পড়কুট থেকে চিরকুট পর্ব শেষ

পড়কুট থেকে চিড়কুট

শেষ অংশ

অাদনান ভাইয়ের সাথো দেখা করতে গিয়ে অামি ‘থ’ বনে গেলাম।তিনি মাথা ন্যাড়া করে এসেছেন। অামি দেখেই হেসে ফেললাম ; কড়া গলায় বললেন, খবরদার হাসবি না।থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবো।নিজেকে অন্যরকম লুকে এনেছি।কেমন লাগছে বলতো??
—–অাপনাকে কার্টুনের মত লাগছে।তবে ভীষণ নিরীহ চেহারা দেখাচ্ছে।
ক’দিন থাকবেন??
—-থাকবো না। কালই ফিরবো। দু-জন বন্ধু সাথে এসেছে।অরিজিনাল সাদা; এরা ঝামেলাবাজ! এদের নিয়ে বেশিদিন থাকতে গেলেই দুনিয়ার খরচ।দুদিনেই হোটেল ভাড়া লাখখানেক।
তাছাড়া হাইজিন হাইজিন করে করে এরা যণ্ত্রণা দিচ্ছে।
তুই জরুরী কথা বলে এক্ষুণি বিদায় হ।
—–অাপনি অামার দরকারে এসেছেন, ইংরেজ বন্ধুবান্ধব সাথে কেনো??
—–তুই কি ভি অাই পি, যে তোর কাছে একা অাসতে হবে?? অামার বন্ধু, অামার ইচ্ছা। বাই দ্য ওয়ে তুই এমন সেঁজেগুঁজে এসেছিস কেনো?? ছিঃ যাত্রার সংয়ের মত লাগছে।
অামি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মনে মনে বললাম, অামি অাপনার জন্য শুধু ভি অাই পি না অাদনান ভাই অামি অাপনার মহারাণী, অামায় কুর্নিশ করে চলতে হবে অাপনার! এতদিন অামি যেটা বুঝিনি, বা অাপনি যেটা বুঝতে দেননি, তা অাজ স্পষ্ট! শুধু অাগে সেটা বুঝতে দিলে অামাদের দুজনের সময়টা ভালো যেতো!
অামি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম,
—–অাদনান ভাই, ভালোবাসার মত একটা সুন্দর কারণ থাকতে অামায় বিয়ে করতে মিথ্যে বলার দরকার কি ছিলো?? অাপনি গুছিয়ে বলতে পারতেন।শুধু শুধু মিথ্যে গল্পটা ফাঁদলেন।
অাদনান ভাই থতমত খেয়ে গেলেন। হাত কেঁপে উঠে চা ফসকে পড়ে গেলো!!
তিনি উঠে গিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে প্যান্ট মুছতে লাগলেন। স্পষ্ট অামার দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা! খুব কৌশলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,

—–উপস! তুই খুব অল্প সময়ে একটু বেশিই ম্যাচিউর হয়ে যাস নি নিতু??নিজের বুদ্ধি ফুদ্ধিতে এসব বের করেছিস?? কিসব অাজেবাজে ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছিস!
অামি শক্ত গলায় বললাম,
—– এই ব্যাখ্যা অামি দাঁড় করাইনি; অামার স্যার বলেছেন! তিনি অারও বলেছেন, অাপনাকে যাতে এই অপরাধে কঠিন একটা শাস্তি দিই! কঠিন শাস্তিটা অামি অনেক কষ্টে ভেবে বের করেছি, তা হলো অাপনাকে অামি একটা ছোট্ট বাক্সে বন্দী করে অামার ব্যাগে রেখে দিবো।অাচ্ছা, মানুষ ছোট্ট করার ইনজেকশান, কোথায় পাওয়া যায় বলুন তো!!!
অাদনান ভাই অামার দিকে রাগী চোখে তাঁকিয়ে বললেন,
——এত বেড়েছে সাহস তোর!!বসে বসে অামায় তোর স্যারের অাজগুবি ব্যখ্যা শুনাস।দেখি, তোর স্যারের ঠিকানা দে.. অামি নিজে গিয়ে একবার উনার ব্যাখ্যা শুনবো।
অামি অাদনান ভাইকে শতগুণ বিস্মিত করতে ফোন করে স্যারের সাথে অালাপ করিয়ে দিলাম। ফোন রেখেই অাদনান ভাই বললেন,
——-তুই বাসায় ফিরে যা নিতু; বিদেয় হ।তোকে একদম সহ্য হচ্ছে না কেনো জানি!
এই প্রথম অামার ভিতর অলৌকিক শক্তি চলে এলো,
অামি প্রচন্ড গলা শক্ত করে বললাম,
—–অামি বাসায় যাবো না।অাজ অামি অাপনার কাছে থাকবো।অাপনি অাজ শুধু অামার কথা শুনবেন।শুনতেই হবে।অামায় অাজ থাকতে না দিলে অামি মরে যাবো, এক্ষুণি মরে যাবো।
বলে অামি উঠে গিয়ে হোটেলরুমের বিশাল জানালার ভারী পর্দাটা টেনে দিলাম।
অাদনান ভাই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে।অামি তাঁর চোখে ভীষণ ভয় দেখলাম।শিশুর মত চেহারা করে কাতর নয়নে তাঁকিয়ে….
——অামি অনেকদিন ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারিনা।অামি খুব ক্লান্ত, অাদনান ভাই! বড্ড ক্লান্ত….

অাদনান ভাই অসহায় গলায় বললেন,
——এমন করলে অামি ফিরে যেতে পারবো না নিতু, অামার পড়াশোনা??? তুই এত কেনো পাগলামী করছিস??
——জলে ভেসে যাক সব অাজকে……
অাদনান ভাই বিড়বিড় করে বললেন,
——ফিরে যাওয়া অসম্ভব হবে, অসম্ভব!অামি কিচ্ছু জানিনা এবং অামায় অবাক করে দিয়ে তিনি কেঁদে ফেললেন। অামি জানি এ অানন্দের কান্না, অপেক্ষার কান্না।যেই কান্নাগুলো অামি রাতের পর রাত কেঁদেছি।
এই প্রথম অামার কাছে অাদনান ভাইকে ভীষণ সুন্দর লাগলো! অামি ফিসফিস করে তাঁর কানে কানে বললেন, ফ্রম নাউ এভরিথিং উইল হ্যাপেন হ্যাভেনলি… এভরিথিং উইল…… এভরিথিং….
তিনি ঘামতে ঘামতে বললেন,
——বাতিটা নিভাই নিতু;; অামার খুব লজ্জা করছে! খুব….
অামি চোখ রাঙিয়ে বললাম,
—খবরদার না।অামি দেখবো অাপনাকে….
বেচারা অসহায় গলায় বিড়বিড় করতে লাগলেন,
—-তুই পাগল হয়ে গেছিস.. পাগল হয়ে গেছিস…….

অাদনান ভাই চলে গেলেন পরদিন রাতেই! যাবার সময় উল্টোটা হলো, অাদনান ভাই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে গেলেন। অামি তাঁকে সি অফ করলাম হাসিমুখে.. কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
—-এই অপেক্ষায় তো এতদিন বেঁচেছি.. এখন কিভাবে থাকবো?? তুই ফোন করবি কিন্তু; অামার অত সময় নেই!

অামার জীবনের সুখ.. অামার জীবনের সবথেকে দামী সময় শুরু হলো তারপর থেকে… স্বপ্নময় মুহূর্ত।সবকিছুতে এক অপার্থিব অানন্দ! এই অানন্দের উৎস নিশ্চয় এই পৃথিবীতে নয়! দূরে কোথাও, পৃথিবীর বাইরে সৃষ্টিকর্তার নিজের রাজ্যে। অামার জীবনের সবটুকু ঢেলে দিয়ে সেই সময়টা অামি উপভোগ করতে লাগলাম।
অাদনান ভাইকে সপ্তাহে দু-বার করে অামি ফোন করতাম। রুটিনটা উনিই বেঁধে দেন!অার ফোন করলেই কড়া গলায় কথা! অামি অবাক হয়ে ভাবতাম, এত ভালোবাসে অামায় মানুষটা; তাও যেনো নরম হবে না একটু, সবসময় হামকি ধামকি!

এর প্রায় মাসখানেক পরের কথা! একদিন রাতে প্রায় দুটোর দিকে মা হঠাৎ এসে অামায় ডেকে তুললেন, বললেন, নিতু, অাজ রাতে অামি তোর সাথে শুই??
অামি কড়া গলায় বললাম,
——প্লিজ মা যাও তো! কাঁচা ঘুম কেনো যে ভাঙালে//??
মা চলে গেলেন। মাঝখান থেকে ঘুম ভাঙার কারণে অামার অার সেই রাতে অার ঘুম হলোনা! বারান্দায় হাটাহাটি করে রাত পার করলাম। ঘুম এলো সকালের দিকে।অামি ঘুমিয়ে উঠলাম বিকেল চারটারও পরে…. চা খেতে নিচে নেমেছি, মা ঠান্ডা গলায় বললেন,
——রাতে তোকেঁ খবরটা বলিনি, তুই ভয় পাবি তাই।অাত্মীয় স্বজন কেউ মারা গেলে তোর তো অাবার ভয়ে টয়লেট বন্ধ হয়ে যায়! অাদনানদের বাসায় যাবো, রেডী হয়ে নে। সবাই অলরেডী চলে গেছে।
অামি চায়ের কাপে টোস্ট ভিজিয়ে কামড় দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম,
——খবরটা যদি নাই বলবে, রাতে শুধু শুধু ডাকলে কেনো।পরে অার অামি ঘুমোতে পারিনি! সেই ঘুমই তো সারদিন ঘুমালাম।সারাদিনের পড়া নষ্ট!
মা অাহত গলায় বললেন,
—–তোরা সবাই একসাথে কত মজা করেছিস, তাই ভাবলাম খবরটা তোকে জানানো দরকার! ছেলেটা কত রোগে ভোগে মারা গেলো, অথচ অামাদের কাউকে বুঝতেই দিলো না। সাকসেসফুল কেমো চলছিলো, পরশুর অাগেরদিনও নাকি বাসায় দিব্যি কথা বলেছে।।।গতকাল রাত সাড়ে অাটটায় হুট করে নাকি বডি অাউট অফ রেসপন্স হয়ে গেলো!
—–কার কথা বলছো মা??
—–অারে অাদনান। অাদনান মারা গেছে। রাত দুটোর ফ্লাইটে বডি অাসছে…..
তাড়াতাড়ি রেডী হ….. নিতু নিতু…..

অামার বুকে ব্যাথা করতে লাগলো, প্রচন্ড ব্যাথা… ব্যাথার অতল গহ্বরে পরে যাচ্ছি অামি মা… মা… অামায় ধরো মা
……

এরপরের ঘটনা অামার মনে নেই!

অামার জ্ঞান ফিরলো দুদিন পর। হাসপাতালে চোখ খুলে অামি প্রথম যাকে দেখলাম, তিনি অামার সেই রাগী স্যার!
ভীষণ মমতায় অামার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—–অামি অাছি তো নিতু! তুমি একদম একা নও….
অামার মা পাশেই রাগান্বিত চোখে তাঁকিয়ে… কঠিন গলায় বললেন,
—–এইসব বিয়ে ফিয়ে কিচ্ছু অামি মানি না। এই বেবী রাখা যাবেনা। যেহেতু ছেলেটা মারা গেছে, এই বিয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই!
অামার স্যার বিনীত গলায় বললেন,
—–স্পৃহা, যাস্ট একটা ট্রিমেন্ডাস শক থেকে উঠলো।উই ক্যান ডিসকাস ইট লেটার!
তারপর অাবার অামার অার কিছু মনে নেই…….

অাদনান ভাই ব্রেইন ক্যান্সারে ভুগছিলেন! ইউ এস তে তিনি পড়াশোনার জন্য নয়, চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন। পুরো ঘটনাটা তিনি ও তাঁর পরিবার তাঁর ইচ্ছেতেই গোপন রাখেন।
ইভেন, উনি যখন অামায় মিট করতে অাসেন, উনার চিকিৎসায় এপয়েন্টেড দুজন ডক্টর সাথে করে নিয়ে অাসেন যাদের তিনি বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এই সবঘটনার একজন সাক্ষী ছিলেন; তিনি হলেন অামার স্যার।পরবর্তীতে তিনিই অামার বিয়ের ডকুমেন্টস গুলো নিয়ে দুই পরিবারের সাথে কথা বলেন। তাতে কোনো লাভ হয় না, দুই পরিবারের কেউই অামার গর্ভে অাসা সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে রাজী হয়না।
তার পরের একটা ঘটনাও অামার জন্য সুখকর নয়, অামার ফ্যামিলি অাদনান ভাই”র ফ্যামিলির উপর মামলা করলো।
প্রমাণ দিতে দিতে অামি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।অামার সন্তানের বৈধতা অার অবৈধতার বিতর্কে অাদনান ভাই চলে যাবার দুঃখে অামি স্বস্তিতে কাঁদবার একটুও সুযোগ পাইনি।
শেষমেশ অামায় কথা না শুনাতে পেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো।বাবু পেটে অামি অাশ্রয় পেলাম স্যারের কাছে।অাদনান ভাই’র পরিবারও অামায় এক্সসেপ্ট করলো না। ওই যে, বললাম না, অামার জীবনের পড়াশোনাই অামার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত সহজ করে দিয়েছিলো। তা’ই একমাত্র অবলম্বন করে অামি বাঁচতে শিখলাম। সিঙ্গেল মাদার সমাজে অামি অাজ প্রতিষ্ঠিত, এবং প্রথম শ্রেণীর সরকারী চাকুরীজীবী।অাশেপাশের কোনো কুৎসিত, অামি এবং অামার সন্তানকে ছুঁতে পারেনা এখন।

তবে অাদনান ভাই, হাসপাতালে চিকিৎসারত থাকা অবস্থায় অামার জন্য অসংখ্য চিড়কুট লিখে রেখে গিয়েছেন, যা তিনি অামায় ভালোবেসে বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কথা রেখেছিলো,
তারা তা সযত্নে অামার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো। প্রতিটা চিড়কুটেই তিনি অামার সাথে করা সব ধরনের অাচরণের ব্যাখ্যা করে গেছেন। এমনকি বিয়েটা কেনো, এভাবে করেছেন, তাঁর ও ব্যখ্যা অাছে। সেসব কথা না হয় অারেকদিন লিখবো।

তবে তাঁর সর্বশেষ চিড়কুটটা ছিলো এমন,
“নিতু, শাড়ি পড়লে তোঁকে খুব বোকা বোকা লাগে। মনে হয় হাবাগোবা বৌ! তুই অামার হাবাগোবা বৌ! অাচ্ছা, অামি কি কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে অামার হাবাগোবা বৌটাকে কোলে করে হাটতে পারবো???”

পরিশিষ্ট : অামার মেয়ে “রূপা” এখন মেডিকেলে পড়ছে। স্যার মারা গেছেন সাত বছর হলো। তারপর থেকে অামরা মা মেয়েতে বেশ অাছি, ভালো অাছি। অামার মেয়ে ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে, অামি বেঁচে অাছি অাদনান ভাই’র রেখে যাওয়া চিড়কুট গুলো নিয়ে! শুধু মাঝে মাঝে মাঝরাতে অামি যখন স্টাডিতে বসে চিড়কুটগুলো পড়তে বসি, তখন অামার মেয়ে এসে দরজা ধরে দাঁড়ায়।বিষণ্ন চোখে তাঁকিয়ে কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—–মা, বাবা কেনো অামার জন্য একটাও চিড়কুট রেখে যায়নি??তোমায় এতগুলো সুন্দর চিড়কুট দিয়ে গেলো, অার অামায় একটাও না! কেনো মা???
অামি জবাব দিতে পারি না।নিশ্চুপ তাঁকিয়ে থাকি, তাঁকে বলতে পারিনা, তুমি যে পৃথিবীতে অাসবে এই সুন্দর খবরটা অামি তাঁকে জানাতে পারিনি।জানালে নিশ্চয় তোমাকেও কিছু চমৎকার করে লিখে যেতো।
কি করে জানাবো বলো, কি করে?? অামি নিজেই তো তা জানতাম না তখন।
“রূপা” অামার জবাবের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।অামি অাবার দ্রুত চিড়কুট খুলে বসি…..

অামি মিসেস স্পৃহা জান্নাত নিতু। অামার স্বামী মি. অাদনান হাবীব…
অার এই অামাদের গল্প…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here