসে পড়লো আর বলতে শুরু করল,

— এই তোরা এতদিন স্কুলে আসিস নি কেন?

আমি আশাকে আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বলতে শুরু করলাম। ও আমার কথা শুনে মুখের ওপর হাত দিয়ে অবাক হয়ে বলতে লাগল,

— রবিন এমন করেছে তোর সাথে? কিন্তু তোরা কি জানি’স ওর সাথে কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে?

আমি আশার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলাম কি হয়েছে রবিনের সাথে? আশা বলতে শুরু করল,

— তোর সাথে এই ঘটনা ঘ”টায় পরের দিন,, ওকে আহত অবস্থায় ওর বাড়ির পাশে কে যেন ফেলে রেখে যায়! অবস্থা নাকি খুব খারাপ বাঁচ’বে কিনা সন্দেহ? প্রায় ছয়দিন ধরে ও হসপিটালে। তার উপর ওর ও*টা ও নাকি কেটে দিয়েছে!

কথাটা শুনে আমি আর টায়রা একে উপরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে বসে রইলাম।

অতঃপর ঘণ্টা পরে যাওয়ায় আমরা ক্লাসে মনোযোগ দিলাম।কিন্তু আমার মাথা কাজ করছে না কিছুতেই, কে করলো এসব! আমিতো রায়ায ভাইয়া ছাড়া আর কাউকে এসব বলি’নি। তাহলে কি রায়ায ভাইয়া করেছে এসব? কিন্তু! উনিতো আমাকে সহ্যই করতে পারে না।তাহলে কে করলো?হয়তো হবে কেউ! কারো চড়কায় রবিন নিশ্চয়ই আগুন দিয়েছে।তাই হয়তো কেউ ওকে শিক্ষা দিয়েছে।যাক’গে আমার কি? তাই এসব আর আমলে না নিয়ে আমি ক্লাসে মনোযোগ দিলাম।

____

বাড়ি ফিরেছি সেই কখন। এখন প্রায় বিকেল।ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে শুয়ে আছি আর এক মনে কিছু এক’টা ভেবে চলছি।যেই করেই হোক এই প্রশ্নের উত্তর আমার চাই।তাই আর নিজেকে দমা’তে না পেরে রায়ায ভাইয়ার রুমের দিকে অগ্রসর হলাম।কিছুক্ষন আগেই ভাইয়া বাড়িতে ফিরেছে।আমি চুপি চুপি ভাইয়ার রুমের দরজায় আড়ালে দাড়িয়ে আছি, ভয়ে ভিতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না, যদি বকে! অপমান করে? উনি ল্যাপটপ নিয়ে বসে বসে কি যেন করছেন।
কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে রায়ায ভাই আমাকে ডেকে উঠলেন।গম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন,

— সমস্যা কি তোর? এভাবে আমার রুমের বাহিরে দাড়িয়ে রুমে’র ভিতর উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিস কেনো?সামনে আয়।

ভাইয়ার কথা শুনে আমি অনেকটা চম’কে উঠলাম।এই’রে! ভাইয়া আমাকে দেখলো কি করে? আমিতো আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম।ভাইয়া পূনরায় বলতে লাগলেন,

— এসব ন্যাকামো রে’খে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আয়।আর কিছু বলার থাকলে তাড়া’তাড়ি বলে বিদেয় হ।

ভাইয়ার কথা শুনে আমি বের হয়ে আসলাম।আর কাচু’মাচু করতে লাগলাম।তখনই ভাইয়ার কথা শুনে আমি অনেক’টা চককে উঠলাম সাথে অবাক ও।ভাইয়া আমাকে কি’না নিজের রুমের ভেতর প্রবেশ করতে বলছেন! তাও নিজের মুখে’ই।আমি চোখ বড় বড় করে ভাইয়ার দিকে তাকালাম।আমার এমন রিয়েকশন দেখে ভাইয়া নিজের ভ্রু কুঁচকে বলতে লাগলেন,

— ন্যাকা’মো করার থাকলে, এখান থেকে গিয়ে কর।আমার সামনে থেকে যা।

ভাইয়ার কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে ওনার রুমে প্রবেশ করে একপাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম,

— আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি ভাইয়া- (ওনাকে ভাইয়া ডাকতে আমার মোটেও ম’ন চাই না।ইচ্ছা করে সাই’য়া বলে ডাকি।কিন্তু বাধ্য হয়ে ভাইয়াই ডাকতে হয়)

— বলে ফেল শুনছি।

— রবিন কে কি আপনি…

আমাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে ভাইয়া উঠে দাঁড়ালে’ন। উনাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা! আমাকে কি এখন মার’বে নাকি!কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে ভাইয়া আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে হুট করে আমার কোমরে’র দুই পাশে হাত চে’পে ধরে নিজের দিকে টেনে নিলেন। এতে আমি আরও অবাক হয়ে ভাইয়ার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।ভাইয়া হালকা আমার দিকে ঝুঁ’কে আমার কানে কানে বলতে লাগলেন,

— রবিনের ব্যাপার’টা আমি পুরোটাই জানি।তোর সাথে কি করছে তাও বলে’ছিস।কিন্তু তাই বলে আমি ঐ ছেলেকে পেটাতে যাবো?এর কোনো মানে’ই হয় না। কারন তুই আমার এমন কেউ’ই না যে, তোর জন্য অযথা নিজের শক্তি আর সময় দুটো’ই ব্যয় করতে যাবো আমি।তাই নিজেকে এতো ইম্পর্টেন্ট দিস না।আর আমার চোখের সামনে থেকে দুর’হ এখন।

কথাটা বলে উনি আমাকে নিজের রুমের বাইরে এনে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আর সাথে সাথে আমার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

উনার এমন ব্যবহারে আমি একটু কষ্ট পেলাম।কিন্তু পক্ষান্তরে ভাবতে লাগলাম, এ আর নতুন কি? যেদিন থেকে ওনাকে ভালো’বাসার কথা বলেছি।সেদিন থেকে’ই তো উনি আমার সাথে এমন ব্যবহার’ই করেন।তাই আর ভাবলাম না নিজের রুমে চলে এলাম।

চলবে ইনশাল্লাহ,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here