জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ১৬

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

১৬.
ফজরের নামায পড়ে আর ঘুম লাগেনি মোহনার। তাই মোবাইলটা হাতে নিয়ে ছাদে গেল সে। সূর্য তখন আস্তে আস্তে পৃথিবীর বুকে উকি দিচ্ছে। রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে ভোরের শিরশির বাতাস গাঁয়ে লাগাচ্ছে মোহনা। সেইযে রাতে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলো, এখনও অন করেনি। মোবাইল অন করার মিনিট দু’য়ের মধ্যে ছয়টা ম্যাসেজ এসে জমা হলো। সবগুলো ম্যাসেজই আরাফাতের দেয়া। মুচকি হাসলো মোহনা। রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কল করলো আরাফাতের নাম্বারে। প্রথমবারের কল ধরলোনা আরাফাত। দ্বিতীয় কলটা ধরতেই মোহনা খ্যাঁক করে উঠলো, ‘এখনও ঘুমাচ্ছো?’

‘হুম…’ ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বললো আরাফাত।

‘কী হুম?’ ধমক দিলো মোহনা।

‘ফোন অন করেছো?’ এবার উঠে বসলো আরাফাত। চোখ কচলাতে কচলাতে আবার বললো, ‘ক’টা বাজে?’

‘মানে? এই তুমি নামাজ পড়োনাই এখনও?’

‘হ্যাঁ, ন-না তো। তুমি ডাকোনাই তো।’

‘কেন আমি ডাকা লাগবে কেন? এলার্ম দিয়ে রাখোনাই?’

‘এলার্মে ঘুম ভাঙেনা।’

‘তাড়াতাড়ি উঠে যাও। নামাজ পড়ে আসো। পনেরো মিনিট সময় দিলাম। পাঁচ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়বা।’

‘পাঁচ মিনিট!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো আরাফাত।

‘হ্যাঁ, এতো গলা বাড়াচ্ছো কেন?’

‘আরে, সম্ভব নাকি? মানে, পাঁচ মিনিটে প্রকৃতির ডাকে পুরোপুরি সাড়া দেয়া সম্ভব না তো!’ আরাফাত বললো অনেকটা অনুরোধের সুরে। কথাটা শুনে মোহনার এতো হাসি পেলো! কিন্তু সে হাসলো না শব্দ করে। চাপা হাসি দিলো যাতে আরাফাত শুনতে না পায়। তারপর বললো, ‘আচ্ছা, তাহলে দশ মিনিট। এর বেশি এক সেকেন্ড ও না।’

‘জল্লাদ বউ একটা ঘাড়ে পড়তে যাচ্ছে আমার।’ বিড়বিড় করে বললো আরাফাত।

‘আমি শুনেছি তুমি কী বলেছো।’ শান্ত স্বরে বললো মোহনা।

‘এতো কান পাতলা কীভাবে হয় মানুষ! আসছি আমি নামাজ পড়ে।’ বলে কল রাখলো আরাফাত। মোহনা তখনও মোবাইল কানে চেপে রাখলো। আর হাসলো একা একা, অনেকক্ষণ।

প্রায় আধা ঘণ্টা ছাদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো মোহনা। আরাফাতের কল আসেনি। তারপর সে নিচে নেমে গেল। দেখলো ডাইনিং এ তার মা বাবা চা খাচ্ছেন। মোহনাকে দেখে মঞ্জুরা বললেন, ‘কীরে, চা খেয়েছিস?’

‘খাবনা, মা। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করব। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।’

‘এই রোদের মধ্যে ছাদে যেতে মানা করেছিলাম।’

‘ভোরের রোদ আমার ভালো লাগে, মা।’ কথাটা বলে একটা হাসি দিয়ে চলে গেল মোহনা। আলতাফ চৌধুরী মঞ্জুরাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলে?’

‘করি নি। করার প্রয়োজন নেই হয়তো। প্রতিদিন এই সময় সে এমনি এমনি ছাদে যায়না অবশ্যই?’

‘আমি ওদের মতিগতি কিছু বুঝতে পারছিনা। সত্য মিথ্যা যাচাই করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।’ চিন্তিত মুখে বললেন আলতাফ। মঞ্জুরা উনাকে আস্বস্ত করতে বললেন, ‘এতো চিন্তা করো না। যা ভালো হওয়ার তাই হবে। তুমি বরং মোহনার বন্ধুদের সাথে একবার কথা বলো। আমার মনে হয় ওরা জানবে সব।’

আলতাফ চৌধুরী ডানে বামে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ওরা কিছুই জানেনা, মঞ্জুরা। তুমি তোমার মেয়েকে চেনো না? সে কাউকে কিছুই বলেনি। ঐ বিষয়ে কেউ কিছুই জানেনা।’

‘তাহলে তাহমিনা…’

মঞ্জুরাকে থামিয়ে আলতাফ বললেন, ‘কেউ জানেনা। তোমার মেয়ে জানায় নি।’

আলতাফ চৌধুরীর সাথে এবার মঞ্জুরাও চিন্তায় পড়ে গেলেন। জীবন এ কোন গোলকধাঁধার মাঝখানে ফেলে রাখলো মোহনাকে?

অনেকক্ষণ ধরে মোবাইল ভাইব্রেট করছে। কেউ বারবার কল দিচ্ছে। মোহনার ঘুম ভাঙছে একটু একটু করে। আরেকবার কল আসতেই মোহনার ঘুম ভেঙে গেল পুরোপুরি। ইশ, মাত্রই ঘুমটা গাঢ় হয়েছিলো। যে কল করছে তার পিণ্ডি চটকাতে ইচ্ছে হলো মোহনার। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো আরাফাতের চারটা মিসডকল। সময় দেখলো, সকাল সাড়ে আটটা। কল বেক করলো মোহনা। আরাফাত রিসিভ করে বললো, ‘কী ব্যাপার?’

‘ঘুমাচ্ছিলাম।’

‘ওহ, তাহলে ঘুমাও। রাখি।’

‘ঘুম ভেঙে গেছে।’

‘আচ্ছা।’

‘তোমার বিশ মিনিট শেষ হলো?’

মোহনার প্রশ্ন শুনে হেসে দিলো আরাফাত। বললো, ‘নামাজ পড়ে উঠে দেখি মা চা নিয়ে বসে আছেন আমার বিছানায়। একটু পর বাবাও এলেন। বুঝতেই পারছো তার পরের কাহিনী।’

মোহনা উঠে বসলো। ঢোঁক গিলে বললো, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘করো।’

‘তুমি উনাদের জোর করছো না তো?’

‘কিরকম জোর?’

‘মানে, উনারা আমাকে মেনে নিয়েছেন তো?’

‘মেনে না নিলে আমাদের বিয়েটা ঠিক হলো কীভাবে?’

মোহনা কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে রইলো। আরাফাত বললো, ‘তুমি এতো চিন্তা কেন করছো? আমি আছি তো! আমি তোমাকে ভালোবাসি, মোহনা। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের ভালোবাসার জোর অনেক। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। জাস্ট সময় দরকার।’

‘হুম।’ অস্ফুট স্বরে বললো মোহনা। তারপর আবার কণ্ঠে পূণরায় ঝাঁঝ নিয়ে বললো, ‘কালকে আসো নাই কেন?’

‘এসেছিলাম। চলে গিয়েছিলে তুমি।’ মিনমিন করে বললো আরাফাত।

‘তো চলে যাবো না তো থেকে যাব নাকি?’

‘আসলে, দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম…’

‘হয়েছে হয়েছে। আর তো পনেরো দিন পর দেখা হবে।’

‘কেন?’ অবাক কণ্ঠে বললো আরাফাত।

‘আমাদের ক্লাশ শুরু পনেরো দিন পর।’

‘তো কী? তুমি এমনিই বেরোতে পারবে।’

‘আমি পারবোনা। শোনো, রাখছি এখন। পরে কথা হবে।’

‘আচ্ছা।’

মোহনা কলটা কেটে দিলো। আরাফাত মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর হাসলো। মেয়েটা তার জীবনের সমস্তটা জুড়ে রেখেছে। যাকে ছাড়া নিশ্বাস নেয়া কষ্ট, বেঁচে থাকা মৃত্যু সমতুল্য!

মোহনা যে কলেজে পড়তো, আরাফাতে ছিলো সেই কলেজের সিনিয়র। মোহনা কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে সে পাশ করে বেরিয়েছে। আরাফাতদের ব্যাচের পুণর্মিলনী অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো দুজনের। সেই থেকে পরিচয়, কথাবার্তা, একটা সময় দুজন দুজনের প্রতি ডুবে যায় এক নামহীন অনুভূতির মাঝে। সেই অনুভূতির জোরে আজ দুজনের সম্পর্কের একটা বৈধ নাম হতে চলেছে। মোহনার বাবা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সহজেই মেনে নিয়েছিলেন। বাঁধ সাজলেন আরাফাতের বাবা-মা। কিছুতেই উনারা ছেলের প্রেমের বিয়ে মেনে নেবেন না। নিজেরা একটা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন, তার সাথেই আরাফাতের বিয়ে দেবেন। কিন্তু আরাফাত মোহনাকে ছাড়া কেউকে বিয়ে করবেনা। শেষ পর্যন্ত ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হলো তাদের। দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, আরাফাতের অনার্স কমপ্লিট হলেই বিয়ে দেয়া হবে তাদের। আর তো কয়েকটা মাস অপেক্ষা মাত্র!

আজকের সকালটা দারুণ স্নিগ্ধ। সূর্যের আলো থেকে যেন ঠিকরে হিরে বের হচ্ছে। ভোরবেলা ছাদে আসার পর থেকে একের পর এক কল করেই যাচ্ছে আরাফাতকে মোহনা। কিন্তু আরাফাতের নাম্বারটা বন্ধ আসছে। গত রাতেও আরাফাত কল করেনি। মোহনাও কল করে ওকে পায়নি। হঠাৎ এমন কী হলো! ভাবতে ভাবতে চারিদিকে তাকাচ্ছিলো মোহনা। হঠাৎ দেখলো তার বাবা ছাদে এসেছেন। সচরাচর এভাবে ছাদে আসেন না আলতাফ চৌধুরী। আজ কেন আসলেন? মোহনার সামনে এসে যখন দাঁড়ালেন তার বাবা, মোহনার বুকের ভেতরটা তখন হুহু করে উঠলো হুট করে। বাবার চোখের দিকে তাকাতেই তার পৃথিবী থমকে গেল। কী হয়েছে?

‘বাবা…’ আস্তে করে ডাকলো মোহনা।

আলতাফ চৌধুরী মেয়ের একটা হাত তার মাথার উপর রেখে বললেন, ‘আমার মাথায় হাত রেখে কসম কর, আজকের পর থেকে কোনোদিন তুই আরাফাতের ছায়াও মাড়াবি না। ঐ ছেলে বেইমান। তোর সাথে বেইমানি করেছে। তোকে ধোঁকা দিয়েছে।’

ঝট করে নিজের হাতটা সরালো মোহনা। তার বুকের ভেতর তুফান হচ্ছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘কী বলছো বাবা? কিসব বলছো? কী করেছে ও?’

‘কী করেছে সেটা আমি বাবা হয়ে তোকে বলতে পারবনা রে মা। কিন্তু তুই আমাকে বিশ্বাস কর, ঐ ছেলেটা তোকে ধোঁকা দিয়েছে রে মা! ধোঁকা দিয়েছে। ধোঁকা দিয়েছে…’ বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন আলতাফ চৌধুরী। মোহনার দুনিয়া ওলটপালট হয়ে গেছে। সে কিছু বুঝতে পারছেনা। বাবার পাশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো। কী হলো, কী হচ্ছে, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। নিজের রুমে এসে থম মেরে বসে আছে সে। মিনিট পাঁচেক বসে থাকার পর
সে শাহেদের নাম্বারে কল করলো। শাহেদ রিসিভ করতেই মোহনা আকুতিভরা কণ্ঠে বললো, ‘ভাইয়া, আরাফাতের নাম্বারটা বন্ধ। ফেসবুক আইডি ডীয়েক্টিভ। একটু খবর নিবেন?’

শাহেদ উত্তরে যে কথাটা বললো, সেটা শোনার জন্য মোহনা একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। শাহেদ বললো, আরাফাতের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার মা বাবার পছন্দ করা মেয়ের সাথেই এক সপ্তাহ পর ওর বিয়ে। আর কিছুই শুনতে পারলোনা মোহনা। কলটা কেটে মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকলো। আরাফাতের সাথে প্রেম হওয়ার পর যেদিন প্রথম দেখা করেছিলো, সেদিন আরাফাত মোহনা মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিজের অনেকগুলো ছবি তুলেছিলো। অনেক এঙ্গেলে তুলেছিলো। চোখ টিপ দিয়ে, জিহবা বের করে, আরো অনেক ভাবে। সেগুলো দেখছে আর হাসছে মোহনা। কেমন উউদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিলো তাকে। বিড়বিড় করে বলছিলো, ‘মোবাইলটা আমার কাছে রাখবো। একেবারে রেখে দেব। কাউকে দেবনা।’

তারপর বালিশে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। খুব, খুব কাঁদলো মোহনা। প্রতিজ্ঞা করলো, আর কোনোদিন আরাফাতের সাথে সে কথা বলবে না। কক্ষনো না। কোনোদিনও না। বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে। এখনই গিয়ে বলবে, সে আর লেখাপড়া করতে চায় না। তাকে বিয়ে দিয়ে দিক।

আধা ঘণ্টায় আটটা সিগারেট শেষ করেছে আরাফাত। দু’চোখ তার টকটকে লাল। বিশ্বাসঘাতকতার অনলে দগ্ধ সে। ভালোবাসার মতো ভালোবেসেছিলো যে মেয়েকে, সেই মেয়েটাই তার হৃদয়টাকে ভেঙে চুরমার করে দিলো। তাকে ধ্বংস করে দিলো। হাহ! জীবন কী দারুণ খেল দেখালো! এতো নিখুঁত অভিনয় করতে পারে কেউ? আরাফাত আরেকটা সিগারেট ধরালো। মনেমনে জেদ করলো, যার সাথে বিয়ে করবে তাকে সে রাণীর মতো রাখবে। ফুলের টোকাও শরীরে পড়তে দেবে না। ভালো না বাসুক, হৃদয়ে সম্রাজ্ঞীর জায়গা দিবে। এই বিশ্বাসঘাতকের জন্য নিজের জীবনের রঙ বেরঙ করবেনা।

সেই থেকে শুরু হয়েছিলো, দুটি মানুষের বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা পুড়ে যাওয়া অনুভূতি। যে অনুভূতি ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না, শুধুমাত্র বুকের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা অনুভব করা যায়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এই অতীতটা যন্ত্রণা দিতে থাকে, তিল তিল করে।

চলবে…….
©ফারজানা আহমেদ

রিভিশন দেইনি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন দেখবেন। আর হ্যাঁ, আগামী পর্বই শেষ পর্ব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here