তোকে দিয়েছি মন পর্ব ২৫+২৬

তোকে_দিয়েছি_মন❤
২৫.২৬
পর্ব – ২৫
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান ভাইয়া আমার কাধে হাত রাখতেই কম্পন সৃষ্টি হলো শরীরে। ভীত চোখে উনার দিকে তাকালাম আমি। আমার দৃষ্টিতে ভয় সন্দেহ দুটোই উপস্থিত। উনি বুঝলেন কিনা জানিনা। নরম সুরে আমাকে বললেন—

ভয় পেয়েছো? তারা আমি এই ঘটনাটা চাইলেই অবিশ্বাস করতে পারতাম। কিন্তু এই ক্ষতচিহ্ন কিভাবে অবিশ্বাস করি?

আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। আমার ঠোট হাত পা এখনো কাপছে। জানিনা কেনো। ঈশান আমার অবস্থা খেয়াল করে বললেন–

তারা তুমি ঠিকাছো? এমন কেনো করছো?

আমি পুরো মুখে একবার মালিশ করে নিলাম। কোনো উত্তর না দিয়ে দুই হাটু উচু করে ভাজ করে গুটিশুটি মেরে বসে রইলাম। ঈশান ভাইয়া আবার আমায় ডাকলেন–

তারা!

আমি একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। কাপা কাপা কণ্ঠে বললাম–

ভয় লাগছে খুব। আমি কি একবার মায়ের ঘরে যেতে পারি? এখানে আমার ঘুম আসবে না। আর কাল তো চলেই যাচ্ছি। শেষবারের মতো মায়ের সাথে ঘুমিয়ে নেই?

কথাটা শেষ করে উনার মুখের দিকে তাকালাম আমি। আমার উত্তরে উনি যথেষ্ট অবাক। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন। এমন উত্তর আশা করেন নি উনি। হয়তো চেয়েছিলেন আমি উনাকে শান্তনা দেই…. উনাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি…..উনার কথা বিশ্বাস করি……উনি কিছু একটা চিন্তা করে হতাশ গলায় বললেন–

আচ্ছা যাও।

শব্দটা উনি যত দেরি করে বললেন ঠিক ততটাই তাড়াতাড়ি আমি উঠে দাড়ালাম। এক দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। ঈশান ভাইয়ার দিকে ফিরেও তাকালাম না। মায়ের ঘরে মা আর বুড়ি একসাথে ঘুমিয়ে আছেন। এইখানে আমার শোয়ার কোনো জায়গা নেই। আমি যে কেনো এখানে আসলাম আমি নিজেও জানিনা। ঈশান ভাইয়ার সাথে এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছিল না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মাঝে মাঝে মানুষ নিজেকেই নিজে বুঝে উঠতে পারেনা। নিজের মন বুঝতে বুঝতেই মানুষের জীবনের অর্ধেক সময় কেটে যায়। সবাইকে বোঝার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল নিজেকে বোঝা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রথম কাজ হবে জায়মাদের বাসায় যাওয়া। ওর পেট থেকে সমস্ত কথা বের করাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। সোফাতে বসে বসে এসব চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ মা ডেকে উঠলেন আমায়—

তারু তুই এখানে?

আধখোলা চোখে মা দেখছে আমাকে। আমি মায়ের কাছে গিয়ে বিছানা ধরে মাটিতে বসলাম। মা আমার গাল স্পর্শ করে বললেন–

কি হয়েছে মা? তুই এখানে কেনো?

মা আমি এখানে ঘুমাতে চাই।

এইটা আবার কেমন কথা? এখানে কিভাবে ঘুমাবি তুই? জায়গা হবে নাকি?

আমি নিচে শুয়ে থাকবো মা! তোমার পাশে। এইযে এইভাবে।

মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। মা আমার কান্ড দেখে ভ্রু কুচকে উঠে বসলেন এবার।

তোর কি হয়েছে বল তো তারু? ঈশানের সাথে ঝগড়া করেছিস??

কথাটা শুনে চোখ ভিজে আসলো আমার। মাকে কিভাবে বলি এই কথা। আমি মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখলাম। মা মৃদু হেসে আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। অনেক কিছু বলতে লাগলেন আমায়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যাপারে বললেন…… স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য বোঝালেন…. আরো অনেক অনেক উপদেশ। কিন্তু আমি সেসব কিছুই মনোযোগ দিয়ে শুনলাম না। আমার মন যে অন্য জায়গায় পড়ে আছে। কখন যে চোখটা লেগে এলো…… আর এভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম…. নিজেও টের পাইনি। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। মাথা উঠিয়ে দেখলাম মা বিছানার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘড়িতে দেখলাম আটটা বাজে। আমি উঠে দাড়ালাম। আর অপেক্ষা করা যাবেনা। তারিফ ভাইয়ার ঘুম ভাঙার আগেই আমাকে বের হতে হবে। ঈশানকেও জানতে দেওয়া যাবে না কিছু। আমার ঘরে গিয়ে দেখলাম ঈশান ঘুমাচ্ছে। কয়েক মিনিটের জন্য আমার চোখ দুটো আটকে গেল তার ওই ঘুমন্ত মুখে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পারাটা সৌভাগ্যের মতো লাগছে। এতোটা নিষ্পাপ দেখতে লাগছে যা বলার বাহিরে। নিজের মনের অজান্তেই উনার মাথায় হাত বুলিয়ে পরম আদরে উনার কপালে চুমু একে দিলাম আমি। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উঠে দাড়ালাম। আর দেরি করা চলবে না। কেউ জেগে উঠার আগেই আমাকে বের হতে হবে। মাথাটা কোনোমতে আছড়ে বেধে নিলাম। ওরনা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জায়মার বাসার উদ্দেশ্যে। সাইকেলের ঝুড়িতে নিয়ে রেখেছি সাদা একটা দড়ি। ফুটো করা পানির বোতল…… শক্ত হ্যান্ড গ্লাভস….ভাইয়ার নকল পিস্তলে নকল বুলেট আর রান্নাঘর থেকে ফল কাটার ছুড়ি।

.

.

জায়মাদের বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি। আন্টি মানে জায়মার মা কল পাড়ে বসে থালা বাসন ধোয়ার কাজ করছে। আমি সামনে গিয়ে দাড়াতেই আন্টি আচল দিয়ে কপালের পানি মুছে হেসে উঠলেন। আমি আন্টিকে সালাম দিলাম। আন্টি সালামের উত্তর নিয়ে জানতে চাইলেন কেমন আছি। বাসার সবার কেমন অবস্থা। তারিফ ভাইয়ার বিয়ে পেছনোর কারণ…… ব্লাহ ব্লাহ ব্লাহ। আমার আপাতত রাগে হাত পা কাপছে। তবুও খুব ধৈর্য্য নিয়ে আন্টির সব কটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হল আমায়। জায়মার কথা জিজ্ঞেস করতেই পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো জায়মা। জায়মাকে দেখে মেজাজ আমার আকাশচুম্বী। ইচ্ছে করছিল সামনে গিয়ে আগে দিয়ে নেই কয়টা চড় থাপ্পর। কিন্তু এখনি সেটা করা যাবেনা। আগে আমায় নিজেকে কন্ট্রোল করতে হবে। যেটা সবথেকে জরুরি কাজ। আমি একটা ইমোশোনাল টাইপ লুক নিয়ে জায়মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কান্না করার ভঙ্গি করে বললাম—

দোস্ত তুই একদম ঠিক বলেছিস। আমি তোর কথা বিশ্বাস না করে অনেক বড় ভুল করেছি। প্লিজ মাফ করে দে।

জায়মা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল– কি হয়েছে দোস্ত তোর?

ওর চোখের দৃষ্টি দেখে যা বুঝলাম আন্টির সামনে এসব কিছুই বলা হোক ও সেটা চায়না। আমি চোখের কোণে জমে থাকা পানি মোছার ভান করতে করতে বললাম— চল দোস্ত। তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। অনেক কথা আছে তোকে বলার।

জায়মা একবার আন্টির দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল— আচ্ছা তুই দাড়া আমি আসছি।

ঘরের গিয়ে চুলটা বেধে মাথায় ওরনা দিয়ে বেরিয়ে আসল জায়মা। জায়মাকে নিয়ে সাইকেলে করে আমি পাড়ি জমালাম এক অজানার উদ্দেশ্যে। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই জায়মা আমার কাধ স্পর্শ করে বলল—

দোস্ত তুই কি তখন ঈশান ভাইয়ার কথা বলছিলি?

আমি গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলাম– হুম।

জায়মা স্বস্তির একটা হাসি হেসে বলল— তার মানে তুই সত্যিটা জেনে গেছিস?

আমি একইভাবে হুম উচ্চারণ করলাম।

জায়মা আবার বলল— দোস্ত তোদের আবার বিয়ে হয়ে যাইনি তো??

আমি কঠিন গলায় না বললাম। জায়মা খুশি হয়ে পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল–

একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস দোস্ত। খুব ভালো করেছিস।

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। জায়মা আবার জিগ্যেস করল–

দোস্ত এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আমি এবার সাইকেল থামিয়ে দিলাম। সাইকেল থেকে নেমে ঝুরিটা খুলেই হ্যান্ড গ্লাভসগুলো বের করে পড়ে নিলাম। এই হ্যান্ড গ্লাভস পড়ে কাউকে আচ্ছামতো থাপরালে অনায়াসে বেহুস হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু জায়মাকে বেহুস করা যাবে না। তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রেখেই ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম। জায়মা কিছু বুঝে উঠার আগেই বা হাত উল্টো করে সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা চড় লাগিয়ে দিলাম মেয়েটার গালে। জায়মা কাত হয়ে পড়ে গেল নিচে। এইবার আমি দড়িটা দিয়ে ওর হাত বাধতে লাগলাম। জায়মা চাতক পাখির মতো ছটফটানি শুরু করে দিয়েছে। ছুড়িটা মুখের সামনে ধরতেই শান্ত হয়ে বসল। আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। কিন্তু তাতেও আমার কিছুই যায় আসেনা। আমি ওকে সাইকেলের সাথে বেধে ফেললাম। সাইকেলটাকে ঠেলতে ঠেলতে অনেক টা দূরে নিয়ে গেলাম। এই পুরোটা সময় জায়মা শুধু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল। না পেরেছে নড়তে না পেরেছে চিৎকার করতে। ওরই শরীরের ওরনা দিয়ে ওর মুখ বেধে নিয়েছি আমি। এই পুরোটা কাজ আমি একা হাতে কিভাবে করলাম আমি জানিনা। আমি যে এতোটা হিংস্র হতে পারি সেটা আজ জানলাম। নিজের এই ভয়ংকর রুপ টা আমার নিজেরই অজানা ছিল। তবুও বারবার হার্টবিট মিস হয়ে যাচ্ছে আমার। শ্বাস আটকে আসছে। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালেও ঘামছি আমি। জায়মাও ঘামছে। পার্থক্য হল সে ঘামছে ভয়ে….. আর আমি রাগে…. প্রতিশোধের আগুনে জর্জরিত হয়ে। আমি আরো কিছুটা পথ সাইকেলটা ঠেলে নিতেই জায়মা গোঙানি শুরু করলো। আমি পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে হাসলাম। পেছনে যে অতল সাগর। সাইকেলটা কে একটা ধাক্কা দিলেই উড়ে যাবে জায়মার প্রাণপাখি। ঘুচে যাবে তার বাচার আশা। নিভে যাবে জীবন প্রদীপ। কিন্তু এটা আমি করতে পারবো কি?? মেরে ফেলতে পারবো ওকে?, না….. এতোটা নির্দয় অন্তত আমি হতে পারিনা। আমার কাজ শুধু ওর কাছ থেকে সত্যি কথাটা আদায় করা। সেটা ভয় দেখিয়ে হোক….. কি অন্যরকম মানসিক টর্চার করেই হোক। আমি সাইকেলের ঝুড়ি খুলে পানির বোতলটা বের করলাম। বিশাল এই বোতলটা দড়ি দিয়ে বেধে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দিলাম। জায়মা বিস্ফোরিত চোখে আমার কান্ড দেখে যাচ্ছে। বোতলের ফোটা ফোটা পানি এসে লাগছে ওর হাতের একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। এই জায়গা থেকে সে চাইলেও নিজেকে নাড়াতে পারবে না। প্রথম প্রথম পানির ফোটা গুলো তার ভালোই লাগবে…… কিন্তু যতটা সময় অতিবাহিত হবে…..এই ফোটার ওজন ততই ভারী হতে থাকবে জায়মার জন্য। অসহ্য এই টর্চার কতক্ষণ কেউ মেনে নিতে পারে সেটাই প্রমাণ হয়ে যাবে আজ। আমি আসন পেতে বসে পড়লাম সবুজ ঘাসের উপর। আমার একহাতে নকল পিস্তল….. অন্যহাতে ফল কাটার ধারালো ছুড়ি।
🍂

তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ২৬
Writer: Sidratul muntaz

🍂
বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ জায়মা পাগলের মতো ছটফটানি শুরু করল। বাচ্চা মুরগীর গলায় ছুড়ি চালানোর পর যেমন কাপাকাপি অবস্থা শুরু হয়….. জায়মার অবস্থাটাও এখন ঠিক সেরকম। পানির ফোটার থেরাপিটা তাহলে ভালোই কাজ করছে। ঈশান ভাইয়ার কাছে পেয়েছিলাম এই শারীরিক টর্চারের আইডিয়া। এতো ভালো কাজে দেবে সত্যিই ভাবিনি। মেয়েটার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। ক্রমাগত নড়াচড়া করছে…. নিজেকে বাচানোর এক আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। আমার দয়া হলো। পানির বোতলটা খুলে নিলাম গাছ থেকে। জায়মা যেন এবার শ্বাস ফিরে পেল। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস একসাথে নিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি ওর মুখের বাধন খুলে দিলাম। গলা চিপে ছুড়িটা ঠিক টুটি বরাবর ধরলাম—

বল! সব সত্যি কথা ভালোয় ভালোয় বল। একটুখানি উনিশ বিশ হলেই তুই খালাস।

জায়মা আবার ছটফট শুরু করল। মুখ দিয়ে কথা বের করতে চাইছে কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আমি এবার ওর গলা ছেড়ে দিলাম। জায়মা আরেকবার হাফ ছেড়ে মাথা নিচু করল। ভীষণ হাপাচ্ছে মেয়েটা। মুখের যেটুকু অংশ এতোক্ষন বাধা ছিল তা সম্পূর্ণ লাল বর্ণ ধারণ করছে। আমি আমার চুল গুলো খোপা বেধে ওরনাটা ভালো মতো গলায় জড়িয়ে নিলাম। আরেকবার জায়মার গাল চেপে ধরে কড়া গলায় বললাম—

তুই কি সবটা বলবি?

জায়মা কোনো উত্তর দিল না। লাল চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে। ওর এই চাহনির মানে বুঝতে পারলাম না আমি। তাই দিলাম আরেকটা চড়। শক্ত গ্লাভসের চাপে গালটার প্রায় ঝাঝরা অবস্থা। জায়মা ব্যথায় কুকিয়ে উঠে তুমুল গতিতে মাথা নাড়তে লাগল। আমি বুঝলাম সে এবার সবকিছু বলতে চাইছে। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম। ধপ করে মাটিতে বসে বাম হাটু উচু করে ওই হাটুর ওপর বাম হাতটা ঝুলিয়ে বলে উঠলাম আমি–

বল!

জায়মা কান্না আটকে কাপা কাপা কণ্ঠে উচ্চারণ করল–

আমি…… আমি ঈশান ভাইয়াকে ভালোবাসি!

বলেই কেদে দিল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু। আমার মেজাজটা আপাতত তুঙ্গে উঠে গেছে। দাতে দাত চেপে জায়মার কাছে গিয়ে ওর চুলের ঝুটি টেনে ধরলাম। জায়মা আরেকবার আর্তনাদ করে চেচিয়ে উঠল–

তারু ছাড়… ব্যাথা…

ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি বললাম–

জানে মেরে ফেলবো একদম। ন্যাকামো বাদ দিয়ে আসল কথা বল।

জায়মা ঠোট চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল। মাথা নেড়ে বোঝালো সে সব বলবে। আমি ওকে ছেড়ে দিলাম। আবারও একই জায়গায় গিয়ে একই পজিশনে বসলাম। জায়মা কয়েকবার ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলল। জড়ানো গলায় কথা বলা শুরু করল–

প্রথম থেকেই ভালোবাসতাম ঈশানকে। ঠিক তোর মতোই। গল্প শুনে শুনে কল্পনার ছবি একেছিলাম মনে। ভালো লাগা থেকে আস্তে আস্তে ভালোবাসার জাল বুনেছিলাম। সেই জালে আবদ্ধ হয়ে কখন যে নিজের আমি টাকেই হারিয়ে ফেললাম….. টেরও পাইনি। খুব ভালোবাসতাম বিশ্বাস কর! এখনো বাসি! অনেক বেশি ভালোবাসি। তোর মতোই কল্পনার পৃথিবী সাজিয়েছিলাম। পার্থক্য ছিল একটাই। তুই সব প্রকাশ করতি। আর আমি নিজের মনে চেপে রাখতাম। না দেখেই ভালো বেসে ফেলেছিলাম উনাকে। তোর মতো পাগলামি আমিও কম করিনি। তুই তো ঘুমের মধ্যে প্রতিরাতে উনাকে স্বপ্নে দেখতি। আর আমি যে উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমাতেও ভুলে যেতাম। মনের সব আবেগ উজাড় করে উনাকে নিয়ে কবিতা লিখতাম। প্রেমের কবিতা। ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন দেখা হবে…..উনাকে আমার কবিতার ডায়েরি টা দেখাবো। আমার মনের সব ফিলিংস উনি পড়ে ফেলবেন এক পলকে। আমাকে আমার মতোই ভালোবাসবে। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন বৃথা গেল যখন জানতে পারলাম উনি তোকে ভালোবাসে।

জায়মার লাস্ট লাইনটা শুনে আমার কপালে বিস্ময়ের ভাজ ফুটে উঠল। হাটু নিচে নামিয়ে সোজা হয়ে জায়মার দিকে ঘুরে বসলাম আমি। অবাক স্বরে বলে উঠলাম —

মানে?

জায়মা মাথা নিচু করে কয়েক ফোটা চোখের পানি ফেলল। মেয়েটা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আসল কথা বলার নাম নেই খালি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না। ইচ্ছে করছে সত্যি সত্যি লাথি মেরে অথৈ সাগরে ফেলে দিতে। আমার লাথি দেওয়ার প্রয়োজন হল না। তার আগেই জায়মা আবার বলতে শুরু করল–

দুই বছর আগে। তোদের সেই পুরনো বাসায় ঈশান ভাইয়া এসেছিলেন। তারিফ ভাইয়ার সাথে কি একটা জরুরি কাজে। বেশিক্ষণ থাকেন নি। এতো দুর থেকে জার্নি করে এসেও কয়েক ঘণ্টা বসে চলে গিয়েছিলেন। তুই তখন দাদীর সাথে ঢাকা গিয়েছিলি। আর আমি ছুটে এসেছিলাম ঈশানকে এক নজর দেখার আশায়। সেদিন উনাকে দেখার পর আমার পাগলামি গুলো দ্বিগুন হয়ে গেল। সেই পাগলামি ক্ষোভে পরিণত হল যখন বুঝলাম ঈশান ভাইয়ার এইখানে আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তোর সাথে দেখা করা। বারবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন সেদিন। আমাকে তেমন একটা খেয়াল করেন নি উনি। হয়তো উনার মনেও নেই যে আমি ওখানে ছিলাম। তোর একটা হলুদ জামা পড়া ছবি ছিল দেয়ালে বাধাই করা মনে আছে? ( আমি মাথা নাড়লাম) ঈশান ভাইয়া ওই ছবির দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলেন। তারিফ ভাইয়া উনাকে ছবিটা দেখিয়ে বলেছিলেন এইটা তোর ছবি। উনি আড়ালে ছবিটার একটা কপি নিয়ে রেখেছিলেন নিজের ফোনে। তখন আর আমার বুঝতে বাকি ছিলনা সবটা। শুধু মানতে বাকি ছিল। মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুতেই। এরপর থেকে তোকে যতবার দেখতাম শরীরে জ্বালা ধরে যেতো। ইচ্ছে করতো তোকে মেরেই ফেলি।

কথাগুলো বলতে বলতে থেমে গেলো জায়মা। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে আবার বলল–

আমি সবসময় চাইতাম তোর সাথে যেন থাঞ্চুর সম্পর্ক হয়ে যায়। থাঞ্চুকে পেয়ে যেন ঈশান ভাইয়ার ভুত তোর ঘাড় থেকে নামে। তারু তোরা নতুন বাসায় চলে আসার পর কিন্তু থাঞ্চুর আর কোনো খোজ পাওয়া যায়নি। ও তোকে জ্বালানো বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু আসলে তোর সমস্ত খবরা খবর আমি থাঞ্চুকে দিতাম। থাঞ্চু ঈশান ভাইয়ার বিষয়ে সবটা জানে। তুই কখন কি করিস…. কোথায় যাস…..সবকিছুর নজরদারি করে ও। আমার আর থাঞ্চুর মধ্যে ডিল ছিল। আমি যদি ঈশানকে পাই……. তাহলে থাঞ্চুও তোকে পাবে।

কথাটা শুনে আমি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলাম।

তারপর বল।

জায়মা আবার বলতে শুরু করল– আমি সবসময় চাইতাম তোকে মেরে দিতে। কিন্তু থাঞ্চুর জন্য পারতাম না। থাঞ্চুও প্রথম দেখায় ঈশানকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার জন্য পারেনি। সেদিন যখন আমি আর তারিফ ভাইয়া ঈশান দের বাস স্ট্যান্ড থেকে আনতে গিয়েছিলাম….. ঈশান ভাইয়া চেয়েছিলেন পুরো এলাকা ঘুরে দেখতে। আমার মাথাতেও তখন বুদ্ধি খেলে গেল। সেটাই আমার জন্য একমাত্র সুযোগ ছিল ঈশানের সাথে থাঞ্চুর দেখা করানোর। আমি ঈশান ভাইয়ার সাথে ঘুরতে যেতে চাইলাম। উনি প্রথমে বিব্রত হলেও তারিফ ভাইয়ার সম্মতি পেয়ে যেতে রাজি হলেন। আমি থাঞ্চুকে মেসেজ করে সব জানিয়ে রেখেছিলাম। থাঞ্চু বিরাট একটা প্ল্যান সাজিয়েছিল। যেন তোর আর ঈশান ভাইয়ের সম্পর্ক হয়ে গেলেও আমরা সেটা এক চুটকিতে ভেঙে দিতে পারি।

আমি জায়মার দিকে ঘৃণ্য দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। সত্যিই কি এই কালসাপকে এতোদিন আমি বেস্ট ফ্রেন্ড ভেবে এসেছি? কতটা বোকা আমি! কপালে হাত রেখে হতাশ গলায় বললাম—

তারপর বল।

সেদিন ইচ্ছে করে পায়ে কাটা ফুটিয়েছিলাম আমি। যেন ঈশান ভাইয়া আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌছে দিতে বাধ্য হয়। বাসায় আমরা ঠিকই গিয়েছিলাম৷ কিন্তু বাসায় যাওয়ার আগে আরেকটা জায়গায়ও গিয়েছিলাম। সেটা ছিল থাঞ্চুর সিকরেট ক্যাম্প। ওখানে ওরা পাহাড়ি রা কিসব কালো জাদু করতো। ঈশান ভাইয়াকে দেখে থাঞ্চুর যেন মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল সেদিন। পকেটের ধারালো ছুড়িটা ঈশান ভাইয়ার গলায় চালাতে চেয়েছিল সে। কিন্তু আমি বাধা দিয়েছিলাম। হুমকি দিয়েছিলাম যে ঈশানের গায়ে একটা আচড়ও যদি লাগে তাহলে তারুকে মানে তোকে দুনিয়া থেকে বিদায় করবো আমি। সবাইকে সবটা বলে দিব। এছাড়াও থাঞ্চুর কুকর্মের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ আমার কাছে আগে থেকেই ছিল। আমি মরে গেলে সেগুলো ভাইরাল হতো সবার আগে। তাই আমার কোনো ক্ষতি কখনোই করতে পারতো না থাঞ্চু।

আমি ভ্রু কুচকে বললাম—

আচ্ছা তার আগে এইটা বল ঈশান ভাইয়া তোর সাথে থাঞ্চুর সিকরেট জায়গায় যেতে রাজি কেনো হয়েছিল?

উনি যেতে রাজি হয়নি। আমি উনাকে বুঝিয়েছিলাম আমরা বাসায় যাচ্ছি। উনি অন্ধকার জায়গা দেখে সন্দেহ করেছিলেন প্রথমে। কিন্তু ঈশান কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবচেতন করে ফেলেছিলাম উনাকে। মানে উনি হাটতে পারছিলেন….. কথা বলতে পারছিলেন….. সব করতে পারছিলেন….. শুধু উনার ব্রেইন কাজ করছিল না। কিছু চিন্তা করতে পারছিল না উনি। একটা সুগন্ধি ধোয়ার মাধ্যমে এটা করা হয়েছিল। এতে মানুষ বোধ বুদ্ধি হারায়। হুশ জ্ঞান হারিয়ে সে কি করছে কিছুই তার মনে থাকে না। ঈশান ভাইয়ার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। উনার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। আমরা ঘটনাটা কে এমন ভাবে সাজিয়েছিলাম যেন ঈশান ভাইয়ার বিরুদ্ধে রেইপ কেস আনতে পারি। উনি যেন আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।

আমি চোখ বড় করে জায়মার দিকে তাকালাম। মুখ দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আমার। চোখ টলমল হয়ে উঠলো। হুট করে উঠে দাড়িয়ে ঠাস করে জায়মার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। সাইকেল সহ উল্টে পড়ে গেল জায়মা। আবার ন্যাকা কান্না শুরু। সত্যি সত্যি ইচ্ছে করছে নিচে একদম সাগরে ফেলে দিতে ওকে। মেয়েটাকে খুন করে ফেলতে। নিজেকে আরেকবার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে জায়মাকে টেনে তুললাম আমি। ওর হাত পায়ের বাধন কেটে দিলাম। দুইকাধ ঝাকিয়ে কড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম–

তারপর বল। কি করেছিলিস আমার ঈশানের সাথে?

জায়মা কণ্ঠস্বর ঠিক করার চেষ্টা করে বলল–

সেদিন ঈশান ভাইয়া যা করেছেন সব অবচেতন অবস্থায় করেছেন। আমাদের টারগেট ছিল শুধু উনার আর আমার অন্তরঙ্গ মুহুর্তের কিছু ছবি। যেন আমরা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ছবিগুলো ক্যামেরায় তোলা হয়ছিল। ক্যামেরার রিল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ছবিগুলো আমরা হারিয়ে ছিলাম। তবুও আমাদের কাছে প্রমাণ ছিল। প্রমাণ আমি নিজে।

আমি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম। দুনিয়া আমার ঘুরতে শুরু করেছে। মাথাটা ধরে যাচ্ছে। কি শুনছি এসব আমি? এর আগে বধির কেনো হয়ে গেলাম না? এইরকম একটা মেয়ের সাথে এতোদিন আমি মেলামেশা করেছি ভাবতেও বমি আসছে আমার। কিভাবে পারলো এতোটা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করতে? কিভাবে?? মুখ টিপে কাদতে লাগলাম আমি। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে। নিজের শরীর নিজেই খামচে ফানা ফানা করে দিতে। একটা সময় আমার মাথায় নাড়া দিয়ে উঠল লকেটের বিষয় টা। সাথে সাথে জায়মার মুখের কাছে গিয়ে প্রশ্ন ছুড়লাম–

তাহলে লকেটের বিষয় টা কি ছিল? কেনো বলেছিলি ওইটা ঈশান দিয়েছে তোকে?

ওইটা কোনো লকেট ছিল না তারু। ওইটা একটা হিডেন ক্যামেরা ছিল। স্পাই ক্যামেরা। থাঞ্চু ওইটা আমাকে দিয়েছিল যেন সে সবকিছু দেখতে ও শুনতে পারে। ঈশান ভাইয়ার নামে তোর কানে বিষ ঢাললে তোর চেহারার অবস্থাটা ঠিক কেমন হতে পারে সেটাই উপভোগ করতে চেয়েছিল সে।

খুব সুন্দর করে মিথ্যা বলেছিলি সেদিন জায়মা! সরল মনে সবটা বিশ্বাস করেছিলাম। এইভাবে ধোকা দিতে পারলি? কি করে পারলি বল তো??

জায়মা চোখমুখ মুছে শান্ত হয়ে বসে রইল। কোনো উত্তর দিল না। আমি ওর উত্তরের আশাও করলাম না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুজনেই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলাম। চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে আমার। এই অশ্রুর ছাপ মুছে নিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম জায়মাকে—

থাঞ্চু কি আমার আর ঈশানের বিয়ে ঠিক হওয়ার বিষয়টা জানে?

না। জানলে ঈশান এখনো বেচে থাকতো না। আমিই জানাই নি। ভয়ে।

আমি মুচকি হেসে জায়মার দিকে পিস্তল ধরলাম–

আর কোনোদিন জানাতেও পারবি না তাহলে।

জায়মা বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকাল। মুখটা হা করে চিৎকার দিয়ে উঠল সে—

না তারু প্লিজ। প্লিজ তুই এমন করবি না।

জায়মার কপাল থেকে গলা পর্যন্ত ঘামে ভিজে উঠেছে। আমি অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে শ্যুট করলাম। জায়মার আত্মচিৎকারে যেন কেপে উঠল সারা দুনিয়া। চোখমুখ বন্ধ করে নিজেকে সংকুচিত বানিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ তার খেয়াল হল যে তার কিছুই হয়নি। একদম ঠিকাছে সে। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো জায়মা। আমি পিস্তল টা এক ঢিলে ছুড়ে ফেললাম। জায়মার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম–

অমানুষ তুই। আমি না।

উল্টো দিকে ঘুরে হাটা দিলাম আমি। পেছন থেকে হয়তো জায়মা কয়েকবার আমার নাম উচ্চারণ করেছে। তেমন একটা খেয়াল নেই। আমি হেটে চলেছি উদ্দেশ্যহীনভাবে…….
🍂

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here