প্রণয়িনী,পর্ব:৩

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ৩

সন্ধ্যা নামবে বলে, মোহদিঘীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছায়ানিকা ভাবছে আজ রাতেও কি গতকালের মেয়েটি আসবে? তার নাম কি সত্যিই মোহ? সে কি মানুষ নয়! সঙ্গে আরও একটি ব্যাপার তাকে চিন্তিত করছে আর তা হলো মেয়েটির কথা একমাত্র তার মনে আছে, অন্যকারও নেই… কিন্তু কেনো? গত রাতের ঘটনা শুরু থেকে আবার ভাবতে লাগলো ছায়ানিকা আর মুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মনে মনে নিজেকেই নিজে বললো, “ওয়েল ডান ছায়ানিকা”!

রিদান তখন থেকে ওদের তাড়া দিচ্ছে, দুপুর অবধি নিজেদের ব্যাগে থাকা শুকনো খাবার খেয়ে কাটালেও বেচারার মন এখন গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের জন্য আনছান করছে। রাতে ভাত না হলে নির্ঘাত খুদার জ্বালায় তাকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে। ছায়ানিকা হঠাৎ তুলিকে তাড়া দিয়ে বললো,

—চল তুলি রান্না করবো…
—বাজার করে আনুক আগে ওরা। বাজার ছাড়া রান্না কি আমাদের হাত পা কেটে রক্ত দিয়ে করবো?

বিরক্ত হয়েই কথাটা বললো তুলি… মুচকি মুচকি হাসছে ছায়ানিকা, তার মন বলছে মায়াজাল এর রান্নাঘরে রান্নার সকল সামগ্রীই তারা পাবে। তার ধারনা যদি ঠিক হয় তবে সত্যিই গতকালের মেয়েটি আত্মা নাকি মানুষ সে ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। ছায়ানিকাকে হাসতে দেখে রিদান এগিয়ে এসে বললো,

—অমন চোট পেয়ে তোর কি বুদ্ধিরা গোল্লায় গেছে?
—আগে ভেতরে যাই, তারপর দেখবো কার বুদ্ধি গোল্লায় গেছে।

বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই ছায়ানিকার চোখ আটকে গেলো গ্রামোফোনটার উপর। এ জাতীয় গ্রামোফোন সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না, সোনালী রঙের গ্রামোফোন সে আগেও দেখেছে অনেক বাড়িতে তবে এ গ্রামোফোনের রঙটা রূপোলী… তার উপর সোনালী নকশা করা। দেখেই মনে ধরার মতো এক সাজ। ক্যাসেটটাও কি পরিষ্কার, কে বলবে এ বাড়িটা বছরের পর বছর খালি পড়ে আছে! রান্নাঘরের দিকে গিয়ে তুলি চোখ কপালে তুলে বললো,

—কি রে ভাই, সে সময়ও এখনকার মতো ওভেন ছিলো! তার উপর ইলেক্ট্রিক চুলা! গ্লেন্ডার, জুসার, রাইস কুকার, টোস্টার সব আছে, ফ্রিজও!
—খুঁজে দেখ রান্নার সব সরঞ্জামও পাবি, বাইরেটা ভুতের বাড়ি হলেও ভেতরটা মানুষের বাড়ি…

মুচকি হাসলো ছায়ানিকা, এসবের পেছনে কোনো আত্মা নেই এটা নিশ্চিত হয়ে ভালো লাগছে তার। গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো ছায়ানিকা, তুলিও তার হাতে হাতে কাজ শুরু করলো। কাজের মাঝেই রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাহিরে চোখ যেতেই মোহদিঘীর পাড়ে বিজয়কে দেখা গেলো, তুলিকে রান্নার বাকি দায়িত্ব দিয়ে একছুটে মোহদিঘীর পাড়ে চলে গেলো ছায়ানিকা। বিজয় এর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—আমাকে মিথ্যে বললেন কেনো সকালে?
—মিথ্যে বলেছিলাম বলেই এখন সত্যি বলতে আসার সুযোগ পেলাম।
—মানে?
—অপরাধবোধ হচ্ছিলো, কেনো মিথ্যা বললাম।
—তো সত্যিটা শুনি!
—ওইদিকে আমি গর্ত করে পুকুর বানাচ্ছি!

হাতের ইশারায় একটা গর্ত দেখালো বিজয়, কথাটা বলেই সে মাথা নিচু তরে ফেলছে। ছায়ানিকা হাতের টর্চটা নিয়ে গর্তটার দিকে আগালো, অনেক গভীর একটা গর্ত… গর্তটার দিকে তাকিয়েই ছায়ানিকা জিজ্ঞেস করলো,

—আপনি গর্তের ভেতরে ছিলেন?
—হ্যাঁ, সে জন্যই কাঁদা মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলো।

কথাটা শুনে ফিক করে হেসে দিলো ছায়ানিকা, তা দেখে আরও বেশি লজ্জা পেলো বিজয়। মাথাটা নিচু করেই বললো,

—আসলে আমার স্বপ্ন আমি বড় বিজ্ঞানী হবো। তাই নিজের এক্সপেরিমেন্ট এর কাজে এখানে গর্ত করছিলাম। কিন্তু আপনি শুনে যদি হাসেন, তাই মিথ্যা বলেছি। আমি ওসব মাছ ধরতে পারি না।
—তা আপনার এক্সপেরিমেন্টের বিষয় কি?
—পানি দিয়ে বিদ্যুত সৃষ্টি হয় আর বিদ্যুৎ থেকে আলো। আমি সরাসরি পানি দিয়ে আলো তৈরি করতে চাই আর সে আলো রেডিয়েশনের মতো চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহার করতে চাই। সে জন্যই মাটি খুঁড়ে গভীর থেকে পানি বের করার চেষ্টা করছি।
—সত্যি এখান থেকে আপনার বাড়ি ত্রিশ মিনিটের পথ?
—হ্যাঁ, যাবেন আপনি?
—কাল যাবো, ঠিক দশটায় থাকবেন এখানে। বারোটার মধ্যে আমাকে বেক করতে হবে।

ছায়ানিকার বন্ধুরা কেউই বারোটার আগে ঘুম থেকে জাগে না, তাই তাদের ঘুম থেকে উঠার আগেই বিজয়ের কথার সত্যতা যাচাই করে দেখতে চায় ছায়ানিকা। ছায়ানিকার কথার প্রতিত্তরে বিজয় ছোট্ট করে বললো,

—আচ্ছা।

বিজয় চলে যাচ্ছে, ছায়ানিকা আবার গর্তটার দিকে তাকায় আর তখনই তার ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। আপনমনে সে বলে ওঠে, “পাগল লোক একটা”! রিদান পেছন থেকেই রাগীস্বরে বলে উঠে,

—তোর কি কান্ডজ্ঞান নেই? ভর সন্ধ্যায় একা জঙ্গলে কি তোর হ্যাঁ?

কথাটা বলে এগিয়ে আসার সময়ই পা পিচলে বিজয়ের বানানো গর্তটায় পড়ে যাচ্ছিলো রিদান, ছায়ানিকা সময়মতো না ধরলে নিশ্চিত কাঁদায় মাখামাখি হতো সে। ছায়ানিকা রিদানের হাত টেনে ধরে ওকে ঠিকমতো দাঁড় করিয়ে বললো,

—নিজে দু’কদম ঠিকমতো চলতে পারিস না আর তুই আমার উপর খবরদারী করিস? আমার বডিগার্ড হতে হলে শক্তিশালী হতে হয়, তোর মতো ননীর পুতুল না।
—আমি মোটেও ননীর পুতুল না, সময় হলে দেখিয়ে দিবো এই রিদান কি করতে পারে!
—কার জন্য? আমার জন্য?

কথাটা বলে মুচকি মুচকি হাসলো ছায়ানিকা, টর্চের আলোয় রিদানের ভাবভঙ্গী তার চোখে পড়লো না। যদি পড়তো তবে দেখতো সে কতোটা মুগ্ধ হয়ে ছায়ানিকার হাসি দেখছে আর নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলছে, “একমাত্র তোর জন্যই আমার শক্তি ক্ষয় করতে হয় রে চিকা! তোর অতিরিক্ত সাহস আমাকে বারংবার তোকে হারানোয় ভয় দেখায়”! ছায়ানিকা হাসতে হাসতে বললো,

—আসছে আমার শক্তিমান রে। চল ভেতরে, তোর তো আবার ঠান্ডা ভাত হজম হয় না।

মুচকি হাসে রিদান, তার খুঁটিনাটি সব বিষয়েই ছায়ানিকার খেয়াল থাকার ব্যাপারটা তাকে বারংবার স্বীকার করতে বাধ্য করে, এ জীবনে এ মেয়েটা পাশে থাকলে সে সুখে থাকতে বাধ্য। ছায়ানিকা অন্ধকারে রিদানের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়িটার দিকে। হঠাৎ রিদানের দিকে টর্চটা ধরে হেসে বললো,

—অবাক হচ্ছিস কেনো? চারদিকে অন্ধকার, চাঁদের আলোতে চলার অভ্যাস নেই তোর। টর্চও আনিস নি, পড়ে না যাস তাই ধরে রাখলাম। তোর তো আবার ঠিক ঠিকানা নেই…

রিদান কিছু বলে না, তার ভালো লাগছে… অন্ধকার রাত, চারদিকে নিস্তব্ধতা আর তার মাঝে চাঁদের আলোয় সে আর তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছায়ানিকা। তার ভীষণ ইচ্ছা করছে ছায়ানিকার চুলের কাটাটা খুলে দিয়ে বাদামী চুলগুলোকে খোঁপার বাঁধন থেকে মুক্ত করে দিতে। কিন্তু সে কিছুই করলো না, চুপচাপ হেঁটে চললো। মাঝে মাঝে নিজের কিছু ইচ্ছেকে প্রশ্রয় না দিয়ে দমিয়ে রাখা ভালো…

—স্যার, কাল রাতের ছেলেমেয়েগুলো এখনো ওই বাড়ি থেকে যায় নি।
—কথাটা বলতে লজ্জা করে না তোমার জিহান? এতো টাকা দিয়ে গত তেরোটা মাস ধরে ওই বাড়িটা নিয়ে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করলাম আর এখন এদের তাড়াতে পারছো না? ভয় দেখাও, হামলা করো, যা মন চায় করো… ওদের তাড়াও!
—স্যার সব দোষ এই মিশুর, ও ঠিকমতো ভয় দেখাতো পারে নি ওদের।
—বিশ্বাস করেন স্যার, আমি আমার কাজ ঠিকমতো করছি কিন্তু মাঝখান থেইকা বিজয় স্যার মাইয়াটারে বাঁচাইয়া নিছে।

কথাটা শুনে অন্ধকারে দাঁড়ানো লোকটার কপালে ভাজ পড়লো, ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হলো তারপর চিন্তিত ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলো,

—বিজয় মেয়েটাকে চেনে মিশু?
—চেনে কি না জানি না তবে গতকাল মেয়েটারে আমি একটা গর্তে ফালাইয়া দিছিলাম, ভাবছিলাম সকালে তার বন্ধুরা তারে এমন অবস্থায় দেখলে এ বাড়িতে দাঁড়াইবো না। কিন্তু বিজয় স্যার সক্কাল সক্কাল মাইয়াটারে বাঁচাইলো।
—বিজয় ও বাড়িতে কেনো গিয়েছিলো?
—বাড়িত না বাড়ির পাশের জঙ্গলে গেছিলো স্যার।
—শোনো, যতো যা’ই হোক বিজয় যেনো এসব ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। ও জানলে সব পন্ড করে দেবে, আর আমাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না।
—ওনার যা রাগ, স্যার আপনে ওনারে সহ্য করেন কি কইরা?
—বিজয় আমার একমাত্র দুর্বলতা, আমার যা সব বিজয়ের জন্য। ওকে হারিয়ে ফেললে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। আজ আর ওদের ভয় দেখিও না, কাল আবার চেষ্টা করবে।
—জ্বী স্যার।
—মিশু…
—হ্যাঁ স্যার!
—ওরা যেনো সত্যিই চলে যায়।
—স্যার সবাইরে বশ করা যতো সোজা ওই মাইয়াটারে বশ করা ততো সোজা না। মাইয়াটা বহুত চালাক, নতুবা আমার চোখে লাইট মারে!
—যাও।

জিহান আর মিশু অন্ধকার ঘরটা থেকে বেরিয়ে করিডোরের দিকে এগোলো, বিজয়কে ভেতরে ডুকতে দেখে চুপচাপ সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে পড়লো তারা। জিহান কিছুক্ষণ চুপ করে বিজয়কে দেখলো তারপর ফিসফিস করে বললো,

—এ ব্যাটাকে যতো দেখি ততো রাগ হয়, কেমন ভাব নিয়ে চলে দেখেছিস?
—জিহান ভাই, আপনে তো আর কিছুই বইলেন না। আপনি কি কইরা আমারে ফাসাইলেন স্যারের সামনে? দোষ করছে হের বাড়ির পোলা আর সাজা পামু আমি! তয় যতো যা’ই কই, বিজয় স্যার কিন্তু বহুত সুন্দর আছে। দেহেন, গুন গুন করতে করতে কেমনে চাবিটারে হাতের মধ্যে ঘুরাইতাছে… মনে হইতাছে সিনেমার হিরো…
—মিশু, একদম বিজয় স্যারের দিকে নজর দিবি না। স্যার যেমন সহজ তেমনই কঠিন। আজ অবধি স্যারের সাথে কোনো মেয়েকে টিকতে দেয়া হয় নি আর ভবিষ্যতেও দেয়া হবে বলে মনে হয় না। সাতটা মেয়ে মারা পড়েছে কেবল বিজয় স্যারকে তাদের ভালো লাগতো বলে, ভবিষ্যতে আরও কতোজন মরবে তার হিসেব নেই। বিজয় স্যার হলো হিরার মতো বুঝলি? দেখতে সুন্দর কিন্তু ধরতে গেলে হিরার ধারে হাত কেটে যাবে…
—আমি কি আর তারে ধরতে গেছি? কেবল দেখছি আরকি… সুন্দর মানুষ দেখতে কার না ভালা লাগে?
—সৌন্দর্য্য সবসময় আর্শীবাদ হয় না, কখনো কখনো অভিশাপও হয়। এই যে তুই সুন্দরী, তাইতো আজ তুই মায়াজালে নকল ভূতের অভিনয় করছিস… অসুন্দর হলে আজ তোর একটা সাধারন জীবন হতো।
—আমার আফসোস নাই জিহান ভাই, ঘরের বেকে পেট পুইরা খাইতে পারতাছে আমার লাইগা। অসুস্থ বাপটারে প্রতি হপ্তায় ডাক্তার দেইখা যাইতাছে, এর লাইগা আমি সারাজীবন ভুত সাইজা থাকতেও রাজি আছি।

জিহান সিঁড়ির নিচে বসেও মিশুর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, মেয়েটার চেহারায় অনেক মায়া অথচ আজ কি না সে মায়া কেউ তার অসৎ উদ্দেশ্য পূ্রনের জন্য ব্যবহার করছে! মানুষ বড্ড স্বার্থপর আর অর্থ থাকলে সে মানুষগুলো তো তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সব করতে পারে। জিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কালো দুনিয়ার মানুষ না হলে আজ হয়তো সে মিশুকে প্রেম প্রস্তাব দিতো… তাদেরও হয়তো একটা সাজানো সংসার হতো! কিন্তু যে জীবনের একটা সেকেন্ডেরও নিশ্চয়তা নেই সেই অনিশ্চিত জীবনে কাউকে জুড়ে দিয়ে নতুন করে পাপের ভাগীদার হতে চায় না সে। কালো দুনিয়ার জীবনে একা থাকাই শ্রেয়… তাছাড়া মিশুও এখন কালো দুনিয়ার বাসিন্দা, এ দুনিয়ায় আসার পথ আছে তবে যাবার পথ নেই। হয়তো কোনো এক সকালে মিশুর নিথর দেহ দেখতে হবে জিহান কে, ফেঁসে যাবার ভয়ে হয়তো সে দেহটাকে গুম করতেও হবে। এ জীবনের কি কোনো মানে হয়? একে কি বাঁচা বলে? হায় অদৃষ্ট, প্রয়োজন মানুষকে কতো নিকৃষ্ট জীবনযাপনেই না বাধ্য করে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here