#মন_পাড়ায়
#পর্ব_২৯
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
সাথে সাথে কেঁপে উঠলো প্রভা। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। হাত তার পিছনে নিয়ে বারান্দার গ্রিল চেপে ধরলো। তার মনে হচ্ছে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
চোখ দুটো বন্ধ করতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক বেমানান দৃশ্য। একটি লোক তার দিকে আসছে। তার লোভাতুর দৃষ্টির কথা মনে পরতেই বুকে কেঁপে উঠলো প্রভার। ঘিনঘিন করতে শুরু করল তার সম্পূর্ণ দেহ। পরের দৃশ্যতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সে ঘটনায় ভীতিকর অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়েছিলো বিনয়কে। কারণ বিনয় তাকে চেয়েছিলো। হাজারো কষ্ট নিজের বুকে দাবিয়ে নিজের অস্তিত্বের উপর প্রশ্ন তুলে সেদিন বিলিয়ে দিতে হয়েছিলো নিজেকে। সেদিন থেকে এক অজানা ভয় তার বুকে কাবু করে যা ধূম্র হয়ে তার স্বপ্নে তাকে মিটিয়ে দেয় বারবার। তাকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায় এই জীবনটা সহ্যের। তার সুখের নয়, তার ইচ্ছের নয়, তার জীবনটা পরাধীন। যেমনটা সেদিন বিনয় করেছিলো আজ হয়তো অর্কও তেমন কিছু করবে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। যেখানে তার কোনো অস্তিত্বের, তার কোনো স্বপ্নের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। ভাবতেই কিছু নোনাপানি এসে তার চোখে বিরাজ করতে চাইছিল। এর পূর্বেই অর্ক মুখ তুলে তাকালো। বলল, “তোমার অনুমতি ছাড়া এমনটা করা উচিত হয় নি।”
প্রভা চোখ খুলে চমকে তাকাল। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
অর্কের মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব। সে চোখ নামিয়ে মাথার পিছনে হাত দিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছিলো তাই…… হঠাৎ করে কী হয়ে গেছিলো জানা নেই আমার। নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলাম না সরি।”
প্রভা কিছু বলল না। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্কের দিকে। অর্ক চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। ফিরে তাকিয়ে যেতে নিলেই দেয়ালে ধাক্কা লেগে কপালে ব্যাথা পেল। সে কপালে হাত বুলিয়ে পিছনে প্রভার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে আবার রুমে চলে গেল।
প্রভা কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো বিস্মিত দৃষ্টিতে। এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। পরের মুহূর্তে অর্কের একটু আগের দৃশ্য মনে পরতেই ফিক করে হেসে দিলো।
অর্ক রুমের ভেতর থেকে উঁচু স্বরে বলল, “আমি টেবিলে খেতে বসছি।”
প্রভা রুমে যেয়ে দেখে অর্ক নেই অর্থাৎ সে খেতে বসেছে। খাবার দিতে সে বের হতে নিলো। যাওয়ার পূর্বে এক পা পিছিয়ে আয়নায় নিজের দর্শন করল একটিবার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল। তাকে অতি সাধারণ লাগছে। অতি সাধারণ। তবে অর্ক বলল কেন যে তাকে সুন্দর লাগছে বিধায় সে নিজের অজান্তেই কাছে এসে পড়েছে?
ভাবতেই একরাশ লজ্জা কাবু করল প্রভাকে। যখন অর্ক এই কথাটা বলেছিল তখন তার লজ্জা লাগে নি কিন্তু এখন ভাবতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। সাথে একরাশ ভালোলাগাও কাজ করছে।
.
.
ঝিনুক কানে হেডফোন লাগিয়ে বিছানার উপর লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছিলো। তার চোখ দুটো বন্ধ। আচকায় এক টান দিলো কেউ তাকে। সে চমকে চোখ দুটো খুলল। চোখ খুলতেই দেখল সৈকত নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার কোমর দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে, চিবুক তার পেটে ঠেকিয়ে উপরে তাকালো। আর বলল, “বিছানার উপর এমন উড়াধুরা নাচের কারণ কী জানেমান?”
মুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেল ঝিনুকের৷ সে ক্রোধিত স্বরে বলল, “তোমাকে আমি বলেছিলাম আমার কাছে আসবে না। কথা তো কানে যায় না তাই না?”
“ইশশ তোমাকে রাগে এত কিউট লাগে কেন?”
“লাত্থি মারলে আরও বেশি কিউট লাগে। এখন ছেড়ে দেও, নাহয় উড়াধুরা মাইর খাবে।”
“এখন নাহয় নাটক করছ যখন মা ও দাদিমা বলবে তাদের এই ঘরে একটা বাবু লাগবে তখন কী করবে?”
ঝিনুক চোখ দুটো বড় বড় করে তাকাল সৈকতের দিকে। তার গাল দুটো মুহূর্তে লালচে হয়ে গেছে। সে একটু কেশে বলল, “আমি তো তোমার সাথে সারাজীবন আর কাটাবো না। প্রভা আপু ও দুলাভাইয়ের মাঝে সব ঠিক হলেই ফুরুৎ করে চলে যাব। তারপর তুমি বাকি জীবন কাটিও তোমার জ্যোতির সাথে। ”
জ্যোতির কথা শুনতেই সৈকত ঝিনুককে ছেড়ে বিছানায় বসল। ব্যাপারটা আরও বেশি মেজাজ খারাপ করল ঝিনুকের। অন্যকোনো কথায় সৈকত তাকে ছাড়লে সে শান্তি পেত। এই কথাটা ভীষণ অভিমানী করে তুলল তাকে। সে বিছানা থেকে নামতেই সৈকত জিজ্ঞেস করল, “তুমি ও জ্যোতি না’কি বাজি লেগেছ? যে জিতবে সে যা চাইবে পরাজিত জন তাকে তাই দিবে। ও যদি আমাকে চায়?”
ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে তাকালো সৈকতের দিকে। মিথ্যে এক হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে উওর দিলো, “প্রশ্নই আসে না। যে মানুষ আমারই না তাকে চাইলে আমি কীভাবে দিব?”
“আমি তোমার না?”
“তুমি আমার? তাহলে তুমি জ্যোতির কে?”
প্রশ্নটা ভীষণ দ্বিধায় ফালিয়ে দিলো সৈকতকে। সে কথা ঘুরানোর জন্য বলল, “আজ আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিবে একটু?”
“কেন নবাবজাদা আপনার হাতে ছালা পড়ে গেছে?” ঝিনুক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও বিরক্তিকর হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল। সৈকত অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ঝিনুকের দিকে। তার ডান হাত উঠিয়ে দেখালো তার হাতের ব্যান্ডেজ। সে বলল, “আজ হাতটা পুড়ে গেছে?”
ঝিনুক তা দেখে অস্থির হয়ে তার সামনে যেয়ে হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে পুড়ে গেছে?”
“ইকবালের বাসায় গিয়েছিলাম জানালায় হাত রাখলাম। জানালার কাঁচ ভাঙা ছিলো সেভাবে।”
ঝিনুক সৈকতের হাত ছেড়ে কাঠখোট্টা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “জানালার কাঁচের সাথে হাত লেগে তোমার হাত পুড়ে গেছে? একদম কয়লা এনে হাতে লাগিয়ে দিব।”
সৈকত বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল, “এমন করো কেন জানেমান। রোদে হাত পুড়ে গেছে সানবার্ন আর কি?”
ঝিনুক কতক্ষণ সৈকতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে গেল।
.
.
আকাশটা জ্যোৎস্নাময়। চাঁদের একরাশ জ্যোৎস্না এসে পরছে অঞ্জলির উপর। সে বিছানার এক কোণে বসে কথা মৃদুস্বরে কথা বলছিলো সাবেকের সাথে, “তুমি দয়া করে একটু সিরিয়াস হও না প্লিজ। তুমি জানো যে আমার পরিবার তোমার জন্য মানবে না এর উপর তুমি যদি এমন গাফলতি কর তাহলে কীভাবে আমি আমার মা বাবাকে তোমার কথা বলব বলো?”
“উফফ জান এত অসহায় ভঙ্গিতে বলো না তো। একদম বুকে যেয়ে লাগে।”
“মজা না সাবেক। আই এম ড্যাম সিরিয়াস। আমার পর আমার দুই ছোট বোন ও এক ভাই আছে। বাবারও বয়স হয়েছে। বাবা মায়ের ইচ্ছা এমন কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দিবে যে আমাদের সংসারও দেখতে পারবে।”
“ডিরেক্ট বললেই তো হয় টাকাওয়ালা বর চায় তারা। আর এইদিকে তুমি প্রেম করে বসসো এক মুদির দোকানের ছেলের সাথে যে জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করে। তার ভবিষ্যত কী সে তা নিজেও জানে না।”
“এইজন্যই তো বলছি ভালো মতো পড়াশোনা কর যেন ভালো পজিশনে চাকরি পাও।”
“করছি তো জান্টুস। এখন চাকরি পাওয়া না পাওয়া আল্লাহর ভরসা। তুমি এখন ভালো মেয়ের মতো ঘুমিয়ে যাও আমিও যেয়ে ঘুমাই। আজকে এক প্লেট বিরিয়ানি খাইসি এত মজার ছিলো যা বলার মতো না। এখন ঘুম পায় শুধু। সময় আসলে আংকেল আন্টির সাথে কথা বলে তাদের বুঝানো যাবে। তুমি চিন্তা কর না।”
অঞ্জলি ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একপলক তার পাশে ঘুমন্ত দুই বোনের দিকে তাকিয়ে আবার তাকালো জানালার ওপাড়ের স্নিগ্ধময় চাঁদের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটুর উপর মাথা রাখল। সে জানে সবাই তাকে ভালোবাসে। সাবেক, তার পরিবার সবাই। অথচ কেউ তাকে চায় না। মানুষ কেন ভালোবেসেও ভালোবাসার মানুষদের বুঝতে চায় না?
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_৩০
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
“তীব্র হাওয়া বইছিলো। শীতের রাতে মনের উল্লাসে সবাই গানের কলি খেলছিলাম বাসের মধ্যে। তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। রুহানির সাথে দুলাভাইয়ের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার নামে আমরা বান্ধবীরা তাদের সাথে যাই রাঙামাটি। যদিও আমি প্রভা আপুকে সত্যিটা বলে যাই এবং আপুও অনুমতি দেয় সাথে সৈকত থাকবে বলে। প্রভা আপি প্রথম থেকেই সৈকতকে খুব বিশ্বাস করতেন। আপিই বলে যেন বাসায় না বলি, পরিশ ভাইয়া জানলে সমস্যা হবে। এবং পরিশ ভাইয়ার রাগ দেখে খালামণিই কথায় কথায় নিজেই সত্যিটা বলে দিবে। পরিশ ভাইয়াও তখন কক্সবাজারে থাকে তাই বিশেষ সমস্যা হয় না।
সেসময় মিথিলা ও রাজু ভাইয়ার জন্য প্রায় আমার ও সৈকতের দেখা হতো তবে বেশি কথা হতো না। ও তেমন কথা বলতো না। আর আমি তো সেধে-সেধে কথা বলতে যাব না।
সেদিন আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। রাত তখন দেড়টা বাজে। ঘুম আসাটাও তো অস্বাভাবিক নয়। উঠে যেয়ে বসলাম বাসের শেষ সিটে। জানালার ওপাড়ে দেখি কুহেলিকা ও আঁধারের চাদরে ঘেরা। আমি পাশে তাকিয়ে দেখি সৈকত এসে বসেছে এক সিট পর। ঔষধ খাচ্ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করতে চাইলাম কিসের ঔষধ কিন্তু আর জিজ্ঞেস করলাম না পরে। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ও আমায় বলল, ‘আমার প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে একটু শুতে পারি?’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। আমি সিট ছেড়ে উঠতে নেওয়ার পূর্বেই ও আমার কোলে মাথা রাখল। আমি চমকে উঠলাম। সে সময় কিছুটা লাজুক ছিলাম বটে। এভাবে কেউ এসে কোলে শুয়ে পরলে লজ্জা ভাবটা বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমি কিছু বলতেও পারছিলাম না বিস্ময়ে। ও নিজ থেকে আমার হাত নিজের মাথায় রেখে বলল, ‘একটু চুলে হাত বুলিয়ে দেও না প্লিজ। মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ।’
সত্যি বলছি অঞ্জলি যদি আমি আজকের ঝিনুক হতাম একদম জুতাটা খুলে ঠাস ঠাস করে মারলাম।”
অঞ্জলির মুখে একরাশ বিরক্তির ছাপ পরল। সে বলল, “মানে তোর শান্তি নেই তাই না? আমি এত কিউট মোমেন্ট কল্পনা করছিলাম আর মাঝখানে এই কথাটা বলে আমার কল্পনা আর আবেগ সব কিছুই বারোটা বাজিয়ে দিলি। তো কাহিনী আর শুনবই না। একটা ঘটনা বলিস যখনই সুন্দর কোনো মুহূর্ত আসে তখনই এমন কিছু বলিস যে মন মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়।”
“তো তোর কি মনে হয় আমি ওই সৈকতের প্রশংসা করব যে নিজের বউয়ের সামনে অন্য মেয়ের হাত ধরে ঢ্যাংঢ্যাং করে ঘুরে বেড়ায়।” ঝিনুক তার ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল। আর উঠে দাঁড়ালো।
অঞ্জলি নিজেও উঠে দাঁড়ালো। বলল, “কিন্তু সৈকত ভাইয়া জ্যোতির দিকে কখনো সে দৃষ্টিতে তাকায় না যে দৃষ্টিতে তোর দিকে তাকায়।”
“কোন দৃষ্টিতে?”
“বুঝাতে পারব না। মানে ভালোলাগা…..ভালোবাসার দৃষ্টিতে।”
ঝিনুক চোখ বন্ধ করে আবার বসলো বেঞ্চে। বলল, “সব ওর অভিনয়।”
“মানুষ সব অভিনয় করতে পারে কিছু মুহূর্তের জন্য কিন্তু প্রতি মুহূর্ত মুখোশ পরে থাকতে পারে না। এক না এক সময় সে মুখোশ খুলতেই হয়। আর চোখ কখনো মিথ্যা বলতে পারে না।”
“তাহলে আমি বলবো তুই চোখের ভাষা বুঝতে পারিস না। আমিও পারি না। কারণ আমি যতবার ওকে ঘৃণা করতে চাই ওর ততবারই চাহনি দেখে সব ভুলে যাই।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঝিনুক।
অঞ্জলিও ঝিনুকের সামনের বেঞ্চে বসে ঝিনুকের এক হাত ধরে বলল, “তুই সৈকত ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখ। কোনো না কোনো কারণ থাকতে পারে উনি যা করছে তার পিছনে।”
“যেমন? তোর কী মনে হয় কোন কারণ থাকতে পারে?” প্রশ্নটা শুনেই অঞ্জলি চুপ হয়ে গেল। ঝিনুক আবারও বলল, “কোনো কারণ নেই, ওর স্বভাবটাই এমন। ও আগের থেকেই এমন। আর আমি এমন একটা মানুষের সাথে থাকতে পারব না যে তার স্ত্রীর সামনে অন্য মেয়ের সাথে…..” থেমে গেল ঝিনুক তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “এই বিষয়ে না কথা বললেই ভালো। আর আমরা এই বিষয়ে তর্কই বা করছি কেন? চল বাসায় যাই দেরি হচ্ছে। কাল সকালে আবার অনেক কাজ আছে। তুই কাল কয়টা আসছিস বাসায়?”
“সকাল আটটায় তোর বাসায় থাকব। অদিনকে পড়িয়ে একবারে তোকে রেডি করিয়ে এইখানে আসব। আসতে আসতে ধর সাড়ে এগারোটা বাজবে।”
“অনুষ্ঠান না দশটায় শুরু?”
“ওইসব বলেই শুরু হতে হতে ওই বারোটা বাজবে। চল নিচে যেতে যেতে কথা বলি।”
দুইজনেই উঠে দাঁড়ালো। নিজেদের ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে লিফটে যায়। ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, “অদিনক তো এই এক সাপ্তাহ ধরে পড়াচ্ছিস। কেমন লাগলো?”
“এত দুষ্টু ছেলে আমি আজ পর্যন্ত দেখি নি। এইজন্যই বলি তুই নিজে ওকে পড়াতে পারিস। আমাকে বললি কেন? ভেবেছিলাম আমার হেল্প করার জন্য বলেছিস এখন দেখছি অন্য কাহিনি৷”
ঝিনুক হেসে বলল, “ওকে পড়াতে নিলে আমাকে বকা দেয় উল্টো। আরও নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে একটু। বন্ধু-বান্ধব সব পিছনে ছুটে গেছে তাই আমাদের সাথে আরও দুষ্টুমি করে। এর মধ্যে আরেক কাহিনী। আমার শশুড় আব্বা সেই রাগ যে আমরা ঘুরতে যাব সেখানে বিনু আর অদিনকে নিয়ে যাব কেন? এখন বল বাচ্চারা কী মা ছাড়া থাকতে পারবে? তাও বিনু অনেক বুদ্ধিমান, ওকে রেখে গেলেও অদিন কত ছোট না? তবে দুলাভাইয়ের এক কথায় মেনে গেছে।”
“বড় স্যার অর্ক স্যারের কোনো কথা ফালায় না। এমনকি বাবা বলল অর্ক ভাইয়া শুধু অফিসে এসে বলেছিল যে সে প্রভা আপুকে বিয়ে করবে। আংকেল জানতো প্রভা আপুর আগে বিয়ে হয়েছে বাচ্চাও আছে কিন্তু এই নিয়ে একটা কথাও বলে নি। তবে অর্ক স্যারের খালা, মামারা না’কি ভীষণ রাগ করেছে। বড় স্যারকে উল্টা-পাল্টা অনেক কথা বলেছে অফিসে এসে। এইজন্য অর্ক স্যার তাদের সাথে কথা বলাও ছেড়ে দিয়েছে।”
ঝিনুক চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “বলিস কি আমি কিছুই জানি না।”
অঞ্জলি হেসে বলল, “জানা লাগবে না। যেয়ে ডান্স প্রাক্টিস কর। কাল যেন ওই জ্যোতির অহংকার মাটিতে মিশাতে পারিস।”
ঝিনুক কপালে হাত রেখে বলল, “জ্বি ম্যাম ঠিকাছে।”
ঝিনুক অঞ্জলিকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে নিজে রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলো। বাসার গলির সামনে যেতেই তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে রিকশা থামিয়ে একটি গাড়ির সামনে যেয়ে উৎসুক গলায় বলল, “ভাইয়া আপনি এইখানে কীভাবে?”
আদিল পরিশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ঝিনুকের কন্ঠ শুনতেই তার দিকে তাকালো। পরের মুহূর্তেই আবার চোখ নামিয়ে কাওকে ফোন দিয়ে বলল, “হ্যালো হ্যাঁ, ঝিনুক আমার সামনে। তুই ভিতরর ঢুকিস না গাড়ির কাছে আয়।” আবার ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেমন আছো?”
“আমি ভালো। কিন্তু আপনি এইখানে কীভাবে? আর কাকে ফোন করে বললেন আমি আপনার সামনে।”
“স্যারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”
“পরিশ ভাইয়া পাঠিয়েছে?” উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল ঝিনুক। পিছন থেকে এক কন্ঠ এলো, “না পরিশ ভাইয়া নিজে এসেছে।”
ঝিনুক চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে পরিশকে দেখতেই সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর লাফিয়ে উঠে পরিশের কাছে যেয়ে তার একহাত ধরে বলল, “ভাইয়া তুমি কবে এসেছ? আমাকে কেউ বলে নি কেউ? আর তুমি…… ” পরিশ তার কথা কেটে গম্ভীর গলায় বলল, “ওইসব বাদ দিয়ে বল তোর বিয়ে হয়েছে মানে কী? তাও ওই সৈকতের সাথে! তোকে আমি এত সতর্ক করলাম তাও তুই ওকেই বেছে নিলি?”
“না ভাইয়া তুমি ভুল বুঝছ। হঠাৎ করে বিয়েটা হয়ে গেছে।”
পরিশ আরও গম্ভীর স্বরে বলল, “আর তুই আমাকে জানাসও নি বিয়ের কথা।”
“খালু না করেছিলো তোমাকে জানাতে, নাহয় আমি তোমার থেকে এত বড় কথা লুকাতাম না’কি?”
পরিশকে তবুও সন্তুষ্ট মনে হলো না। সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। ঝিনুক বলল, “ভাইয়া তুমি বাসায় চলো, প্রভা আপু তোমায় সব বুঝিয়ে বলবে।”
ঝিনুক পরিশের হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে নিলেই পরিশ হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, “তুই যেয়ে গাড়িতে বস।”
“কিন্তু ভাইয়া…..” ঝিনুকের কথা সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই পরিশ ধমকের সুরে বলল, “কথা কানে যাচ্ছে না? যেয়ে গাড়ি বস।”
ঝিনুক কেঁপে উঠলো। আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলো পরিশের দিকে। তার এই পৃথিবীতে দুইটা মানুষের থেকেই সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে তার খালু ও পরিশ ভাইয়া। ঠিক পরিশ ভাইয়া থেকে না। পরিশ ভাইয়ার রাগ থেকে। পরিশ ভাইয়া আবারও বলল, “বলেছি গাড়িতে উঠে বস আমরা বাসায় যেয়ে কথা বলব।”
ঝিনুক কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
.
.
রাত তখন নয়টা বাজে। অর্ক এসে তার টাই খুলে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরল। প্রভা কিছুক্ষণ পর তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “লেবুপানি এনেছি। জলদি খেয়ে নিন ক্লান্তি দূর হবে।”
“প্রভা যাও তো এইখান থেকে ভালো লাগছে না।”
“আপনার কন্ঠ শুনে আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।”
“এখন না প্রভা। ভালো লাগছে না।”
অর্ক আর প্রভার কন্ঠ না শুনতে পেয়ে ভাবলো সে চলে গেছে। সাথে তার বিছানার সাইড বক্সে লেবুপানির গ্লাস রেখে গেছে, তার শব্দও পেয়েছে। ভালোই হলো। ভীষণ চিন্তায় আছে সে। একদিকে কোম্পানির ঝামেলা অন্যদিকে তার মা’য়ের বাড়ির কেউ তার সাথে কথা বলে না। আর চিন্তায় তার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না তার একা থাকতে ইচ্ছে হয়।
অবশেষে যখন একটু ভালো লাগলো তখন সে উঠে বসে সামনে তাকাল। দেখলো প্রভা সেভাবেই দাঁড়ইয়ে আছে। অর্ক প্রভার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “তুমি এখনো যাও নি?”
প্রভা মিষ্টি হেসে বলল, “পুরুষরা চিন্তিত থাকলে সহজে কাওকে বলতে চায় না। নিজে একাই কষ্ট পায়। আপনারও নিজের কথা শেয়ার করাটা অপছন্দ কিন্তু এত চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবেন না। আমি আপনার মাথায় তেল মালিশ করে দেই তারপর আপনি খেয়ে দেখে ঘুম দেন। আগামীকাল সকালে যখন মাথা ঠান্ডা থাকবে তখন আপনার চিন্তার সমাধানও বের হয়ে যাবে।”
“আমি তোমায় একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল প্রভা। অনেকটা সংশয়ে ভুগছিল সে। তবুও হ্যাঁ-এ উওর দিলো। অর্ক সাথে সাথে বসা অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরলো প্রভাকে। বলল, “তুমি এত কম সময়েও আমাকে ততটা বুঝতে শিখেছ যতটা আজ পর্যন্ত কেউ বুঝল না।”
প্রভা স্তব্ধ রইল কিছুক্ষণ। অর্কের স্পর্শের অনুভূতি অনুভব করতে সময় লাগলো তার। এই অনুভূতি পাওয়ার পর সে অর্কের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। কিন্তু কিছু বলল না। অর্ককে সময় দিলো নিজেকে গুছিয়ে নিতে। সে মুহূর্তটায় জাদু ছিলো। মুহূর্ত হারিয়ে গেল দুইজন একে অপরের মধ্যে। কিন্তু সে জাদুময় মুহূর্ত বেশিক্ষণ রইলো না। পর্দার ওপাড় থেকে সৈকত জিজ্ঞেস করল, “ভাবি আসতে পারি?”
প্রভা সাথে সাথে পিছিয়ে গেল। অর্ক প্রভার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। ইশারা করল সৈকতকে আসতে বলতে। প্রভা বলল, “আসো।”
সৈকত ভিতরে ঢুকে একপলক অর্কের দিকে তাকিয়ে আবার প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবি ঝিনুক কোথায়?”
প্রভা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় মানে? কাল তোমাদের ভার্সিটি অনুষ্ঠান দেখে দেরি করে তোমার সাথে আসতো না? তুমি না বললে আজ আসতে দেরি হবে?”
“সেটা তো শুধু আমার জন্য ভাবি। অঞ্জলিকে ফোন দিয়ে জানলাম ও দুপুরে বের হয়েছে।”
প্রভা চিন্তিত সুরে বলল, “দাঁড়াও মা কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি সেখানে গিয়েছে নাকি?” প্রভা যেতে নিলেই সৈকত তাকে থামিয়ে বলল, “না ভাবি আমি ফোন দিয়ে দেখেছি ঝিনুক সেখানেও নেই।”
চলবে……
[