#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_14
#Writer_TanhaTonu
আরশি স্কুলের গেইটে পা রাখতেই হালকা অবাক হলো।ক্যাম্পাসের ডান পাশে হালকা ভিড়।প্রিন্সিপাল স্যারকেও দেখা যাচ্ছে।আরশি রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই অবাক হলো।স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী,সিদ্রাত,প্রিন্সিপাল স্যার সহ বেশ কয়েকজন স্যার আছে এখানে।সাথে নিরা আর ছোঁয়ার বাবা-মা।নিরা আর ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আরশিকে দেখতে পেয়েই প্রিন্সিপাল স্যার বললেন…
—”আরশি সিদ্রাত স্যার তোমার ব্যাপারে যা যা বলেছে সবই কি সত্যি?নিরা আর ছোঁয়া কি কি করেছে তোমার সাথে?”
আরশি চমকে উঠল প্রিন্সিপাল স্যারের কথায়।সিদ্রাতের দিকে তাকাতেই সিদ্রাত ইশারায় আরশিকে আশ্বস্ত করল।আরশি গতকাল ঘটে যাওয়া সবকিছু সবার সামনে বলল।বলতে বলতে মেয়েটা কেঁদেই দিয়েছে।প্রিন্সিপাল স্যার সাথে সাথে উঠে নিরা আর ছোঁয়াকে পুরো ভরা ক্যাম্পাসে সবার সামনে চড় দিলো।লজ্জায় ওদের ফ্যামলির মাথা হেইড হয়ে যাচ্ছে।অন্তত তারা এটা ভাবতে পারেনি যে তাদের সন্তান এভাবে তাদের নাক ডুবাবে।প্রিন্সিপাল স্যার গর্জে নিরা আর ছোঁয়ার বাবা-মাকে বলে উঠলেন..
—”ছেলে-মেয়েদের এই শিক্ষা দিয়েছেন?ছিহ..স্কুল থেকে শিক্ষা অর্জন করার আগে সন্তানদেরকে পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হয়।আপনাদের নৈতিক শিক্ষা কেমন ছিলো যে তারা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সাথে এতো নোংরা কাজ করতে পারে!পারিবারিক শিক্ষা না দিয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবেন না।ছেলে-মেয়েদের প্রতি আপনাদের উদাসীনতাই ছেলে-মেয়েদেরকে বখাটে বানাচ্ছে আজ।আর নিরা ছোঁয়া..তোমাদেরকে নিয়ে আমি আর কিছুই বলব না।এটুকু বয়সেই এই কাজ করে ফেলেছো!তোমাদের ফিউচার আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি।তোমাদেরকে নিয়ে কথা বলতেও আমার লজ্জা হচ্ছে।গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার এন্ড আগামীকাল এসে মনে করে টিসিটা নিয়ে যেও দুজনই..”
ক্যাম্পাসের সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা।ছোঁয়ার বাবা লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে।ভরা মজলিসে নিজেই এবার ছোঁয়ার গালে দুটো চড় মেরে হনহনিয়ে চলে যায়।আর নিরার বাবা-মা আড়চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে রাগে ফুসছে। পারলে এখনি আরশিকে জ্বালিয়ে দিতো নিজেদের ক্ষোভের আগুনে।প্রিন্সিপাল স্যার আবারও ধমক দিলেন।নিরা ছোঁয়া আর ওদের বাবা-মা সহ ভিড় জমানো স্টুডেন্টরাও সরে গেলো।আরশি এখনো মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে।প্রিন্সিপাল স্যার আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে সিদ্রাতকে ইশারায় কি যেনো বলে চলে গেলো…
সিদ্রাত আরশির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর বলে…
—”তুমি একদম ছিচকাঁদুনে”
আরশি কান্না মুছতে মুছতে নাক ফুলিয়ে তাকায় সিদ্রাতের দিকে। নাক টানতে টানতে বলে….
—”আপনি প্রিন্সিপাল স্যারকে দিয়ে ওদের বাবা-মাকে ইন্সাল্ট করালেন কেন?তারা তো,,”
সিদ্রাত আরশিকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠে….
—”লিসেন…সন্তান যদি কোনো অপরাধ করে তাহলে বাবা-মা দোষী হোক বা না হোক দোষ কিন্তু বাবা-মার কাঁধে এসেও পড়ে।আজ তুমি একটা ভুল করলে কিন্তু তোমার বাবা-মাকে সমাজ ছেড়ে কথা বলবে না।
কিন্তু আমি আজ যা করেছি তা সমাজের একজন হওয়ার জন্য করিনি।প্রয়োজন ছিলো এটুকু ইন্সাল্ট তাদের জন্য।কোনো সন্তানই তার বাবা-মায়ের অপমান সহ্য করতে পারেনা।আজ যদি প্রিন্সিপাল স্যার নিরা বা ছোঁয়াকে কিছু না বলে বা পারসোনালি কয়েকটা ধমক দিয়ে টিসি দিয়ে দিতো তাতেও কোনো কাজ হতো না।কিন্তু আজ যা হয়েছে সেটার ক্ষত ওদের মন থেকে মুছতে বেশ সময় লাগবে।এই আঘাতটা বেশি গভীর।এটা তো পয়েন্ট ওয়ান।আর পয়েন্ট টু কি জানো?প্রিন্সিপাল স্যার বলল না সন্তানের বখে যাওয়ার পেছনে বাবা-মায়ের উদাসীনতাই প্রধান..স্যার কিন্তু ঠিক কথা বলেছে। দে হ্যাভ টু বি মোর কেয়ারফুল এবাউট দেইয়ার চিল্ড্রেন।আজকের এই অপমানের সূত্র ধরে তারা একটু হলেও কেয়ারফুল হবে তাদের সন্তানদের ব্যাপারে..তারা যে একবারেই বিনা দোষে এত কথা শুনেছে তা কিন্তু না”
আরশি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সিদ্রাতের দিকে।শুধু এটাই ভাবছে লোকটা এতো সুন্দর করে কথা বলা শিখল কীভাবে?টিচার বলে নাকি মানুষটাই মুগ্ধ হওয়ার মতো?কী সুন্দর করে অল্প ভাষায় কত বড় কারণগুলো তুলে ধরল পাশাপাশি তার প্রতিকার..এতো অল্প ভাষায়ও যে এতো সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তা তো কোনোদিন জানাই হতো না যদি সিদ্রাত না আসত লাইফে।সিদ্রাত আরশির সামনে তুড়ি বাজালে আরশি ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে।একটু ইতস্ত করে সিদ্রাতের দিকে তাকায়।সিদ্রাত আবারও বলে…
—”তো আমার কথাগুলো ক্লিয়ার হয়েছে তো?”
আরশি মাথা নিচু করে মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়..
—”ওকে ক্লাসে যাও।বেল পড়বে”
আরশি একবার সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে ক্লাসে চলে যায়।সিদ্রাত হালকা হেসে টিচার্স রুমে চলে যায়…
থার্ড পিরিয়ডের টিচার এখনো আসেনি।হয়ত দু এক মিনিটের মধ্যেই আসবে।আরশি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো..
যেহেতু টিচার্স রুম আর আরশিদের ক্লাস রুম দুটোই একই ফ্লোরে তাই ডান পাশের জানালা দিয়ে টিচার্স রুমের সামনের বারান্দা ভালো করেই দেখা যায়।আরশিও প্রতিদিন ইচ্ছা করেই জানালার পাশে বসে যেনো প্রতিটি পিরিয়ডের বেল বাজার সাথে সাথে একবার করে সিদ্রাতকে দেখতে পায়।কারণ সাতটা পিরিয়ডের মধ্যে একটানা পাঁচটা পিরিয়ডেই ক্লাস আছে সিদ্রাতের।লাস্ট দুটো পিরিরিয়ডের সময় ও অফ টাইম পায়।তো যতবার সিদ্রাত ক্লাস নেয়ার জন্য অফিস রুম থেকে বের হয়ে অন্য ফ্লোরে যেতে নেয় ততবারই আরশি ওকে দেখতে পায়।আজও একইভাবে আরশি জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলো।কিন্তু আজকের দৃশ্যটা ভিন্ন ছিলো।সিদ্রাত একটা মেয়ের হাত ধরে কথা বলছে বারান্দায়।মেয়েটা ওদের স্কুলের কোনো স্টুডেন্টও না আবার টিচারও না।বয়স হয়ত সিদ্রাতের কাছাকাছি হবে….
—”তবে কি এটাই সেই মেয়ে যাকে নিয়ে লিখে উনি উনার মোবাইলের ডকুমেন্টস ভরেছে?”
আরশির চোখের কোণায় পানি চিকচিক করে উঠে।ও নিজে নিজেই মুচকি হেসে পানিটা মুছে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে।পাঁচ/ছয় মিনিট পর মেয়েটা চলে যায়।সিদ্রাত অন্য ক্লাসে যাওয়ার সময় আরশির সাথে চোখাচোখি হয়।আরশি মুখ ঘুরিয়ে ক্লাসে মন দেয়…
স্কুল ছুটি হলে আরশি একবার সিদ্রাতের কারের দিকে তাকায়।ওই ঘটনার পর থেকেই মন খারাপ মেয়েটার।অজানা কারণেই সিদ্রাতের প্রতি অভিমান হয়।কিন্তু তারপরও মানুষটাকে না দেখেতো থাকতে পারে না..কি করবে!তাই তো অভিমানগুলো চাপা দিয়ে সিদ্রাতের কারের দিকে তাকিয়ে ছিলো অনেক্ষণ।কিন্তু তবুও সিদ্রাতকে দেখতে পায়না।নিজের ভাগ্যর উপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আরশি হাঁটা ধরে বাসার উদ্দেশ্যে।আজ রিকশায় উঠতেও মন চাচ্ছে না।হেঁটেই পাড়ি জমাবে বাসার উদ্দেশ্যে…
চলবে…