তোকে_দিয়েছি_মন❤
২৭.২৮
পর্ব – ২৭
Writer: Sidratul muntaz
🍂
সেই তখন থেকে ধীরপায়ে হেটে যাচ্ছি আমি। এ পথ যেন অনন্তকালের……শেষ হওয়ার নামই নেই। চারিপাশের সবকিছু ঘোলাটে অন্ধকার। যেন সবকিছু আপন গতিতে ঘুরছে। মাথাটা ভার হয়ে আসছে। এই বুঝি পড়ে যাবো। মনে হচ্ছে,,, আশেপাশের সবকিছু স্লাইড কেটে পড়ে যাচ্ছে। এবার আমিও লুটিয়ে পড়বো। পা গুলো স্থির হয়ে এসেছে। আর চলতে পারছিনা। নিজের এই শরীর টা কে বোঝা মনে হচ্ছে খুব। মাথায় হাত রেখে এক পা দু পা করে এগুতে লাগলাম আমি। সামনে যেতেই হঠাৎ সন্ধান পেলাম এক চিরচেনা মুখের। এক চিলতে হাসি জমে উঠল আমার ঠোটের কোণে। ঈশান ভাইয়ার চোখেমুখে আতঙ্ক বাসা বেধেছে। যেন উনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারিয়ে ফেলেছে। আমি প্রশান্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে উনার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমার থেকেও আরো কয়েক গুন দ্রুত গতিতে উনি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি আবারও মুচকি হাসলাম। ঢলে পড়লাম উনার বুকের উপর। উনার পারফিউমের গন্ধে আসক্ত হয়ে পড়লাম আমি। নেশার মতো লাগছে। এতোটা শান্তি কেনো? চোখ বন্ধ করে উনার বুকের উপর ভর ছেড়ে দিলাম আমি। তারপর আর তেমন কিছু মনে নেই। মাঝে একবার চোখ খুলেছিলাম…… তখন মা আমার সামনে দাড়িয়ে ছিলেন। খুব কাদছিলেন মা। বুড়িটার চোখেও পানি দেখতে পেলাম। ঈশান ভাইয়া হতাশ মুখে আমায় কোলে নিয়ে বসেছিলেন। এটাই যে শান্তি……. আর কি লাগে? আমি আবারও শান্তির নীড়ে ডুব দিলাম। এবার যখন জ্ঞান ফিরল….. ভাইয়াকে দেখতে পেলাম আমার সামনে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। খুব ক্লান্ত লাগছিল ভাইয়াকে। যেন অনেক বড় একটা বিপদ হয়ে গেছে। চিন্তিত ছিলেন খুব। আমি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই মুচকি হাসলো ভাইয়া। আমিও ভাইয়াকে একটা মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে আবার তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতল সাগরে। খুব অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি আমি। স্বপ্নের মাঝে জেগে উঠছি…. আবার ঘুমের দেশে হারিয়ে যাচ্ছি। কোনটা যে স্বপ্ন আর কোনটা যে বাস্তব। সেটাই খুজে বের করা যাচ্ছে না। একবার দেখলাম বুড়ি কয়েকটা পেয়ারা হাতে দাড়িয়ে আছে আমার সামনে। বুড়ির মুখে দাত কেলানো হাসি। কিন্তু এবার বুড়ির দাত গুলো আর নোংরা নয়। ঝকঝকে সাদা দাত। আমি বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম— কি গো বুড়ি! তোমার নোংরা দাত সাদা হলো কি করে? বুড়ি একগাল হেসে দিয়ে বলল— “পেয়ারা খেয়েছি পেয়ারা! তুই খাবি নাকি?”
আমি হাসতে লাগলাম। পেয়ারা খেলে দাত সাদা হয় বুঝি? বুড়িটা আজ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। আমাদের সাথে থাকতে থাকতে শুদ্ধ ভাষা শিখে গেছে বুড়িটা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুড়িটা হারিয়ে গেল…..মিলিয়ে গেল নিরালায়! এবার আমি নিজেই পেয়ারা গাছের উপর বসে আছি। নিজেকে এমন অদ্ভুত জায়গায় আবিষ্কার করে চমকে উঠলাম আমি। চিৎকার করতে লাগলাম। আমার গাছে উঠতে ভীষণ ভয় লাগে। এইবার গাছ থেকে নামবো কিভাবে আমি?? আমার শরীর কাপতে শুরু করল। দুম করেই পড়ে গেলাম নিচে। হাটু বরাবর ছিলে গেছে আমার। রক্তপাত হচ্ছে। আমি হাটু ধরে ব্যথায় কাদছি। তখনই আমার সামনে এসে দাড়ালো জায়মা। জায়মাকে দেখে আমি কান্না থামিয়ে দিলাম। জায়মা আমার কান্না দেখে উল্লাসের হাসি হাসছে। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল উঠে গিয়ে জায়মাকে ঠাস করে একটা চড় মারি। কিন্তু আমার হাত পা যেন স্থির হয়ে আছে। নড়াচড়া করতে পারছি না আমি। এমন সময় ঈশান ভাইয়ার দেখা পেলাম। উনি আমায় দেখে মুচকি হাসলেন। আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। এবার নিশ্চয়ই উনি আমায় কোলে তুলে নিবেন…… উনার কোলে উঠেই জায়মাকে আমি দুটো চড় মারবো। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। উনি আমায় কোলে তুলে নিলেন না। বরং জায়মার হাত ধরে চলে যেতে লাগলেন। আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি। উনি কি তাহলে এখন জায়মাকে ভালোবাসেন?? অভিমানে কান্না আসছে আমার। এইটা যদি স্বপ্নও হয়…… তাহলে স্বপ্নের মধ্যেও আমি ঈশান ভাইয়াকে হারাতে চাইনা। স্বপ্ন বাস্তব দুই জায়গাতেই আমার উনাকে চাই। চাইই চাই। আমি গলা ছেড়ে চিৎকার করলাম– যাবেন না প্লিজ! আমায় ছেড়ে যাবেন না।
চিৎকার দিয়েই শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি। চোখের পলকে বদলে গেল আমার দুনিয়া। এবার আমি একটা নরম বিছানায় শুয়ে আছি। একটা বিশাল আলিশান ঘরে। কি সুন্দর এই ঘর…… যেন কোনো রাজপ্রাসাদ। কাচের গ্লাস দিয়ে পুরো রুমটা ঘিরে আছে। রঙ বেরঙের লাইট জ্বলছে ঘরে। নাম জানা অজানা অনেক জিনিসের ভীড়ে কি আশ্চর্য সুন্দর একটা ঘর। আচ্ছা আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো? কিন্তু স্বপ্ন কি এতো পরিষ্কার হয়? এতো ঝকঝকে সুন্দর হয়? পরিচিত এক সুভাষ পাচ্ছি আমি। এইটা তো ঈশান ভাইয়ার সুভাষ। উনার শরীরের গন্ধ এতোটা তীব্র লাগছে কেনো আজ? অদ্ভুত এক মাদকতায় জড়িয়ে পড়ছি আমি। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছি…..শুধু এই সুভাষটা অনুভব করার জন্য। যেন আমার সাথে মিশে আছেন উনি। হঠাৎ ঈশান ভাইয়ার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। শব্দের উৎস বরাবর তাকাতেই দেখলাম ঈশানকে। একটা সাদা টি-শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলেন উনি। হাতে তোয়ালে। চোখমুখ মুছছেন। আমার মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর একটা দৃশ্য দেখছি এখন। বেখেয়ালি ভাবে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। উনি আমার কাছে আসতে আসতে বললেন—
জ্বর কমেছে?
বলতে বলতে আমার কপালে হাত রাখলেন। হালকা একটা হাসি দিয়ে বললেন–
অনেকটাই কমে গেছে জ্বর।
উনার হাসিতে মাতাল হলাম আমি। ইশশ……. এই হালকা হাসিটা এতো সুন্দর কেনো? ঈশান আমার কপালে চুমু একে দিলেন। এবার যেন আমার ঘোর কাটল। আরেকবার আশেপাশে তাকিয়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম—
আমি এখানে কেনো? এটা কোন জায়গা?
ঈশান ভাইয়া মাথা নিচু করে হাসলেন—
সব ভুলে গেছো? এইটা ঢাকা। বাসায় চলে এসেছি আমরা।
উনার কথা শুনে চোখ বড় করে তাকালাম আমি। আমরা ঢাকায় চলে এসেছি? তার মানে এইটা ঈশান ভাইয়ার রুম? অনেকটা অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি–
তাহলে আমার কিছু মনে পড়ছে না কেনো? কখন আসলাম আমরা এই জায়গায়?
ঈশান ভাইয়া ভ্রু কুচকালেন। মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে বললেন— তোমার কি আসলেই কিচ্ছু মনে নেই? অবশ্য মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। সারাদিন যেভাবে মরার মতো ঘুমিয়েছো। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। পুরোটা রাস্তা আমাকে নাকানি চোবানি খাইয়ে ছেড়েছো তুমি। ঘুমের ঘোরে কিসব আবোল তাবোল বলছিলে…. একবার চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছিলে…… আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছিলে…….মহা বিপদে পড়ে গেছিলাম তোমাকে নিয়ে। মাঝে জ্বরও এসেছিল প্রচুর। কিন্তু এখন অনেকটা ঠান্ডা লাগছে শরীর। জ্বরটা নেমেছে মনে হচ্ছে।
কথাটা বলে মৃদু হাসলেন উনি। টেবিলে থাকা কলিংবেলের মতো একটা বাটনে চেপে ধরলেন। সাইরেনের মতো কিছু একটা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল এক মেয়ে। খুব সুন্দরী এক মেয়ে। কালো কোর্টের সাথে মিনি স্কার্ট পড়া। মাথায় উচু করে খোপা বাধা। আর ঠোটে ডার্ক বেগুনি লিপস্টিক। অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে দেখতে। মেয়েটা দুই হাত একত্র করে দাড়িয়ে আছে খুব সোজাভাবে। ঈশান ভাইয়াকে স্যার বলে সম্বোধন করল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল–
হেলো ম্যাম!
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম– হেলো!
এমন একটা মেয়ে আমাকে ম্যাম বলছে। বিষয়টা খুবই মজার লাগল আমার। ঈশান ভাইয়া ইংলিশে উনাকে কি কি যেন বললেন। ঠিক ইংলিশ না….. ইংলিশ আর বাংলার সংমিশ্রণে অনেকটা জগা খিচুড়ি টাইপ ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। শুধু এইটুকু বুঝলাম…… যে উনি আমার ব্যাপারেই বলছেন। হয়তো আমাকে মেডিসিন দেওয়ার কথা বলছেন। মেয়েটাও বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। প্রত্যেক কথার লাস্ট লাইনে ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার বলছে। প্রায় পাচ মিনিটের মতো বকবকানির পর অবশেষে বিদায় হলো সুন্দরী রমনী। ঈশান ভাইয়া এবার আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমার গালে হাত রেখে কপালে আরেকবার চুমু দিয়ে বললেন–
তুমি রেস্ট নাও। আমি একটু বাহিরে থেকে আসছি।
বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম—
কোথায় যাচ্ছেন??
উনি হালকা হেসে বললেন– কাজ আছে। জলদি চলে আসবো। তোমার কিছু দরকার লাগলে বাটন ক্লিক করবে। কেউ না কেউ চলে আসবে। আর আমি ফোন করব। ফোনটা সাথেই রেখো।
আলমারি থেকে ব্ল্যাক জ্যাকেট টা বের করে পড়ে নিলেন উনি। চুল গুলো ঝারতে ঝারতে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। আমার সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। আমি কি সত্যিই বাসা ছেড়ে চলে এসেছি? সবাইকে ছেড়ে? অবাক লাগছে খুব। কান্না আসছে। ঈশান ভাইয়া ফিরে আসলে সব ঘটনা জেনে নিতে হবে। এইখানে কিভাবে এলাম…. মা ভাইয়া বুড়ি আমায় কিভাবে বিদায় দিল…..কান্নাকাটি করল কিনা…..সব। আমার যে কিছুই মনে পড়ছে না। মুখ ভার করে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। শব্দ করে বলল–
ম্যায় আই কাম ইন ম্যাম!
আমি কিছুটা ভয় পেয়ে জবাব দিলাম—
ইয়েস কাম ইন।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল এক মোটাসোটা ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের মাথায় সাদা ক্যাপ। পড়নেও সাদা এপ্রোন। ঠিক রেস্টুরেন্টের লোকেদের যেমন থাকে। উনি হাতে একটা ফাইল আর একটা কলম নিয়ে আমার সামনে দাড়ালেন। খুব ফরমালিটি দেখিয়ে বলে উঠলেন —
ডিনারে কি খাবেন ম্যাম? মেনু লিস্ট করতে এসেছি।
উনার প্রশ্ন শুনে আমি হতবাক। কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থেকে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল—
আপনি কে?
ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে এমন প্রশ্ন আশা করেন নি। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে ঝেড়ে কাশলেন। উনাকে দেখে মজাই লাগছে আমার। নিজেকে কেমন রানী রানী ফিল হচ্ছে। এদের আমি যখন তখন ঝাড়তে পারবো কথাটা ভাবতেই পৈশাচিক আনন্দ লাগছে। ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন–
আমি শেফ। সায়েদ হোসাইন।
পকেট থেকে আইডি কার্ড টা বের করে দেখালেন আমায়। আমি ভ্রু কুচকে গম্ভির মুখে বললাম–
তারমানে আপনি রাধুনী?? রান্নাবান্না করেন?
ভদ্রলোক বিব্রত গলায় বললেন– জ্বী না ম্যাম। রাধুনি তো মেয়েরা হয়। আমি তো পুরুষ।
আমি নিচের ঠোটটায় আঙুল রেখে বললাম– ও আচ্ছা!! তাহলে রাধুনির মেইল ভারসন কি হবে বলুন তো?
উনি আমতা আমতা করে বললেন— জানিনা তো ম্যাম!
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম– আচ্ছা! আমি জানি। সেটা হয়তো বাবর্চি হবে। আচ্ছা বাবর্চি ভাই…. না থাক আঙ্কেলই বলি! আপনি আমার বাবার বয়সী হবেন। তো বাবর্চি আঙ্কেল…… আমি যেটা খেতে চাইবো সেটা আপনি বানাতে পারবেন তো?
অবশ্যই পারবো ম্যাম! আপনি একবার বলেই দেখুন না।
আচ্ছা! তাহলে আমি আজ খেতে চাই…. কাচকলার ভরতা….. চিংড়ি শুটকির তরকারি….. আর ঢেড়স ভাজি।
ভদ্রলোকের মুখটা এবার অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুক্ষণ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন–
এসব রান্না করতে হলে তো ম্যাম এখন বাজারে যেতে হবে। ল্যাডিস ফিংগার তো বাসায় নেই। ড্রাই ফিশও নেই…..
আমি উনার কথা শেষ হতে দিলাম না। রাগী কণ্ঠে বলে উঠলাম —
এই কি বললেন আপনি? ল্যাডিস ফিংগার কি হ্যা? আমি কি লেডিস ফিংগার খেতে চেয়েছি?
সরি ম্যাম। কিন্তু ঢেড়সের ইংরেজি নাম তো লেডিস ফিংগার।
কথাটা শুনে অবাক হলাম আমি। ঢেড়সের ইংরেজি আমার জানা ছিল না। কিন্তু এইটা তো উনাকে বুঝতে দেওয়া যায়না….. তাই আমতা আমতা করে বললাম—
আপনি যান তো এখান থেকে। আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি।
সরি ম্যাম?
আমি অগ্নিদৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম– বাংলা কথা বোঝেন না? যান এখান থেকে। ফুটুন! গেট আউট।
কিন্তু ম্যাম টাইম মতো আপনাকে ডিনার সার্ভ না করতে পারলে স্যার রাগ করবে।
রাগ করলে আপনার উপর করবে! তাতে আমার কি? ভাগেন তো এখান থেকে! যান আউট।
ভদ্রলোক অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই হেসে দিলাম আমি। বেশ মজাই লাগছে। কারো উপর হুকুম জারি করা যে এতোটা মজার…… সেটা আগে জানা ছিলনা আমার। কিছুক্ষণ বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। এতো এতো বিলাসিতা দেখে শরীরে আলসেমি ভর করেছে আমার। আরাম করে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই আবার কেউ দরজায় নক করল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম–
কে??
একটা মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল– ম্যাম আসবো?
আসুন।
মেয়েটা ভেতরে ঢুকল। এ তো দেখছি সেই সুন্দরী রমনী।মেয়েটাকে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। এতো সুন্দর কেনো মেয়েটা? গা জ্বালানো রুপ। মেয়েটা মুচকি হেসে হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখল–
ম্যাম আপনার জন্য স্ট্রবেরি জুস। আর স্যার রাত ৮ টা বাজে আপনাকে একটা মেডিসিন দিতে বলেছে। এখন তো প্রায় ৭ঃ৫৫। মেডিসিনটা দিয়ে দিবো?
আমি মেয়েটার কথার উত্তর দিলাম না। রাগী চোখে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা আবার বলল–
ম্যাম?
মেডিসিন পরে। আগে বলুন আপনি এতো সেজেছেন কেনো?
সরি ম্যাম??
বলছি আপনি এতো মেক আপ কেনো করেছেন?? এইখানে কাজ করতে আসেন নাকি রুপ দেখাতে আসেন শুনি?
মেয়েটা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়তো কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম—
মেক আপ টা মুছুন।
জ্বী ম্যাম??
আরে একবার বললে বুঝেন না নাকি?? মুখের মধ্যে যে দলা করে ময়দা মেখে রেখেছেন সেটা এবার মুছেন।
টেবিল থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে মেয়েটার হাতে দিলাম আমি। মেয়েটা বিস্মিত চোখে একবার টিস্যু বক্সটার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার আমার দিকে। কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দে ভুগে অবশেষে হাতে নিল টিস্যু বক্সটা।কয়েকটা টিস্যু বের করে মুখ মুছতে শুরু করল। আমি মেয়েটাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললাম–
এসব কি পোশাক পড়েছেন হ্যা? অর্ধেক আছে তো অর্ধেক নেই। এসব এখন থেকে চলবে না ঠিকাছে? এবার থেকে সেলোয়ার কামিজ পড়বেন।
কিন্তু ম্যাম এটা তো আমাদের ইউনিফর্ম।
ইইউনিফর্ম??এসব ইউনিফর্ম টিউনিফর্ম বুঝিনা। যা বলছি তাই হবে। কাল থেকে আপনাদের ইউনিফর্ম হবে সাদা সেলোয়ার কামিজ। বুঝেছেন?
মেয়েটা মাথা নিচু করে বলল– জ্বী ম্যাম।
আর এমন উচু করে পাহাড় বানিয়েছেন কেনো মাথায়? চুল খুলুন। এইভাবে আর কখনো চুল বাধবেন না। সবসময় দুই বেণী করবেন।
সরি ম্যাম? বেণী?( মুখ কুচকে)
হ্যা! কেনো কোনো অসুবিধা আছে? মাথায় একগাদা তেল দিয়ে বেণী করবেন চুলে। আর তেল দিতে না পারলে আসুন আমি দিয়ে দিচ্ছি।
না না ম্যাম…… আপনি কেনো দিয়ে দিবেন। আমিই পারবো।
হুম গুড। এবার থেকে ভদ্রবেশে আসবেন।এসব উরাধুরা সাজ আর চলবে না। গা জ্বালানো রুপ দেখিয়ে আমার ঈশানের মাথাটা খারাপ করার ধান্দা।( বিড়বিড় করে)
জ্বী ম্যাম কি বললেন??
অ্যাই এতো জ্বী ম্যাম জ্বী ম্যাম করবেন না তো। যান এখান থেকে ভাল্লাগেনা।
ম্যাম আপনার মেডিসিন?
লাগবে না মেডিসিন। আপনি যান।
মেয়েটা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল। আমি আরেকবার মুখ টিপে হেসে উঠলাম। উফফ মেয়েটাকে ঝারতে পেরে কি যে মজা লাগছে!!! সেইরকম মজা।
🍂
তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ২৮
Writer : Sidratul Muntaz
🍂
অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে এপাশ অপাশ করছি। সারাদিন ঘুমানোর পর এখন শুয়ে থাকাটাও খুব কঠিন মনে হচ্ছে আমার জন্য। ঈশান ভাইয়াকে খুব মিস করছি। কোথায় গেলেন উনি? এখনো আসছে না কেনো? অচেনা অজানা একটা জায়গায় আমাকে একলা ফেলে রেখে চলে গেলেন। একবারও কি দয়া হলো না উনার? হার্টলেস একটা! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। নয়টা বাজতে চলেছে। ক্ষিধেও পাচ্ছে খুব। ওই বাবর্চি আঙ্কেল কে তাড়িয়ে দিয়ে মনে হয় ভুলই করেছি। এখন ক্ষিধেয় প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আচ্ছা একবার বাটন টিপ দিয়ে কাউকে ডাকলে কেমন হয়?? না থাক…..পরে যদি ওই সুন্দরী রুপসী চলে আসে? মেয়েটাকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তার থেকে ভালো আমি নিজেই একটু বের হয়ে দেখি। সারাদিন এক রুমে বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে একটু ঘুরাঘুরি করাই ভালো। এই ভেবেই উঠে দাড়ালাম। দরজাটা খুলে বাহিরে পা রাখতেই চেচিয়ে উঠলাম আমি। পুরো ঘর নিস্তব্ধ নিরব। হাজার হাজার লাইটের আলো থাকলেও নিস্তব্ধতার কারণে ভয়ংকর লাগছে সবকিছু। বাড়ি তো নয় যেন আস্তো কোনো গোলক ধাধা। যেদিকে তাকাচ্ছি শুধু সিড়ি আর সিড়ি। ডানে সিড়ি উপরে উঠার আবার নিচে নামার। বামেও ঠিক তাই। যেন একসাইড আরেকসাইডের প্রতিবিম্ব। এই ধরনের বাড়ি টিভিতে দেখেছি অনেক।তখন তো খুবই সুন্দর মনে হতো। কিন্তু বাস্তবে যে এতোটা ভয়ানক হবে সেটা ভাবিনি। কোন জায়গা ছেড়ে কোন জায়গায় যাবো সেটা ঠিক করতে গেলেও এক ঘণ্টার জন্য মিটিং এ বসতে হবে । নিজের রুমের দরজা ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ারও সাহস হচ্ছে না। তাহলে হয়তো এই ঘরটাও হারিয়ে ফেলব। নিস্তব্ধ নিরালায় আমি নিজেও হারিয়ে যাবো। কথাটা ভাবতেই হালকা পাতলা একটা চিৎকার দিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম আমি। বুকে হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস ছাড়ছি। ঈশান ভাইয়ার রুমটা এখন খুব ছোট মনে হচ্ছে। এতোক্ষন এই রুমটা আমার জন্য বিশাল খেলার মাঠ মনে হচ্ছিল। ১০/১২ জন কে নিয়ে অনায়াসে ফুটবল খেলা যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই রুমটা নিছক পাখির বাসা। রুমের বাহিরের পরিবেশ টা যে আরো অনেক অনেক বিশাল। হঠাৎ দরজায় কেউ নক করল। আমি যেন এবার একটু স্বস্তি পেলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে ঈশান ভাইয়া এসেছে। হাসিমুখ নিয়ে দরজা খুলতেই আমার মুখ মলিন হয় উঠল। ঈশান আসেনি। এসেছে ওই সুন্দরী। কিন্তু এবার আরেক সুন্দরী কে সাথে করে নিয়ে এসেছে। এইটা যেন আগেরটার চেয়ে ডাবল সুন্দরী। আমি বুঝতে পারছি না। এইটা কি সত্যিই বাড়ি?? নাকি সুলতান সুলেমানের আমলের হেরেম? এইখানে সব জান্নাতী হুরদের বসবাস। আচ্ছা এতো কিউট কিউট মেয়েগুলো ভাইয়ার বিয়ের জন্য মেয়ে খোজার সময় কই ছিল? তাহলে অন্তত একটা সুন্দরী ভাবির অধিকারী হতে পারতাম। যেদিকে যেটা দরকার সেদিকে সেটা কক্ষনো পাওয়া যায়না। যেই জায়গায় দরকার নেই সেই জায়গাতেই অভাব হয়না। ঠোট দুটো চেপে ধরে নাক ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি—
কি চাই??
দুইজন একসাথে বলল– এনি প্রবলেম ম্যাম??
আমি হাত নাড়িয়ে বললাম– সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি আপনাদের কি প্রবলেম? এখানে কেনো এসেছেন?
দুই সুন্দরী একবার চোখাচোখি করল। এক সুন্দরী বলে উঠল–
ম্যাম আপনি চিৎকার করছিলেন তাই দেখতে এলাম কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা।
আমি ভ্রু উচু করে বললাম–
ও আচ্ছা!!
আরেকজন সুন্দরী বলল– কিছু দরকার হলে বলবেন ম্যাম।
আমি একটু নরম সুরে বললাম–
আচ্ছা শুনুন। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। আমি একটু ফ্রেশ হতে চাই। চেঞ্জও করতে হবে। আপনাদের কাছে এক্সট্রা কোনো কাপড় আছে? তবে এমন শর্ট কাপড় না কিন্তু। সেলোয়ার কামিজ টাইপ??
দুইজনই মাথা নেড়ে বলল– অভিয়াসলি ম্যাম।
একজন আরেকজনকে বিড়বিড় করে বলল–
একশ পিস কুর্তি আর প্লাজু অর্ডার করা হয়েছিল না?? ওগুলো রেডি আছে??
দ্বিতীয়জন মাথা নাড়ল। প্রথমজন বলল– তাহলে যাও তুমি ড্রেস রেডি করো। আমি শাওয়ার রেডি করছি। ( আমার দিকে তাকিয়ে) ম্যাম আপনি যাস্ট ফাইভ মিনিটস ওয়েট করুন।
আমি ওদের কথা কিছুই বুঝলাম না। চোখের পলকে দুজন হাওয়া হয়ে গেলো। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হতেই আবার দুইজন হাজির হলো। একজনের হাতে ড্রেস। আরেকজনের হাতে টাওয়েল… শ্যাম্পু…. সাবান… আর কি কি যেন নাম বলতে পারছি না। জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। দুজন আমাকে ওয়াশ রুমে ঢুকিয়ে দিল। ওয়াশ রুমে এসে আমি যেন ফ্রিজড হয়ে দাড়য়ে আছি। এইটা কি আসলেই ওয়াশরুম?? আমাদের কলেজের দৌড় প্রতিযোগিতা গুলো এই জায়গায় সংঘটিত হলেই তো ভালো হতো। এক মাথা থেকে আরেক মাথায় দৌড় দিলে আর কোনো হদিশ পাওয়া যাবেনা। ওয়াশরুমের ঠিক মাঝ বরাবর বিশাল সাইজের একটা বাথটাব। এইটা বাথটাব না টাইটানিকের সেই ডুবে যাওয়া জাহাজ সেটাই বুঝে উঠতে আমার দশ মিনিট লাগল। এইখানে উঠতে গেলে তো আমার সিড়ি লাগবে। কথাটা চিন্তা করতেই দেখলাম সত্যি সত্যিই মেয়ে দুটো একটা মই টাইপ জিনিস এনে বাথটাবের সাথে রাখল। আমাকে এইটার সাহায্যে বাথটাবে উঠতে বলছে। ওরা নাকি এইখানে দাড়িয়ে থাকবে। আমার যা যা দরকার হবে সব নিচে থেকে সাপ্লাই দিবে। কথাটা শুনে চরম অস্বস্তিতে পতিত হলাম আমি। আমি ওদের সামনে খোলামেলা গোসল করব ভাবতেই তো কেমন লাগছে ছি! এর থেকে আমার ছোট্ট রুমের অন্ধকার বাথরুম অনেক ভালো। নিজের মতো স্বাচ্ছন্দে গোসলটা অন্তত করা যায়।
🍂
চলবে