‘নিশীথচিত্র'(৩৬)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে
____________
বাস ছেড়েছে কেবল।জানালার পাশের সিটে বসার জন্য বাকবিতণ্ডা হওয়ার কথা থাকলেও হলো না দীপ্তি রিনির মাঝে। শুকনো ওষ্ঠে খড়খড়ে হাসি নিয়ে মধ্যের সিটেই ধপাস করে বসেছিলো রিনি।কারণ তার দিহান ভাইয়ের পাশেই বসতে হবে। জানালার পাশের সিট যাক গোল্লায়।একটার পর একটা চিপ্স খচমচ করে চিবিয়েই যাচ্ছে। নিয়ম করে আবার দিহানের মুখে ধরছে দীপ্তির মুখে ধরছে।তারাও খাচ্ছে।দীপ্তি চুপসে আছে। মায়ের মুখটা আজ খুব বেশিই টানছিলো তাকে । রিনি ভালো থাকার মানুষটাকে সাথে নিয়ে গেলেও মনের মাঝে কোথাও একটা মায়া খচখচ করে জানান দিচ্ছে জায়গাটাকে মানুষগুলোকে সে ভালোবেসে ফেলেছে।
তমশা ঘনীভূত হয়ে আসছে পৃথিবীর বুকে। গরমও লাগছে বেশ।দিহান মাঝে মধ্যেই শার্ট ফাকা করে ফু দিচ্ছে।রিনি দীপ্তি টুকটাক গল্পে মজেছে।তবে এক হাত দিয়ে দিহানের দুটো আঙুল পেচিয়ে রেখেছে।তাই দিহানের যা করতে হচ্ছে অন্য হাত দিয়েই করতে হচ্ছে।আস্তে আস্তে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেলো।দিহানের ক্লান্তিতে চোখে ঘুম ঢুলুঢুলু।মুখ থুবড়ে রিনির কাধে পরেই ভুসভুস করে ঘুমের আওয়াজ এলো।রিনি দীপ্তিকে জানালা আর একটু মেলে দিতে বললো।পরখ করে দেখলো দিহানের গায়ে বাতাস লাগছে কিনা।দীপ্তিকে ফিসফাস করে বললো
–“দেখলে আর একটু লম্বা হলে ভালো হতো না? দিহান ভাইয়ের মাথা টা কেমন বেশি এলিয়ে আছে। ঘুম থেকে উঠে ঘাড় ব্যাথা হয় যদি?”
রিনি আবার বললো
–“পায়ের কাছে ব্যাগটা থেকে দু তিনটা ওড়না বের করে দাও তো।”
দীপ্তি তাই করলো।রিনি দিহানের মাথা সাবধানে তুলে কাধের উপর ওড়না রেখে আবার মাথাটা সাবধানে রাখলো তাও যদি একটু উঁচু হয়।বাসের মধ্যে সামনের একটা লাইট জ্বলছে।বাসের ফ্যান গুলো পুরো দমে বাতাস দেয়ার চেষ্টা করলেও আশ পাশের গুটিকয়েক মানুষ বাদে আর কারো গায়ে তেমন লাগছে না।চোখ বুজে প্রশান্তির ছায়া তলে নিবিষ্ট হলো সে।নিবিড়ভাবে দিহানকে অনুভব করছে।ভালো লাগছে তার।অন্ধকার থেকে অন্ধকার পুরোপুরি ভাবে গায়ে মেখে গেলো যেনো।
দীপ্তি রিনিকে ডাকলো। সাড়া না পেয়ে বুঝতে পারলো ঘুমিয়ে গেছে।দুজনের দিকে তাকিয়ে ওর মুখ থেকে অজান্তেই হাসি বের হলো। রিনির মাথাটাও এলিয়ে আছে দিহানের মাথার সাথে,দিহানের হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে।হালকা টুন করে শব্দ হলো ফোনে।মেসেজ এলো
“কতদূর?”
দীপ্তি মেসেজিংয়ে মনোযোগ দিলো।
“বলতে পারছি না ঠিক।কিন্তু বেশি দূরও না। ”
“আফসোস হচ্ছে।”
“কেন?”
“চাইলে তোমাদের সাথে যাওয়া যেতো।আব্বার জন্য পারলাম না।রাতের বাসের জার্নি।আল্লাহ জানে কবে আছে ভাগ্যে।খুব শখ জাগছেগো দীপ্তি রানী খুব”
মেসেজটা পরে চাপা হাসলো দীপ্তি। মেসেজেই মনে হলো করুণ আর্তনাদ করছে তনয়।
“ভাইয়া বাসে আপনার পাশে বসতে দিতো?”
“তাও ভাবনার বিষয়। তোমার ভাইকে বোঝা আর…..”
“আর কি?”
“থাক বললাম না।”
পরাপর আবার মেসেজ এলো
“চলে গেলা সুন্দরী, ভালোবাসি বলে গেলা না।”
দীপ্তির নিস্তব্ধ হাসির বেগ বাড়লো হালকা মন খারাপও হলো। মন খারাপময় হাসি।
____________
রিনির ঘুম ভাঙতেই দেখলো বাহুর মধ্যে আবদ্ধ সে।মাথা পরে আছে প্রসস্থ বুকে,মুখের সামনে খাবার ধরে আছে।মূলত খাবারের নাড়াচারায় ঘুম ভেঙেছে।রিনি চোখ কচলে নিজের সিটে হেলান দিলো।ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো
–“আমি ঘুমের মধ্যে খেতে পারি না।”
–“তাহলে এখন খাও।”
রিনি খেয়ে নিলো। দীপ্তি গভীর ঘুমে। রিনি দীপ্তি কারো চোখেই ঘুম নেই।হুট করেই রিনি টেনে দিহানের মুখ নিজের দিকে ফেরালো।শক্ত করে ধরে থাকলো।
দিহান ভাবলেশহীন ভাবে বললো
–“হলো কি? ভূত টূত ধরেছে নাকি?
রিনি একভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তবে দিহানের মুখ ছাড়ে নি। দিহান ভেবে পায় না এই মেয়ে অন্ধকারে দেখছে কি!
কিছুক্ষণ বাদে রিনি ঠোঁট উল্টে ফেলে।দিহানের দুই গাল ছেড়ে চুল টেনে দেয় জোরেসোরে।
–“আল্লাহ করছি কি আমি?এমন কেন করতেছো?”
রিনি গমগম কণ্ঠে অভিযোগ করে বললো
–“সব কিছুতে বারণ আপনার।কিছু চাইলেও করা যায় না।তাহলেই বলবে ‘রিনি পরে তোমারই আফসোস হবে’।দিহানের নকল করলো রিনি।আবার বললো”আমি কখন বললাম আমার আফসোস হয়?বাল।”
দিহানের চরম হাসি পেলো।
–” কি বললা তুমি? ”
রিনি আবার মেজাজ খারাপ নিয়ে বললো
–“বাল থামেন তো।বাসায় ফিরে যাবো ভালো লাগছে না এমনিই।”
–“এতো দিন পর বাসায় ফিরছো ভালো কেন লাগছে না?”
রিনির মেজাজ অধিক খারাপ হলো।দিহান বুঝতে পেরেছে।
–“আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু এতো মেজাজ খারাপের কারণ কি?”
রিনি আরও চটে গেলো।
–“বলবো না। কিচ্ছু দ্যান না আপনি।বর্বর,পাষান আপনি।”
–“আস্তে রিনি আস্তে মানুষ উঠে যাবে সব।”
রিনি থামলো।বিরবির করে একটা কথা আওড়াতে লাগলো
–“আমার আফসোস লাগবে না তো।লাগবে না।কখনও বলেছি আফসোস লাগে?”
দিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো
–“পাশে আমার বোন।বাস ভর্তি মানুষ। আফসোস না লাগলেও কিছু করার নেই।”
–“তো কি? তো কি? দীপ্তি ঘুমে না?ও তো প্রেম করে। ও কি নিজের ভাইয়ের কথা ভেবে আর পুরুষ মানুষ স্পর্শই করবে না?আর বাসের মানুষের কাজ নেই যে আমাদের কথা গিলবে!”
দিহান কিছু বললো না।রিনির মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো।
–“যেভাবে বলছো তাতে অবশ্যই গিলবে।”
রিনি হাত টেনে সরালো মুখের সামনে থেকে।দিহানের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আকুতি নিয়ে বলে,
–“এতো লুকাচ্ছেন কেন দিহান ভাই।তুমি একবার বলেন প্লিজ একবার।এতো ভয় কিসের আপনার?আমি বুঝি আপনি আমাকেই ভালোবাসেন।”
–“হুম পিএইচডি করছেন বুঝেছি।এবার থেমে যান।”
রিনির মেজাজ খারাপ বাড়লো।গায়েই লাগাচ্ছে না তাকে।
–“আমি কিন্তু চিল্লাবো।ভালোবাসা দিবেন কিনা বলেন।”
রিনির মুখ শক্ত করে চেপে ধরলো আবার।দাঁত কিরমির করে বলো
–“কিসের এতো ভালোবাসা লাগবে তোর হ্যা?মেরে তক্তা বানাবো কিন্তু।”
রিনি কষ্ট পেলো ভীষণ। মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিহানের উল্টো দিকে ঘুরলো।বিরবির করে বললো
–“পারেই ওই তক্তা বানাতে।”
কান্নার হালকা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।দিহান কান চেপে চোখ বুজে রইলো। নাক টানার শব্দ কানে বিধছেই।রিনিকে টেনে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো।রিনি শক্ত হয়ে রইলো।
–“এতো ঘাড় ত্যাড়ামি।”কথাটা টেনে টেনে বললো দিহান।আবার বললো”এদিক আয়।”
রিনি কর্ণপাত করলো না।সব সময় ফিরিয়ে দেয়।মেনে নেবে না একদম সে।
দিহান রিনির মুখ টেনে ফেরানোর চেষ্টা করল।রিনি দাঁত বসিয়ে দিলো।
দিহান হাত ছাড়ালো। ব্যাথায় হাত ঝাড়ছে অনবরত। দিহান রিনির হাত টেনে কামড় বসালো।রিনি শত টানাটানি করেও ছাড়াতে পারলো না।দিহান ছেড়ে দিয়ে বললো
–“টিট ফর ট্যাট।”
রিনি চোখের নাকের পানি সব দিহানের শার্টেই মুছলো।দিহান আহাম্বক হয়ে তাকিয়ে আছে।
চাপা আর্তনাদ করে বললো
–“এটা কি করলে? আমি কি এমন করেছি?”
রিনি শুনলো না।চট করে অধরে অধর ছুয়িয়ে পুর্বাস্তায় বসলো।
–“এবার শোধ তুলুন।”
আবছা আলোয় দেখা গেলো দিহান হা করে তাকিয়ে আছে।
রিনি আবার তাগাদা দিয়ে বললো
–“কই তুলুন।”
দিহান দুইবার কেশে বললো
–“নিরীহ বালিকাদের উপর আমি শোধ তুলি না।”
রিনি ঘোর আপত্তি জানায়।
–“হবে না দিহান ভাই একদম হবে না।সবসময় এমন করেন।”
দিহান হাসলো রিনির বাচ্চামো দেখে।সারা রাত কেউ ঘুমালো না।খুনসুটি করতে করতেই পৌছে গেলো গন্তব্যে।
_______________
কেটে গেলো বেশ কিছু দিন।আজ এসএসসি রেজাল্ট দিয়েছে।দীপ্তির ‘এ’ প্লাস আসলেও রিনির রেজাল্টে সন্তুষ্ট নয় দিহান মোটেই।মাত্র কাটায় কাটায় ফোর পয়েন্ট?
দিহানের মুখভঙ্গি দেখে রিনি চুপসে ঘরে চলে গেলো।বাসার সবাই মোটামুটি খুশি।রাতে দিহানকে ডাকলো কলেজে ভর্তির ব্যাপারে।মুনির হোসেনের সাথে দিহান বেশ জোরপূর্বক হেসেই জবাব দিচ্ছে।রিনির দিকে একবারও তাকালো না।মুনির হোসেনের জোরাজোরিতে রাতের খাবারটাও খেয়ে যেতে হলো।
রুমে যেতে যেতে দীপ্তি বললো
–“ভাইয়া রেগে থাকিস না।রিনি কষ্ট পাচ্ছে।কেমন মুখ চুপসে আছে।”
দিহান কোনো কথার উত্তর দেয় না।চোখ বুজে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো দিহান।কষ্ট ঠিক কোন ব্যাপারটা নিয়ে হচ্ছে বোঝা দুষ্কর। রেজাল্ট খারাপে কষ্ট হচ্ছে নাকি ভালোবাসি বলার ডেট টা আবার পিছিয়ে গেলো বলে কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারছে না সে।নিজেকে পরাজিত লাগছে তার।কতো চেষ্টা করেছে মেয়েটাকে নিয়ে তবুও কেন পারলো না? তারই হয়তো ঘাটতি ছিলো।কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না তার।ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো দিহান।
__________
রাতে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।দীপ্তি ঘুমায় নি।রিনি চাপা কণ্ঠে ডাকে দীপ্তি দীপ্তি করে।দীপ্তি চারবার ডাক শোনার অপেক্ষায় থাকে।হতেও তো পারে ভূত পেত্নি।দীপ্তি দরজা খোলে।ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে
–“আসলে কিভাবে?”
রিনি ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলে “গাছ বেয়ে।”
দীপ্তি মুখ হা করে বলে
–“ভয় করলো না?”
–“তোমার ভাই ভয় রাখতে কই দিলো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ায় দিহানের বিছানার দিকে।দীপ্তি নিজের রুমে চলে যায়।রিনি দিহানের পায়ের কাছে বসে পরে।খুব শক্ত করে পা দুটো চেপে ধরে মাথা রাখে পায়ের উপরে।ফুপিয়ে কেদে ওঠে সে।
চলবে,’নিশীথচিত্র'(৩৭)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে
____________
হাটুর উপর মাথা রেখে নাক মুছছে আর কাদছে রিনি।বার বার মনে হচ্ছে সে হারে নি অন্য একজনকে হারিয়ে দিয়েছে।হু হু করে কান্নার বেগটা বেড়ে গেলো।রেজাল্ট নিয়ে নিজে সন্তুষ্ট হলেও দিহানের জন্য কিছুতেই সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভব হচ্ছে না।দিহানের গম্ভীর মুখ রিনিকে আরও মিয়িয়ে দিচ্ছে।কতো রাত অব্দি পড়িয়েছে পাশে বসেই।এমন না যে কমন বাধে নি।কিন্তু তার বাধিয়ে রাখার মতো মাথা আর পরীক্ষা নিয়ে অতিরিক্ত ভয় সব আশা ভরসা মাটি করে দিলো।রিনি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না করতে করতেই দিহানকে করুণ সুরে ডাকলো।
–“ও দিহান ভাই, দিহান ভাই।”
কয়বার নাড়াচাড়া দিতেই দিহান চোখ মেললো।রিনিকে দেখে তরাক করে উঠে বসলো।চোখ কচলে বললো
–“সকাল হয়ে গেছে?”
–“এখন তো রাত।”
পাশের টেবির থেকে পানি খেয়ে বললো
–“এতো রাতে পায়ের কাছে বসে কান্নাকাটি কেন করছো? হয়েছে কি?”
রিনি মরা কান্না শুরু করে দিলো এবার।
–“দিহান ভাই, আমি খুব সরি দিহান ভাই। আমার রেজাল্ট আরও ভালো হওয়া উচিত ছিলো কিন্তু হলো না।আপনার এতো খাটনি এতো চেষ্টা সব বিফলে গেলো।সব আমার ভয়ের জন্য।ভয়েই….”
কথা শেষ করতে দেয় না দিহান।আধা খাওয়া পানির গ্লাসটা রিনির মুখের সামনে ধরে।রিনি সব থামিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে।দিহান ইশারায় বলে খাও।রিনি ঢকঢক করে পানির গ্লাসটা খালি করে দেয়।টানে একটা প্রলম্বিত নিশ্বাস।
–“রাতে দেখলাম খাবার নেড়ে চেড়ে উঠে গেছো।খাও নি।খাবে?”
দিহানের শান্ত মেজাজের কথা রিনির ঠিক হজম হচ্ছে না।ভেবে ছিলো দিহান গুম মেরে আছে মুখ খুললেই তার মাথায় বাজের মতো পরবে।এমন কিছু হলো না দেখে অবাকের চরম পর্যায় সে।
দিহান উত্তরের অপেক্ষায় রইলো না।দুপুরের রান্না করা খাবার গরম করতে দিলো।রিনি বিছানার কোণায় বসে আছে।রিনির দিকে তাকিয়ে বললো হাত দিয়ে খাবে নাকি আমি খাওয়াবো।রিনি বাকরুদ্ধ হয়।কি বলবে সে?আচ্ছা খাওয়ায় দাওয়ায় শক্তি বানিয়ে কি ইচ্ছা মতো পেটাবে?যাতে মার খেলেও হজম করতে পারি? অবাঞ্চিত প্রশ্ন গুলো খচমচ করছে তার মনে।ভাব ভালো না আসলেই।মেঘের গুরুম গুরুম ডাক হয়তো এখনও বিদ্যমান।খাওয়া হলেই ফেটে পরবে।রিনির হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো।কপালে চিনচিনে ঘাম।মার তো কম দেয় নি দিহান পড়ার জন্য। রেজাল্টের জন্য দিতেই পারে।স্বাভাবিক।
ইতিমধ্যেই দিহান মুখের সামনে ভাতের লোকমা ধরলো।রিনি বিনাবাক্যে গোগ্রাসে গিলতে রইলো।হাত ধুয়ে মুখ মুছে রিনির সামনে বসে।ভাবুক চিত্তে বলে
–“তো কি বলতে এসেছো?”
রিনির কান্না পাচ্ছে না।তবু নাকে ফ্যাচ ফ্যাচ করতে করতে বললো
–“রেজাল্ট দিহান ভাই।আম সরি।আই নেভার থট দ্যাট উড হ্যাপেন। ”
–“আমিও ভাবি নি। কিন্তু হয়েছে তো। এতে তো কান্না কাটির কিছু দেখছি না আমি।কাদছো কেন?”
রিনি আবার ফ্যাচ ফ্যাচ করে বললো
–“আপনি এতো চেষ্টা করলেন।”
দিহান রিনির মুখোমুখি বসলো।রাশভারী কন্ঠে বললো
–“রিনি আমি চেষ্টা করলে তোমার কিছুতেই হবে না।আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিলো তোমাকে প্রোপার গাইড দেয়া।কিন্তু একশ পার্সেন্ট দেয়া তো কারো পক্ষেই সম্ভব না আমিও হয়তো পারি নি। রেজাল্টের থেকে চেষ্টা বড়।তোমার রেজাল্ট আমি জাজ করেছিলাম তোমার চেষ্টা দেখে।কিন্তু আশানুরূপ হয় নি একটু কষ্ট পেয়েছি সত্যি কিন্তু তুমি চেষ্টা করেছো এটাই দেখার বিষয়। সফলতা মানুষের হাতে থাকে না ভাগ্যে থাকে কিন্তু চেষ্টা মানুষের হাতে থাকে।আর তুমি যখন সেটাই ভালো ভাবেই করেছো তা নিয়ে আমার অভিযোগ নেই।একটা ঘুম দিয়ে উঠেছি মাথা ফ্রেশ, এখন আমার মন খারাপ নেই, রাগ নেই, অভিযোগও নেই কিচ্ছু নেই।স্বাভাবিক হও।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো দিহান। তারপর আবার বললো “বুঝেছো?”
রিনি দু দিকে মাথা নাড়ায়।ঠোঁট উল্টে আবার বলে
–“সত্যি তো?”
–“কিভাবে বললে বিশ্বাস করবে?”
রিনি চাতুরী হাসি দিলো।বললো
–“প্রাক্টিকালি দেখাই?”
দিহান সরু চোখ করে বললো
–“থাক এই রাতে প্রাক্টিকাল কিছুই দেখার ইচ্ছা নেই। ”
–“দেখেন না প্লিজ।”
দিহান উঠে দাড়ায়।রিনির হাত ধরে টানতে টানতে দরজা দিয়ে বাইরে নামে।রাতের আকাশে এক ফালি চাঁদ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরিত্রীতে।দিহান টানতে টানতে গাছের পাশে নিয়ে এলো।
–“ফটাফট উঠে পরো রিনি। ”
রিনি ওঠে না।হাটু গেড়ে বসে পরে।দিহান বিস্ময়ে ফেটে পরে।চাপা আওয়াজে বলে
–“রাত কি গাছ তলায় কাটাতে চাচ্ছো?”
গাছের ডালপালায় আরও অন্ধকার দেখাচ্ছে।দুটো মানুষের অবয়ব ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রিনি গলায় পেচানো ওড়নাটা খুলে হাতে নিয়ে বলে
–“আমি তোমাকে ভালোবাসি দিহান ভাই। উইল ইউ ম্যারি মি?”
দিহান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।এই পাগলকে কিভাবে ফিরায় এখন?বুক ধক করে ওঠে তার।ভেতর থেকে হাজার বার একই উত্তর আসছে।উত্তর একটাই ‘হ্যা’।
–“হাতের ওড়নাটা কি গোলাপের রোল প্লে করছে?”দিহান বললো।
রিনির গলা রাশভারী।ভেতর থেকে গভীর আবেগ নিয়ে বললো
–“হ্যা।”
–“এমন প্রোপজ আগেই প্লান করে এসেছিলে?”
–“না।কিন্তু আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন।আপনি আজ কথা ঘোরালে আমি সত্যি বাচবো না।”
রিনির গলা একরকমই।পরিবর্তন এটুকু যে কাপছে কন্ঠস্বর।
দিহান ভয় পায় না।ভাবে হ্যান্ডেল করা তার কাছে কোনো ব্যাপার না।রিনির হাত ধরে দাড় করায়।হাত থেকে ওড়না নিয়ে নিজের হাতে পেচিয়ে নেয়।
শান্ত ধীর আওয়াজে বলে,
–“আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দান করলে ইনশাআল্লাহ। এমন মিষ্টি মেয়েকে ফিরিয়ে দেবো না আমি।এমন মায়াবতীকেই বিয়ে করবো।”
–“ওহ এমন মায়াবতী? কিন্তু আমায় না তাই না?”
দিহান ভেবে ছিলো রিনি এতেই খু্শি হবে।সে বোঝে রিনি আর ওতো ছোট নেই।ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলা কথা গুলো এখন বেশ বুঝে নেয়।
রিনি চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে উত্তরের অপেক্ষায়।
–“আমি মায়াবতী তোমাকেই ডাকি।”দিহান বললো।
–“প্রমাণ কি?তাহলে ভালোবাসি বলেন।”
দিহান কথা বলে না।রিনি ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য আগায়।দিহানের মনে এবার ভয় জাগে।শক্ত করে জড়িয়ে নেয়।বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।ভেজা কণ্ঠে বলে,
–“কিছু করো না রিনি।আমায় সময় দাও।প্লিজ সময় দাও।তুমি বড় হয়েছো, বুঝাতে চাচ্ছি না কিছু আমি।পাগলামি করো না।”
রিনি শুকনো হাসি ছুড়ে দেয়।
–“কানে শোনার খুব ইচ্ছা জাগে দিহান ভাই।মনে মনে তো হাজার বার শুনেছি।”
দিহান গম্ভীর হয়। রিনির শুকনো ওষ্ঠ ভিজিয়ে নেয়।জানে তার দিহান ভাই কষ্ট পাচ্ছে।ভালোবাসি বলতে না পারার কষ্ট, চাপিয়ে রাখার কষ্ট । রিনি আর ঘাটায় না।কেন ঘাটালো তাও সে জানে না।
–“হেল্প করেন উঠবো।”
দু বার বলার পরও দিহানের হেলদোল নেই।রিনি চট করে দিহানের গালে হাত দেয়।ভেজা গাল অনুভূত হয় তার।চমকে ওঠে সে।সাথে সাথে দিহান পেছনে সরে যায়।রিনি আর কথা বাড়ায় না।গাছ বেয়ে উঠে যায়।মনে মনে শপথ করে আর কখনো ভালোবাসি বলতে বলবে না সে।সব জেনেশুনে কষ্ট দেয়ার মানেই হয় না।
____________
রিনি দীপ্তি কলেজে ভর্তি হয়।একসাথে দুজনের রিকশায় যাতায়াত। প্রথমে দীপ্তি নেমে যায় এরপর রিনির কলেজের সামনে এলে রিনি নেমে যায়।দিন মাস এভাবেই পার হচ্ছে।দিহানের কাছে শুধু ইংরেজি সাবজেক্টটা পড়া হয়।আর সব বাইরে কোচিং করে দুজনই।সব মিলিয়ে হাতে গোনা টাইম।দিহানের প্রাইভেট, টিউশনি, কোচিং,ভার্সিটি, রিনি, নিজের বোন সব মিলিয়ে ভালো যাচ্ছে।ব্যস্ততা থাকলেও দিন শেষে ঘরের দরজায় দাড়াতেই যখন দেখে ব্যালকুনিতে মায়াবতী তার জন্য গভীর ভালোবাসা, চোখে একরাশ আকুলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঘাম মুছে ক্লান্তি দূর করার আগে ওই হাসিতেই তার ক্লান্তি উবে যায়।
রাতের বেলা ফুসকা, আইসক্রিম কিনে প্রায়ই টুন করে একটা মেসেজ দেয়।রিনি তখন বারান্দা থেকে রশি সাথে ঝুড়ি বেধে ঝুলিয়ে দেয়।দিহান সেই ঝুড়িতেই খাবার রেখে দেয় আর রিনি টেনে টেনে তুলে বারান্দায় বসেই খায়।দিহান ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তার বেশ প্রশান্তি লাগে এটা দেখে যে তার প্রেয়সী অল্পেই কতো তৃপ্ত।রিনি মাঝে মাঝে দিহানের ঘরেই চলে যায় এসব একসাথে খেতে,মাঝে মাঝে পড়ার কথা বলে রাত দশটা এগারোটা অব্দি অনায়াসে কাটিয়ে দেয়া যায় দিহানের বাসায়।রিকশায় ঘোরাঘুরি, বেশ কয়টা স্থানে ঘুরতেও গিয়েছে ছুটির দিনে তিনজন মিলে।এক রিকশায় তিনজন।তবে মাস ঘুরতে না ঘুরতে রিনির স্বাস্থ্য অনেকটাই চোখে পরার মতো ভালো হয়েছে।রিকশায় তিনজন আগের মতো সাবলিল ভাবে ওঠা যায় না।
____________
দুপুরে খাওয়ার সময় রিনি আসে।দিহান দীপ্তি খাচ্ছে তখন।দীপ্তি রিনিকে ডাকে।চেয়ার টেনে বসতে বলে।
খেতে খেতে বলে
–“খাবে রিনি?”
–“খেয়েই এসেছি। তবে দিলে খেতে পারবো।”বলেই ফোলা গালে হাসি টানে রিনি।
–“আমার খালি ক্ষুধা পায় খালি ক্ষুধা পায়।” টেনে টেনে আবার বললো রিনি।
–“আসলেই রিনি চারমাসে তোমার অনেক চেঞ্জ হয়েছে।”দীপ্তি বলে।
দিহানও শায় দেয়।মজা করেই বলে
–“রসগোল্লা হয়ে গেছে।”
–“না ভাইয়া, রিনি বেসাইজের মোটার দিকে যাচ্ছো দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
দিহান কিছু বলে না। এ নিয়ে তার মাথা ব্যাথাই নেই তেমন। ভালোবাসা যেমনই হোক সেটা ভালোবাসাই।
–“আরে আমি প্রচুর খেতে পারি এখন।বলতে পারো সারাদিন মুখ চলে। আমাদের সাথে খেলে দেখতে পেতে।কি যে করি খালি ক্ষুধা পায়, না খেয়েও পারছি না।”
দীপ্তি হাত ধুতে ধুতে বলে
–“ভুরিই বেশি বাড়ছে তোমার।অয়ার্ক আউট করো।দাড়াও খাবার আনছি।কি খাবা দেখে বলে যাও তো।”
দীপ্তি রিনি হাসাহাসিতে মেতে ওঠে।কি ব্যায়াম করবে না করবে এসব আলোচনা। তবে দীপ্তির কথাটা দিহানের কানে বেশ বাজলো।রিনির সাথে যে সম্পর্ক হয়েছে তাতে শারীরিক পরিবর্তন হতে পারে ঠিক আছে কিন্তু এতো?আর দিহান ওতো কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে কখনোই খেয়াল করে নি। অপ্রস্তুত ভাবে খাবার নাকে গেলো তার।
_______________
টিফিন টাইমে রিনির ফোন বেজে উঠলো।দিহান ফোন করেছে।সাবধানে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে শোনা যায়
–“ব্যাগ নিয়ে চলে আসো গেটেই আছি।”
রিনিও তাই করলো।গেট থেকে বের হতেই দেখে রিকশায় দিহান, দীপ্তি বসা।রিনি বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে
–“ঘুরতে যাচ্ছি আমরা?”
–“হ্যা। দাড়াও রিকশা ডাকি আর একটা। ”
রিনি বাধসাধে,
–“তিনজনই যাই না।”
–“তোমারই কষ্ট হবে রিনি।আগের বারও এতোটা মোটা ছিলা না।তাও ঘুরতে গেছি একমাস আগে।”
রিনি ঠোঁট উল্টে বলে
–“কষ্ট হলে আমার হবে।তোমার কি?”
দিহান দীপ্তি হাসে।দিহান বলে
–“আমি তোমার সাথে একা যাবো রিনি।দীপ্তু অন্য রিকশায় যাবে। আর কোনো কথা না।”
তেমনটাই হলো।রিনি মাথা এলিয়ে দিলো দিহানের কাধে।দিহান বাতাস করছে হাতের খাতাটা দিয়ে।মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছে
–“ক্লান্ত লাগছে?”
রিনি সাফসাফ জানিয়ে দেয় “না”
–“তাহলে গা ছেড়ে দিছো যে?”
রিনি হেসে বলে
–“একটু লাগছে।”
বলার ভঙ্গিতে দিহানও হেসে দেয়।
কিছুদূর রিকশা যেতেই রিকশা ওয়ালা দাড়িয়ে যায়।দীপ্তি বেখেয়ালি ছিলো।রিকশায় লাফ দিয়ে একটা ছেলে ওঠে।হকচকিয়ে যায় দীপ্তি।চিৎকার দেয়ার আগেই অতিপ্রিয় মুখটা দেখতে পায়।আতংকে চোখ বুজে ছিলো সে এতোক্ষন।বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরে।চোখ থেকে খুশিতে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।রিকশা চলছে।তনয় শক্ত করে গাল দুটো চেপে ধরে দুই হাতে। যত্নে গড়িয়ে পরা মুক্ত কণা মুছে দেয়। দীপ্তির মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে
–“ভাইয়া এ জন্য? ”
তনয় চোখ বুজে সম্মতি জানায়।দীপ্তির চোখের বাধ আবার ভাঙে।কতো মাস পরে দেখা।ছবিতে দেখা আর সামনা সামনি দেখার আকাশ পাতাল তফাত খুজে পায় সে।তনয় প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।সে কারো কান্নার কারণ হতে পেরেছে এই তো অনেক!
কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে
–“ভালোবাসা তো সব চোখ দিয়েই গড়িয়ে পরবে।এই ঘাটতি আমি মানবো না একদম।”
____________
দুইপাশে সবুজের সমারোহ। মধ্যখানে পরিষ্কার রাস্তা।আর দুইপাশেই বিল। অপরূপ পরিবেশ প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেয়ার জন্য।দীপ্তি তনয় বেশ খানিক সামনে। রিনি দিহান আস্তে আস্তে হাটছে। দিহানের মন খচ খচ করছে।মধ্যে জড়তা-সংকোচে আটকে এলেও জিজ্ঞেস করতে হবে একটা প্রশ্ন।কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো সে।
–“রিনি তোমার শরীর ঠিক আছে?”
রিনি ঠনঠন করে হেটে বললো
–“হুম কোনো সমস্যা নেই।”
–“না মানে কোনো পরিবর্তন নেই?”
–“যা পরিবর্তন তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।মটু হয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন।” কথাটা বলে হাসলো রিনি।
দিহান ভেবেই পায় না কিভাবে জিজ্ঞেস করবে।স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও তার লজ্জা লাগছে।রিনি কি ভাববে না ভাববে।ভাবতে ভাবতেই সে ঠিক করলো লিখে দেবে।তাই ই করলো।রিনির দিকে কাগজটা এগিয়ে দিতেই সে যেনো দ্বিগুণ লজ্জা পেলো।কাগজটা হাতে মুচরে মাথাই তুলছে না।দিহানের এতে আরও লজ্জা লাগলো। কিন্তু লজ্জা পাওয়ার সময় না জানতে হবে,
–“রিনি বলো আমার জানা প্রয়োজন।এটা নরমাল ব্যাপার বলো।”
রিনি মিয়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে
–“হ্যা তাই তো লিখে দিছেন।”
–“আচ্ছা বুঝলাম বলো এবার।”
রিনি কথা বাড়ায় না। মাথা নিচু করেই বললো
–“সব ঠিক আছে।”
দিহান আটকে থাকা নিশ্বাসটা ছাড়লো।এই চিন্তাটা বেশ হয়রানি করছিলো তাকে।সব ঠিক হলেই ভালো।আবার সে পুরো উদ্দ্যমে হাত ধরে হাটে।
চলবে