#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৩
বিস্তর ফ্ল্যাটে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা।তিনরুম,রান্নাঘর,আর বড় ড্রইংরুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা।সব লাইট নিভিয়ে রুমের দরজা ভিড়িয়ে বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে তোহা।জ্বরটা এখন আবার বাড়ছে।অস্থির লাগছে।মুখ দিয়ে অস্ফুষ্ট স্বরে গোঙানির মতো শব্দ বের হচ্ছে।পানি পিপাসা পেয়েছে বড্ড।ঘরে পানি নেই।ঘুমানোর আগে বোতল সাথে নিয়ে ঘুমায়নি সে।
বহুকষ্টে পাশে হাতরিয়ে ফোনটা মুঠোয় নেয় তোহা।রাত বাজে তিনটা পনেরো।আধো আধো চোখে তিহানের নাম্বারে ডায়াল করতে যেয়েও করেনা সে।সামান্য পানি খাওয়ানোর জন্য তিহানকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তোলাটা নিতান্তই বোকামি মনে হলো।অগত্যা কোনরকমে দাঁতে দাঁত চেপে উঠে বসলো সে।গা ঝাঁড়া দিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে গেলো।ড্রইংরুম অন্ধকার।তবুও ঘরের আলোয় এখন হাল্কা আলোকিত।শুকনো ঢোঁক গিলে দুরুদুরু মন নিয়ে দ্রুত হেঁটে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে যেইনা সে ঘুরেছে সঙ্গে সঙ্গেই অবচেতন মস্তিষ্ক আর ঘোলাটে দৃষ্টিতে ড্রইংরুমের মাঝখানটায় ছায়ার মতো একটা কিছু চোখে পরলো তার।শরীর জমে গেলো সেকেন্ডেই।আকস্মিক ভয়ে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পানির বোতলটা ওখানেই ফেলে ছুট লাগালো সে ফ্ল্যাটের দরজার দিকে।দরজার লক খুলে দৌড়ে তিহানদের দরজায় পর পর চার পাঁচবার কলিংবেল বাঁজালো।সাথে চললো হাতের ঠাস ঠাস বাড়ি আর ভয়ার্ত কন্ঠের ডাক,”তিহান ভাই,দরজা খুলেন”।
কিছু জরুরি কাজ সেরে খাওয়া দাওয়া করে তখন সবেমাত্র একটু শুয়েছে তিহান।তোহার এহেন ডাকাডাকিতে বুকটা ধরফরিয়ে গেলো তার।উদাম গায়ে জামা না জড়িয়েই হনহন করে দরজা খুললো সে।আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষ এই রাতের বেলা দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনলে তিল কে তাল বানিয়ে ছাড়বে।
দরজা মাত্র খুলতে না খুলতেই তার উপর একপ্রকার হামলে পরলো তোহা।একহাত কাঁধে আরেকহাতে পিঠ জড়িয়ে তিহানের বাহুতে কপাল ঠেকালো সে।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরে তিহান।তোহাকে হঠাৎই এতটা কাছে আশা করেনি সে।চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলালো তিহান।অত:পর তোহার চুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবিয়ে শান্ত স্হির কন্ঠে বললো,
—“জ্বর তো আবার বেড়েছে তোর।ফোন দিসনি কেনো?”
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তোহা।একেতো জ্বর তার উপর এরকম আকস্মিক ভয়ে হৃদস্পন্দন প্রবলহারে বেড়ে গেছে তার।তোহাকে সহই একটু পিছিয়ে গিয়ে দরজাটা আটকে দিল তিহান।এই অবস্থায় তাদের কেউ দেখে ফেললে ব্যাপারটা খুবই বাজে দেখাবে।
তোহা চুপটি করে তিহানের বাহুতে মুখ লুকিয়ে রেখেছে।মাথার হাত বুলানোটা ধীরে ধীরে তার উর্ধ্বগতিতে দৌড়ানো হৃদস্পন্দনটাকে নিজস্ব গতিতে ফিরিয়ে আনছে।খানিকবাদে একটু শিথিল হলো সে।কাঁপুনি কমে আসতেই তিহান স্নেহময় কন্ঠে আস্তে করে বলে,
—“ভয় পেয়েছিস কেনো?”
কিছুক্ষন নিরবতা!তারপর তোহা বললো,
—“ছায়ার মতো কি যেন একটা…”।এখনও ভীত কন্ঠ তার।
নি:শব্দে হুট করে হেসে ফেলে তিহান।কন্ঠে হাসির রেশ টেনে বলে,
—“ওটা তোর মনের ভুল,এমন কিছু নেই।”
—“বিশ্বাস করুন।আমি সত্যিই দেখেছি।”
—“আচ্ছা ঠিকাছে,বিশ্বাস করলাম।এখন ছাড়।রাত হয়েছে অনেক।”
তোহা সাথে সাথে তাকে ছেড়ে দাড়ালো ঠি কই তবে পরমূহুর্তেই বলে উঠলো,
—“আমি যাবোনা ওখানে।”
তিহান উওর দিলোনা।ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে ঘর থেকে টি-শার্ট গায়ে দিয়ে এসে তোহার হাত টেনে বললো,
—“পাগলামো করিস না তিহু।আমার সাথে আয়।কিছু নেই ওখানে।আমি বলছিতো।”
অনিচ্ছা সত্তেও সেদিকে পা বাড়ালো তোহা।তার অস্থির মনিজোড়া বারবার এদিক ওদিক ছুটে বেরাচ্ছে।ফ্ল্যাটে ঢুকতেই চুঁপসে গিয়ে তিহানের হাত ঘেঁষে দাড়ালো সে।ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত করলো তিহান।ড্রইংরুমের লাইট জ্বালিয়ে তোহাকে আশ্বস্ত করে বললো,
—“বলেছি না কিছুই নেই।কেবলই তোর মনের ভুল।ফ্ল্যাটে একা তো,একটু এমন হতেই পারে।ভয় পাস না।”
তোহা প্রত্যুওরে কিছু বললোনা।বারকয়েক পিটপিট করে সারা ড্রইংরুমে চোখ বুলাতেই তিহান বললো,
—“এখানে এসেছিলি কেনো?”
—“তেষ্টা পেয়েছিলো।পানি নিতে এসেছিলাম।”
—“ঘরে পানি ছিলোনা?আর না থাকলেও কি?আমাকে ফোন করতি।”
—“এইটুকুর জন্য আপনাকে বিরক্ত করবো?”
“সেই তো আমার কাছেই গেলি।”বিরবির করে কথাটা বলে তোহাকে রুমে নিয়ে বিছানায় বসালো তিহান।
টেবিলের উপর থেকে প্যারাসিটামলের পাতাটা থেকে একটা ওষুধ বের করে বাইরে থেকে পানি নিয়ে আসলো ।তোহার মুখে ওষুধটা দিয়ে পানি খাইয়ে দিতে দিতে ধীরস্হির কন্ঠে বললো,
—“তোমার উপর কখনো বিরক্ত হতে পারিনা আমি।”
কথাটা শুনতেই পানি মুখেই একটু কেঁশে উঠলো তোহা।তাড়াহুড়ো করে পানিটা গিলে নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে ফ্লোরের দিকে চেয়ে রইলো সে।তিহান হাল্কা হেসে তার মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে বললো,
—“ঘুমিয়ে পর।এভাবে জেগে থাকলে আরো অসুস্থ অসুস্থ লাগবে।”
বলে তিহান দরজার কাছাকাছি যেতেই তোহা দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
—“আপনি এখানেই থাকেননা প্লিজ।”
তিহান থামে।তোহার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে রূঢ়ভাবে বলে,
—“তুই কি বুঝতে পারছিস তুই কি বলছিস?এতোটা অবুঝ থাকার বয়স তো তোর নয়।”
তিহানের কথার মানে বুঝে আসতেই বিচলিত হয়ে পরে তোহা।তাড়াহুড়ো করে বলে,
—“আ..না না এখানে নয়।আসলে আমি বলতে চাচ্ছি আপনি পাশের রুমে থাকেন আজকের রাতটা।একা ফ্ল্যাটে আমি থাকতে পারবোনা।প্লিজ।”
কিছুক্ষন হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘঁসলো তিহান।অত:পর তোহার মিনতি ভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“আচ্ছা আমি তূর্যর রুমে আছি।দরজা খোলাই রাখবো।আর ভয় লাগলে বা কিছু হলে আস্তে ধীরে ডাকবি।চেঁচামেচি করবিনা একদম।”
মুখ লটকালো তোহা।তিহান তাকে ইশারা করতেই গায়ে কাঁথা টেনে শুয়ে পড়লো সে।
লাইট নিভিয়ে দিয়ে বের হওয়ার আগে তিহান গম্ভীর স্বরে ডাকলো,
—“শোন?”
—“জি?”ঘাড় উঁচিয়ে বললো তোহা।
—“চাইলে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে ঘুমাস।”বলেই তোহার উওরের জন্য অপেক্ষা করতেই তোহা বললো,
—“প্রয়োজন নেই।”বলে আবারো আগের মতো শুয়ে পরলো তোহা।
তিহান মুচকি হাসলো।মনের মাঝে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বারি খেতে লাগলো প্রশান্তির অনুভূতিগুলো।কারো এতটা বিশ্বাস অর্জন করা সহজ কথা নয়।একেবারেই সহজ কথা নয়।
________________
সকালে ঘুম ভাঙতেই দুহাতে মাথা চেপে উঠে বসলো তোহা।এখন একটু ভালো লাগছে তবে মাথাটা ভার ভার লাগছে।দুহাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে রুম থেকে বেরিয়ে তূর্যর রুমে উঁকি দিলো সে।কিন্তু এমা!তিহান তো নেই রুমে।তবে বিছানার কুঁচকানো চাদরটা দেখেই সে বুঝলো রাতে তিহান এখানেই শুয়েছিলো।
ঘড়ির দিকে চোখ পরলে হঠাৎই আৎকে উঠলো সে।প্রায় দুপুর বারোটা বাঁজতে চললো।দ্রুতপায়ে ড্রইংরুমে যেতেই টেবিলের উপর নাস্তার প্লেট চোখে পরতেই আরো একটু অবাক হলো সে।ধীরপায়ে রুমে যেতেই ফোন বাঁজলে দ্রুত সেটা রিসিভ করতেই তিহানের কন্ঠ ভেসে আসলো,
—“ঘুম থেকে উঠিসনি এখনো?”
—“উঠেছি।”
—“এখনই উঠেছিস তাইনা?”
—“আপনি কিকরে বুঝলেন?”
—“তোর কন্ঠ শুনে।(অস্পষ্ট স্বরে বললো তিহান)
—“কি বললেন?বুঝিনি।”
তিহান প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে,
—“আমি অফিসে।ফ্ল্যাটেই থাকিস।বের হবিনা একদম।শুধু দুপুরবেলা খাবার দিয়ে যাবে একজন তখন দরজা খুলবি।তাছাড়া আর যেই আসুক না কেনো রাতে আমি ফিরা না পর্যন্ত দরজা খুলবিনা।বুঝেছিস?”
—“বুঝেছি।…আপনার কি দেরি হবে ফিরতে?”
—“হতে পারে।বলতে পারছিনা।”নিরস কন্ঠে বলে তিহান।অফিসে অনেক কাজের চাপ।নয়তো কখনোই তোহাকে একা রেখে আসতোনা সে।নেহাতই চাপে পরে আসতে হয়েছে।
________________
রাতের বেলা…..
সব কাজ শেষে বারান্দায় মোড়ায় বসে গিটার নিয়ে টুংটাং শব্দ করছে তিহান।হঠাৎ পাশের বারান্দায় চোখ পরতেই তোহাকে সেখানে দেখে সে উচ্চস্বরে ডাকলো,
—“তিহু,এখানে আয়তো।”
—“জি?”
—-“শুনতে পাস না?এই বারান্দায় আসতে বলেছি।ফ্ল্যাটের চাবি আছেনা তোর কাছে?”
তিহানের গিটারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তোহা।তারপর বলে,
—“ওখানে এসে কি করবো?”
—“আসতে বলেছি মানে আসবি।ফাস্ট।”
তিহানের ধমকে মুখ গোমড়া করে কিছুক্ষন বাদেই সেখানে উপস্থিত হয় তোহা।তিহান মুচকি হেসে পা দিয়ে ঠেলে তার পাশের মোড়াটা একদম মুখ বরাবর রেখে বলে,
—“বস।”
তোহা বসেনা।মিনমিনে কন্ঠে বলে,
—-“আমার ঘুম পাচ্ছে।আমি ঘুমাবো।”
তিহান তাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে চোখে চোখ রেখে মোহনীয় কন্ঠে বলে,
—“একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেনা আমার সাথে।ভুলে যাচ্ছো বোধহয়,তোমাকে তোমার থেকেও বেশি আমি চিনি।।”
বলে আরো কিছুক্ষণ গিটারে উল্টাপাল্টা স্বুর তুলে তিহান।তোহা আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে।তার চোখে মুখে অস্থির অশান্ত ভাব।
তিহান হেসে তোহার দিকে চেয়ে ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা টেনে গান ধরে,
Hum tere bin ab rhe nhi sakte,
Tere bina Kya wajood mera.
Tujhe juda agar Ho jayenge ,
To khudse hi ho jayenge juda.
এটুকু গেয়ে একমূহুর্ত থামলো তিহান।এতক্ষনের একধ্যানে চেয়ে থাকা দৃষ্টিতে একবার চোখের পলক ফেলে আবারো গাইতে শুরু করলো,
Cause you’re the one,Girl you’re the one
You mean my life cause you’re the one
~
I find My peace in you
My pain in you
My love in you
~
Cause you’re the one
You’re the one…..
#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৪
বারান্দায় নতুন লাগানো ফুল গাছের ছোট্ট টবের উপর একটা প্রজাপতি বসেছে।টবটা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকায় দক্ষিণা হাওয়ার ধাক্কায় একটু আধটু দুলছে।তোহার মাধুর্যে ভরা দৃষ্টি আটকে রয়েছে প্রজাপতির রঙিন পাখাদুটোর উপর।নি:শব্দে একপা দু পা করে এগিয়ে দরজা ঘেঁষে দাড়ালো সে।তার থেকে মাত্র দুহাত দূরেই সদ্য ফোঁটা দুটো ফুলের উপর রং বেরঙে পাখা মেলে বসে রয়েছে প্রজাপতিটা।তোহা একটু হাসলো।নামমাত্র দুরত্ব হওয়া সত্তেও প্রজাপতিটাকে ছুঁয়ে দিতে ভয়।ছুঁয়ে দিলেই তো তা উড়ে যাবে।হারিয়ে যাবে।মিলিয়ে যাবে সুবিশাল আকাশের গহীন সাম্রাজ্য।তখন আর তাকে দেখা যাবেনা,ধরা যাবেনা,ছোঁয়া যাবেনা।মৃদু হেসে হাঁফ ছাড়লো তোহা।
ফুলের টবটা তূর্য এনেছে তার জন্য।যে বন্ধুর বাড়ির গিয়েছিলো ওদিকে নাকি অনেক ফুলের গাছ পাওয়া যায়।সেখান থেকে কিনে বোনের জন্য এতদূর এটাকে বয়ে এনেছে সে।মূলত ফুল প্রচন্ড পছন্দ তোহার।
॥
মনটা আজকে ফুরফুরে।দুপুরে নিশা আসবে তার জামাই সহ।তাছাড়া সাইফ,নুহাশ আর স্বর্নালিও আসবে।থাকবে দুদিন।বিয়ের পর এই প্রথম আসা নিশার।আরো আগেই আসতো তবে নানার অসুস্থতার খবর শুনে আর আসেনি।কারণ বাসায় তোহা ছাড়া আর কেউই ছিলোনা।এসে কি করতো?তবে এখন সমস্যা নেই।দুদিন আগেই তার মা,খালামনি ফিরে এসেছে।নানা এখন অনেকটাই সুস্থ।
_______________
বিকেল প্রায় চারটা বাজে।হাসি তামাশার প্রবল আনন্দে মেতে উঠেছে তোহার ঘর।দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই বসেছে আড্ডা দিতে।হাস্সোজ্জ্বল কন্ঠ গুলো যেনো অনুভূতিদের স্বতস্ফুর্ত মিলনমেলা।
নিশার বর সৌহার্দ্য মির্জা অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের একজন সুপুরুষ।সবার থেকে বয়সে প্রায় অনেকটা বড় হওয়া সত্তেও সবার সাথে মিলেমিশে কোনো অসস্তি ছাড়াই আড্ডা দিচ্ছে সে।
খাটে জায়গা না হওয়ায় পাশে একটা চেয়ার টেনে দুই পা ভাঁজ করে তুলে বসে আছে তোহা।মুখে নজরকাড়া হাসি টেনে সবার সাথে গল্পে মশগুল সে।
॥
হাসাহাসির মাঝেই চুলে হাত চালাতে চালাতে রুমে প্রবেশ করে তিহান।সবার দৃষ্টি আচমকা তার দিকে পরতেই চমৎকার করে হেসে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সে বলে,
—“আমাকে ছাড়াই আড্ডা দিচ্ছিস সবগুলা?কথাটা বলে সৌহার্দ্যর দিকে চোখ পরতেই তোহাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে সে বললো,”আরে দুলাভাই যে,কেমন আছেন?”
সৌহার্দ্য হাসলো।হাতে হাত মিলিয়ে বললো,
—“আছি ভালোই।তুমি কেমন আছো?”
—“এইতো আছি।তো কি নিয়ে এত হাসাহাসির হচ্ছিলো?”বলে বসার জন্য আশেপাশে তাকায় তিহান।প্রায় সাথে সাথেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় তোহা।একটু সরে দাড়িয়ে তিহানের দিকে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলে,
—“বসুন।”
তিহান তোহার দিকে না তাকিয়েই চেয়ার টেনে বসে পরলো।মুখের হাসি ততক্ষনে সরে গেছে তোহার।চুপটি করে চেয়ারের পাশ ঘেঁষে দাড়ালো সে।
সৌহার্দ্য একবার আশেপাশে চোখ বুলালো।স্বর্ণালি,তোহা,এমনকি নিশাও একটু চুপসে গেছে।
সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বললো,
—“এদেরকে খুব বেশি টাইটে রাখো বুঝি?তোমাকে দেখেই সবকটা ভিজে বিড়াল হয়ে গেলো?”
উওরে তিহান শুধুমাত্র হাসলো।হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়া হাসি।সেদিক তাকিয়ে একটুখানি থমকালো তোহা।বামহাত দিয়ে তিহানের চেয়ারের পিঠ ঠেকানোর উপরের অংশটা আরো একটু খামছে ধরলো সে।
নিশা তেঁতে উঠে বললো,
—“আমরা মোটেও ভিজে বিড়াল হইনি।তিহান ভাইকে আমরা যথেষ্ঠ সম্মান করি বুঝলে?সেজন্যই উনাকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্যই আমরা চুপ হলাম।”
তিহান ভ্রু উচিয়ে বললো,
—“তাই নাকি রে?তুই চুপ না করলেতো আমি কথাই বলতে পারতামনা।বড় উপকার করলি রে নিশা।অনেক বড় উপকার করলি।”
তিহানের কথায় অপদস্ত হয়ে চুপ করে গেলো নিশা।তবে নিশা ছাড়া সবাই ই সমস্বরে হেসে উঠলো।
খানিকবাদেই তিহানের চোখ গেলো বিছানার কোঁণে সাইফ,নুহাশের সাথে বসে থাকা সুদর্শন ছেলেটার উপর।এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি।মূহুর্তেই ভ্রু কুচকে গেলো তার।থুতনি তে হাত বুলিয়ে সে বললো,
—“উনি কে?”
সাথে সাথেই ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হাসি টেনে বললো,
—“আমি ভাবির দেবর।অনন্ত”।বলে নিশার দিকে ইশারা করলো সে।
—“তোমাকেতো দেখিনি বিয়েতে?।”কৌতুহলটা কন্ঠ তিহানের,
সৌহার্দ্য উওর দিলো,
—“ও আসতে পারেনি বিয়েতে।অসুস্থ ছিলো।তবে এংগেজমেন্টে এসেছিলো।তুমি হয়তো খেয়াল করনি।”
তিহান মাথা নাড়িয়ে বললো,”হয়তোবা।” অনন্ত আবারো মুচকি হাসলো।
তোহা তখন বসে আছে খাটের পাশের কাঠের ছোট্ট টেবিলের উপরে।বেশ অনেকটা সময় পর তিহানের চোখ আবারো পড়লো অনন্তের উপর।ঘাড় বাঁকিয়ে তার চকচকে দৃষ্টি অনুসরণ করে তোহার আপত্তিকর স্হানে চোখ পরতেই মূহুর্তে মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।
দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা আটকিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে তোহাকে তার পিছে আড়াল করে বসলো সে।
______
আকাশী রংয়ের একটা হ্যান্ডপ্রিন্টের সুতি শাড়ি পরেছে তোহা।আকাশী রংয়ের মধ্যে সাদা মেঘের মতো সাদা রংয়ের রংতুলির ছোয়াঁ দিয়ে খুব যত্নে তৈরি করা হয়েছে শাড়িটা।গতবছর বৈশাখের সময় মেলা থেকে শখ করে কিনেছিলো তবে আজ পর্যন্ত পরার সুযোগ হয়নি।আজকে সুযোগ পেয়েই পরে ফেলেছে।
সাদা রংয়ের ব্লাউজের সাথে গলায় ছোট একটা সাদা পাথরের লকেটটা একদম ফুঁটে উঠেছে।চুলে খোঁপা করে সামনে থেকে কিছু চুল বের করে নিলো তোহা।দু’হাতভর্তি সাদা রংয়ের তিহানের দেয়া সেদিনের কাঁচের চুড়ি।চোখে খুব সাবধানতার সাথে আইলাইনার লাগিয়ে ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক লাগিয়ে পরিপাটি হয়ে বের হলো সে।সে বের হতে না হতেই স্বর্ণালি আর নিশাও পাশের রুম থেকে বের হলো।তাদের পরণেও শাড়ি।তারা বেরিয়ে আসতেই ড্রইংরুমে বসা ছেলেরা উঠে দাড়ালো।একবার পুরো ড্রইংরুমে চোখ বুলাল তোহা।তিহানকে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও।
॥
সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে যাবে তারা।সৌহার্দ্যর পক্ষ থেকে বিয়ের পর প্রথম ট্রি ট।বিকেল তখন পাঁচটা সতেরো বাজে।এখনও রোদ আছে আশেপাশে।আলোয় ঝলমলে চারিপাশ।
একহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে তোহা।তার আগে আগে নিশা আর স্বর্ণালি।হঠাৎ পিছে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই একটু থেমে ঘাড় ঘুরালো সে।ধবধবে সাদা পান্জাবিতে তিহানকে দেখে একমূহুর্ত পলকহীনভাবে চেয়ে থেকে একটু সাইড দিয়ে বললো,
—“আপনি আগে যান।”
তিহান কিছুক্ষন তোহাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মুখ এগিয়ে এনে বললো,
—“আমি আগে গেলে তোমাকে সামলাবে কে?ধীরেসুস্থে শাড়ি সামলে নামো।”
কথাটা কানে যেতেই চকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকালো তোহা।নিশারা শুনলে কি একটা লজ্জায় পরবে সে।তবে নিশা আর স্বর্ণালিকে সামনে না দেখে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতেই তিহান বললো,
—“কেউ শুনেনি।নামো।”।
তোহা আর কিছু বললোনা।চুপচাপ নিচে নামতেই দেখলো পাশাপাশি তিনটে গাড়ি দাঁড় করানো।একটার ড্রাইভিং সিটে বসেছে সৌহার্দ্য তার পাশে নিশা।পেছনে বোধহয় তূর্য,অনন্ত আর স্বর্ণা।আরেকটা গাড়ি সাইফদের।সাইফ আর নুহাশ উঠেছে সেটায়।
তোহাকে দেখে অনন্ত জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললো,
—“তুমি এখানে আসো তোহা।”
তোহা আমতাআমতা করতেই তিহান তার হাত টেনে বললো,
—“ও আসলে চাপাচাপি করে বসতে পারে না।সমস্যা নেই।তোমরা যাও।ও আমার সাথে যাবে।”
অনন্ত আরো কিছু বলার আগেই সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট দিলো।তিহান মুচকি হেসে সাইফদের গাড়ির কাছে যেয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো,
—“তোরা যা,আমি তোহাকে নিয়ে আসছি।”
_______________
গাড়িতে বসে আছে তোহা।বারবার সামনের চুলগুলো চোখের উপর থেকে সরাতে গিয়ে কাঁচের চুড়িতে রিনঝিন করে বেঁজে উঠছে শব্দতরঙ্গ।তিহান ড্রাইভ করছে মনোযোগ দিয়ে।তার দৃষ্টি সামনের দিকে।তোহার দিকে তাকচ্ছেনা সে।
হঠাৎই গাড়ির মোড় ঘুরাতে ঘুরাতে তিহান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“তিহু,ডানপকেটে হাত ঢুকাতো।”
তোহা বুঝতে না পেরে বললো,
—“জি?”
—“পান্জাবির ডানপাশের পকেটে হাত ঢুকা।”
ইততস্ত ভাবে তিহানের পকেট হাতরাতেই একটা সিলভার কালারের ছোট্ট ঝুমকা কানের দুল বেরিয়ে এলো।
সেগুলো হাতে নিয়ে তোহা কিছু বলার আগেই তিহান বললো,
—“পড়।”
তোহা বিনাবাক্য দুলদুটো পরে নিতেই গাড়ি থামালো তিহান।ঝুঁকে গিয়ে তোহার পাশের গাড়ির জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে একটানে তোহার চুলের খোঁপা খুলে দিলো সে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে পরতেই তোহা লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে পিটপিট করে বললো,
—“তিহান ভা….”
বাক্যটা শুরু করলেও শেষ করতে সক্ষম হলোনা সে।তার আগেই তিহান তার সারামুখে চোখ বুলাতে বুলাতে বামগালে হাত রেখে বৃদ্ধাআঙ্গুল ঠোঁটের উপর রেখে নিচু কন্ঠে বললো,
—“একদম “মেঘময়ূরী” লাগছে তোমাকে।নীল সাদা মেঘে জর্জরিত আমার একমাত্র “মেঘময়ূরী”।”
~চলবে~
[পর্ব কিন্তু ১০০০ শব্দের বেশিই লিখি আমি।তবুও আপনারা ছোট ছোট বলেন কেনো?]
~চলবে~