আমি পদ্মজা পর্ব ৬৭+৬৮

আমি পদ্মজা- ৬৭
____________
আমির হাতের ছুরি চেয়ারের উপর রাখলো। তারপর রক্তমাখা জ্যাকেট খুলে মেঝেতে ফেললো। পদ্মজা ভয়ে মিইয়ে গেছে। অস্বাভাবিকভাবে ফোঁপাচ্ছে। খলিল যত দ্রুত সম্ভব জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন। মজিদ তীব্র বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে বিকৃত রূপ ধারণ করলেন। শফিক তাদের কতো কাজে লাগতো,সেটাও শেষ! পদ্মজাকে তার শুরু থেকেই অপছন্দ। মেয়েটার রূপের আড়ালে তিনি আগুন দেখতে পান। যে আগুন আমিরকে ঘায়েল করে তাদের নিঃশেষ করে দিবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমিরকে কিছু বলে লাভ নেই। পরে সময় করে বোঝাতে হবে। মাথায় অনেক চিন্তা নিয়ে তিনিও জায়গা ত্যাগ করলেন। আমির তার গায়ের শার্ট খুলে হাত-মুখের রক্ত মুছে,পদ্মজার দিকে এগিয়ে আসলো।
পদ্মজা আমিরের দিকে তাকানোর সাহস অবধি পাচ্ছে না। সে খুনের দৃশ্যটি বার বার দেখছে। মনে হচ্ছে,এই বুঝি আমির তার চোখ দুটি… না ভাবা যাচ্ছে না! পদ্মজা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলো। আমির ছুঁতেই দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমির দুই সেকেন্ডের জন্য থামে। তারপর জোর করে পদ্মজাকে বসালো। পদ্মজার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজা বিছানার এক কোণে চলে গেল। সে স্থির হতে পারছে না। তার মন,শরীর ভীষণভাবে অস্থির হয়ে আছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আমির অনেকক্ষণ পদ্মজার ভয় পাওয়া দেখলো। তারপর ডাকলো,’পদ্মজা।’
পদ্মজা হাঁটুতে মুখ গুঁজে রেখেছে। সে আমিরের ডাকে সাড়া দিল না। আমির উঁচু কণ্ঠে বললো,’তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমাকে কিছু করবো না।’
তাও পদ্মজা তাকায় না। তার শরীর বিরতিহীনভাবে কাঁপছে। আমির বিছানায় উঠে আসে। জোর জবরদস্তি করে পদ্মজাকে নামিয়ে আনে বিছানা থেকে। ধমক দেয়। পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসে এফোর(A4) ঘরে। এ ঘরটা অন্যরকম। সাধারণ ঘরের মতো। পদ্মজাকে বিছানায় রাখতেই, পদ্মজা আমিরকে জোরে ধাক্কা দিল। কিন্তু অদ্ভুত! তার ধাক্কায় আমির এক আঙ্গুলও নড়েনি। আমিরকে পদ্মজার আর স্বামী মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দানব। একটা দানব দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সে মুক্তির জন্য ছটফট করছে আর কাঁদছে। আমির পদ্মজাকে স্থির করার চেষ্টা করে। পদ্মজা কিছুতেই স্থির হয় না। সে তার মাকে খুঁজছে। মুক্তি চাইছে। ভয়ে তার শরীর শীতল হয়ে গেছে। বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মতো হু হু করে কাঁদছে। আমিরের ধৈর্য্য ভেঙে যায়, জোরে ধমকে উঠে,’কান্না থামাও। থামাও বলছি।’

পদ্মজা কান্না থামানোর চেষ্টা করে। ভয়ার্ত চোখে আমিরের দিকে তাকায়। আমির আসার সময় আরভিদকে দেখেছে। আরভিদের হাতে একটা ব্যাগ ছিল। সে পদ্মজাকে রেখে দরজার কাছে এসে আরভিদকে ডেকে ব্যাগ নিল। ব্যাগে পদ্মজার ঔষধপত্র,শাড়ি,ব্লাউজ,সোয়েটার,শাল রয়েছে। যখন বের হয়েছিল তখন বাইরে লতিফা দাঁড়িয়ে ছিল। ফরিনা পাঠিয়েছেন পদ্মজার খোঁজ নিতে। নয়তো তিনি খাবেন না। তাই লতিফা বাধ্য হয়ে এসেছিল। আমির লতিফাকে দেখে রেগে যায়। লতিফাও ভয় পেয়ে যায়। তবে আমির রেগে কিছু বললো না। শুধু প্রশ্ন করলো কেন এসেছে? তারপর উত্তর দিয়ে দিল,পদ্মজা ভালো আছে। একটা ব্যাগে যেন পদ্মজার দরকারি জিনিসপত্র দিয়ে দেয়া হয়। শেষ রাতে যেন বাড়ির পিছনে অপেক্ষা করে। আর দুইদিন থাকা হবে এখানে। দুটো দিন পদ্মজাকে চোখের আড়াল করা যাবে না। লতিফা শেষ রাতে ব্যাগ নিয়ে আসে। আমির লতিফার কথা ভুলে যায়। তারপর যখন মনে পড়ে,আরভিদকে পাঠায়। আমির ব্যাগ থেকে শাড়ি,ব্লাউজ বের করে বিছানার এক পাশে রাখলো। পদ্মজাকে বললো,’তখন বমি করেছো,এখন আবার রক্তও লেগেছে। পাল্টে নাও।’

আমিরের কণ্ঠ শান্ত,স্বাভাবিক। কিছু মুহূর্ত আগের ঘটনার কোনো ছাপ নেই তার মুখে। সে পদ্মজার জবাবের জন্য অপেক্ষা করে। পদ্মজা জবাব দেয় না। তার ফোঁপানো ধীরে ধীরে কমে আসে। ফিরে আসে তার স্থির স্বভাবে। পদ্মজার গাল থেকে রক্ত ঝরছে। আমির তুলা এনে কিছুটা বিছানায় রাখলো,আর কিছুটা দিয়ে পদ্মজার গালের রক্ত মুছার জন্য পদ্মজার এক হাত ধরে তার দিকে ফেরানোর চেষ্টা করতে চাইলো, তখনই পদ্মজা ছ্যাৎ করে উঠে দূরে সরে যায়,চোখ বড় বড় করে বললো,’দূরে থাকুন।’
‘রক্ত ঝরছে তো।’
‘আমারটা আমি দেখে নিতে পারবো।’
পদ্মজা বাকি তুলাটুকু নিজের গালে চেপে ধরলো। আমিরের আর কি বলার! সে পদ্মজার সাথে কথা বাড়ানোর সাহস পায় না। বিছানার চেয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে কাঠের চেয়ারে বসলো। দুজন দুইদিকে বসে থাকে চুপচাপ। নিস্তব্ধ,শান্ত পরিবেশের জন্য পদ্মজার নিঃশব্দে কান্না করাটা শুনতে পাচ্ছে আমির। সে কথা বলতে গিয়ে দেখলো,তার কথা ফুটছে না। আরো দুইবার চেষ্টা করার পর কথা ফুটল,’কী করবে ভেবে পাচ্ছো না? অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে?’
পদ্মজা আগুন দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। কটাক্ষ করে বললো,’আনন্দ হচ্ছে আপনার?’
‘আনন্দ হওয়ার কী আছে?’
‘কিছু নেই?’
‘না।’
‘ওই লোকটিকে খুন করে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন?’
‘নিজেকে ভালো প্রমাণ করার চেষ্টা করলে তোমার কাছে ভালো হতে পারবো?’
পদ্মজা থমকাল। সময় নিয়ে বললো,’আপনি আমার মাকে খুন করতে চেয়েছেন। আপনি আমাকে একটার পর একটা মিথ্যা বলেছেন। আর অন্যদের সাথে নৃশংসতার কথা না হয় বাদই দিলাম। তারপরও আমি আপনাকে ভালো মনে করব?’
‘সেটাই তো বললাম।’
তীব্র ঘৃণায় পদ্মজা মুখ ফিরিয়ে নিল। আমির বললো,’এসব কে বলেছে?’
‘মিথ্যে তো বলেনি।’
‘রিদওয়ান?’
‘সত্য তো?’

আমির উত্তর দিল না। পদ্মজা বললো,’আমার নিজেকে নর্দমার কীট মনে হচ্ছে। আপনার মতো একটা মানুষের সাথে এতদিন বসবাস করেছি আমি।’
‘গোসল করে পরিষ্কার হয়ে যাও।’
‘মজা করছেন?’
‘না।’
‘তারপর তো ঠিকই ছুঁবেন। জোর করে অপবিত্র করে দিবেন। পুরুষ তো আপনি। পেরে উঠবে না কোনো নারী। নারী তো ভোগের জিনিস। ভোগ করে করে ফেলে দেওয়ার জিনিস।’
আমিরের কপালে ভাঁজ পড়ে। বললো,’কবে তোমাকে জোর করেছি?’
‘আপনাকে ভালোমানুষ ভেবে,স্বামী ভেবে কখনো জোর করার সুযোগ দেইনি।’
‘ভালোবেসে না?’
‘দয়া করে,ভালোবাসার নাম মুখে নিয়েন না। আমার রূপে পাগল আপনি। আমার মতো সুন্দর মেয়ে আপনি দুটো দেখেননি এজন্য রেখে দিয়েছেন। বিয়ে করেছেন। হালাল সনদের অধিকারে ভোগ করেছেন। আমার এই সৌন্দর্য যদি না থাকতো, কবেই ছুঁড়ে দিতেন আবর্জনায়।’
‘রূপ নিয়ে অহংকার করছো? পাগল হয়ে গেছো তুমি।’
‘তাই করছি। আপনার ভাই রিদওয়ানের মনোরঞ্জনের জন্য আমাকে তুলে আনতে গিয়েছিলেন। নিজের বউকে অন্যজনের ভোগের জন্য আনতে গিয়েছিলেন।’
আমির হাসলো। হেসে বললো,’তখন তুমি আমার বউ ছিলে? দেখার পর হয়েছো।’
আমিরের হাসি পদ্মজার রাগ আরো কয়েনগুণ বাড়িয়ে তুললো,’আমার এই সুন্দর মুখ না থাকলে আমার জায়গা কি আপনার বিলাসবহুল বাড়িতে হতো? স্থায়ী রক্ষিতা হিসেবে?’
‘তোমার মনে হচ্ছে না,তুমি বাড়াবাড়ি করছো? তোমার সাথে এমন কথাবার্তা যায় না।’
‘আপনি তো আমাকে আমার জায়গায় থাকতে দিলেন না। আমাকে আপনার স্তরেই নামতে হবে এখন। নয়তো বাঁচবো কী করে? কয়দিন পরতো আমার বোনদের উপরও আপনার হাত পড়বে। ব্যবসায় বিপদে পড়েছেন তো।’
‘আটপাড়ার মেয়েদের-
পদ্মজা আমিরের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,’জানি আমি। কিন্তু সেই নিয়ম ভেঙে আপনি আমাকে ঠিকই তুলে আনতে গিয়েছিলেন। মেয়ের প্রয়োজনে আমার বোনদের উপর হাত দিবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? যেখানে আপনি আমার মাকে খুন করতে চেয়েছিলেন।’
‘তোমার বোনদের উপর কখনো কোনো আক্রমণ আসবে না। তুমি খুব বেশি কথা বলছো।
‘শরীরের শক্তির সাথে তো পেরে উঠি না।’
‘তাই কথা বলে মাথা খাচ্ছো?’
‘আপনার মরে যেতে ইচ্ছে করে না? এতো খারাপ কাজ করার পরও নিজেকে ক্লান্ত মনে হয় না? মনে হয় না,এইবার থামা উচিত?’
আমির মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। বললো,’অনেক কথা বলেছো। এইবার গোসল করে, খাওয়াদাওয়া করে আমাকে সুযোগ দাও।’
‘কীসের সুযোগ?’
‘তোমাকে বাঁধার। আমাকে বের হতে হবে আবার।’
পদ্মজা অন্যদিকে ফিরে বসে। যার অর্থ সে গোসল করবে না। তার অসহ্য লাগছে আমিরকে। আমিরের খুন করার অভিজ্ঞতা দেখে হাতাহাতি করার সাহস মরে গেছে। এখন থেকে যা করতে হবে,পরিকল্পনা মাফিক করতে হবে। নয়তো সে কিছুতেই পারবে না। মেয়েগুলোর মুক্তির আকুতি করে যে লাভ নেই সেটাও বুঝে গেছে। আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলো।। খপ করে পদ্মজার হাতে ধরলো। বললো,’যাও গোসলে।’
‘ছাড়ুন!’ কিড়মিড় করে বললো পদ্মজা।
‘গোসলে যাও। গোসল করে খাওয়াদাওয়া করে,ওষুধপত্র খেয়ে আমাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করো।’
‘নাটক করছেন কেন?’
‘নাটক তো তুমিও করছো। যেভাবে কথা বলছো এটা তো তুমি না।’
‘উফফ! ছাড়ুন।’
‘আমাকে বাধ্য করো না,তোমাকে গোসল করিয়ে দিতে।’
পদ্মজা বিস্ফোরিত হয়ে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’তখনই আমি মরে যাবো।’
‘সেজন্যই বলছি,নিজে যাও।’
‘আমি আপনার কথা শুনবো না।’
‘আমার হাতের মার কিন্তু খুব শক্ত। নরম আছি নরম থাকতে দাও।’
‘অন্যজনকে দিয়ে মার দিয়েছেন,এবার নিজে মারাটা বাকি। মেরে দিন না, এখুনি মেরে দিন।’
‘আমি কাউকে মারতে বলিনি। কিন্তু এরকম চলতে থাকলে,তুমি আমার হাতে শক্ত আঘাত পাবে।’
পদ্মজার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। সে ভেজাকণ্ঠে বললো,’সেদিনটাও যে আমাকে দেখতে হবে আমি জানি। তাহলে এখন কেন দরদ দেখাচ্ছেন? নাটক করছেন কেন?’
‘পদ্মজা আমার দেরি হয়ে যাবে। সময়টা আমার কাছে খুব মূল্যবান। দুই দিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। মাথা চড়ে আছে,কথা শুনো।’

পদ্মজা কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে,থুথু ছুঁড়ে মারলো। আকস্মিক ঘটনায় আমির হতভম্ব। পদ্মজা কথায়,কথায় থুথু ছুঁড়ে দিচ্ছে। যা অপমানজনক। কিন্তু আমির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে পদ্মজাকে জোর করে টেনে নামালো। বললো,’গোসলে যাও।’
‘গায়ের জোর দেখাচ্ছেন?’
‘দেখাচ্ছি।’
‘ছয় বছর তো জোরই দেখিয়েছেন।’
‘তোমার সম্মতিতে।’

পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকালো। শান্ত,গভীর ক্লান্ত দুটি চোখ। হিংস্রতার বিন্দুমাত্র রেশ নেই। খাড়া নাক,পাতলা ঠোঁটে হালকা গোলাপি ছাপ। থুথুনিতে কাটা দাগ। এলোমেলো চুল,কপালে দারুণ দুটো ভাঁজ। উত্তপ্ত চেনা নিঃশ্বাস মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় প্রাণের স্বামীর কথা। কত কত আদর,সোহাগ,ভালোবাসার ছন্দ এই মানুষটিকে ঘিরে। ঘৃণার মোটা দেয়াল ভেঙে ভালোবাসার অনুভূতিটা কী অদ্ভুতভাবেই ছুঁয়ে ফেললো পদ্মজাকে। তখনই কানে ভেসে আসে রিদওয়ানের কথাগুলো,ভেসে আসে মেয়েদের চিৎকার। চোখের সামনের রঙিন পর্দাটা সরে গিয়ে হয়ে উঠে ক্রোধী। পদ্মজা চাপাস্বরে আমিরকে জানায়,’শেষ অবধি আমি পদ্মজাই থাকবো।’
আমির পদ্মজার স্বরেই বললো,’পারবে না। আমার সাথে তুমি পারবে না। বিশ্বাস করো,গায়ের জোরে,বুদ্ধির খেলায় আমার সাথে পারবে এমন মানুষ জন্মিয়েছে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। তবে কোনো অনুভূতি জন্মালেও জন্মাতে পারে।’

আমিরের শেষ কথাটা দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে। কোনো অনুভূতি কি তলোয়ারের চেয়েও ধারালো হয়? সত্যি কি অনুভূতি কারো ধ্বংসের কারণ হতে পারে? তাহলে সেই অনুভূতি পদ্মজা কোথায় পাবে? যে অনুভূতি দিয়ে আমিরকে নিঃস্ব করে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠানো যাবে। শেষ হবে দুশো বছরের পাপ। আমিরের পদ্মবতী হয়ে উঠবে শুধুমাত্র পদ্মজা।
আমি পদ্মজা -৬৮
_____________
পদ্মজার শরীর ঘামে ভিজে একাকার। প্রচণ্ড গরম লাগছে। সকালে খুব ঠান্ডা ছিল। সোয়েটার পরার পরও তার শরীর কাঁপছিল। তাই আমির পদ্মজার গায়ে শাল পেঁচিয়ে দিয়েছিল। তারপর তো আমির বেরিয়েই গেল। এখন পদ্মজা গরমে ঘামছে। সময়টা দুপুরবেলা। সূর্য আজ অনেক তেজ নিয়ে আকাশে উঠেছে। পদ্মজার হাসঁফাঁস লাগছে। গরমে মাথা ব্যথা হয়ে গেছে। বসে থাকতে থাকতে কোমরও যেন অবশ হয়ে গেছে। আশেপাশে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভোরের দিকে মেয়েদের চিৎকার কানে এসেছিল। পদ্মজার কিছু করার ছিল না। সে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে। খট করে দরজা খুলে যায়। পদ্মজা চোখ তুলে তাকালো। আমির এসেছে! পরনে ফুলহাতা সাদা গেঞ্জি। পদ্মজা চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। আমির পদ্মজার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। তারপর শাল সরাতে চাইলে,পদ্মজা বাঁধা দিয়ে বললো,’ আমি পারবো।’
আমির সরে দাঁড়ালো। পদ্মজা গা থেকে শাল বিছানায় রেখে সোয়েটার খুললো। তারপর কাঠ কাঠ গলায় বললো,’দয়া করে আমাকে আর বাঁধবেন না।’
‘নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার স্বভাব আমার নেই।’
‘বসে থাকতে,থাকতে আমার কোমরের হাড় ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।’
‘দুই-তিনদিন বসে থাকলে হাড় ক্ষয় হয় না।’
পদ্মজা হতাশ হয়ে বললো,”আমার যন্ত্রণা হয়। ঝিমঝিম করে পা।’
আমির ঘরের এক কোণে থাকা কাঠের বক্সের দিকে এগোতে এগোতে বললো,’মামার বাড়িতে আসোনি যে,যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে।’
‘একুশটা মেয়ে কি জোগাড় হয়ে গেছে?’ আচমকা পদ্মজার এমন প্রশ্ন,তাও শান্ত কণ্ঠ।
আমির বক্সের তালা খুলে একটা ছুরি বের করলো। পদ্মজার জবাব দিল স্বাভাবিককণ্ঠে,’এতো সহজ নাকি! এতসব রিদওয়ান কেন যে তোমাকে বললো!’
‘আপনি আমার মাকে কীভাবে মারতে চেয়েছিলেন?’
‘পথের কাঁটা রাখতে নেই।’

পদ্মজা চমকে গেল,আহত হলো। আমির কত সহজভাবে তার মাকে উদেশ্য করে বললো ‘পথের কাঁটা রাখতে নেই।’ পদ্মজা কথা বলার মতো আর মন পাচ্ছে না। কষ্টও যেন সয়ে গেছে। শুধু তীক্ষ্ণ চোখে আমিরের পিঠের উপর তাকিয়ে রইলো। আমির উঁবু হয়ে কী যেন খুঁজছে। দরজা খোলা। পদ্মজা পরিকল্পনা করলো,সে এখন এক দৌড়ে ধ রক্তে চলে যাবে। যে ভাবনা সেই কাজ, এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায়। আমির না দেখেই পদ্মজার উদ্দেশ্যে বললো,’ পালাতে পারবে না।’
পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। বললো,’পালাচ্ছি না।’
আমির উঠে দাঁড়াল। পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বললো,’তো কোথায় যাচ্ছো?’
পদ্মজা বিছানায় এসে বসলো। তার মাথা কোনো কাজই করছে না। এখানে কোনো পথই নেই। সব পথ যেন বন্ধ করা। সে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললো,’ আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করছি না। করবও না। আমাকে বাঁধবেন না অনুরোধ।’
‘ছলনার পথ নিতে চাইছো?’
‘ছলনা করবো কেন? টয়লেটে যেতে পারি না,শুতে পারি না। স্বামীর নতুন বাড়িতে এসেছি তো নাকি? একটু শান্তি তো দিবেন।’
‘অভিনয়ে খুব কাঁচা তুমি। হচ্ছে না। ভালো করে অভিনয় করো নয়তো যা বলার সোজাসুজি বলো।’

পদ্মজা থতমত খেয়ে গেল। সে সোজাসুজি আর কিছুই বললো না। এক রাত চলে গেছে। মানে আর সাতদিন বাকি। কিছু করতে পারবে তো! আমির বক্স থেকে একটা বস্তু হাতে নিল। পদ্মজার দিকে ফিরে বললো,’যদি এটা ধরতে পারো তোমার বসা,শোয়া সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব।’
কথা শেষ করেই বস্তুটি পদ্মজার দিকে ছুঁড়ে মারলো। পদ্মজা ধরে ফেললো। আমির আবার বক্সের দিকে ফিরলো। বললো,’দারুণ। আমি আমার কথা রাখবো।’

পদ্মজা বস্তুটির এক মাথা ধরে টান দিতেই একটা ছুরি বেরিয়ে আসে। সে অবাক হয়ে আমিরের দিকে তাকালো। আমির মনোযোগ দিয়ে কি যেন খুঁজেই চলেছে। পদ্মজা তাৎক্ষণিক ভাবলো,ছুরি দিয়ে সে আমিরকে ভয় দেখাবে। ভয় দেখিয়ে সবগুলো মেয়েকে বাঁচিয়ে ফেলবে। তার উত্তেজিত মস্তিষ্ক গভীরভাবে কিছু আর ভাবলো না। পরিস্থিতিকে পানির মতো সহজ ভেবে,সে ধীরে,ধীরে এগিয়ে গেল। আমির আড়চোখে খেয়াল করলো, পদ্মজা আসছে। আর তার হাতে ছুরি। তাও আমির নড়লো না। ওইভাবেই রইলো। আমির যখন একটু দূরে তখন পদ্মজা হাঁটা থামিয়ে দৌড়ে এসে আমিরের গলায় ছুরি ধরে বললো,’সবগুলো মেয়েকে ছেড়ে দিন নয়তো আমি আপনাকে মেরে ফেলবো।’
আমির হাসলো। বললো,’পদ্মজা,এখানে শুটিং হচ্ছে না।’
পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে আছে। তবুও সে ভাঙা গলায় হুংকার ছেড়ে বললো,’ যা বলছি করুন।’
আমির নাছোড়বান্দা স্বরে বললো,’করব না।’
পদ্মজার আশার পাহাড় দুই ভাগ হয়ে যায়। তবুও সে হার মানার মেয়ে নয়। বললো,’আমাকে সহজ ভাববেন না। আমি কিন্তু স্বামী বলে ছেড়ে দেব না।’
‘এতো লম্বা হয়ে লাভ কী হলো? স্বামীর গলায় ছুরি ধরতে পায়ের আঙুলের উপর ভর দিতে হচ্ছে তোমার। এবার পায়ের পাতা মাটিতে ফেলো নয়তো আঙুল ভেঙে যাবে।’
পদ্মজা দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,’গতকাল থেকে আপনি আমার সাথে মশকরা করে যাচ্ছেন।’
আমির চমৎকার কৌশলে তার জায়গায় পদ্মজাকে নিয়ে আসে আর পদ্মজার জায়গায় সে চলে আসে। শুধু ছুরিটা আলাদা। আমির বললো,’তোমার হাতের ছুরি দিয়ে সুতাও কাটা যাবে না। ভোঁতা ছুরি। খেয়াল না করেই আমাকে আক্রমণ করতে চলে এসেছো। মশকরা আমি করছি নাকি তুমি? বাচ্চাদের মতো আচরণ করছো। বুদ্ধি হাঁটুতে চলে এসেছে। গতকালের শফিকের মৃত্যুটা তোমাকে তোমার জায়গা থেকে নড়বড়ে করে দিল, সেখানে আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করছো! বোকা মেয়ে। এখন আমি যদি তোমার গলার শিরাটা কেটে ফেলি? আমার হাতের ছুরি কিন্তু ভোঁতা না।’

পদ্মজার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে যায়। আমির এমনভাবে চেপে ধরে ছুরি ধরেছে যে, মনে হচ্ছে এখুনি আমির তার প্রাণ নিয়ে নিবে। কিন্তু আমির সেটা করলো না। পদ্মজাকে আলগা করে দিল। পদ্মজা ছাড়া পেয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আমির বললো,’আগে ঘোর কাটিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে আসো।’
কথা শেষ করে যখনই আমির বের হবে তখন পদ্মজা প্রশ্ন করলো,’এতো মন্দ ভাগ্য কেন হলো আমার?’

আমির জবাব না দিয়েই চলে গেল। পদ্মজা মেঝেতে বসে,ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে কোনদিকে যাবে,কী করবে? দিকদিশা পাচ্ছে না। এতো ভেবেও কোনো কূলকিনারা পেল না। আমির যদি তাকে বেঁধে না যায় তবে সে কিছু করার চেষ্টা করতো। কিন্তু সেটা কখনোই হবে না। আমির বোকা না। সে খুব সতর্ক এবং চালাক। পদ্মজা কান্না করা ছাড়া করার মতো আর কিছু পাচ্ছে না। নিজের কপাল চাপড়ে শুধু কান্না করারই সুযোগ আছে এখানে। আমির হ্যান্ডকাপ নিয়ে আসলো। পদ্মজার হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিল। পদ্মজা কিছু বললো না,আমিরও বললো না। হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আমির তার মতো চলে গেল। বের হওয়ার পূর্বে আরভিদকে বললো,’পদ্মজার হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো আছে। যদি এখানে হাঁটাহাটি করে কিছু বলো না। আমি বড় দরজায় নতুন তালা দিয়েছি। চাবি একটা আর সেটা আমার কাছে। যা ই করুক,বের হতে পারবে না।’
আরভিদ বললো,’যদি আমাকে আক্রমণ করে?’
‘ও হাত ছাড়া কাউকে আক্রমণও করতে পারে না। তাই নির্ভয়ে থাকবে। যা ইচ্ছে করুক পাত্তা দিবে না। মনে করবে,পিঁপড়া ঘোরাঘুরি করছে।’
আরভিদ বললো,’জি,স্যার।’
‘মেয়েগুলোকে খাবার দিবে। আমার আসতে অনেক রাত হবে।’
‘জি,স্যার।’
আমির রাফেদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার পূর্বে ভালো করে সবকিছু দেখে নিলো। পদ্মজা দ্বারা তার ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো পথ আছে নাকি! নেই! আমির নিশ্চিন্তে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। আচমকা তার খেয়াল হলো,তার হাত বন্দি কিন্তু পা বন্দি না। দরজাও খোলা। সে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে আসলো বাইরে। চারিদিক নির্জন,থমথমে। সে আগে প্রতিটি ঘর দেখলো। এটুতে(A2) রিদওয়ান ঘুমাচ্ছে। বাকি ঘরগুলো খালি। সে পা টিপে,টিপে স্বাগতম দরজা পেরিয়ে ধ-রক্ত দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ধ-রক্তের মানে সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে,ধর্ষণ এবং ধ্বংস থেকে নেয়া ধ। রক্তটা বোধহয় এদের মনের আনন্দ। তাই নামকরণ হয়েছে,ধ-রক্ত। পদ্মজা দরজা ধাক্কা দিতেই আরভিদ সামনে এসে দাঁড়ালো।

___________
মৃদুল সাইকেল নিয়ে বড় সড়কে পূর্ণার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা রায়পুর মেলায় যাবে। আজ শেষ দিন। পূর্ণার নাকি অনেকদিনের ইচ্ছে রায়পুর মেলায় যাওয়ার। কিন্তু হেমলতা কখনো মেলায় যেতে দেননি। তিনি সবসময় ভীড় থেকে মেয়েদের দূরে রেখেছেন। পূর্ণা তার বন্ধুদের কাছে শুধু শুনেছেই কখনো যায়নি। কথায় কথায় যখন মৃদুলকে সে বললো তার ইচ্ছের কথা। মৃদুল তাৎক্ষণিক পূর্ণাকে জানালো,’আমি তোমারে নিয়া যামু। কাইল দুপুরে বড় সড়কে আইসা পড়বা। বোরকা পইরা আসবা। ‘
মৃদুল অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে উঠে। তখন দূরের ক্ষেতে দেখা যায় পূর্ণাকে। কালো বোরকা পরা। আপাদমস্তক ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা। মাথার উপর তুলে রেখেছে নিকাব। সড়কের দুই পাশে বিস্তীর্ণ ক্ষেত। ক্ষেতের আইল ধরে ছুটে আসছে পূর্ণা। ওড়নার আংশিক অংশ বাতাসে উড়ছে। মৃদুল মনোমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণা মৃদুলের কাছে এসে হাঁপাতে থাকলো। হাঁপাতে,হাঁপাতে বললো,’অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই না? বড় আম্মা আসতেই দিচ্ছিল না।’
মৃদুল পূর্ণার পাতলা ত্বকের মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললো,’কী বইলা আইছো?’
‘কিছুই না। বলেছিলাম,সুরুজ চাচার বাড়িতে যাব। তখন বললো,কোথাও যাওয়া-যাওয়ি নাই। আপা জানতে পারলে নাকি বড় আম্মার উপর রাগবে। তাই না বলেই চলে এসেছি।’
‘চিন্তা করব তো।’
‘না বলে কতবার বের হয়েছি। কিছু হবে না।’
মৃদুল তাড়া দিয়ে বললো,’তাইলে তো হইলোই। তাড়াতাড়ি উঠো। যাইতে সময় লাগব।’
পূর্ণা এতক্ষণে সাইকেল খেয়াল করলো। সে বললো,’ সাইকেলে করে যাব?’
মৃদুল ফিরে তাকাল। বললো,’তাইলে কী দিয়া যাইবা? হাঁইটা গেলে বাড়ি আইতে আইতে আজকে সারা রাইত লাগব।’

মৃদুলের পিছনে থাকা খালি জায়গাটায় পূর্ণা তাকাল। মৃদুলের খুব কাছে। আর এখানে বসলে মৃদুলের পেট জড়িয়ে ধরতে হবে। ভাবতেই পূর্ণার হাড় হিম হয়ে আসে। এতদিনের পরিচয়ে একজন আরেকজনের হাতও ধরেনি। আর আজ এতো কাছে বসে পেট জড়িয়ে ধরতে হবে! পূর্ণা ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বললো,’সাইকেল দিয়ে যাব না আমি।’

মৃদুলের ভ্রুযুগল বেঁকে যায়। সে ধমকে উঠে,’নাটক করতাছো কেন? তাড়াতাড়ি উঠো। আর মুখটা ঘুরো। মানুষ দেখব।’

সূর্যের কিরণ এসে পড়ে মৃদুলের চোখেমুখে। স্নিগ্ধ, চকচকে ফর্সা মুখের সাথে বেঁকে যাওয়া দুটি ভ্রু কী সুন্দর করেই না মানিয়েছে! পূর্ণা সেদিকে চেয়ে থেকে কিছু বলতে পারলো না। নিকাব দিয়ে মুখ ঢেকে মৃদুলের পিছনে বসলো। মৃদুল মৃদু হাসলো, যা চোখে পড়লো না পূর্ণার। মৃদুল সাইকেলের চাকায় পা দিতেই পূর্ণা খামচে ধরে মৃদুলের শার্ট। মৃদুলের সর্বাঙ্গে একটা অজানা,অচেনা সুন্দর অনুভূতির উথালপাতাল ঢেউ উঠে। পূর্ণার বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে! নিঃশ্বাস এত বেশি এলোমেলো হয়ে পড়ে যে,পূর্ণার মনে হচ্ছে এখুনি সে মারা যাবে। মৃদুল আটপাড়া পার হয়ে, পূর্ণার উদ্দেশ্যে বললো,’কাঁপতাছো কেন?’
পূর্ণা কিছু বলতে পারলো না। কী লজ্জা! সে কাঁপছে সেটাও মৃদুল টের পাচ্ছে। পথের দুই দিকে যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ মাঠ। কোথাও কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না। পূর্ণা দূরে চোখ রেখে চুপ করে রয়েছে। মৃদুল বললো,’পূর্ণা?’
এ কেমন মায়াময় ডাক! পূর্ণার হৃদয়ে উঠা অপ্রতিরোধ্য তুফান বেড়ে যায়। বুকে এতো জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে কেন? যদি মৃদুল শুনে ফেলে! সে তো লজ্জায় মরেই যাবে। মৃদুল আবার ডাকলো,’পূর্ণা?’
পূর্ণা জুবুথুবু হয়ে উত্তর দিল,’কী?’
‘আমার হাত পা অবশ হইয়া যাইতাছে কেন?’
‘আমারও।’
সাইকেল থেমে গেল। মৃদুল পূর্ণাকে বললো,’নামো।’
পূর্ণা নামলো। মৃদুল বললো,’সাইকেল দিয়া আর যাওয়া যাইবো না। দূরে থাকা ভালা। তোমার ছোঁয়া বিজলির মতোন বাইরিতাছে আমারে।’
মৃদুলের কথা শুনে পূর্ণার খুব হাসি পেলো। সে হাসি আটকে রাখলো না। হেসে ফেললো। যদিও হাসি দেখা যায়নি। তবে মৃদুল বুঝতে পারলো,পূর্ণা হেসেছে। সে মুখ ভার করে বললো,’হাসো,হাসো। হাসবাই তো। আরেকটু হলে মরেই যেতাম।’
পূর্ণা সশব্দে হেসে উঠলো। মৃদুল বললো,’ হইছে আর হাসা লাগব না। হাঁটো। মাঠের মাঝখান দিয়া যাই কী বলো? তাইলে তাড়াতাড়ি যেতে পারব।’
পূর্ণা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। বললো,’সাইকেল কী করবেন?’
‘হাত দিয়া ঠেলে নিয়া যাব।’
দুজন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রায়পুর চলে আসে। মেলায় ঢুকতেই আছরের আযান পড়ে যায়! পূর্ণার মাথায় যেন বাজ পড়ে। সে ভীত কণ্ঠে বললো,’আছরের আযান পড়ে গেছে। বাড়ি কখন যাব? একটু পর তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আসুন,চলে যাই।’
‘মাত্র তো আইলাম। কিছু কিইনা এরপর যামুনে।’
‘দেরি হয়ে যাবে।’
‘খালি চুড়ি আর লিপস্টিক হইলেও নিয়া যাবা। আসো।’

মৃদুল শক্ত করে পূর্ণার হাত ধরলো। এই প্রথম মৃদুল হাত ধরেছে! সঙ্গে,সঙ্গে পূর্ণার মনে হয়,চারিদিকের সব ভীড়,কোলাহল থমকে গেছে। থমকে গেছে নাগরদোলার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ! পূর্ণার মনের আঙিনা জুড়ে নৃত্য শুরু হয়। সে ভুলে যায়, তার বাড়ি ফেরার তাড়া! মৃদুল যেদিকে নিয়ে যায়,সেদিকে ছুটে যায়। চারিদিকে কত শব্দ,কত মানুষ,রঙ-বেরঙের কত শাড়ি,গহনা,চুড়ি। কিছুই পূর্ণার চোখে পড়ছে না। শুধু অনুভব করছে,একটা পুরুষালি শক্ত হাত তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনে মনে এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে! রঙিন,রঙিন স্বপ্ন দেখে। এই সমাজ বিয়ের বাজারে সাদা-কালোর ভেদাভেদ করবে জেনেও সে ভালোবাসে। গায়ের রঙ মেনে কী আর ভালোবাসা হয়! মৃদুল একটা চুড়ির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আট ডজন চুড়ি কিনলো। পূর্ণা মানা করেছে,মৃদুল শুনেনি। চুড়ি কেনার পর মৃদুল বললো,’ অন্যকিছু দেখো। নূপুর নিবা না?’

পূর্ণা মাথা নাড়াল। সে নূপুর নিবে। সে একটা,একটা করে নূপুর দেখা শুরু করলো। মৃদুল এক ডজন সুতার চুড়ি হাতে নিল। চুড়িগুলো নিজের চোখের সামনে ধরলো। চুড়ির গোল ফাঁকা অংশে পূর্ণার মুখটা ভেসে উঠে। নিকাব মাথার উপর তুলে রাখা। চিকন নাকে নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছে। পূর্ণা একজোড়া নূপুর হাতে নিয়ে মৃদুলের দিকে তাকালো। মৃদুল দ্রুত চুড়ি সরিয়ে নিল। অন্যদিকে তাকালো। পূর্ণার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।
কথা ছিল শুধু চুড়ি,লিপস্টিক কিনে চলে যাবে অথচ মৃদুল পারলে পূর্ণার জন্য পুরো মেলাটাই কিনে ফেলে। পূর্ণা মৃদুলের পাগলামি দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে। এতকিছু নিচ্ছে! সব জিনিস রাখার জন্য বড় ব্যাগও কিনেছে! পূর্ণা মৃদুলকে চাপা স্বরে প্রশ্ন করলো,’এত কিছু কেন নিচ্ছেন?’
মৃদুল বললো,’জীবনে প্রথম আম্মার জন্য শাড়ি,জুতা কিনছিলাম। আজ যখন আবার সুযোগ পাইছি মেয়ে মানুষের জন্য কেনাকাটা করার,কিনতে দেও।’

সন্ধ্যার আযান কানে আসতেই পূর্ণার গলা শুকিয়ে যায়। সে খপ করে মৃদুলের হাতের বাহু খামচে ধরে, কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,’আমার আর কিছু লাগবে না। জীবনে আর মেলায়ও আসব না। বাড়ি নিয়ে চলুন।’
‘কাঁদতাছো কেন? আইচ্ছা আর কিছু কিনব না। বাজারে যাই। এরপরে বাড়িত যামু।’

মেলায় প্রবেশ করার পূর্বে,রায়পুরের বাজারের এক দোকানে মৃদুল তার সাইকেলটা রেখে এসেছে। যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে। দোকানদার মজিদ হাওলাদারের নাম শুনে,মৃদুলকে বাসায় যেতে বলেছিল। মৃদুল বলেছে,আরেকদিন যাবে। তারা মেলা থেকে বের হতে প্রস্তুত হয় তখন একজন লোক মৃদুলের পিঠ চাপড়ে বললো,’মৃদুল না?’
মৃদুল পরিচিত কারো কণ্ঠ পেয়ে উৎসুক হয়ে ফিরে তাকালো। লোকটিকে দেখে চিনতে পারলো। বললো,’আরে গফুর ভাই। কেমন আছেন?’
‘এইতো ভালাই আছি।’
‘রায়পুরে কী? মেলায় আইছেন?’
‘ছোট বইনডার জামাইর বাড়ি এইহানে। তোমার সাথে কেলা এইডে? বউ নাকি? বিয়া করলা কবে?’
পূর্ণা আড়ষ্ট হয়ে চোখ নামিয়ে নিল। মৃদুল আড়চোখে পূর্ণাকে দেখলো। তারপর বললো ‘জি ভাই,বউ। মাস খানেক হইলো।’

তখনই পূর্ণা মৃদুলের পিঠে চিমটি কাটলো। মৃদুল ‘আউ’ করে উঠে। গফুর উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তাই সে জোরপূর্বক হেসে বললো,’আজকে অনেক শীত! শীতে চিমটি মারে! আইচ্ছা,ভাই আজ আসি।’
‘রায়পুর কার বাড়িত আইছো কইলা না তো?’
‘অলন্দপুরে আইছি,ফুফুর বাড়িত। এহন যাই ভাই।’
‘মজিদ হাওলাদার তোমার ফুফুর ভাসুর না?’
‘জি।’
‘মানুষটারে দেখার অনেক ইচ্ছা আছিলো। অনেক ভালা কথা হুনি।’
মৃদুলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,’চইলা আইয়েন। আমিতো আছিই। আমারে এখন যাইতে দেন।’
‘যাও মিয়া।’

মেলার বাইরে এসে পূর্ণা বললো,’বউ বললেন কেন?’
মৃদুল বললো,’তে কী কইতাম? গ্রামে তোমারে আমারে মানুষ এক লগে কথা কইতে দেখে,হাঁটতে দেখে। এতেই নিন্দা করে। এখন যদি কেউ জানে সন্ধ্যা বেলা আমার সাথে এতো দূরে মেলায় আইছো কী হইবো জানো?’
‘এইজন্য বউ বলছেন?’ পূর্ণার কণ্ঠে অভিমান টের পাওয়া গেল। মৃদুল মুচকি হাসলো। বললো,’আর কী জন্যে বলব?’
পূর্ণা কিছু বললো না। শীতে তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে,এখানে অনেক বাতাস। হাঁটতে হাঁটতে মৃদুল বললো,’ভয় হইতাছে না?’
পূর্ণা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,’কীসের ভয়?’
‘পর পুরুষের সাথে রাতের বেলা এতো দূরে আছো। যদি কিছু হয়ে যায়?’
মৃদুলের কথা শুনে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যায় পূর্ণা। সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে মৃদুলের দিকে। মৃদুল পূর্ণার তাকানো দেখে হেসে উঠলো।
পূর্ণা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমতাআমতা করে বললো,’হা…হাসছেন কেন?’
‘তোমার ভয় পাওয়া দেইখা।’ মৃদুল হো হো করে হাসতে থাকলো। পূর্ণার খুব রাগ হয়। সে মৃদুলকে ফেলে সামনে হাঁটতে থাকে। মৃদুল পিছনে ডাকে,’আরে খাড়াও।’

বাজারে অনেক ভীড়। চিৎকার,চেঁচামেচি। মারামারি লেগেছে বোধহয়। মৃদুল,পূর্ণা রায়পুরের ছোট বাজারের ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত ভেজাল দেখে মৃদুল পূর্ণাকে বললো,’তুমি এইখানে খাড়াও। এইদিকে কেউ নাই। আমি যাইতাছি আর আইতাছি।’
পূর্ণা চারপাশ দেখলো। ঘাটে অনেক নৌকা,ট্রলার বাঁধা। কেউ নেই,সবাই বোধহয় বাজারে। মানুষ ঝগড়া করতে আর সময় পেল না! মৃদুল চলে গেল। পূর্ণা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দূর থেকে ইঞ্জিনের শব্দ আসছে। কোনো ট্রলার এদিকেই আসছে। গা হিম করা ঠান্ডা! পূর্ণা ব্যাগ থেকে নতুন কেনা শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল। এবার ঠান্ডা কম লাগছে!

ট্রলারের ছাদে বসে আমির সিগারেট ফুঁকছে। তার এক পা ঝুলছে। শীতের তীব্রতায় আমিরের রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তবুও উঠে গিয়ে শীতবস্ত্র ব্যবহার করছে না। সহ্য করছে। নদীর জলে চেয়ে থেকে কিছু ভাবছে। তার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। তিন-চার দিন ধরে সারাক্ষণ কপালের রগগুলো দপদপ করছে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করেছে। খুব ঝুঁকি নিয়ে এইবার তারা মেয়ে শিকার করছে। কখন কোন ভুল হয়ে যায় কে জানে! সারাক্ষণ একটা আতঙ্ক কাজ করে। আমির যে ট্রলারে বসে আছে,সে ট্রলারটি ঘাটে বাঁধা। তাদের আরো চারটা ট্রলারও পাশে আছে। আমিরের ডানপাশে একটা ইঞ্জিনের ছোট নৌকা এসে থামলো। নৌকায় রয়েছে মজিদ,খলিল সাথে আরো দুজন লোক। তাদেরকে দেখে আমির দ্রুত সিগারেট ফেলে দিল। ছাদ থেকে নামলো। মজিদকে ভক্তির সাথে সালাম দিল। মজিদ গম্ভীরস্বরে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,’ এইখানে কী করছো?’
আমির বাধ্য ছেলের মতো বললো,’মেলায় এসেছি। আম্মা পাঠিয়েছেন।’
‘তাড়াতাড়ি ফিরো।’
‘জি,আব্বা।’
মজিদের সাথে থাকা দুজন লোক মজিদের সাথে বুকে বুক মিলিয়ে বললো,’তাইলে এহন আসি ভাই?’
মজিদ বললেন,’ জি,আসুন। শুক্রবার কিন্তু আসবেন।’
‘আরে,আসব,আসব। আপনি দাওয়াত করবেন আর আমরা আসতাম না?’
মজিদ হেসে বললেন,’সাবধানে যাবেন।’

লোক দুটি চলে যেতেই আমির ছাদে উঠে বসে আরেকটা সিগারেট ধরাল। তীক্ষ্ণ চোখে মজিদের দিকে তাকিয়ে বললো,’সব চাপ কি আমার উপরেই? অন্যদের নাকে সরষে তেল দিয়ে আরাম করা হচ্ছে?’
মজিদ বললেন,’আরে আব্বা আমার! আমরাও তো আছি।’
খলিল বাঁকা স্বরে বললেন,’সারাবছর তো আমরাই এইহানে দৌড়াই। এই কয়দিনে তোর…’
খলিল পুরো কথা শেষ করতে পারলেন না। আমির বাঁধা দিয়ে খুব বিরক্তি নিয়ে বললো,’তুই চুপ থাক। তোর ছেড়ারে বলবি,কাল বিছানা ছাড়তে। নয়তো ওর ইঞ্জিনে এমন আঘাত করব, সামনে না বিয়ে করাতে যাচ্ছো সেই বিয়ে ভেস্তে যাবে।’
‘আহ আমির! চাচাকে তুই-তুকারি করতে নিষেধ করেছি না অনেকবার? মানুষ শুনলে কী বলবে?’
‘মানুষের জন্যই ওরে চাচা ডাকি। আর তোমার জন্যই ও বেঁচে আছে। নয়তো ওর দেহ এতদিনে পঁচে মাটির সাথে মিশে যেত।’

খলিলের মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে যায়। প্রতিদিন আমিরের অপমান, দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছে। বিন্দুমাত্র সম্মান করে না। খলিল মজিদের পাশ থেকে দূরে গিয়ে বসেন। মজিদ মুখ দিয়ে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে বললেন,’কেন যে তোরা নিজেদের মধ্যে ভেজাল করিস। এতে তো আমাদের দলই দূর্বল হয়ে যাবে।’
আমির নির্বিকার কণ্ঠে বললো,’কাউকে লাগবে না। আমি একাই যথেষ্ট।’
‘বললেই তো হবে না। একা চলা যায় না।’
‘আরে যাও তো।’
আমিরের মেজাজ তুঙ্গে। মজিদ সময় নিয়ে বললেন,’এতো রেগে আছিস কেন?’
আমির চোখ বড় বড় করে তাকালো। তার চোখ দুটি লাল। ভয়ংকর রেগে আছে সে। মজিদ আর কথা বাড়ালেন না। নৌকা ছেড়ে দেয়া হয়। চোখের পলকে দূরে হারিয়ে যায় নৌকাটি। ট্রলারের ভেতর থেকে মন্তু বেরিয়ে আসে। আমিরকে বলে,’ভাই,ছেড়িডারে সামলানি যায়তাছে না।’
‘যেভাবে সামলানো যায়,সেভাবে সামলা। চুলের মুঠি ধরে মা-বাপ তুলে গালি দিবি। মেয়েরা ছেলেদের মুখে নোংরা গালাগাল শুনলে দূর্বল হয়ে যায়। ভয় পায়। এ কথাটা কতবার বলব?’
মন্তু ভেতরে চলে যায়। আমির সিগারেটের ধোঁয়া শূন্যে উড়িয়ে ঘাটের উপরের ভিটায় তাকালো। একটা বোরকা পরা মেয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রখর দৃষ্টি মেয়েটিকে নিশানা করে। রাফেদ বাজার থেকে রঙ চা নিয়ে আসে। আমির রাফেদকে বললো,’ঘাটের মুখে মানুষ আছে?’
‘না স্যার। বাজারে এক দোকানদার আরেক দোকানদারের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে রক্তারক্তি অবস্থা। সবাই ওখানে।’
আমির চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। কেউ নেই। রাফেদকে বললো,’ওইযে মেয়েটিকে দেখছো? নিয়ে আসো।’
রাফেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! এতো ঝুঁকি নিয়ে খোলা জায়গায় শিকার! সে ঢোক গিলে বললো,’কী বলেন স্যার! এভাবে…’
‘তো? সময় আছে হাতে? এখন ঝুঁকি নিতেই হবে। পারলে,মানুষের মাঝ থেকেও তুলে আনতে হবে। মন্তুরে নিয়ে যাও। কোনোরকম বিপদ ছাড়া মেয়েটিকে নিয়ে আসবে।’
‘স্যা..’
আমির জায়গা ছেড়ে দূরে চলে যায়। রাফেদের কথা সে শুনলো না। তার বার বার মনে হচ্ছে,পদ্মজাকে মায়া দেখিয়ে এভাবে ছেড়ে এসে সে ভুল করে ফেলেছে। কেন ভুল মনে হচ্ছে জানে না! পদ্মজা একবার খুন করেছে এছাড়া সে খুব সাহসী,বুদ্ধিমতী। সে চাইলে বুদ্ধি দিয়েও অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু কী করবে? বের হতে তো কোনোভাবেই পারবে না। মেয়েগুলোর ঘরে ঢুকতে পারবে,কথা বলতে পারবে। এর বেশি কিছু না! তবুও মনটা কু গাইছে। ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে। সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,’আমি কি কোনো বোকামি করে ফেললাম? ওদিকে সব ঠিক আছে তো!’

রাফেদ হা করে আমিরের যাওয়া দেখলো। তারপর একটা কাচের বোতল থেকে তরল কিছু ঢেলে নিল রুমালে। মন্তুকে নিয়ে ট্রলার থেকে নামলো। তাদের লক্ষ্য অপেক্ষারত কালো বোরকা পরা মেয়েটি।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here