#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ১৫
,
,
ইরা চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে।আশেপাশের এতো কোলাহলে তার মাথা ব্যাথা করছে।
এই জন্যেই বৌভাতে আসতে চেয়েছিলো না ইরা,তবুও আসতে হলো।রেহেনা বেগম জোর করে পাঠালেন।
ইরা আসতে চায়নি কারনটা মুগ্ধ।
ইরার ধারনা ছিলো মুগ্ধ এখানে আসার পর থেকে তাকে জালিয়ে মারবে।
অযথা বিরক্ত করবে।
কিন্তু না,এমন কিছুই হয়নি।
আসার পর থেকে একবারও মুগ্ধ ইরাকে বিরক্ত করেনি।
শুধু দুর থেকে একবার তাকে দেখেছিলো ইরা।
মুগ্ধ ইরাকে বিরক্ত করা দুরের কথা বিয়ে বাড়িতে অন্য কোন মেয়ের পিছনেও লাগেনি।
অথচ এই মুগ্ধ ভার্সিটিতে সারাদিন মেয়েদের সাথে লেগে থাকে,তাদের সাথে ফ্লার্ট করে সময় কাটায়।
মুগ্ধর হঠাৎ এমন পরিবর্তনে ইরা বেশ অবাক হয়।
ভাবে তবে কি মুগ্ধর জিবনে কোন পরশ পাথরের ছোয়া লাগলো?যে মুগ্ধকে এক নিমিষেই সঠিক পথের দিকে টেনে আনলো?
পাশে চেয়ার টানার শব্দ হতেই ইরা পাশ ফিরে তাকায়।
দেখে শৌখিন।
তাকে আজ খুব কম দেখেছে ইরা।এখানে আসার পর তো তাকে দেখাই যায়নি।
কোথায় ছিলো কে জানে?
হয়তো মিতালীর সাথে ছিলো।
ইরা চোখ ফিরিয়ে নেয়।
শৌখিন চেয়ার টেনে আরো কাছ ঘেসে বসে।
বলে,
—একা একা কি করছিস?
ইরা বিরক্ত হয়।সে কি করছে দেখতে পাচ্ছে না বুঝি?
বলে,
—বসে আছি।
শৌখিন চুপ থাকে কিছুক্ষন।মনে মনে কথা হাতড়ে বেরায়।ইরার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু কি বলবে খুজে পাচ্ছে না।
হঠাৎ পাশে শব্দ হয়।
ইরা শৌখিন দুজনেই তাকায়।
তাদের দিকে তাকিয়ে রিফাত বোকা হাসি দেয়।
ইরাও পাল্টা হাসি দিয়ে প্রতুত্তর করে।কিন্তু শৌখিন হাসেনা।তার মুখে হাসির পরিবর্তে বিরক্তি প্রকাশ পায়।
এই মুহুর্তে সে রিফাতকে এখানে আশা করেনি।
ইরার সাথে কথা বলার মাঝে কাউকে ভালো লাগেনা শৌখিনের।রিফাতকে তো একেবারেই না।
তাছাড়া শৌখিন ইদানীং লক্ষ করেছে রিফাত একটু পর পর ইরার পিছু পিছু ঘোরে।ব্যাপারটা তার কাছে বেশ সন্দেহজনক লেগেছে।
রিফাতের ইরার পেছনে ঘোরার কারনটা কি?ইরা তো তার বন্ধুর বউ নাকি?
যদিও সে জানেনা ব্যাপারটা,তবুও।
শৌখিন ভাবে,যতো দ্রুত সম্ভব ইরার আর তার বিয়ের ব্যাপারটা সবাইকে বলতে হবে।
সবাইকে মানে সবাইকে।
এমনকি মিতালিকেও।
মিতালিকে এভাবে ধোয়াশার মাঝে রাখা ঠিক হচ্ছে না।তাকে দ্রুত সবটা খুলে বলা দরকার।যদিও এ কাজটা শৌখিনের আগেই করা উচিৎ ছিলো।কিন্তু করেনি।
এখন কি আর করার?আগে যে ভুল করেছে এখন কিছুটা হলেও শোধরাতে তো হবে।
হঠাৎ রিফাতের কথা বলায় শৌখিন সেদিকে তাকায়।
রিফাত ইরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
—এখানে কি করছো ইরা?
ইরা এবার বেশ বিরক্ত হয়।সবাই এসে আজ এই একই প্রশ্ন কেনো করছে তাকে।
সে বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করেনা।মুখের হাসির রেখা টেনে বলে,
—বসে আছি রিফাত ভাই।
শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে জ্বলে ওঠে।একই প্রশ্ন সে যখন করলো তখন তো ইরা বিরক্ত হয়ে মুখ চোখ কুঁচকে জবাব দিয়েছিলো কিন্তু রিফাতের বেলায় মুখে হাসি ফুটলো কেনো?
সে রাগে কটমট করে।
রিফাতকে বলে,
—চল তো রিফাত,আমার সাথে ঐদিকে চল।
রিফাত উঠতে চায়না। সে আরেকটু বসতে চেয়েছিলো।
সে হতাশ হয়।বলে,
—কই যাবো?আর একটু বসি না?
শৌখিন রিফাতের হাত টেনে সোজা করে।
বলে,
—দরকারি কাজ আছে একটা।তুই চল তাড়াতাড়ি।
রিফাত অগত্যা উঠে দাড়ায়।যাওয়ার আগে ইরার দিকে তাকিয়ে আবার হাসে।অকারণেই হাসে।
ইরা সেদিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়।লোকজনের যাতায়াত দেখে।তাদের কাজকর্ম দেখে।
শাম্মির কাছে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ায়।
রুমে ঢোকার পথে মুগ্ধর মুখোমুখি হয়।
মুগ্ধ ইরাকে দেখে চোখ নামায়।
ভেতরে অপরাধবোধ কুঁড়ে কুড়ে খায় তাকে।
সে একসময় এই মেয়েটার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিতো।তাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করতো,ভাবলেই মাথা আপনাআপনি নিচু হয়ে আসে মুগ্ধর।
সে চোখ বন্ধ করে মিতালির চেহারা মনে করে।
মেয়েটার কথা ভাবলে মনটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে।
কি মায়াবী মুখশ্রী তার!
ইরা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায়।
মুগ্ধ পথ রোধ করে।
ইরা ভয় পায়।
সে মুগ্ধর চরিত্র সম্পর্কে অবগত।
ছেলেটা কম বিরক্ত তো করেনি তাকে।
ইচ্ছে মতো জালিয়েছে।
এখন না জানি আবার কি করে।
ইরা আশেপাশে চোখ বুলায়।চেনা কেউ নজরে আসেনা।
মুগ্ধ বলে ওঠে,
—তোমার সাথে কথা ছিলো ইরা।
ইরা ভয়ার্ত চোখে তাকায়।তার সাথে কথা?কি থাকতে পারে,?
—কি কথা?বলুন।
—এখানে না,অনেক মানুষ এখানে।
ছাদে যাবে?
ইরা চমকে ওঠে।ছাদে যাবে?সে? তাও আবার মুগ্ধর সাথে?
মানুষজনের ভিতরই তো অসভ্যতামো করতে ছাড়ে না মুগ্ধ। আর ছাদে নিরিবিলি গেলে কি করতে পারে ভাবলেই গায়ের কাটা দাড়িয়ে পরে ইরার।
সে কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়,
—না,যা বলার এখানেই বলুন।
মুগ্ধ অনুরোধ করে।
–প্লিজ চলো।
শুধু দু’মিনিট, দুটো মিনিট সময় দাও আমায়।
একটা বার বিশ্বাস করো প্লিজ।
ইরা মুগ্ধর দিকে অবাক নয়নে তাকায়।আগে কখনো এই রুপ সে দেখেনি মুগ্ধর।সে ভেবে পায়না,এটা কি মুগ্ধর কোন চাল?নাকি আসল রুপ?
ইরা রাজি হয়।
মুগ্ধর পিছু পিছু ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে ইরা।
রেলিং ঘেসে দাড়ায়।
মুগ্ধর দিকে তাকায়।তার কথা বলার জন্য ইশারা করে।
মুগ্ধ বড় করে নিশ্বাস ফেলে।
বলে,
—জানোতো ইরা,
আমার মা নেই।
আমার বাবা, ভাইয়া আর আমি,এই তিনজনের সংসার আমাদের।
মা খুব ছোটবেলায় আমাদের দুভাইকে ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিলো।আমি তখন ছোট,খুব ছোট।
বাবাকে মায়ের জন্য চুপিসারে কাদতে দেখতাম,ভাইকে মায়ের জন্য আকুতিমিনতি করতে দেখতাম।
কি কষ্টে কাটতো আমাদের জিবন।
মা ছাড়া জিবন আমাদের।
বাবাকে অনুরোধ করলাম নতুন মা এনে দাও।বাবা কথা রাখলো।
তবে মা না এলো সৎ মা।
তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ভাইয়া হোস্টেলে চলে গেলো।বাবা চাকরীতে।
অত্যাচারগুলো সহ্য করলাম আমি।
একসময় সেও চলে গেলো।
তার আগের স্বামীর কাছে।
মেয়েদের প্রতি আস্তে আস্তে আমার তৈরী হলো ঘৃনা।
তাদের প্রতি লালসার দৃষ্টি ছাড়া আর কোন দৃষ্টি আমি দিতে পারতাম না।
কোন রমনীকে সে নজরে দেখিওনি কোনদিন।
কথাগুলো বলে মুগ্ধ থামে।ইরার প্রশ্নবোধক মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে,
—আমি হঠাৎ তোমায় এসব বলছি কেনো তাই ভাবছো তাইনা?
ইরা মাথা নাড়ে।সত্যি তার মাথায় এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
মুগ্ধ আবার বলে,
—আমি তোমার সাথেও অন্যায় করেছি।তোমাকে কারনে অকারণে বিরক্ত করেছি।তার জন্য আমি অনুতপ্ত। খুব খুব অনুতপ্ত।
আমি আমার জিবনের ঘটনাগুলো তোমায় বললাম যাতে তুমি বোঝো কেনো আমি ওরকম ব্যবহার করতাম।
যাতে তুমি আমায় ক্ষমা করো।
একটু থেমে বলে,
—করবেতো ক্ষমা?
ইরা মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়।বলে,
—অবশ্যই।
মুগ্ধ ও হাসে।
তার হাসিটা আজ খুব স্বচ্ছ লাগে ইরার কাছে।
মুগ্ধ পেছন ঘুরে চলে যেতে চায়।ইরা পিছু ডাকে।
বলে,
—তার নামটা কি?
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলে,
—কার নাম?
—যার জন্য আপনার এই পরিবর্তন।
মুগ্ধ মাথা নিচু করে হাসে।
মাথা চুলকায়।বলে,
—সময় হলেই জানাবো।
,
,
চলবে…..