এক মুঠো গোলাপ
sinin tasnim sara
২০-২১
২০
____
আমাদের শহরে হিউম্যানিটিজের জন্য কোচিংয়ের সংখ্যা বেশ কম, হাতে গোনা দু তিনটে।
আমি যেখানটায় পড়ছি সেটা বাসা থেকে বেশ দূরে। খুব সকালে বেরিয়ে পড়তে হয়, চার ঘণ্টা ক্লাস। ফিরতে ফিরতে দুপুর।
এতটা সময় বাইরে থাকার কারণে খাওয়া দাওয়ায় বেশ অনিয়ম হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে প্রতিদিন মায়ের বকুনি। ফজরের নামাজের পর পর-ই উঠে সে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দেয় কিন্তু এত সকালে খাওয়ার অভ্যেস নেই আমার।
কোচিং-এ আবার ব্রেইক নেই, মা টিফিনও সাজিয়ে দিতে পারেনা। কি যে আক্ষেপ তার!
আমি মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যাই, দু’দিন বাদে ভার্সিটিতে উঠবো আর সে আমায় টিফিন সাজিয়ে দেবার কথা ভাবছে!
এখনই এত টেনশান তাহলে আমি ঢাকায় যাওয়ার পর তার কি অবস্থা হবে?
,
আজ কোচিং পৌঁছুতে বেশ লেইট হয়ে যাবে। ঘুম থেকে উঠতেই পারিনি সকালবেলা । সবই হয়েছে নিদ্রর জন্য । ফের কাল রাতে এসেছিল বাসায়, এবার ব্যালকনি টপকে।
সারারাত আমায় জেগে জেগে পাহারা দিতে হয়েছে। মহারাজ তো শান্তিমত ঘুমুচ্ছিলেন। তার কোনো টেনশান নেই।
আমার থেকে থেকে সন্দেহ হয়, সামহাউ এই ছেলের মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি!
এ তো একদম মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত পাল্টে গিয়েছে।
— মিস.ক্লোজাপ হাসি, কোচিংয়ে যায়?
নিদ্রর মেসেজ পেয়ে ঘোর কাটলো, ওর সাথেই তো চ্যাটিং করছিলাম মনে হয়।
মুচকি হেসে রিপ্লাই দিলাম_
— ইয়েস। আপনার কি খবর কি করা হচ্ছে?
— আমি ঘুম বিলাস করি।
— এখনো ঘুম?
— ইয়েস। তোমার বেডটা ভালো না সুপ্ত, একদমই ঘুম হয়না।
— উমমহ কি মিথ্যেবাদী। আমার সাধের কোলবালিশ জড়িয়ে ভুশ ভুশ করে ঘুমালে আর এখন বলছো বেড ভালো না?
— আমি ঘুমের অভিনয় করেছি, ঘুমাইনি।
— তাই নাকি? তো আমি এতবার চিমটি কাটলাম, গালে হাত বুলিয়ে দিলাম, মাথার চুল টেনে দিলাম; কই উঠলে তুমি?
— হেই ওয়েট। তারমানে আমি ঘুমোলে তুমি এভাবে টর্চার করো আমায়? হুমমমম
এই-রে ধরা খেয়ে গেলাম যে। কপাল চাপড়ে নিজেই নিজেকে গালি দিতে দিতে নিদ্রকে “বাই” বলে ডাটা অফ করে দিলাম।
না’হলে অবস্থা খারাপ করে দিবে একদম।
,
এদিকে সুপ্তর ভয়ে পালানো দেখে হেসে ফেললো নিদ্র। মেসেজে সুপ্তকে থ্রেড দিয়ে ফোনটা রেখে দিলো ডেস্ক টেবিলের ওপর।
তারপর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। আবার বেরুতে হবে একটু পর।
——
কোচিং শেষে বাইরে আসতেই দেখি রাস্তার অপজিটে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে নিদ্র দাঁড়িয়ে । ও এই অসময়ে কোচিংয়ের সামনে কি করে?
আমি ভ্রু কুঁচকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করি_
— এখানে কেন?
ও হাত উঁচু করে রাস্তা পার হতে বলে।
আমি পিছু ঘুরে বন্ধুদের দিকে তাকাই। ওরা এখনো দেখতে পায়নি নিদ্রকে। দেখলেই শেষ একদম জোঁকের মত চিপকে যাবে আর ছাড়বে না। তাছাড়া ফাগুনও আছে, সেও মাইন্ড করতে পারে। এমনিতেই সেদিনের পর থেকে আমার সাথে তেমন কথা বলেনা।
আমার ভাবনার মাঝেই আভা এসে কাঁধে হাত রাখলো। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো_
— ভাই এখানে কি করে?
— আমি জানি না। ও আবার আমাদের কোচিং চিনলো কি করে?
ফিসফিসেই উত্তর দিই আমি। আভা ঠোঁট কামড়ে বলে_
— মনে হয় মা বলেছে। আমাকে নিতে আসবার নাম করে তোর কাছে এসেছে।
— এখন কি করবো?
— গিয়ে শোন আগে কি বলতে চায়।
— সবাই আছে, কি করে যাই?
— হুম তাও তো কথা। এক কাজ কর ওকে মেসেজ করে একটু সাইডে যেতে বল, তারপর তুই চলে যা।
— আইডিয়া ভালো।
আভার কথা শুনে আমি চটপট ফোন বের করে নিদ্রকে মেসেজ করে দিলাম। ওর হাতেই ফোনটা ছিলো, আমার মেসেজ পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমি চোখ পাকিয়ে বোঝালাম বন্ধুরা দেখলে মুসিবত।
ও ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে থাকলো যার মানে এই, “দেখুক তো কি হয়েছে?”
আমি বুঝলাম এই ছেলে কথা শুনবে না। আভাকেই বললাম ওদের অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে আমি ততক্ষণে চলে যাই ওপাশে।
আভা আমার কথা অনুযায়ী বন্ধুদের কাছে চলে গেলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে নিদ্রর কাছে চলে এলাম।
আমি নিকটে আসামাত্র সে দাঁত বের করে হেসে বললো_
— সারপ্রাইজ কেমন দিলাম?
— ওয়ার্স্ট সারপ্রাইজ । না বলে এভাবে আসে কেউ? আমার বন্ধুরা কেউ জানেনা তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড।
মুখ বেঁকিয়ে বললাম আমি।
— তাই নাকি? তাহলে চলো শ্যালক-শ্যালিকাদের সাথে মিট করে আসি।
— আরেহ আরেহ। ওদের সাথে মিট করতে হবে কেন?
আমি ওর হাত টেনে আটকালাম। ও হাসিটা বজায় রেখেই বললো_
— পরিচিত হতে হবে না? তাদের একমাত্র কিউট ফ্রেন্ড সুপ্তর উড বি আমি। আমাকে না চিনলে হবে?
— অত চেনা পরিচিতির দরকার নেই। সঠিক সময়ে সব হবে।
— আচ্ছা তাহলে দেখাসাক্ষাৎ হলো না।
মন খারাপের ভান করে বললো ও। আমি চোখ সরু করে বললাম_
— এত্ত রঙঢঙ শিখলে কবে বলো তো?
ও মুখটা নামিয়ে দুষ্টু হেসে বললো_
— তোমার প্রেমে যেদিন পড়লাম সেদিন থেকে।
ওর বলার ধরনে আমিও হেসে ফেললাম। আলতো হাতে ওর মুখটা সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম_
— কি যে করো! লোকে দেখছে।
— দেখুক। আমার কি যায়-আসে!
— আমার যায় আসে। একটু ঊনিশ বিশ হলেই তো বদনাম হয়ে যাবো।
— আরো ভালো। প্রেমে বদনাম হলে সে প্রেম স্মরণীয় হয়ে থাকে।
— কিছু না করেই বদনাম!
— কিছু কি করতে চাও?
— ছিঃহ্ নিদ্র। তুমি নটি হয়ে যাচ্ছো।
— এখনই ছিঃহ্? পিকচার তো এখনো পুরোটাই বাকি। এখন নটি হয়েছি, এরপর নটিয়ার-নটিয়েস্ট হয়ে যাবো। তখন আমাকে কেমনে সামলাবা মিস.ক্লোজাপ হাসি!
— ইশশ চুপ করো। এখন বলো না বলে আসলে কেন?
— তোমাকে নিয়ে প্রেমবিলাস করতে যাবো বলে।
— প্রেম বিলাস? সেটা কীভাবে
— চলো দেখাই।
পকেট থেকে বাইকের চাবিটা বের করে বাইকের সিট থেকে হেলমেট টা নিয়ে আমার হাতে দিলো।
আমি খানিক অবাক হয়ে শুধালাম_
— কোথাও নিয়ে যাবা নাকি?
— হ্যাঁ প্রেমবিলাস করতে নিয়ে যাবো।
— কিন্তু বাসায় কি বলবো?
— বলো আভার বাসায় যাচ্ছো, গ্রুপ স্টাডি করতে।
— বকা দিলে?
— তুমি না ডেয়ারিং সুপ্ত, মাঝরাতে আমায় দেখতে আসো। এখন ভয় পাচ্ছো কেন?
— কে জানে! আমি দিনে দিনে ভীতু হয়ে যাচ্ছি ।
মিন মিন করে কথাটা বলে বাসায় কল করলাম।
মা প্রথমে নিষেধ করলেও আমার রিকোয়েস্ট শুনে আর অমত করলো না তবে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বললো।
আমিও তাকে আশ্বস্ত করলাম।
পরিশেষে আভাকে একটা মেসেজ করে দিতে ভুললাম না। ও সব সামলে নিবে ইনশাআল্লাহ।
_______________
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ। সূর্যের আলোর তেজও কিছুটা কম। জনাকীর্ণ রাস্তায় নিদ্র আর আমি হেঁটে চলেছি, অজানা গন্তব্যে।
দু’জনেই নিশ্চুপ৷ আসলে নিস্তব্ধতাই মানাচ্ছে পরিবেশের সাথে। ভালোবাসা জিনিসটা ফীল করার বিষয়।
শুধুমাত্র ঠোঁটে ঠোঁটে কথা নয়, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে;আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে; মনের সাথে মনের সন্ধি করাটাও অন্যরকম ভালোবাসা।
,
কিছুটা সময় হাঁটার পর আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম ।
— আর কত হাঁটবো নিদ?
— আর অল্প একটু। সামনেই রেললাইন দেখতে পারবে। আজ বিনি পয়সায় ট্রেনে উঠাবো তোমায়। আসো?
— বিনি পয়সায়! সেটা কীভাবে
ভ্রু কুঁচকে শুধালাম আমি।
— আরে আসোই না?
ও হাত বাড়িয়ে ডাকলো। আমি মৃদু হেসে ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম।
— জানো আমি না কখনো ট্রেন জার্নি করিনি।
— তাহলে দূরের জার্নি গুলো কীভাবে করেছো?
— কারে করে।
— আচ্ছা আচ্ছা। বাপির আদরের মেয়ে আমার সুপ্ত।
— হ্যাঁ। বাপি বলে দূরের জার্নির জন্য কারের চাইতে কমফোর্টেবল কিছু হয়না।
— তুমি যে তুলোর বলের মত মোলায়েম তাই তোমার জন্য স্পেইশাল সব ব্যবস্থা। তাছাড়া কম্ফোর্টেবল তো সব কিছুকেই বানানো যায়। এটা একান্তই মনের ব্যাপার। বুঝলে?
— বুঝলাম।
মাথা নেড়ে বললাম আমি।
আমাদের কথার মাঝেই ট্রেনের হুঁইসেল কানে আসে। ও আমার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে_
— তুমি তৈরি তো?
আমি ভ্রু কুঁচকে শুধাই_
— কিসের জন্য।
ও স্রেফ বলে_
— লেটস গো।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতে টান পড়ে। ওর পিছু পিছু আমিও ছুটে চলি।
রেললাইন দেখামাত্র আমি বুঝতে পারি আমরা ছুটছি ট্রেন ধরতে।
কংকর বিছানো রাস্তায় দৌড়োতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু সব কষ্ট চাপা পড়ে যায় প্রথম ট্রেন জার্নির এক্সাইটমেন্টের নিচে।
নিরন্তর ছুটতে ছুটতে মন্থর গতিতে এগোতে থাকা ট্রেনের একদম লাস্ট কম্পার্টমেন্টে আমরা উঠে পড়ি৷
নিদ্র ট্রেনের দরজায় হেলান দিয়ে হাঁপাতে থাকে, আর আমি দেহের সমস্ত ভার ওর শরীরে এলিয়ে দিয়ে আনন্দ-উত্তেজনায় কাঁপতে থাকি।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিদ্র বলে_
— মিস.ক্লোজাপ হাসি, লাইফের ফার্স্ট বিনি পয়সায় ট্রেন জার্নিতে আপনাকে স্বাগতম ।
নিদ্রর কথায় সুপ্ত ওর বাহু জড়িয়ে প্রাণখোলা একটা হাসি দেয়।
অনিমেষ দৃষ্টিতে সেই হাসি দেখতে থাকে নিদ্র।
প্রেয়সীর ঠোঁটের কোণে হাসি দেখবার বাহানায় তো এতকিছু ।
অল্প সময়ের মধ্যে ট্রেনের গতি বেড়ে যায়। দূরন্ত ছুটে চলা ট্রেন থেকে বাইরের দৃশ্য অপরূপ লাগে সুপ্তর কাছে।
সারি সারি গাছপালা, ধানক্ষেত পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে চলে অজানায়।
নিদ্র আলতো স্পর্শে ডাকে সুপ্তকে, ওর দিকে তাকালে আঙুলের ইশারায় নীলচে আকাশ টাকে দেখিয়ে দেয়।
মুগ্ধতা আরো বেড়ে যায় সুপ্তর। সারা আকাশ জুড়ে শুভ্র মেঘ পেঁজা তুলোর ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
খানিক যেতেই পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়া সূর্য দৃষ্টিগোচর হয় । সূর্যের রক্তিম আভায় নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো কয়েকগুচ্ছ সাদা মেঘ রঙ পরিবর্তন করে গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রকৃতির অপার সৌন্ধর্য মন্ডিত দৃশ্য অবলোকন করে সুপ্ত, সব যেন আত্মস্থ করে নিচ্ছে মনের মনিকোঠায়।
এদিকে নিদ্র, দখিনা বাতাসে আন্দোলিত প্রেয়সীর দিঘল কালো কেশ সামলে দিতে ব্যস্ত। সেও পলকহীন চোখে শুষে নিচ্ছে তার বাহুডোরে বন্দী অষ্টাদশী তরুণীটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
দু’জনারই চোখের মোহাবিষ্টতা, ভালোলাগার অনুভূতি সবটা, সবটা অবলীলায় পড়ে ফেলা যায়।
তাদের দেখে মনে হয়, ভালোবাসার এ অন্যরূপ স্বর্গসুখ নামিয়ে দিয়েছে ধরণীর বুকে।
এক মুঠো গোলাপ
২১
_____
(রাফনিদ-তৌহিদ)
আজ অভিমানী চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। তার পরিবর্তে সমস্ত আকাশ জুড়ে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। থেকে থেকে দমকা হাওয়াও বইছে।
ঠান্ডা বাতাস গায়ে অদ্ভুত সুখের পরশ বইয়ে দেয়। সম্ভবত বৃষ্টি হবে।
ব্যালকনির ডিভানে বসে গভীর মনোযোগে অফিশিয়াল কাজগুলো করছে রাফনিদ। কোনো দিকে তার খেয়াল নেই ।
তৌহিদ বিছানায় বসে ফলো করছে তার রাগী বৌটাকে।
পরনে ব্ল্যাক কালার গেঞ্জি আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। সোনালী চুলগুলো আলুথালু করে কাঁধের কাছে পেঁচিয়ে রাখা। চশমাও চোখে উঠেছে দেখা যাচ্ছে ।
কিছুটা সময় চোখ সরু করে তাকিয়ে থেকে বিছানা ছেড়ে উঠলো তৌহিদ। গুটি গুটি পায়ে ব্যালকনিতে একদম রাফনিদের পাশে এসে দাঁড়ালো।
আ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য দু একবার গলা খাঁকারিও দিলো, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারলো না।
এদিকে রাফনিদ ঠিকই বুঝতে পেরেছে তার পিচ্চি বর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
রাফনিদের এমন ইগনোরেন্স দেখে ক্ষেপে গেলো তৌহিদ। পূর্বের তুলনায় আরো জোরে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো।
ওর কাজকারবার দেখে খুব হাসি পেলো রাফনিদের। বড্ড কষ্টে সেই হাসি চেপে রেখে মাথা তুলে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো তৌহিদের দিকে। বিরক্তি মাখানো গলায় প্রশ্ন করলো_
— হইছে টা কি?
তৌহিদ যেন অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। ভ্রু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করলো_
— তোমার কি হয়েছে? তুমি আমার সাথে এমন বিহেইভ করছো কেন?
— কিরকম বিহেইভ করলাম!
হেয়ালি ভাবে জবাব দিয়ে পুনরায় ল্যাপটপে মনোনিবেশ করলো রাফনিদ। ওর এহেন আচরণ এবার হজম হলো না তৌহিদের। বেশ চটে গেল সে।
নিচু হয়ে বসে রাফনিদের চুল টেনে মুখটা ঘুরিয়ে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এলো।
চোখে চোখ রেখে রাগত্ব স্বরে বললো_
— একদম হেয়ালি করবি না রাফনিদ। আমার সাথে ঠিকমত কথা বলছিস না কেন উত্তর দে?
— এ্যাই তুই আবার আমার সাথে তুই তোকারি করছিস?
— করবো, একশো বার করবো। হাজার বার করবো। তুই আমার সাথে এরকম বিহেইভ করছিস ক্যান?
— সেটা আমার ইচ্ছে ।
— সব তোর ইচ্ছে মত হবে নাকি! যখন ইচ্ছে হবে কথা বলবি, যখন ইচ্ছে হবে বলবি না। আমাকে কষ্ট দেয়ার অধিকার তোকে কে দিয়েছে।
রাফনিদ সে কথার জবাব না দিয়ে নিজের চুল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
তৌহিদের রাগের সীমা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে এবার। ও আরো শক্ত করে রাফনিদের চুলগুলো চেপে ধরলো।
রাফনিদ এবার বেশ ব্যাথা পেয়ে মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো।
— আমার কিন্তু ব্যাথা লাগছে তৌহিদ।
— লাগুক। আমার যে ব্যাথা লাগছে এটা তুই দেখিস না রাফনিদ? আমি গতকাল এসেছি এই বাসায়। তুই একবারও আমার সাথে ঠিকমত কথা বলিস নি, বরং ইগনোর করেছিস। এর পূর্বে প্রায় এক সপ্তাহ কোনো কল পিক করিস নি কিংবা মেসেজের রিপ্লাই করিস নি। বিনা দোষে আমাকে এভাবে শাস্তি দেয়ার কোনো মানে হয়!
— উহ্ বিনা দোষে! আমার সাথে কথা বলতে হবে কিসের জন্য? তোর তো সানডে মানডের অভাব নেই।
— সানডে মানডে!
ভ্রু জোড়া ফের কুঁচকে গেল তৌহিদের। রাফনিদ ওকে দু হাতে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অভিমানী সুরে বললো_
— ইয়েস সানডে-মানডে। ইউনিভার্সিটির কোঁচি কোঁচি সানডে মানডে ইন শর্ট ফর্ম শিলা-মিলা।
— শিলা- মিলা আবার কে?
— এখন চিনিস না তাইনা?
— উফফ হেয়ালি নয় রাফনিদ। খুলে বলো কি বলতে চাইছো।
— আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ডদের কথা বলছি।
— ওহ্ সেজ্যোতি আর মুনিরা! ওরা শিলা-মিলা হলো কবে?
— কেন শিলা-মিলা ডাকায় খুব কষ্ট হলো মনে হয়?
— ওরা কি করেছে রাফনিদ?
— ওরা কি করবে। তুই করেছিস। ওদের সাথে রঙচঙ মেখে সঙ সেজে ছবি তুলেছিস, নাচ-গান করেছিস। খোদা জানে আরো কি কি করেছিস!
— হেই হেই ওয়েট। তুমি কি সাজিদের বার্থডে প্রোগ্রামের কথা বলছো?
— তুই ভেবে দেখ রঙচঙ মেখেছিলি কবে!
চড়া গলায় বললো রাফনিদ।
তৌহিদ এবার কপাল চাপড়ে মেঝের ওপর বসে পড়লো।
— তুমি ওদের সাথে পিকচার আপলোড দেয়ায় রেগে গেছো রাফনিদ? ওহ্ মাই গড। আমরা সেদিন খারাপ কিছুই করিনি। সাজিদের বার্থডে ছিলো, ডিপার্টমেন্টের সকলে মিলে ওকে জাস্ট সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল । আমি কি শুধু ওদের সাথেই পিকচার আপলোড দিয়েছি? আরো তো ফ্রেন্ড ছিলো ওখানে।
— ওদের সাথে সবচাইতে বেশি ক্লোজ ছিলি তুই।
— ওহ্ গড, দে আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ডস রাফনিদ। ওদের সাথে সাড়ে বারো বছরের বন্ধুত্ব আমার। বন্ধুত্বের বাইরে আর কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের মাঝে। ইনফ্যাক্ট ওরা আমার বোনের মত ।
— বোনের মত না? বোনদের সাথে অমন জড়াজড়ি করে ছবি তোলে মানুষ!
— জড়াজড়ি কোথায় করেছি? ওরা আমার কাঁধে হাত দিয়ে ছিলো।
— কেন দিবে? তোর গায়েই কেন হাত দিবে। আর তোর ক্যাপশন! উফফ, ফ্লার্টিংয়ের শেষ নেই।
— ডিয়ার ওয়াইফ। তুমি একদম ভুল বুঝে ফেলেছো। আমি ফোনটা বের করি, দেখো ওরা এঙ্গেইজড। ওরা তোমার কথাও জানে।
— আমি ঐসব দেখিনা। তুই দেখ, চোখ বড় বড় করে দেখ।
— রাফনিদ তুমি কিন্তু ওভার রিআ্যাক্ট করছো।
— হ্যাঁ করছি, তো কি করবি? আমারে ছেড়ে দিবি। তাই দে। তোর ফ্যামিলি এমনিতেও আমাকে মেনে নেয়নি, আমার বয়স বেশি-আমি কখনো মা হতে পারবো না। তুই-ই বা আমার সাথে থেকে কি করিস। তুইও চলে যা। আমি আজই, এক্ষুনি ডিভোর্স লইয়ারের সাথে কনসাল করবো।
কথাগুলো বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো রাফনিদ ।
তৌহিদের বুঝতে সমস্যা হলো না মূল বিষয়টা কি!
ফ্যামিলি মেনে নেয়নি এবং অপারগতার কথা চিন্তা করতে করতে একটা ভয় বাসা বেঁধে ফেলেছে ওর মনে।
এই ভয়টাকে তৌহিদেরই কাটাতে হবে। শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়েই এটা সম্ভব।
করতলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে রাফনিদ। ক্রন্দনরত রাফনিদ কে চট করে বুকে টেনে নিলো তৌহিদ।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ক্ষীণ,আদর মাখা কণ্ঠে বললো_
— শোনো রাফনিদ আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। আমার এ হৃদয়ে তোমার স্থান কতটা জুড়ে তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
তোমাকে ছাড়া শ্বাস নিবো ভাবতে পারিনা। তোমাকে এক পলক না দেখলে আমার দিন কাটে না৷ তোমার কণ্ঠ না শোনা অবধি আমি ঘুমাতে পারিনা।
মায়ের মৃত্যুর পর এ পৃথিবীতে আমার আপনজন বলতে একমাত্র তুমি আর নানীজান ।
যেখানে তুমি আমার বাঁচার অবলম্বন- সেখানে এই ভয়টা কেন তোমার মনে কাজ করে যে, আমি তৌহিদ একদিন তোমাকে ছেড়ে যাবো?
তোমাকে ছাড়লে বেঁচে থাকাটা ছাড়তে হবে আমার। সেটা কখনো সম্ভব?
আমার ভালোবাসা নিয়ে কখনো মনে সন্দেহ রেখো না বউ। তোমার এই আচরণ গুলো আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমি জানি তুমি নিজেও ভালো থাকতে পারো না। খামোখা দু’জনার মনে কষ্ট নিয়ে লাভ আছে?
তৌহিদের কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো রাফনিদ। অশ্রুসিক্ত নয়নে আর্দ্র কণ্ঠে বললো_
— আমার ভীষণ ভয় করে তৌহিদ।
— ভয়ের কিচ্ছু নেই নিদ। প্লিজ বিলিভ মি। আমাদের সম্পর্কটার ভিত হলো বিশ্বাস। বিশ্বাসটা রাখতে পারলেই ভয় ভ্যানিশ হয়ে যাবে । তার পাশাপাশি ওভার থিংকিং টাও বাদ দিতে হবে।
এত কিসের চিন্তা রাফনিদ। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ এই জীবন, বাজে চিন্তা করে নষ্ট করার জন্য তো নয়। জীবনটাকে উপভোগ করো। পূর্বের মত প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে যাও। আমি আমার পূর্বের রাফনিদকে খুব মিস করি।
রাফনিদের গালে হাত রেখে মোলায়েম স্বরে বললো তৌহিদ।
রাফনিদ নাক টেনে উত্তরে বললো_
— আমি তোমাকে অনেক বিলিভ করি কিন্তু….
— শসস্ কোনো কিন্তু নয়। বিশ্বাস আর ভালোবাসা যেখানে থাকবে সেখানে কোনো কিন্তুর স্থান নেই।
— আমাদের একটা সুস্থ স্বাভাবিক সংসার কবে হবে তৌহিদ?
তৌহিদের বুকে হেলান দিয়ে উদাস কণ্ঠে শুধায় রাফনিদ।
ওকে আগলে নিয়ে তৌহিদ বলে,
— অন্যদের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করতে নেই বউ। আমরা স্বাভাবিক সংসারই করছি। তোমার জন্য আমি আর আমার জন্য তুমি আছো। আমাদের আর কাউকই প্রয়োজন নেই। সৃষ্টিকর্তা দু হাত ভরে দিয়েছেন আমাদের। আমরা খুব সুখী, খুউব….
_____
সকাল থেকে ভীষণ অসুস্থ বোধ করছে সুপ্ত। দু’বার বমি হয়েছে সাথে পেটে ব্যাথা। হুট করে এমন অসুস্থ হওয়ার কারণ বুঝতে পারছে না কেউ। নিশাত খাবার বানাচ্ছেন আর একাধারে বকাঝকা করছেন সুপ্তকে। তার ধারণা অনিয়মিত খাওয়াদাওয়ার কারণেই এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে সুপ্ত।
হুমায়ুন কবির সাহেব মেয়ের শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সামনে এডমিশান টেস্ট, মেয়েটা এই সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়লো। এটা কোনো কথা!
বমি করার ফলে চোখমুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। জ্বরও আসছে বোধহয়। পেট চেপে ধরে কোঁকাচ্ছে সুপ্ত।
— বাবু, হঠাৎ তোমার শরীরটা এমন খারাপ হতে শুরু করলো কেন! খুব কি কষ্ট হচ্ছে মামণি,ডক্টর ডাকবো?
সুপ্তর কানে সে কথা পৌঁছুলো কি পৌঁছুলো না, সে কেবল চোখ মেলে বাবা-র মুখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করলো।
,
মায়ের চেঁচামেচি তে ঘুম ভেঙে গেলো রাফনিদের। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে পাশে তৌহিদকে পেলো না। ডেস্কের ওপর থেকে চশমা টা টেনে নিয়ে চোখে পরে, গলা বাড়িয়ে মা’য়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো_
— আম্মু কি হয়েছে? কাকে বকাঝকা করছো এভাবে!
— কাকে আবার তোর গুণধর বোন টাকে । সারাবছর লেখাপড়ার খোঁজ নেই, শেষে এসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়েছে সে। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে পড়ালেখা করছে। এখন হলো তো অসুস্থ! বারবার বলেছি আমি অনিয়ম করিস না অনিয়ম করিস না, তুই একটুতেই অসুস্থ হয়ে যাস। এখন ফললো তো আমার কথা?
থাক এখন বিছানায় পড়ে। ইশ চোখ-মুখ কালো হয়ে গিয়েছে বমি করে করে।
রান্নাঘর থেকে রাগ আর কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন নিশাত।
সুপ্ত অসুস্থ শুনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল রাফনিদের। চট জলদি উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।
এদিকে তৌহিদ ঘুম থেকে উঠেই মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিল। সে রংপুরের রাস্তা ভালোমত চেনেনা।
টাউন হলের দিকটায় হাঁটতে গিয়ে রাস্তার মোড় ভুলে গিয়েছে। সব রাস্তা তার কাছে একই মনে হচ্ছে । ফোনটাও সাথে নিয়ে আসেনি যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে।
বাধ্য হয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে শান বাঁধানো বেঞ্চে বসে মনে করার চেষ্টা করছে, কোন ডিরেকশনে বাসাটা হতে পারে!
— আরে তৌহিদ তুমি এখানে?
পুরুষালী কণ্ঠে নিজের নাম শুনে ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে চোখ তুলে তাকায় তৌহিদ। কুঞ্চিত ভ্রু যুগল শিথিল হয়ে যায় সামনে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের চেহারা দেখেই।
বিনীত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে চমৎকার হেসে সালাম দেয়।
— আরে ছোটো মামা আপনি এখানে?
ভদ্রলোক সালাম গ্রহণ করে হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করতে।
— হ্যাঁ এক ক্লোজ ফ্রেন্ডের বাসায় দাওয়াতে এসেছি গত পরশু।
— মামীও এসেছেন?
— হ্যাঁ তোমার মামীও এসেছে। সে আমার ফ্রেন্ডের বাসাতেই আছে। আমি একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।
— মামা আপনি রংপুরেই আছেন আর বাসায় যাননি এগুলো কোনো কথা!
— আজই যাবো ভাবছিলাম। তা তুমি কবে এলে ঢাকা থেকে?
— আমিও পরশুই এসেছি।
— ওহ্ আচ্ছা, আচ্ছা । এসো চা খাই?
— জ্বী চলুন।
ভদ্রলোক আসাদ মির্জা। রাফনিদ এবং সুপ্তর ছোটো মামা। পেশায় একজন ডাক্তার। ফ্যামিলি সহ ঢাকায় থাকেন।
মামা শ্বশুরের সাথে চা-আড্ডা দিতে দিতে বেশ বেলা হয়ে গেল।
গল্প তাদের শেষই হয়না। এরই মধ্যে আসাদ সাহেবের ফোনটা বেজে উঠলো । হাতে নিয়ে দেখে সেজ বোন নিশাত।
— তোমার শ্বাশুড়ি মা কল করেছেন।
তৌহিদের উদ্দেশ্যে বলে কলটা রিসিভ করে। এক কথা দু কথা কানে আসতেই ভদ্রলোকের চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বোনের উদ্দেশ্যে বলে_
— আমি রংপুরেই আছি আপা। এক্ষুণি আসছি। তোরা ওর হাত পা মুছে দে একটু।
–…
— আমি এসে সব বলছি তো।
তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিয়ে হাত উঁচু করে রিকশা ডাকেন আসাদ সাহেব। তৌহিদ চায়ের বিল মিটিয়ে মামা শ্বশুরের পিছু পিছু রিকশায় ওঠে।
পথেই জানতে পারে সুপ্ত ভীষণ অসুস্থ । সেও ভাবনায় পড়ে যায় হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লো কেন এই মেয়ে!
তার মধ্যেই মামা শ্বশুরের শুকনো ফ্যাকাশে মুখটা দেখে খটকা লাগে। ভাগ্নির অসুস্থতায় এমন অস্থির হতে কম মামাকেই দেখেছে তৌহিদ।
খটকার বিষয়টা মনের মাঝেই লুকিয়ে রাখে। পরে এ ব্যাপারে রাফনিদের সাথে আলোচনা করা যাবে।
____
ইন্টারনাল ব্লিডিংয়ের সময় সাধারণত পেটে ব্যাথা হয়না সুপ্তর। লাস্ট টু মান্থ থেকে হুট করে ব্যাথাটা শুরু হয়েছে। গতবারের তুলনায় এবারে ব্যাথা দ্বিগুণ হওয়ায় সে সইতে পারেনি, তাছাড়াও অনিয়মিত খাদ্যভ্যেস শরীরটাকে বেশ দূর্বল করে দিয়েছে। সবকিছুর ফল এই অসুস্থতা।
আসাদ সাহেব একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন এবং ওর খাবারের একটা রুটিন তৈরি করে দিলেন। নিয়ম মেনে না চললে ভবিষ্যতে আবারও অসুস্থ হওয়ার চান্স আছে।
,
খাবার আর ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সুপ্তকে । এক ঘুমে বেলা শেষ। আসরের আজান কানে পড়ামাত্র ঘুমটা হালকা হয়ে গেলো সুপ্তর। অতিরিক্ত শুয়ে থাকার ফলে শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে । ঘুমের সাথে একপ্রকার লড়াই করে উঠে বসে সুপ্ত। মাথা চেপে ধরে কতক্ষণ বসেই কাটায়।
ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটতেই বিছানা থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়।
চোখ কচলে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করতে থাকে। আজান পুরোপুরি থেমে গেলে মোড়ের দোকানের ছোকরা গুলো সাউন্ডবক্সে গান ছেড়ে দেয়_
“আমার মন ভালোবাসা ছাড়া কিছু বোঝেনা…”
কে জানে কেন গানের লিরিক শুনে হাসি পায় সুপ্তর।
জানালার থাই টেনে দিয়ে ফোন খুঁজতে শুরু করে।
রাফনিদ ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে_
— কি খুঁজিস?
— আমার ফোনটা। পড়ার টেবিলের ওপর রেখেছিলাম পাচ্ছি না।
— ঘুম থেকে উঠেই ফোন?
— আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল আসবে আপু।
— ফ্রম স্পেইশাল পার্সন?
রাফনিদের কথা শুনে ওর দিকে তাকায় সুপ্ত। রাফনিদ মুচকি হেসে ঘরের ভেতরে ঢোকে।
— ইম্পর্ট্যান্ট কল কি নিদ্র সাহেব করবে?
— ইয়ে মানে…
ইতস্ততভাবে মাথা নাড়ে সুপ্ত।
— সে কিন্তু নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
— হ্যাঁহ!
অবাক হয়ে যায় সুপ্ত।
— হ্যাঁ তুই অসুস্থ জন্য দেখতে এসেছে। এত বারণ করলাম,বাপির ভয় দেখালাম , শুনলোই না। কি সাহস ছেলেটার!
— ওর কল তুমি রিসিভ করেছিলে?
— হ্যাঁ। তুই ঘুমুচ্ছিলি আর ও বারবার কল করছিল। রিসিভ না করে উপায় আছে!
নিচে এসেছে এটাই বলতে আসছিলাম আমি।
তুই একটু ব্যালকনিতে দাঁড়া। হাই হ্যালো কর।
পকেট থেকে ফোন বের করে সুপ্তর হাতে ধরিয়ে দিলো রাফনিদ।
— কিন্তু কেউ আসলে?
— চিন্তা নেই, বাবা-মা তাদের রুমে আছে এদিকটায় আসার চান্স নেই।
সুপ্তকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে গেলো রাফনিদ।
চোখেমুখে কোনোরকমে পানি দিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো সুপ্ত।
নিদ্র এদিকটাতেই তাকিয়ে আছে প্রিয়তমাকে এক পলক দেখার আশায়।
তার অপেক্ষার অবসান ঘটলো জলদি।
সুপ্তকে পেয়ে ফিঁকে একটা হাসি দিলো নিদ্র। সুপ্তও পাল্টা হাসি দিয়ে হাতের ইশারায় কল করতে বললো নিদ্রকে।
নিদ্র চট করে বুঝে গেলো তার ইশারা। এক মুহুর্ত দেরি করলো না আর।
ওপাশে কল রিসিভ হতেই চিন্তিত ভাবে জিজ্ঞেস করলো_
— অসুস্থ হয়ে পড়লে কীভাবে?
— খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম হয়েছিল।
— একদিনেই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তোমার।
— বমি করলে এরকম হয়। তুমি এত টেনশন কোরো না তো। ঔষধ দেয়া হয়েছে আমাকে।
— তুমি যা কেয়ারলেস, ঔষধও ঠিকমতো খাবেনা।
— উমমহ্ মা খুব স্ট্রিক্ট হয়েছেন। না খেয়ে যাবো কোথায়!
— একদম পারফেক্ট । শ্বাশুড়ি মা স্ট্রিক্ট হলে চিন্তা কিছুটা কম হবে আমার।
— তোমরা সবাই আমার ওপর টর্চার করতে পারলে বাঁচো!
— তোমার জন্য টর্চারই ঠিক আছে। তুমি হলে ঘাড় ত্যাড়া মেয়ে। সব কিছুতেই তোমার গোঁয়ার্তুমি।
— হয়েছে হয়েছে আর ভুল ধরতে হবে না আমার। এখন বলো তো তুমি খাওয়াদাওয়া করে এসেছো?
— নাহ্, তোমার খোঁজ খবর না পাওয়া অবধি গলা দিয়ে খাবার নামবে আমার?
— কি বলো! আসরের ওয়াক্ত পড়েছে। তুমি এ অবধি কিছু খাওনি?
এবার তুমি অনিয়ম করলে তো তুমিও অসুস্থ হয়ে যাবা। আমাকে দেখার মানুষ আছে। তোমাকে কে দেখবে?
— — খেয়ে নিবো আমি, তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন?
— অস্থির হবো না! যাও এই মুহুর্তে বাসায় যাও তুমি। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসবে।
— উঁহু আমি এখন যাবোনা।
— যাবে না মানে! অফকোর্স যাবে।
— নাহ্ যাবো না।
— নিদ্র!
— মাই গড! তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ সুপ্ত?
হাসতে হাসতে বললো নিদ্র। সুপ্ত ফসস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।
— বুঝতে পেরেছি তুমি যাবানা। আচ্ছা আমি একটু নিচে আসি?
— নাহ্ দরকার নেই তোমার শরীর দূর্বল।
— তাহলে তুমি আসো। সেদিন যেভাবে এসেছিলে ।
— আজ পসিবল হবেনা। ওপাশের বাসার ছাদে কয়েকজন মহিলা বসে গল্প করছে।
— তুমি কি ঐপাশের ছাদ টপকে আমাদের বাসার সানসেট এ উঠেছিলে?
— হ্যাঁ।
— আমি ভাবলাম তুমি পাইপ বেয়ে এসেছো।
— পাইপ বেয়ে ওঠা কি সহজ! আর তোমাদের বাসায় পাইপ কোথায়?
— সেটাও কথা।
— বাই দ্য ওয়ে তোমার জন্য একটা গিফট আছে সুপ্ত।
— কি গিফট ।
— দাঁড়াও দিচ্ছি । প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্টো কাগজের মোড়ক বের করলো নিদ্র।
— সুপ্ত ক্যাচ।
মোড়কটা ফোল্ড করে ছুঁড়ে দিলো সুপ্তর দিকে। ও একটুখানি নিচু হয়ে ধরে ফেললো মোড়ক টা।
— কি আছে এতে?
— খুলেই দেখো।
মৃদু হেসে বললো নিদ্র। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ব্যালকনির রেলিংয়ের ওপর রেখে মোড়কটা খুলে ফেললো সুপ্ত।
রিনঝিন শব্দে নুপুর জোড়া বেরিয়ে এলো সেটা থেকে।
পছন্দের গিফট পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলো সুপ্ত। নুপুর জোড়ায় বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে নিদ্রর দিকে তাকালো। উত্তেজনায় মাঝারি একটা চিৎকার দিয়ে বললো_
— থ্যাংক ইউ । আই লাভ ইউ সো মাচ।
— আরেহ্ করো কি! ফোন কানে নাও।
চোখ বড় বড় করে বললো নিদ্র। নিজের বোকামি বুঝতে পেরে জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফোনটা কানে নিলো সুপ্ত।
— এমন পাগলামি মানুষ করে!
— ইশশ আমি এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম যে।
— বেশি এক্সাইটেড হয়ো না। পরে বিপদে পড়তে হবে।
— স্যরি স্যরি।
— গিফট পছন্দ হয়েছে?
— খুউবববব। বাট আমি এখন পরবো না।
— কেন?
— তুমি নিজ হাতে পরিয়ে দিবে আমায়। আমি শাড়ি পরে আলতা পায়ে তোমার কাছে যাবো, তুমি আমাকে নুপুর পরিয়ে দিবে ঠিকাছে?
— ঠিকাছে আমার চাঁদ। তোমার কথাই রাখবো।
— সো সুইট।
— আচ্ছা শোনো আমি এখন বিদায় নিবো। বড় চাচাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তুমি শুয়ে রেস্ট করো, আর নিজের যত্ন নাও ঠিকাছে?
— ওকে। তুমি আগে খেয়ে নিও প্লিজ।
— আসি।
— নিদ্র শোনো।
— বলো চাঁদ।
— আমাকে একটু চুমু দিয়ে যাও।
— তুমি আগে সুস্থ হও তারপর।
— প্লিইজ
— বাই সুপ্ত।
সুপ্তকে কিছু বলতে না দিয়েই কল কেটে দিলো নিদ্র।
এরপর সাইকেলে উঠে হাত নেড়ে ইশারায় পুনরায় বাই বললো।
সুপ্ত এতক্ষণ খেয়াল করেনি নিদ্র সাইকেল নিয়ে এসেছে। ও ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো_
— সাইকেল নিয়ে এসেছো কেন? বাইক কই!
উত্তরে নিদ্র সুরে সুরে বললো_
— তুমি সাইকেল চালানো শিখবে তাই, আমি সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
অন্যকোনো যানবাহন চিনি না…!
চলবে?