জানালার ওপাশে

১.

ইমার্জেন্সি রুমের বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে অনামিকা। সারা শরীর জুড়েই ক্ষতের চিহ্ন। সাদা ধবধবে চাদরটা আর সাদা নেই। রক্তে মাখামাখি হচ্ছে একটু একটু করে। ইমার্জেন্সি রুমে ডাক্তার নার্সদের ভীষন ব্যস্ততা অনামিকাকে ঘিরে। দুশ্চিন্তায় চেহারা কুঁচকে আছে তাদের। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। রুমের বাহির থেকে অসহায় চোখে মেয়েকে দেখছেন মিঃ এ্যান্ড মিসেস রহমান। রুমের ভিতর থেকে মিসেস রহমানের বোনের ছেলে বেরিয়ে এসে বললো,

– একটা জানোয়ারের হাতে আমরা অনামিকাকে তুলে দিয়েছি খালামনি। বাজেভাবে মেরেছে ওকে। বুঝাই যাচ্ছে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। পেটে, বাম পায়ে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে৷ হাতের আঙুল তো দু’টো কেটেই দিলো৷ বাচ্চার আশা ছেড়ে দিয়েছি। অনামিকার জীবন নিয়েই টানাটানি! জানিনা বাঁচাতে পারবো কি না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

হুরমুরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন রুমানা৷ পাশে নাক ডাকতে থাকা ঘুমন্ত স্বামীর দিকে চোখ যেতেই টের পেলেন এতক্ষণ তিনি স্বপ্নের জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মাথার বালিশটা ঠিকঠাক করে নিয়ে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়লেন ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাবেন বলে।

২.

পুরো একসপ্তাহ খালার বাড়িতে কাটিয়ে গতরাতেই বাসায় ফিরেছে অনামিকা। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো পাশের বিল্ডিংয়ে তাদের মুখোমুখি ফ্ল্যাটটাতে নতুন পরিবার এসেছে। ওপাশের বারান্দায় একবার চোখ বুলাতেই মনে হলো যেন এই বারান্দাটা তার ভীষণ আপন। এই বারান্দায় বসে কতশত মুহূর্ত কাটিয়েছে সে কোনো একসময়! কিন্তু কবে? কখনো তো ওপাশের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। এতগুলো বছর ধরে এই বারান্দা দেখে আসছে, কই কখনো তো মনে হয়নি এই বারান্দাটা খুব আপন, খুব পরিচিত! সকাল সকাল এত মাথা খাটাতে ইচ্ছে হয় না অনামিকার৷ কিছু মুহূর্তের জন্য কৌতুহল জাগলেও তা একটু বাদেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে৷ গোলাপের টবগুলোর দিকে নজর দেয় অনামিকা। গতসপ্তাহে পাঁচটা ফুলের কলিসহ গাছ কিনে এনেছিলো। সবগুলো কলি ফুটে এখন পাঁপড়ি ঝড়ার প্রহর গুনছে। পাঁপড়ি গুলো একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। হাত বাড়াতেই ভিতর থেকে ডাক আসে,

– আফা, কফি থুইয়া গেলাম। খাইয়া যান আইসা।

হাত গুটিয়ে নেয় অনামিকা৷ ধীর গতিতে নিজের ঘরে যায়। ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকা কফির মগ হাতে নিয়ে বসে পড়ে নিজের বিছানায়। কফির মগে চুমুক দিয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অনামিকা। নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ওপাশের ফ্ল্যাটে। পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে তার। হাতজোড় কাঁপছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷

৩.

– রাত এগারোটা বাজে। সেই সকাল থেকে তুই এখানেই বসে আছিস। এক সেকেন্ডের জন্যও এখান থেকে উঠিসনি। কেন?

তীব্র বিরক্তিতে ছেয়ে আছে রুমানা রহমানের মুখ। মেয়েকে সামলানো আজকাল তার ক্ষমতার উর্ধ্বে। প্রায়ই থাপ্পর দেয়ার খেয়াল চলে এলেও নিজেকে আটকান তিনি ডাক্তারের পরামর্শের কথা স্মরণ করে৷ কিছু সময় বাদে বুক ভারী হয়ে আসা অনুতপ্তের অনুভূতিগুলো ভীড় করতে থাকে মনের ঘরে৷ মেয়ের জন্য কষ্ট হয়। নিজেকে জগতের সবচেয়ে অসহায় মা বলে মনে হয়।
মেয়ের কোনো হেলদোল না পেয়ে সজোরে ধাক্কা দেন মেয়ের কাঁধে। বললেন,
– অনামিকা, তোকে ডাকছি আমি।

চমকে উঠে অনামিকা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মায়ের দিকে৷ চোখের কোণে, পাঁপড়িতে পানি জমে আছে, চোখ নাক লাল হয়ে ফুলে আছে৷ মেয়ের মুখটা দেখে মায়া হয় রুমানার। ওড়না দিয়ে মেয়ের চোখ মুছে দিয়ে আহ্লাদী স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

– কাঁদছিস কেন বাবু?
– কান্না পায় তাই।
– জানালার গ্লাস লক করে রেখে বসে আছিস কেন?
– ঐ ফ্ল্যাটের লোকগুলো যেন আমাকে দেখতে না পায়।
– তুই ঐ ফ্ল্যাটে সকাল থেকে তাকিয়ে আছিস কেন? কি দেখিস ঐ বাসায়?
– সুখ দেখি আম্মু।
– কার সুখ?
– আমার হারিয়ে ফেলা সুখ।

মেয়ের পাশে এসে বসলেন রুমানা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

– ভাত নিয়ে আসি আমি? খাইয়ে দিবো তোকে। একটু আচার আনবো সঙ্গে? আচার দিয়ে মেখে খাওয়াবো। ভালো লাগবে খেতে।
– খাবো না। তুমি আমার কথা শুনো।
– কি কথা?
– পাশের ফ্ল্যাটে নতুন কাপল এসেছে। ওদের ঘরে অনেক সুখ আম্মু।
– কে বলেছে?
– আমি দেখেছি। সকাল থেকে দেখছি।
– কি দেখেছিস?
– লোকটার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। দেখে মনে হচ্ছে লাস্ট ট্রাইমেস্টার চলছে। কি যত্ন করছে মেয়েটার! সকাল থেকে দুই তিনঘণ্টা পরপর কিছু না কিছু মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। দুপুরে গোসলের পর মাথার চুল মুছে দিয়েছে। অকারণে গালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে। ফোলা পেটটায় হাত রেখে বাচ্চার মুভমেন্ট চেক করছে। পুরো বিকেল বারান্দায় দুজনে হাত ধরে বসে ছিলো৷ কিছুক্ষন পরপরই দুজনে মিলে কি যেনো বলে আর হাসে! মেয়েটার চেহারা দেখো আম্মু। কি সুন্দর! খুব আহ্লাদী চেহারা। হাজবেন্ডের আহ্লাদ পেয়ে ওর চেহারা এমন আদুরে হয়ে গেছে৷ মেয়েটা সুখে আছে ওর চেহারা দেখেই বুঝা যায়৷ ওর হাজবেন্ড খুব আহ্লাদ করতে জানে৷ ভীষণ যত্নে রাখতে জানে। পাগলের মত ভালোবাসতে জানে। আর হাজবেন্ডটাকে দেখো, সেও খুব সুখে আছে। আমি জানি সে সুখে আছে। আমি উনার মুখ দেখে মনের অবস্থা খুব বুঝতে পারি৷ লোকটার খুব ইচ্ছে ছিলো একটা মেয়ে বাবুর। ওদের ঘরে বোধ হয় মেয়ে বাবু আসবে। এজন্যই লোকটার এত সুখ। দেখো, দেখো চেহারায় কেমন উপচে পড়া খুশির ঝলক!

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রুমানা৷ মেয়ের হাত চেপে ধরে বলে,

– ছিঃ মা! অন্যের জানালায় এভাবে লুকিয়ে দেখতে হয় না। অন্যের সুখ দেখে মন খারাপও করতে হয় না৷ অন্যের সুখে খুশি হতে হয়৷
– আমার সুখ অন্য কেউ ভোগ করবে তাতে আমি খুশি হবো কিভাবে? ঐ ঘরে আমার থাকার কথা ছিলো। মেয়েটার ঐ বাবুটা আমার হওয়ার কথা ছিলো। জানালার ঐ নীল রঙের পর্দাগুলো আমার পছন্দে কেনার কথা ছিলো। ওদের বারান্দায় যে গাছগুলো আছে, সেই গাছগুলোতে প্রতিদিন সকাল বিকাল আমরা দুজনে মিলে পানি ঢালার কথা ছিলো। ঐ সংসারটা আমার হওয়ার কথা ছিলো। ঐ লোকটার আদর, ভালোবাসা-যত্ম সবকিছু আমার অধিকারে ছিলো৷ ঐ লোকটা আমার হওয়ার কথা ছিলো। লোকটা কে জানো?
– কে?
– সীমান্ত।

করুণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন রুমানা৷ অনামিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। ভাঙা স্বরে বললো,

-সব শেষ আম্মু। আব্বু, তুমি আর তোমাদের কোটিপতি আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে আমাকে শেষ করে দিলে৷ আমার সুখে অন্য কারো অধিকার খাটানোর সুযোগ করে দিলে। আমার কোনো সংসার হয়নি৷ আমার কোলজুড়ে একটা সন্তান আসেনি, আর কখনো আসবেও না। তোমরা বলেছিলে আমি অনেক সুখে থাকব। আমি তিল পরিমাণ সুখ পাইনি। ভালোবাসা যত্ন কিচ্ছু আমার হয়নি। আমি শুধু হারিয়েছি আম্মু৷ মা হওয়ার ক্ষমতা, একটা পা, হাতের দুটো আঙুল, রাতের ঘুম, একটু স্বস্তি, একটা সুন্দর সংসার, ভীষণ যত্নে আগলে রাখা একটা মানুষ…. সব হারিয়েছি। কিছুই আর নেই৷ সীমান্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, মা-বাবা নেই, এতিম আরো কত কি বাহানায় ওর কাছ থেকে দূরে নিয়ে এলে। আমাকে এত ভালোবেসে যত্নে বেড়ে তোলার কথা বারবার মনে করিয়ে কৃতজ্ঞতার ভারে নুইয়ে দিয়েছো। মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে সুখ পাওয়া যায় না বলে বলে দিনরাত পার করেছো। তোমাদের পছন্দমতই তো বিয়ে করলাম। কথা তো ছিলো সুখের জোয়ারে ভাসবো৷ কৃতজ্ঞতার ভারে নুয়ে মা বাবার সুখকেই তো প্রাধান্য দিয়েছিলাম। কই আম্মু? সুখ তো এলো না। তোমাদের তো অনেক টাকা, আমাকে সুখ কিনে দাও। মা ডাক শোনার ক্ষমতা কিনে এনে দাও। পা টা আবার আগের মত করে দাও। সীমান্তর মা বাবা ছিলো না। আমার তো মা বাবা আছে। মা বাবা নাকি সন্তানের জন্য সব করতে পারে! আমি যা কিছু হারিয়েছে সব আমাকে ফিরিয়ে দাও।
-……………..
– তাকিয়ে দেখো একবার, সীমান্ত অনেক সুখে আছে। যেই ছেলের নাম শুনেই তোমাদের চেহারা কুঁচকে যেত, বাবা যাকে কখনো ছোটলোক ছাড়া আর কিছু ডাকে নি সেই ছোটলোকটা আজ বাবার বরাবর হয়েছে। বাবারই পাশের এ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট কিনেছে৷ বাসায় সব দামী ফার্নিচার কিনেছে। সুন্দরী বউ পেয়েছে। ফুটফুটে একটা বাচ্চার বাবা হতে যাচ্ছে আর কিছুদিন বাদে। সবার সুখের কথা ভেবেই তো সীমান্তকে ছাড়লাম। সুখ কি আমরা কেউ পেয়েছি? পাইনি তো! সীমান্তকে হারিয়ে আমি সর্বহারা হয়ে গেলাম আম্মু। উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়ে রইলাম এই জগত-সংসারে৷ এখন থেকে প্রতিদিন জানালার ওপাশের মানুষটার সুখ দেখে আমার সময় কাটবে৷ এই সংসার, এই সুখ আমার হওয়ার কথা ছিলো আম্মু, আমার।

বিছানায় ধুপ করে শুয়ে পড়লো অনামিকা৷ কোলবালিশটাকে আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে একনাগারে বলে চলছে,
– জানালার ওপাশের সংসারটা আমার হওয়ার কথা ছিলো……. জানালার ওপাশের সংসারটা আমার হওয়ার কথা ছিলো৷

বিছানা ছেড়ে খুব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রুমানা৷ মুখে ওড়না চেপে কান্নার শব্দ আড়াল করছেন তিনি। এখনও প্রায় রাতেই পাঁচবছর আগের সেই রাতটা স্বপ্নে তাড়া করে বেড়ায়।
-সমাপ্ত-

#জানালার_ওপাশে

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here