নিশীথচিত্র পর্ব ৩৮+৩৯

‘নিশীথচিত্র’ (৩৮)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

____________

ফোলা ফোলা গাল নিয়ে মিটি মিটি হাসছে রিনি।দিহানের সেদিনের প্রশ্ন ভাবলেই লজ্জা আর হাসিতে কুটি কুটি হয়ে যায় সে।!আয়নার সামনে দাড়িয়ে কতোক্ষণ মনোযোগ সহকারে নিজেকে দেখলো।কি মটু মটু লাগছে! আর মটু হতে দেয়া যাবে না।ডায়েট কন্ট্রোল করতে হবে এমন সব চিন্তা ভাবনা নিয়ে ডুবে আছে রিনি।মনে পরলো আসরের নামাজ পড়া হয় নি। ওযু করে নামাজটা আদায় করে নেয়।আলাদা প্রশান্তিতে সিক্ত হয়ে যায় তার মন।বিছানার পাশে বসে ফোন স্ক্রলিং করছে।এমন সময় রেহানা এলো। হাতে ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার।রিনির সামনে দিতেই তার খুশির শেষ নেই।রেহানা মেয়ের খাওয়া দেখে হাসে।মায়েদের কাছে সন্তান যতোই খাক তবুও বলবে আর একটু খেলে ভালো হতো।আস্তে আস্তে রিনির সাথে গল্প জুড়ে দেয় সে।কথার এক পর্যায়ে বলে

–“তুই এখন যেমন মোটা হয়েছিস আমাদের বংশের প্রত্যেকটা মেয়ে এমন মোটা হতো প্রেগ্ন্যাসির সময়।আমিও কি শুকনো হ্যাংলা ধাচের ছিলাম যখন রিমি পেটে এলো তখন তরতর করে স্বাস্থ্যের উন্নতি।রিমিকে দেখিস নি কেমন মোটা হইছিলো বাচ্চা পেটে থাকতে?”

–“হ্যা”
রিনি কথা শুনছে আর হাসছে।রেহানার কপাল হুট করে কুচকে গেলো।নিজের কথার জালে নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হলো।জোরপূর্বক মুখে আগের হাসি টেনেই বললো

–“তোর শরীর ঠিক ঠাক রিনি?”

রিনি মাথা না তুলে খেতে খেতেই বললো

–“হুম মা ঠিক ঠাক।”

মাথায় যে প্রশ্নটা নাড়াচাড়া দিচ্ছে সেটা রেহানার একদমই করতে ইচ্ছে করছে না।তবুও বললো

–“তোর রেগুলার পিরিয়ড হয়?”

রিনি খাচ্ছে মন দিয়ে খাচ্ছে।মায়ের কথা শুনে দিহানের প্রশ্নটা মনে পরে যায়।মুহুর্তেই খানিক লজ্জা অনুভব করে সে।এরপর সাবলিল কন্ঠে বলে

–“না মা চার মাস ধরে হচ্ছে না।তোমাকে বলবো বলবো করে বলা হলো না।ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে এই মাসটা দেখি তারপর বলবো।এমন করতে করতে বলা হলো না।এখন তুমিই জিজ্ঞেস করলে।”

রেহানার মুখ যতটা সংকুচিত হওয়া যায় ততটা হলো।মুহুর্তের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো।তবুও নিজেকে শান্তনা দিকে স্বাভাবিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করলো।কিছু না বলেই হেটে চলে গেলো।সন্দেহবশত উল্টো পাল্টা আচারণ করতে চায় না মেয়ের সাথে।হতেও পারে শারীরিক অন্য কোনো প্রবলেম হয়েছে।ডাক্তার পরে দেখাবে আগে নিজে সিওর হতে চায় সে।

সন্ধ্যার পরে রেহানা আবার এলো রিনির রুমে।রিনি ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে দিহানের অপেক্ষা করছিলো।দিহান আসলেই প্রথম সে মুখ দেখে আর আজও দেখবে মনে এমন তীব্র প্রয়াস।মায়ের ডাকে দাঁড়িয়ে থাকা হলো না আর।রুমে এসে দেখে রেহানার বিপন্ন চেহারা। অতিরিক্ত চিন্তা করছে কপালেই ছাপ পরে গেছে তার।রিনি মায়ের পাশে বসে

–“কিছু হয়েছে মা?”

রেহানা জোরপূর্বক হাসি টানতে চায় মুখে।পেরে ওঠে না সে।রিনির হাতে কাগজে মোরানো কিছু একটা ধরিয়ে দেয় সে। রিনিকে বলে দেয় কি করতে হবে। রিনি সাভাবিক ভাবেই নেয়।ঘাটায় না।দিহান আসার সময় হয়েছে তীব্র তাড়া তার মাঝে।রেহানা বললো

–“এতে তোর শরীরের অনেকটা সমস্যা বোঝা যাবে।কাল না হয় ডাক্তার দেখালাম।যা এখনই দে আমায়।”

দিহানের এসে পরবে এই নিয়ে রিনি আপাতত খুব চিন্তিত।মাকে পাঠাতে পারলে বাচে।তাড়াতাড়ি করে রেহানার কথা মতো কাজ করে রেহানাকে বিদায় দেয় সে।দ্রুততম পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়।দেখতে পায় দিহান দাড়ানো দরজার সাথে ঠেকনা দিয়ে দাড়িয়ে আছে ।রিনি মুখের সব চেয়ে বড় প্রসস্থ হাসিটা ছুড়ে দেয় দিহানের দিকে।দিহান মিটি মিটি হেসে দরজা নক করে।দীপ্তি দরজা খুলে দিতেই রিনিকে দেখে।দুই চার ছোড়া কথপোকথন সম্পন্ন করে যে যার ঘরে চলে যায়।

রিনি বেশ কিছুক্ষণ ধরে টানা বই পরছে।হুট করে মনে হলো মা যেটা হাতে দিয়েছিলো সেটা সে আগেও টিভিতে বা কোথাও দেখেছে।চকিতে তার মনে হলো রেহানা তাকে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট কিট দিয়েছে।কিন্তু তার মা তাকে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট কিট কেনো দিবে?প্রশ্নবিদ্ধ হয় সে।নয় ছয় ভাবতে ভাবতেই ফোনে সার্চ দিলো কিছু প্রশ্নের উত্তর।যে উত্তর গুলো সে পেল তার ভেতর নাক মুখ কান থেকে মুহুর্তেই গরম ভ্যাপসা ধোয়া বের হচ্ছে মনে হলো।দৌড়ে নাক মুখে পানি দিয়ে এলো।বেশ কিছুক্ষণ ঝাপটা দেয়ার পর হাসফাস লাগছে প্রচুর।হিতাহিতজ্ঞান শূন্য লাগছে। ধপ করে বিছানায় বসে পরলো সে।কিছু ভেবে চিন্তে যেনে বুঝে না করলে বুঝি এমনই হয়।ইতিমধ্যেই মাতার প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা টনটন করে জানান দিলো অসহ্য ব্যাথার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারা।দিহান ভাই ও নিশ্চয়ই এর জন্যই প্রশ্নটা করেছিলেন?

রিনি দরজাটা আটকে দিলো।চিন্তায় ভয়ে আতংকে মাথার চুল টানছে সে।রাতে কেউ খেতেও ডাকলো না তাকে।সাহস হয় নি নিচে যাওয়ার।জগ দিয়ে ঢেলে ঢেলে শুধু পানি খাচ্ছে।বার বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার।ক্ষুধার কথা আপাতত তার মনে নেই।দিহানের নম্বরে ছোট্ট একটা বার্তা পাঠালো সে,

“দিহান ভাই আপনি রাতে আমার সাথে একটু দেখা করতে আসেন।আপনাকে আমার প্রয়োজন।”

দিহান মেসেজটা দেখে। চিন্তা মাখা মেসেজ দেখেও সে খানিক মজায় নেয়।বার্তা পাঠায়

“না বাবা! তোমার কাছে ওই রাতে যাওয়া নিরাপদ নয়।তুমি পুরোটাই অনিরাপদ।”
দিহান পরাপর আবার মেসেজ দেয়।
“তুমিও তো আসতে পারো।আমার থেকে তোমার প্রাক্টিস বেশি।”
দিহান মূলত মজা করেই কথাটা বলে।মোটা শরীরে নামতে পারবে না সে জানে।রিনির কান্না পায় যেন।

“দিহান ভাই মজা করার সময় না। আপনাকে আমি কিছু বলতে চাই প্লিজ আসেন।আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দিহান ভাই।আপনাকে আমার প্রয়োজন। প্লিজ দিহান ভাই পা ধরি আপনার প্লিজ আসেন।”

দিহানের কপালে চিন্তার ছাপ।হঠাৎ কি হলো?শত ভেবেও ভেবে পায় না সে।সে জানায়

–“আচ্ছা তুমি টেনশন করো না আসবো আমি।”

রাত দশটা এগারোটা গড়িয়ে যায়।রিনির রুমে ওর মা আসে না।রিনি অনবরত কেদে চলছে।কি করবে? কি হবে? কি হতে চলেছে? মা তো জেনেই গেলো।হাসি খুশি সময়টার সমাপ্তি এভাবে লেখা ছিলো?

____________

রাত একটা গড়ায়।কাদতে কাদতে চোখ মুখ ফুলে লাল।তবু কান্না তার ইতি টানছে না।বুক ভেঙে কান্না ভয় লজ্জা সব লাগছে।বাবা জানলে কি হবে? মেরে ফেলবে নিশ্চয়ই! রিনি আবার হু হু করে কেদে ওঠে।সে কি মরে যাবে? মৃত্যু কখনো সল্যুশন হয়? গুগল ঘেটে যে টুকু জেনেছে। সে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হবে ধারণা মোতাবেক। সেটাই হবার কথা।বাচ্চাটার কি হবে?তার মা কি মেরে দেবে এই বাবু?এই সময় তো বাচ্চা নষ্টও করা যায় না।নানান চিন্তা নিয়ে রিনি শুধু কেদেই চলছে।

রাত একটার আশপাশ সময়ে দিহান দরজা ভিজিয়ে প্রবেশ করে।রিনি হাটুতে মাথা গুজে আছে।পাশে টেবিল ল্যাম্পটা অনবরত আলো দিয়ে যাচ্ছে।দিহান বিড়াল পদক্ষেপেই এগোয়।রিনির ভাবগতি বোঝা দায়।মজাও করতে পারে।আচমকা কাধে হাত দেয়।রিনি সাবলীল ভাবেই মাথা তোলে। তার উপস্থিতিতে ভয় পেয়েছে মোটেই না।মুখ তুলতেই দিহানের পিলে চমকে যায়।এ কি অবস্থা মুখের।চাপা কণ্ঠে প্রশ্নটা করে দিহান।রিনির চোখ দিয়ে মোটা মোটা পানির ফোয়ারা পুনরায় গলতে শুরু করে যেন।দিহানের বুকটা ধুক করে ওঠে।মিষ্টি মায়াবতীটার এ কি দশা?সন্ধ্যায়ও তো ঠিক ছিলো।কি হলো এমন?বকেছে কাকা কাকি নাকি তার উপর কঠিন অভিমান করেছে?কিন্তু সে তো কিছু করে নি। নানান প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।বুকের মধ্যে থেমে থেমে হু হু করে উঠছে রিনির কান্না দেখে।

দিহানের বুকে ঝাপিয়ে পরে রিনি।দিহান মুখ টেনে নিজের দিকে ফেরায়।মধ্য সিতির চুল কানের দু পাশে গুজে দেয়।আলতো করে গাল দুটো ধরে জিজ্ঞেস করে

–“কি হয়েছে?”

রিনির কিছু বলতে পারে না।দিহান যে ভয়ে লুকিয়ে রেখেছিলো নিজেকে। আজ দিহানকেই সে জলে ভাসিয়ে দেবে।শুধু মাত্র নিজের বোকামির জন্য।

–“না বললে বুঝবো কিভাবে রিনি?বলতে হবে আমাকে।বলো? কাদলে হবে না বলো।”

–“প্রেগন্যান্ট আমি দিহান ভাই।”

রিনির ভাঙা ভাঙা কথা গুলো দিহানের কানে বজ্রপাতের মতো শোনালো যেনো।জড়িয়ে ধরা হাত দুটো আগলা হয়ে এলো।রিনির বেদনাময় বিস্ময় ভরা চোখ কোনো উত্তর পাওয়ার জন্য তাকাইয়ে আছে।চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে কিন্তু নির্বিকারে।দিহানের হাতের বাধন তার পিঠময় থেকে সরে আসছে।তার চোখ আরও ভীত হয়ে ওঠে।দিহানের স্তম্ভিত ফিরে আসে।হাতের বাধন আবার শক্ত করে ধরে।রিনি প্রাণ ফিরে পায়।দিহান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিনির মাথা কাধে চেপে ধরে।পিঠে হাত বুলাচ্ছে থেমে থেমে।কিন্তু সে নির্বিকার। রিনি অতিরিক্ত ভয় পেয়ে যাচ্ছিলো তাই ই ভরসা দেয়ার চেষ্টায় সে।দুজনের ভুলের বাচ্চা যে বহন করবে তারই কেন মাশুল দিতে হবে?ভুল তারও ছিলো রিনিও। বাচ্চা রিনি বহন করছে বলে হাপ ছেড়ে বেচে নিজেকে কাপুরষও বানাতে পারবে না সে।দায়িত্বজ্ঞান তার লোপ পায় নি এতোটাও।তবুও ভয় হবে কি এর পরিনতি?যেসব নাম দিয়ে বেচে বেড়াতে চাইতো সেসব নামই তার হতে চলেছে?এখন আরও বাড়ছেও?রিনিকে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো।হিতাহিতজ্ঞান শূন্য লাগছে হতাশ লাগছে।বেশ কয়বার বিরবির করে আল্লাহর সাহায্য চাইলো।

রিনিকে মুখ টেনে তুললো দিহান।নিজেকে সাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কিন্তু ভেতর থেকে ততোটাই কাবু হয়ে আছে সে।শান্ত আওয়াজে জিজ্ঞেস করে

–“কিভাবে জানলে?সেদিন না আমি জিজ্ঞেস করলাম বললে সব ঠিক ঠাক।”

রিনির অপরাধবোধ কাজ করলো।সেদিন ঠিক ঠিক উত্তর দিলে আজ অন্তত মায়ের কাছে ধরা খেতো না।কিছু একটা ব্যবস্থা হতো অন্তত ।রিনি সবটা খুলে বলে।দিহানের ধৈর্য্য যেন আর নেই।

–“কাকি তো জেনে গেছে তাহলে?কিছু বলে নি?”

–“না আর রুমেই আসে নি। ”

–“ভেবো না যে আসবে না।আসবে আর তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে।ভয় নেই আমি আছি।”

মলিন হাসে দিহান।রিনি ভয়ে কাপছে। সাভাবিক করার চেষ্টা মাত্র।দিহান হতাশ চিত্তে জিজ্ঞেসা করে

–“সেই রাতের পরের দিন আমি তোমাকে একটা ট্যাবলেট দিয়েছিলাম খাও নি তাই না?”

রিনি কাদতে কাদতেই জবাব দিলো
–“আপনি বলেছিলেন শরীরে ব্যাথার ঔষধ ।কিন্তু তখন আমার তেমন শরীরে ব্যাথা ছিলো না তেমন।তাই খাই নি। ”

দিহান দুই হাত এক করে মুখময় কপালে ঠেকালো।সম্পর্কটা শুরু হলে হয়তো এসব বিষয় খোলাখুলিভাবে বলেই সব করা যেতো। লজ্জার জন্য এমন ত্রুটি বিচ্যুতির কারণেই আজ পরিস্থিতি এখানে।সেদিন তো প্রেগ্ন্যাসির নিরোধক ট্যাবলেট দিয়েছিলো দিহান।লজ্জার কারণে বলেছিলো শরীরের ব্যাথা যাবে। তবুও গুরুত্ব নিয়ে বার বার বলেছিলো খেতে। নিজের কিছু কমতি রিনির কিছু বোকামি সব মিলিয়ে।দিহান দীর্ঘশ্বাস ছারে।নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।আবার ভাবে রিনি আর তার সন্তানের কি হবে? দুনিয়ায় আসতে তার তো চার কি পাঁচ মাস।এর মধ্যে কি হয়ে যাবে কে জানে?বিয়ে করতে চাইলে রিনিকে বিয়ে দেবে তার সাথে?নানান প্রশ্নে দিহানের মাথা দপদপ করে উঠছে।রিনি দিহানের হাত ধরে ঝাকায়।দিহান তাকায় রিনির দিকে। এক জোড়া করুণ চোখ তার দিকে বন্ধি।দিহানের দৃষ্টি স্থির। রিনির ভয় লাগছে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে না তো?

দিহানের কন্ঠ শোনা যায়। বলে
–“ঔষধটা প্রেগনেন্সি নিরোধক ছিলো।”

রিনি কি বলবে বুঝতে পারে না।বরফ হয়ে থাকে। কান্না পায় ভেতর থেকে।চোখ দিয়ে পানি আর বের হয় না।কান্নাও মুখ ফিরিয়ে নিলো যেন।

–“ভয় পেও না।বাচ্চা নষ্ট করার কথা ভাবছি না।আর সম্ভবও না।ভাবছি তোমার বাবা মা আমার সাথে তোমার বিয়ে দিবে?”

রিনি নিশ্চুপ।দিহানের ডায়েরিতে এই প্রশ্নটাই হাজার বার ছিল। আবেগ ভালোবাসাময় নানান চিঠি রিনির উদ্দেশ্যে ছিলো সেই ডায়েরিতে। লুকিয়ে দিহানের ডায়েরি পরতো সে।সেখান থেকেই দিহানের মনের কথা সব জানতো ।দিহান ডায়েরিতে লিখতো “শাড়ি পরা দেখতে পেতাম যদি “আর তাই ই রিনি দিহানের বার্থডেতে শাড়ি পরেছিলো। এমন নানান স্মৃতি আছে। ডায়েরির প্রতি পাতায় “আই লাভ ইউ নিনিপাখি” “ভালোবাসি মায়াবতী ” “তোমাকে ভালোবাসি রিনি”

এমন হরেক রকমের ভালোবাসার বর্নবিন্যাস পেতো সে।লুকিয়ে লুকিয়ে লুফে নিতো ডায়েরির ভালোবাসাময় বাক্যগুলো। নানান রেস্ট্রিকশন লিখে রাখতো তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে দিহাব।কি হলে কি হবে এসব আগে থেকেই লিখে রাখতো। সবটাই জানতো রিনি।আমলে নিতো না একদম।তবে আজকের পরিস্থিতি দিহানের ডায়েরির কোথাও লেখা ছিল না। কিন্তু আজ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বড্ড কঠিন লাগছে তার দিহানের প্রশ্নটাও।

রিনির উত্তর না পেয়ে শুকনো হাসি দেয় দিহান।চোখে মুখে ফুটে ওঠে ভবিষ্যৎ লাঞ্চনা।
স্থির দৃষ্টিতে রিনির পেটের দিকে তাকিয়ে থাকে দিহান।দৃষ্টি অনুসরণ করে রিনিও নিজের উদরের দিকে তাকায়।অসহায় লাগে খুব।ভয় লজ্জার মাঝেও মাতৃত্ব অনুভূতি জেগে ওঠে তার।কেমন একটা নতুন অনুভূতি। দিহানের আওয়াজ শোনা যায়।দৃষ্টি তখনও রিনির উদরে

–“ওর মা বাবা কতো নোংরা তাই না?ওকে নোংরা একটা পরিচয় নিতে হবে। দুনিয়ার আবহাওয়া না যেনেও কতো যুদ্ধ করতে হবে ওর তাই না?”

রিনির চোখে জল ভরে ওঠে। আস্তে আস্তে গড়িয়েও পরে। দিহানও নিজের চোখের উপচে পরা পানি লুকাতে ব্যস্ত।রিনি দিহানের বুকে ঝাপিয়ে পরে।হাউমাউ করে কেদে ওঠে।কান্নারত ভগ্ন কণ্ঠে বলে

–“আপনি আমাকে বিয়ে করেন দিহান ভাই। এক্ষুনি এক্ষুনি। ”

–“এভাবে বিয়ে হয় না রিনি অপেক্ষা করো।”

–“হয়। আপনি এখনই কবুল বলবেন এখনই।”

দিহান বুঝায় হয় না এভাবে বিয়ে।কিন্তু রিনির জেদের কাছে পরাস্থ হয় সে।বুঝতে পারে মায়ের মন তৈরি হচ্ছে রিনির।নিজের সন্তানকে বাজে ট্যাগ থেকে বাচাতে চাইছে।শান্তনা দিতে তিনবার কবুল বলে দিহান।রিনিও বলে দেয়।কে জানে কেমন বিয়ে হলো!কিন্তু রিনির কাছে সন্তানকে বাজে নাম থেকে বাচানো হলো।বুদ্ধি তার এখনও হাটুতে। এসব ভেবে দিহান প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস টানে।কাল কি আছে ভাগ্যে কে জানে?

সারা রাত রিনি দিহানের বুকের উপর শুয়ে ছিলো।রিনির চোখের পানিতে দিহানের বুক চিপচিপে হয়ে গেছে।এক হাতে রিনিকে আগলে অন্য হাতে গভীর চিন্তা করছে সে।কি করবে, কি করা উচিত কি না করা উচিত।পূর্ব চিন্তা পূর্ব প্রস্তুতি।

এক সময়ে রিনির দিকে তাকায় ঘুমিয়েছে হয়তো।সন্তপর্ণে বিছানায় শুইয়ে দেয়।কপালে চুমু খায়,ইচ্ছে দমাতে না পেরে উদরেও চুমু খায়। এরপর চলে যায় সে।

___________

সকালে প দরজায় প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কিতে উঠে দরজা খোলে রিনি। ঘুম থেকে ওঠার দরুন কিচ্ছু মনে নেই রাতের কথা তার আপাতত । তার কাছে প্রত্যেক দিনের মতোই একটা সকাল। শুধু মাথাটা ভার ভার লাগছে।দরজা খোলার সাথে সাথে হকচকিয়ে যায় সে।মুনির হোসেনের চোখ দেখে কেপে ওঠে রিনি। পাশে রেহানাও আছে । গালে থাপ্পড় পরতেই চৈতন্য ফেরে রিনির।মনে পরে যায় সব কথা।থাপ্পড়ের পর থাপ্পড় গালে পরতেই থাকে।হাত দিয়েও কোনোমতে আটকাতে পারে না সে।মারের পরিমাণ বাড়ে হাত দিয়ে মারা বাদ দিয়ে লাঠি হাতে উঠায় মুনির।না চাইতেও চিৎকার দিয়ে কাদে রিনি।

দিহানের ঘুম হয় নি। চিৎকার শুনে দরজার সামনে দাড়ায় দিহান।হাত পা শিথিল হয়ে আসে তার।

চলবে,
‘নিশীথচিত্র'(৩৯)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

____________

ঘরে এসেও ঘুম হয় নি দিহানের। চেয়ারে বসে কপালে হাত ওপর পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিলো।তাই চিৎকারের শব্দ কানে পৌছাতে বেগ পেতে হয় নি মোটেই।দরজার সামনে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।এই মুহুর্তে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে?না যেয়েও বা কিভাবে সহ্য করবে ওই চিৎকার?মিনিট দশেক পেড়িয়ে গেলো।দরজার খুটি শক্ত করে চেপে ধরে রিনির রুমের দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ হলো দীপ্তিও এসে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে দিহানের পাশে দাড়িয়েই।অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো

–“ভাইয়া রিনিকে মারছে?মারছে কেন হঠাৎ? ”

দিহানের চোখ রিনির রুমের দিকেই নিবিষ্ট। উত্তর দিতে পারে না সে।কি ই বা দেবে?দীপ্তি ঝাকুনি দিলো দিহানকে।দিহান অসহায় চোখে দীপ্তির দিকে তাকালো।বললো

–“তোর ভাই কুলাঙ্গারের মতো কাজ করে ফেলেছে রে।”

দিহান আর দাড়ায় না।দৌড় লাগায়, রিনিকে আর মারতে দেয়া যাবে না বাচাতে হবে।দীপ্তি কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।দরজাটা টেনে দিহানের পিছু সেও দৌড় লাগায়।

মুনির ক্লান্ত ভঙ্গীতে ক্রোধ চোখে শার্টের কলার ঝাকিয়ে বিছানার পাশে বসে।তরতর করে ঘাম ঝরছে শরীর বেয়ে বেয়ে।ক্রোধে মাথা ফেটে যাচ্ছে।কি করে ফেললো তার মেয়ে?
রেহানা ফেটে পরে এবার।লাঠি তুলে নেয় অশ্রবণীয় গালাগাল শুরু করে।রিনির কাছে এই বাবা মা বড্ড অচেনা।

–“বল কার বাচ্চা?কার সাথে নোংরামি করছিস বল।তোকে আজ মেরেই ফেলবো।তোর বাচার অধিকার নেই।তোর মতো নষ্টা মেয়ে আমার পেটে ধরছি?”

এমন নানান কথা অনরগল বলে যাচ্ছে সে।রিনি কৈ মাছের মতো ছটফট করছে মারের তোপে।নর্দমার কিট মনে হচ্ছে নিজেকে।অসহনীয় মারের পিঠ পা হাত সব ছড়িয়ে যাচ্ছে।রিনি রেহানার পা ধরে ফেললো মার দিয়ে বাচতে।আকুতি জানালো, সে আর পারছে না।রেহানার দয়া লাগলো না যেন।দরজার কাছে দাড়িয়ে দিহানের চোখ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো এই রিনির আকুতি দেখে।তড়িৎ মুছে নিলো সে চোখ।দীপ্তি এসব শুনে জমে যাচ্ছে যেন। সে দৌড়ে রিনিকে ধরলো।যার দরূন দীপ্তির হাতে একটা মার লাগলো।রেহানা সম্ভিত ফিরলো এবার।থেমে ফোস ফোস করে শ্বাস তুলতে লাগলো।একটু পরেই কর্কষ কণ্ঠে বললো

–“চলে যাও দিহান।পারিবারিক ব্যাপার আমাদের।দীপ্তি ছাড়ো ওকে।”

মুনির নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।সেও গলা মেলালো স্ত্রীর সাথে।

দিহান নিজের গলা যথেষ্ট সাভাবিক করার চেষ্টা করে। বলে,

–“কাকি ব্যাপারটা ঘরের মধ্যে থাকতে দিলেন কই?এই যে আমাদের কান পর্যন্ত গেলো?এভাবে ওকে মারতে থাকলে তো সমাধান হবে না।বরংচ আশে পাশের বাড়ি ঘর গুলোতেও ছড়িয়ে পরবে।বিষয়টা নিজেদের মধ্যে রাখা ভালো না?।”

মুনির রেহানা নিভলো কিছুটা।ভুল বলে নি দিহান।দিহান আবার বললো

–“যদি জানাজানি না হোক চান তাহলে মারামারি করেন না।এটা সমাধান না।বাচ্চা মেয়ে ও।ওর বোধ বুদ্ধি কতো আর?বোধ বুদ্ধি থাকলে তো আপনাদের কাছে ধরা পরতো না।আর না এই অবস্থায় নিশ্চিন্তায় থাকতো।ও তো বোঝেই নি কিছু।আমি বলছি ওর দোষ না।বয়সটা এমন। কারো ফাদে পা দেয়া কোনো ব্যাপারই না আজকাল।একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবেন কাকা।রিনি অনেক বাচ্চা একটা মেয়ে।আমি ওকে চিনি।”

বেঘোরে কেদে যাচ্ছে রিনি। দিহানের টুকটাক কথা কানে যাচ্ছে।কিন্তু দিহানের স্বর এতো সাভাবিক দেখে কষ্ট পেল সে।তবুও নিজেকে আবার বুঝ দিলো এসেছে যখন নিশ্চয়ই কিছু হবে।নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণেই এসব বলছে।দীপ্তি রিনিকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সব কিছু শুনে ওর মাথায়ই চক্কর দিচ্ছে।এসব কবে হলো?পরিস্থিতি সাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় থাকলো সে।আদোও স্বাভাবিক হবে কিনা কে জানে?আপাতত মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয়।

দিহানের কথায় টনক নড়ে মুনির রেহানার।রেহানা আচল মুখে ধরে কেদে ফেলেন।দিহানের নিজেকে শেষ করে দিতে মনে চাচ্ছে।এতো এতো মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কি সুন্দর মহৎ সাজছে সে।নিজেকে থু থু দিতে মন চাইলো তার।তবুও নিরুপায় সে।যদি পরিবেশ স্বাভাবিক করতে হয় এভাবেই করতে হবে। নইলে আরও বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।যার মূল্য দেয়া অসম্ভব হয়ে পরবে।

–“আমার মেয়েটার কি হবে? কে বিয়ে করবে?”

রেহানার কান্নার বেগ বাড়লো।মুনিরের কর্কষ কণ্ঠ ভেসে এলো

–“কারো বিয়ে করতে হবে না।মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসবো। এমন মেয়ে আমি চাই না।”

কেপে উঠলো রিনি।শক্ত করে চেপে ধরলো দীপ্তিকে।দিহানের কণ্ঠস্বরও কেপে উঠলো।

–“যা পারবা না তা বলো না রিমির আব্বু।কি করবা তাই ভাবো আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না।”

কড়া গলায় এসব বলছেন আর কাদছেন রেহানা।
মুনির গর্জে উঠলো
–“করবে কে তোমার মেয়েকে বিয়ে? কে করবে?নইলে বাচ্চা নষ্ট করাতে যাও।ও বাচলে বাচলো না বাচলে মরলো।”

বাবা মায়ের এসব কথা বুকে তীরের মতো বিধছে রিনির।এই জীবনে বাঁচার আশাই তার আর নেই।দীপ্তিকে ছাড়িয়ে দৌড় দিলো সে।সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া চাওয়ি করলো।দিহান দৌড় লাগালো।পেছন পেছন মুনির, রেহানা ,দীপ্তি।ছাদের কিনারায় পৌছে লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।জীবনে এসব কথা শুনবে কখনোও ভাবেনি।তবুও সহ্য করছিলো।এখন কিনা তার মৃত্যুতেও বাবা মায়ের কিছু আসে যায় না?এতো নোংরা সে?

দিহান পেছন থেকে টেনে ধরলো।এসে পরলো অন্য সবাইও।রিনি হাত ছাড়ানোর পায়তারা করছে।দিহানের ধমকে শান্ত হয়ে গেলো সে।দিহান টেনে আবার রুমে নিয়ে এলো।অনুভূতি শূন্য হয়ে দীপ্তিকে জড়িয়ে রাখলো রিনি।দিহান প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস টেনে নিজেকে প্রস্তুত করলো।চকিতে মুনিরের দিকে তাকিয়ে বললো

–“আংকেল ওকে আমি বিয়ে করবো।যদি আপনারা রাজী থাকেন।দয়া ভাববেন না, আপনার কাছে এমনিতেই আমি কৃতজ্ঞ।”

বেশি কথা বলে না দিহান।মিথ্যাচার তার অসহ্য লাগতো। নেহাত আজ মিথ্যা ছাড়া চলছে না।মুনির রেহানা চাওয়া চাওয়ি করলো নিজেদের মধ্যে।

–“কৃতজ্ঞ মানলাম কিন্তু এটা দয়াই। এই দয়া চাই না দিহান।জেনে শুনে তোমার ক্ষতি চাইতে পারি না।”মুনির বললো।

স্বামীর কথায় রেহানা খানিক অসন্তুষ্ট।

এমন কথায় দিহানের নিজেকে ছোট মনে হলো।ব্যক্তিত্বের কাছে আজ সে নগন্য, ঘৃণিত, পরাজিত।তবুও ভেবেছিলো এভাবে বললে মুনির হোসেন ফিরিয়ে দেবে না। অন্তত রিনিকে নিজের সম্মান ফিরে পাবে।আশায় গুড়ে বালি। কান মাথা দপদপ করছে তার।দীপ্তি ফট করে বললো

–“কাকা দিহান ভাইয়া মনে মনে রিনিকে পছন্দ করতো অনেক আগে থেকে।আপনি এটা দয়া ভাববেন না দয়া করে।ভাইয়া ভালোবাসা থেকে বলছে।”

মুনির নিশ্চুপ হয়ে রইলো খানিক্ষন। রেহানাকে ডেকে নিজের রুমে ঢুকে দরজা মিলিয়ে দিলেন।নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করবে তারা।

____________

পুরো শরীর টনটন করছে রিনির বিছানায় পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসালো দীপ্তি।দিহান রিনির সামনে ফ্লোরে বসে পরলো। পা দুটো জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাদতে লাগলো।দিহানের মনে কতো লাঞ্চনা, কতো লজ্জা, কতো অপারগতার ভয়, কষ্ট লুকিয়ে আছে নিজেই জানে।রিনির শরীরের ব্যাথা কিভাবে ভাগ করবে সে কিভাবে?মুনির রেহানা মেনে নেয় কিনা সেটাও চিন্তার।মনে মনে আল্লাহকে হাজার বার ডাকতে রইলো।তার জন্য একটা মেয়ে এমন পরিস্থিতি পরবে তা না কোনো দিন ভেবেছে না চেয়েছে।কিন্তু আজ তাই হলো।

দীপ্তি ভাইয়ের পানে তাকিয়ে রইলো।কি থেকে কি হলো এখনও তার কাছে ধোয়ার মতো অপরিষ্কার।রিনির মনও কু ডাকছে।কিন্তু বাইরে নিজের ভেতরের তোলপার জানান দিতে পারছে না। অধিক কষ্টে পাথরের মতো লাগছে নিজেকে।অসার হয়ে আছে সে।কাল বিকেল থেকে তো খায় নি।রাতে ওতো ওতো কান্না, দুশ্চিন্তা , আর সকালে উঠেই এমন।নিজেকে অনুভূতিহীন লাগছে এখন।

চলবে,

গল্প ছোট হয়েছে? কি করবো বলেন? প্রচুর মাথা ব্যাথা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here