#নষ্ট_গলি
পর্বঃ৩২
লেখা-মিম
সোহানের ঘুম ভেঙেছে সেই অনেক্ষণ আগেই। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারছে না, এপাশ ওপাশও হতে পারছে না। ওর শরীরের উপর উপুর হয়ে ঘুমুচ্ছে মায়া। ওকে দুহাতে শক্ত করে আগলে রেখেছে সোহান। গায়ের জ্বরটা আপাতত নেই। তবু মায়ার রেস্ট নেয়াটা জরুরী। তাই ওকে জাগাচ্ছে না। তবে কারন অবশ্য আরেকটা আছে। মায়াকে এ মূহূর্ত্বে একদম ছোট বাচ্চার মতো লাগছে। এভাবে আগলে রাখতে ভালো লাগছে সোহানের।
জানালার ধারে বসে আছে আলিশা। ঘুম হয় না আজকাল ওর। একদমই হয় না। সোহানের বিয়ে মেনেই নিতে পারছে না ও। সোহানের ভালোবাসা কেমন তা খুব ভালো করেই জানে আলিশা। ব্রেকআপের এত বছর পরও সোহানের ভালোবাসাটা ওর শরীরের লোমে লোমে মিশে আছে। সেই ভালোবাসা এখন অন্য কেও ভোগ করছে। যতটা ভালোবাসা আলিশাকে সোহান দিয়েছিলো তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে মায়াকে। মায়ার অনুভূতিটা কেমন হতে পারে সেটা বেশ বুঝতে পারছে আলিশা। এত সুখ! এত ভালোবাসা! আজ যদি সোহানের বউ হতো তাহলে……. ব্যাপারটা কি আদৌ মেনে নেয়ার মতো? এমন কেনো হলো? হওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিলো?
-আলিশা….
রুপমের গলার আওয়াজ পেলো আলিশা। পিছন থেকে ডাকছে সে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছে না আলিশা। এই মানুষটার ছায়া থেকে সরে যেতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচে ও। সহ্য হয়না। একদম সহ্য হয় না এই লোকটাকে।
– আলিশা… নাস্তা খাবে এসো।
-………….
– কি বলছি? শুনছো না?
– পরে খাবো।
– না, আমার সাথে খাবে।
– ক্ষিদে নেই।
– গতকাল রাতেও কিছু খাওনি।
– ক্ষিদে লাগেনি তাই।
– একটা মানুষ এভাবে না খেয়ে কিভাবে থাকতে পারে আলিশা?
– ক্ষিদে না লাগলে কি করবো?
– ঘুমাও না। খাও না। কোথাও যাও না। সারাটাদিন এইরুমে বসে থাকো। কেনো আলিশা? তোমার কি স্বাভাবিক হতে ইচ্ছে হয় না?
– কি হবে স্বাভাবিক হয়ে?
এগিয়ে এসে আলিশার পাশে বসলো রুপম। ওর হাতের উপর হাত রাখলো। ঘাড় ফিরিয়ে ডানে তাকালো আলিশা। রুপম ওর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।
– সোহান আমাকে খুব ভালোবাসতো। ও আমাকে ভুলে গেলো কি করে?
– আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না?
– জানি না।
– আমিও তোমাকে ভালোবাসি। সোহান তোমাকে কতটা ভালোবাসতো আমি জানি না। তবে আমি তোমাকে ওর চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসি। একটাবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো তো। তোমার বাবা সোহানের নামে মামলা করার পর ও তোমাকে ফেলে চলে গেলো। তুমি ওকে কতবার রিকুয়েস্ট করলে তোমার কাছে ফিরে আসার জন্য। ও কি এসেছিলো? মামলা তোমার বাবা করেছে, তুমি তো করোনি। ও যদি তোমাকে এতই ভালোবাসবে তাহলে ও তোমাকে এমন শাস্তি দিবে কেনো যেটার উপযুক্ত তুমি না?
– ওর রাগ খুব বেশি। তাই ও ব্রেকআপ করেছে।
– আমার কি রাগ নেই। তুমি যেসব কাজ করো তোমার উপর কি আমার রাগ হয় না? আমি কি তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছি?
– তুমি তোমার ছেলের জন্য আমাকে ডিভোর্স দাও না।
– আফিফকে কি তুমি দেখাশোনা করো? ওর দেখাশোনা আমি আর ঝর্নাই তো করি। তোমার তো কোনো প্রয়োজন নেই। তবু তোমাকে আমার ঘরে রেখে দিয়েছি। কেনো বলতে পারো?
– তুমিই তো বলো আমাকে সেই কবেই তুমি ডিভোর্স দিয়ে দিতে। শুধু ছেলের জন্য দাও না।
– আমার মনের কথাগুলো কবে বুঝবে তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি আলিশা। তাই তোমার সমস্ত পাগলামী সহ্য করেও তোমাকে আমার পাশে রাখতে চাই। ডিভোর্স দেয়ার শখ থাকলে কবেই দিতাম। তুমি ভার্জিন না এটা আমি বিয়ের পরই টের পেয়েছি। এমনকি সোহানের সাথে তুমি রেগুলার ইন্টিমেট হতে সেটাও বুঝেছি। আমি কি চাইলে তখন পারতাম না তোমাকে ডিভোর্স দিতে। বিয়ের দু সপ্তাহ পর থেকেই শুরু করলে সোহানের কাছে যাবে। আমি যেনো তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেই। তখন কি আমি পারতাম না তোমাকে ডিভোর্স দিতে? তোমার প্রেগন্যান্সির টাইমে কি যন্ত্রনায় আমাকে তুমি রেখেছিলে মনে আছে? তবু তোমাকে আমি ছাড়িনি। দিন দিন সোহানের জন্য তোমার পাগলামি বেড়েই যাচ্ছিলো। তবু আমি তোমাকে ছাড়িনি। আমি তোমার হাজবেন্ড আলিশা। তোমার সন্তানের বাবা। আমার ওয়াইফ সর্বক্ষণ তার এক্স বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ডুবে থাকে সেটা জেনেও আমি তোমাকে নিয়ে ঘর করছি। এরপরও তুমি আমাকে বলছো আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না তুমি জানো না? মায়া সোহানের ওয়াইফ। ওকে পাগলের মত ভালোবাসাটা খুব স্বাভাবিক। প্রেমিকা আর বউ তো এক হয় না। তুমি ওর প্রেমিকা ছিলে আর মায়া ওর বউ। ওর সাথে নিজেকে কেনো মিলাচ্ছো? অহেতুক হিংসার আগুনে নিজে তো জ্বলছোই সেই সাথে আমি আর আমাদের সংসারটাকেও জ্বালাচ্ছো। ওরা তো সুখে আছে আলিশা। তাহলে শুধু নিজের সুখে আগুন ধরাচ্ছো? আমি মানুষটাকে কেনো এভাবে কষ্ট দিচ্ছো। সোহানের চেয়ে অারো অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে। একটাবার… জাস্ট একটাবার ভালোবাসাটা অনুভব করার চেষ্টা করো আলিশা। সংসারটাকে আগলে ধরো। আমাকে, আমাদের ছেলেটাকে আগলে ধরো। মায়াকে দেখেছো? অতটুকু একটা মেয়ে। অথচ নিজের হাজবেন্ড আর সংসারের ষোলো আনা বুঝে। কতটা সুন্দর করে আগলে রাখে। তোমার মত মেয়ে ওর সাথে কথা বলে পেরে উঠতে পারো নি। ভেবে দেখো ও ওর হাজবেন্ড আর সংসার নিয়ে কতটা প্রোটেক্টিভ।
– তুমি মনে হয় ঐ মেয়ের প্রশংসা করছো?
– হ্যাঁঁ করছি। প্রশংসা করার মতো কাজ করেছে তাই করছি।
– হাত ছাড়ো।
– কেনো?
– আমি খারাপ। মায়া ভালো। সোহান ওর প্রেমে মজেছে। এখন তুমিও ওর প্রেমে ডুবে মরো।
– আমি তোমার মাঝে ডুবে মরতে চাই। আমি চাই তুমি মায়ার মতো আমাকে সংসারটাকে আগলে ধরো।
– আমার সাথে ওর তুলনা করতে এসো না রুপম। আমি ওর চেয়ে হাজারগুনে ভালো করে আগলে রাখতে জানি। দেখো না সোহানকে আজও ভুলতে পারি না। ভালোবাসা আজও আগলে বসে আছি।
– তুমি সোহানকে ভালোবাসো। আমাকে না। তাহলে বুঝবো কিভাবে তুমি কতটা আগলে রাখতে জানো।
– কি চাচ্ছো তুমি? বুঝিয়ে বলো।
– কিছু না। নাস্তা খাবে চলো।
-পরে খাবো।
– আমি এখন নাস্তা করবো। নাস্তা খাও আর না খাও আমার সামনে বসে থাকবে। চলো।
– ভালো লাগছে না। যাবো না।
– প্লিজ….
– রুপম তোমার বিরক্ত লাগে না আমার পিছন পিছন ঘুরতে?
– বউ কি আমার দশটা? একটাই তো। তোমার পিছন ঘুরবো না তো কার পিছনে ঘুরবো। এত ঘুরি তবু তো সোহানকে ভুলতে পারো না।
– ওকে ভুলে যাওয়া এতটাও সহজ না।
– এত কঠিনও না।
আলিশা জানে রুপম ঘ্যানরঘ্যানর করতেই থাকবে। ভালো লাগছে না রুপমের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে। এরচেয়ে ডাইনিং টেবিলে চুপচাপ ওর সামনে বসে থাকা ভালো। মাথার চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে খাট ছেড়ে নেমে এসেছে আলিশা।
জোনাকির ঘরে বসে সিগারেট ফুঁকছে ইমন।
– মায়া এখন তার বিয়া করা বউ। আমাগো সামনেই বিয়া করছে। ওর দিকে আর নজর দিয়েন না স্যার। আরো বহু মাইয়্যা আছে। আমি আইনা দেই। যেইটারে ভাল্লাগবো খালি ইশারা করবেন। রুমে সাজায়া গুজায়া পাঠায়া দিমু।
– মায়াকে লাগবে।
মনে মনে ইমনকে বকছে জোনাকি।
শালায় পাইছে কি? মায়াকে লাগবে, মায়াকে লাগবে। তামশা শুরু করছে। কইতাসি বিয়া হয়া গেছে ছেমড়ির। তবু কথা শুনে না।
ঠোঁটে মিথ্যে হাসি এনে জোনাকি বললো
– এইডা কেমনে সম্ভব। আরেক লোকের বউরে কেমনে আইনা দিমু?
– যেভাবে আমার মায়াকে অন্য লোকের হাতে দিয়েছো, সেভাবেই আমার কাছে আবার ফেরত এনে দিবে।
– স্যার আরো মাইয়্যা আছে তো। মায়ার মতই আছে। আমি আনতাছি।
হাতে থাকা মোবাইলটাতে ভিডিও প্লে করলো ইমন। কারো চিৎকারের আওয়াজ আসছে মোবাইলটা থেকে।
– ব্যাথা পাচ্ছি। ছেড়ে দিন।
ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে ইমন। বারবার ঐ চিৎকারের অংশটুকু টেনে টেনে দেখছে সে। ইমনকে এই মূহুর্তে বিশাল বড় মসিবত মনে হচ্ছে জোনাকির। যাওয়ার নাম তো নিচ্ছেই না।, উল্টো এক চিৎকার শুনিয়ে শুনিয়ে কানটাকে পঁচিয়ে ফেলছে। বিশ্রি অবস্থা।
– মেয়েটা কে জানো?
– না।
– মায়া। কত সুন্দর করে চিৎকার করে। ব্যাথা পাচ্ছি, ছাড়ুন। উফফ!! শুনলেই ইচ্ছে হয় আরো জোরে কামড় দেই। দাঁত শিরশির করছে খুব। ওকে আনার ব্যবস্থা করে দাও না জোনাকি। আর সহ্য হচ্ছে না।
ইমনের মতিগতি বেগতিক মনে হচ্ছে জোনাকির। এখান থেকে লোকটাকে বের করতে হবে। ও চায়নি সোহানের কাছে এই মানুষটার খোঁজ দিতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খোঁজ দেয়াটা অতি জরুরী। আর নয়তো কেলেঙ্কারি ঘটতে পারে৷ সামনের আটখানা দাঁত বের করে হাসলো জোনাকি।
– মায়ারে খুব মনে ধরছে না স্যার? আইচ্ছা স্যার আইনা দিমু। তবে আপাতত সম্ভব না। জামাইর লগে বিদেশ গেছে হানিমুনে। দেশে আইলেই ওরে ধইরা আনার ব্যবস্থা করুম। তবে চার্জ একটু বেশি লাগবো।
– এডভান্স দিয়ে যাবো?
– না স্যার। কাম সাড়ার পর দিয়েন।
(চলবে)