প্রণয়িনী,পর্ব:৯+১০

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ৯

১৮
পোস্ট মর্টেমের পর রায়ানকে দেখে ভীষণ ভয় করছে রাকিবের। এম্বুলেন্সে করে লাশ গ্রামে নেয়া হচ্ছে, বাবা-মাকে কি বলবে সে চিন্তার পাশাপাশি একটা কাটাছেড়া করা লাশের পাশে বসে থাকতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে রাবিকের। পেটের কাটা জায়গাটার ব্যাথাও ক্রমশ শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, এ মুহূর্তে একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। এমন শত চিন্তার মাঝেই চোখ লেগে এসেছিলো রাকিবের…

ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে একা রায়ানের লাশের সঙ্গে দেখে ভয়ে রাকিবের গলা শুকিয়ে গেলো। এম্বুলেন্সের থেকে বের হয়ে ড্রাইভিং সিটে কাউকে পেলো না রাকিব। ড্রাইভিং সিটের পাশে এক টুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখে রাকিব তা তুলে নিলো।কাগজে লাল কালিতে টাইপ করা কিছু লেখা, পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্লাশ জ্বেলে রাকিব পড়লো লেখাটা। “পাপ বাপকেও ছাড়ে না, তুই রাকিব কোন ছাড়? তুই ভূত বাড়ি ছেড়েছিস, ভুত তোকে ছাড়ে নি।” লেখাটা পড়ে রাকিবের হাত-পা কাঁপতে লাগলো। কোনোমতে এম্বুলেন্সে উঠে বসে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছলো সে। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভারকে গাড়ীতে বসতে দেখে রাকিব কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? এভাবে রাতের বেলায় মাঝ রাস্তায় কোথাও যেতে কে বলেছে আপনাকে?”

ড্রাইভার তার বত্রিশটা দাঁত বের করে এক বিদঘুটে হাসি দিলো, তা দেখে রাকিব নিরবে ঢোঁক গিললো। অন্ধকারে মধ্যবয়স্ক ড্রাইভারের হাসিটাও কেমন বিদঘুটে লাগছে রাকিবের কাছে। ড্রাইভার বললো,

-“ডায়বেটিস আছে বাবা, যখন তখন মুতা ধরে। বিজি রাস্তায় তো মুততে পারমু না, তাই এইখানে থামাই মুততে গেছি। তুমি কি রাগ করছো?”
-“না, আপনি দ্রুত চালান। রাস্তাটা ফাঁকা, কেমন অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করছে।”
-“আরে বাবা, ভয় পাইছো নাকি? ভয়ের কিছু না। মৃত্যু হইলো সত্য জিনিস, ভয় পাওন উচিত জীবনরে। কারন এ জীবনের পাপের শাস্তি পামু মৃত্যুর পর। তাই মৃত্যুরে ভয় পাবা না, ভয় পাবা জীবনে করা পাপগুলোরে। পাপ কিন্তু বাপরেও ছাড়ে না…”

কথাটা বলেই আবার হাসলো ড্রাইভার, ড্রাইভারের বলা শেষ বাক্য শুনে রাকিবের ভয়টা দ্বিগুণ হয়ে গেলো। তারপর আর কোনো কথাই বললো না সে, মুর্তির মতো বসে রইলো কাফনে মোড়া রায়ানের লাশটার দিকে। রায়ান কি তবে মরে গিয়ে পাপের জগৎ থেকে মুক্তি পেয়ে গেলো! মরে গিয়ে পাপের শাস্তি পেয়ে সে কি পরিশুদ্ধ মানুষ হয়ে যাবে? আচ্ছা, মৃত মানুষকে তো আমরা লাশ বলি। পরপারে তাদের কি সম্বোধন করে? মানুষ নাকি অন্য কিছু?

হঠাৎ এম্বুলেন্সটা জোরে ঝাঁকি খেলো, তারপর এদিক সেদিক করতে লাগলো। রাকিব ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-” কি হয়েছে?”
-“তেমন কিছু না, আঁকাবাঁকা রাস্তা তো।”

ড্রাইভারের কথায় একটুও ভরসা পেলো না রাকিব, চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে গেলো, দম ধরে বসে রইলো দীর্ঘক্ষণ। হঠাৎ ড্রাইভার রাস্তার পাশে ঝোঁপের দিকে লাফ দিলো আর ড্রাইভার ছাড়া গাড়ীটা এঁকেবেঁকে একটা খাদের দিকে এগোতে লাগলো। মুহূর্তের জন্য রাকিব চিৎকার করতে ভুলে গেলো, বাঁচার চেষ্টাও করলো না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের গভীর গর্তটার দিকে। যখন হুঁশ হলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে, রাকিব বিড়বিড় করে বললো, “পাপ বাপকেও ছাড়ে না, তোমার শুদ্ধিকরণের যাত্রা শুরু রাকিব।”

১৯
ছায়ানিকাকে নিয়ে এমনিতেই রিদানের দুশ্চিন্তার অভাব নেই সেখানে মাঝরাতে মামার ফোন আসায় ফেন তুলে কিছুটা বিরক্ত গলায় বললো,

-“ঘুমোচ্ছিলাম মামা।”
-“রায়ানের লাশ নিয়ে গ্রামে যাবার সময় এম্বুলেন্স এক্সিডেন্ট করেছে রিদান। ড্রাইভার গুরুতর আহত, রাকিবের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। তোরা কি একবার আসবি?”

রিদান কোনো কথা বললো না, ফোনটা কেটে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে তুর্জর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। তুর্জ দরজা খুলতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“রাকিব আর নেই, আমাদের সঙ্গে এমনটা কেনো হচ্ছে? আমাদের কি অন্যায় ছিলো?”

রিদানের কথার বিপরীতে কথা বলতে বলে ভুলে গেলো তুর্জ, মুর্তির মতো দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ। একসময় ওরা পা বাড়ালো ছায়ানিকার ঘরের দিকে। তুলির ভয় করছিলো তাই ছায়ানিকার সঙ্গে ঘুমিয়েছে, কয়েকবার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ছায়ানিকা, রিদান আর তুর্জর বিদ্ধস্ত দেখে ছায়ানিকা প্রশ্ন করলো,

-“এতোরাতে তোরা এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছিস কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

রিদান কাঁপাস্বরে বললো,

-“রাকিব আর নেই, গ্রামে যাবার সময় এম্বুলেন্স খাদে পড়ে গেছে। রাকিব স্পট ডেথ…”

ছায়ানিকা দরজার কাছে মেঝেতে বসে পড়লো, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। এ বাড়িটায় আসার আগেও তারা ছিলো প্রানবন্ত, আর আজ তাদের মনে বিষাদের ছায়া। তাদের মাঝে রাকিব আর রায়ান নেই, তাদের আর কখনো দেখা হবে না। ছায়ানিকা যতোই খাপছাড়া স্বভাবেরই হোক না কেনো, বন্ধু অন্তপ্রাণ সে। সেই বন্ধু হারানো যেনো তার কাছে দুঃখের অতলে নিমজ্জিত হবার সামিল…

তুর্জ তুলিকে দু’বার ডাকার পরও কোনো সাড়া এলো না, ছায়ানিকা ক্ষীণস্বরে বললো,

-“ও এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে, ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। ওকে আর ডাকিস না, সকালে জাগার পর বলিস… বসার ঘরে চল, ভালো লাগছে না একদম।”

তিন বন্ধু চুপচাপ বসে আছে বসার ঘরের সোফায়, ছায়ানিকা নিঃশব্দে কাঁদছে, তুর্জ, রিদান যবথব হয়ে এক কোনায় বসে আছে। তুর্জ হঠাৎ বললো,

-“এখানে আর থাকবো না, তোর কথা শুনে এখানে থাকাটাই আমাদের জন্য কাল হয়েছে ছায়া।”

রিদান তুর্জর কাঁধে হাত রেখে বললো,

-“শান্ত হ তুর্জ, এখন এসব বলার সময় নয়।”
-“কখন বলার সময় হ্যাঁ? রাকিব, রায়ান আমাদের মাঝে আর নেই, তুলি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। আর কতো ছায়ার জেদ সহ্য করবো বল? শেষে না আমরাও মারা পড়ি…”

ছায়ানিকা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো, যাবার সময় একটু দাঁড়িয়ে বললো,

-“দু’টো দিন সময় দে আমাকে, আমি সব ঠিক করে দেবো।”

তুর্জ চেঁচিয়ে বললো,

-“কি ঠিক করবি তুই ছায়া, রাকিব, রায়ানকে ফিরিয়ে আনতে পারবি? তুলির মন থেকে ভয় দূর করতে পারবি?”

কিছু বলে না ছায়ানিকা, নিরবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। তার কিছু ভালো লাগছে না, বিজয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মিশু নামের মেয়েটার কোনো খোঁজ পেলো কি না জানতে হবে।

২০
-“আমরা এখান থেকে যতো দ্রুত সম্ভব চলে যাবো বিজয়, তুমি কি একটু দেখা করবে?”
-“তুমি চলে গেলে আমি একাকিত্বে ডুবে যাবো ছায়া, আমি সম্ভবত তোমার মায়ায় পড়ে গেছি।”

কথার মাঝেই দরজার পাশে কারো ছায়া চোখে পড়ে বিজয়ের, কিন্তু বাইরে এসে কাউকেই পায় না বিজয়। ব্যাপারটাকে অতোটা গুরুত্ব না দিয়ে বিজয় ফোনের ওপাশে থাকা ছায়ানিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“বিয়ে করবে আমায় ছায়া? আমি তোমার মায়ায় পড়ে গেছি, এ মায়া কাটানোর সাধ্য আমার নেই… আমি সারাজীবন তোমার মায়ার চাদরে জড়িয়ে থাকতে চাই।”

শব্দ করে হাসলো ছায়ানিকা, হাসতে হাসতে বললো,

-“ফোনের ওপাশে বসে প্রেম প্রস্তাব দিচ্ছ বিজয়? প্রত্যাখ্যাত হবার এতো ভয় তোমার? পারলে সামনে এসে বলো, তুমি তো এখন অবধি আমার বন্ধুদের সামনেও এলে না… এতো লুকোচুরি কেনো বিজয়?”

মুচকি হাসে বিজয়, এ মেয়েটা সবসময় বন্ধু বন্ধু করে কেনো কে জানে, একটু বিজয় বিজয় করতে পারে না? বিজয় তো ছায়ানিকার সবটা সময় চায়…

-“আমি মোটেও ভিতু নই ছায়া, আমি কেবল তোমাকে হারাতে চাই না। তাই সুযোগ পেয়ে ফোনেই বলে দিলাম, পরবর্তীতে যদি সুযোগ না পাই!”

মুচকি হাসে ছায়ানিকা, বিজয় ফোনের ওপাশে বসেও উপলব্ধি করে ছায়ানিকার মিষ্টি হাসি। যে হাসি দেখে সে সারা বেলা পার করতে পারবে… আচ্ছা, ছায়ানিকাও কি তাকে নিয়ে ভাবে!

দূর থেকে দাঁড়িয়ে ছায়ানিকাকে দেখছিলো রিদান, তার চক্ষু রক্তবর্ণ ধারন করেছে… বিজয় ছায়ানিকাকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে ব্যাপারটা মানতে তার বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছে। ছায়ানিকার ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা, তবে কি ছায়ানিকাও বিজয়কে… ভাবতে পারছে না রিদান। তার মন চাইছে এ মুহূর্তে সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে। তার পুতুল পুতুল দেখতে, ছায়ানিকাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু ছায়ানিকা, সে কি যাবে রিদানের সঙ্গে!

চলবে…

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ১০

তুলিকে রাকিবের এক্সিডেন্টের খবরটা দেয়া হয় নি, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তুলি তুর্জর ঘরে এসে দরজা আটকে দিলো। তুলির আচরনে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে তুর্জ জিজ্ঞেস করলো,

-“কিছু বলবি?”
-“রাকিব আর রায়ান সেদিন রাতে কনফেস করেছিলো যে ওরা মিশু নামের মেয়েটাকে ধর্ষণ করে দিঘীর পাড়ে ফেলে এসেছিলো। ছায়া মেয়েটার খোঁজ করছে, আমাদের কি ওকে মিশুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলা উচিত?”
-“না, বলা উচিত না।”

শান্তস্বরে জবাব দিলো তুর্জ। তুলি জিজ্ঞেস করলো,

-“কেনো উচিত নয়?”
-“একটা দুঃসংবাদ আছে তুলি, রাকিব আর নেই।”
-“কিহ? কিভাবে হলো এসব? কখন হলো?”
-“কালরাতে রায়ানের লাশ নিয়ে গ্রামে যাবার পথে এম্বুুলেন্সটা এক্সিডেন্ট করে, খাদে পড়ে যায়। রাকিব স্পট ডেথ। এখন তুই বল, এ তথ্যগুলো জানার পর রিদান আর ছায়া কি ওদের এখনকার মতো সহানুভূতির নজরে দেখবে? না, দেখবে না। আমি বলছি না ওরা ভালো, কিন্তু একসময় তো আমরা বন্ধু ছিলাম তাই না? বন্ধুত্বের খাতিরেই না হয় ওদের কভার আপ করলাম। তুই কি চাস, ওরা মৃত্যুর পর কারো ঘৃনার পাত্র হোক?”
-“তুই ঠিক বলছিস তুর্জ। আমাদের নিরব থাকাটাই শ্রেয়।”
-“আর কিছু বলবি?”
-“আমার কেনো যেনো রাকিবের মৃত্যুতে কষ্ট হচ্ছে না রে… আসলে রাকিবের কারনেই রায়ানের মধ্যকার পিচাশ স্বত্তাটা বাহিরে এসেছিলো। রাকিব নিজের চেহারা ব্যবহার করে মেধার সঙ্গে ওসব না করলে হয়তো আজ রায়ান আর মেধা কাপল থাকতো। রাকিবের জন্য সবটা শেষ হয়ে গেছে, পরের দিকে সব দোষ রায়ানের হলেও শুরুটা কিন্তু রাকিবই করেছিলো। ওর লোভ সবটা শেষ করে দিয়েছে…”

তুর্জ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“কিছু করার নেই রে, এটাই হয়তো ভাগ্যে লেখা ছিলো। তোর শরীর কেমন?”
-“আগের থেকে ভালো, আসলে রক্ত সহ্য হয় না। লাল রঙটা অসহ্য লাগে, দেখিস তো আমি কখনো লাল জামা পরি না। বিয়েতেও লাল পরবো না…”
-“তোকে বিয়েতে বেগুনী রঙের শাড়ী দেবো, সঙ্গে খোঁপায় গোজার জন্য জারুল ফুল।”

কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটল তুর্জ, মুখ ফসকে কি বলে ফেললো! তুর্জ ভেবেছিলো তুলি রাগ করবে, কিন্তু তা না করে রসিয়ে রসিয়ে বললো,

-“দিস, দিস… আমার বরের টাকা বেঁচে যাবে।”

কথাটা বলে ঠোঁট টিপে হাসলো তুলি, তুর্জ মলিন মুখে বললো,

-“বিয়েতে বর বউকে শাড়ী দেয়, বন্ধু না। তুই কি কিছুই বুঝিস না তুলি?”

তুলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসি আটকে বললো,

-“বুঝিয়ে বললেই বুঝি। এমন কথায় জিলিপির প্যাচ মারলে বুঝবো কি করে?”
-“একবার ফিরে যাই, সব প্যাচ খুলে বুঝিয়ে বলবো। তখন কিন্তু না বললেও কোনো না শুনবো না।”
-“আমি বুঝার অপেক্ষায় থাকবো।”

কথাটা বলেই একছুটে বেরিয়ে গেলো তুলি, মুচকি হাসলো তুর্জ। তার তবে ভালোবাসা হয়েই গেলো!

২১
রাতের অন্ধকারে জিহানের লাশ বাড়ির পেছনের বাগানে পুঁতে ফেলছে একরাম খান, লাশ মাটি চাপা দেয়া অনেকটা শেষ। এখন কেবল তার ওপর নানা রঙের পর্তুলিকা লাগানো বাকি। এতো রাতে নিজের বড় বাবাকে গাছ লাগাতে দেখে বিজয় এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-“বড় বাবা, আপনি এতো রাতে বাগানে? কাল সকালেও তো গাছ লাগানো যেতো। আমি কি আপনাকে সাহায্য করবো?”

একরাম খান গমগম স্বরে বললেন,

-“না, আমার বাগানে কারো হাত দেবার অনুমতি নেই। তুমি ভেতরে যাও।”

একটু থেমে আবার বললেন,

-“এখানে পড়ে আছো কেনো বিজয়? বিদেশে ফিরে যাচ্ছো না কেনো? তোমার এ দেশে থাকা বরণ জানো না? তুমি আমার পরিচয়ে বড় হলেও তুমি তো এক খুনী মায়ের সন্তান, তা কি ভুলে গেলে?”
-“আমার মাকে ভীষণ দেখতে মন চায় বড় বাবা, কিন্তু আপনি তো কখনো মায়ের ছবি দেখান নি। মেহেরুন্নেসা, এ একটা নাম ছাড়া আমার স্মৃতিতে আমার মায়ের কোনো স্থান নেই। আপনি কি মায়ের একটা ছবি জোগার করে দেবেন? আমি তাকে একবার দেখবো।”
-“মাকে দেখে চলে যাবে?”

বিজয় উৎফুল্ল স্বরে বললো,

-“আমি আর কোথাও যাবো না, আপনার জন্য পুত্রবধূ খোঁজা শেষ বড় বাবা। আমি খুব শীঘ্রই তাকে মনের কথা বলবো, তারপর আমরা সবাই একত্রে এ বাড়িতে থাকবো। আসলে দেখতাম আমার মায়ের সঙ্গে ওর চেহারার কোনো মিল আছে কি না, ঘরের লক্ষী বলে কথা…”
-“তোমার মা লক্ষী ছিলো না।”
-“আমার জন্য আমার ওই খুনী মা’ই লক্ষী।”

ভ্রুঁ কুঁচকে বিজয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকালো একরাম সাহেব, মিনমিন করে বললো, “তোমার পঁচিশ বছর না হওয়া পর্যন্ত তুমি কাউকেই বিয়ে করতে পারবে না বিজয়। তোমার জীবনে যে মেয়ে আসবে তাকেই মরতে হবে।”

-“কিছু বললেন বড় বাবা?”
-“না তো, তুমি ভেতরে যাও। আমার কাজ প্রায় শেষ…”
-“আচ্ছা।”

যেতে যেতে দাঁড়ালো বিজয়, পেছন ফিরে বললো,

-“কাল সন্ধ্যায় আমি আমার মনের কথাটা ওকে বলবো, আমার বিশ্বাস ও আমাকে ফেরাবে না। আপনি কি কাল আমার জন্য একটু দোয়া করবেন বড় বাবা? আসলে আমার তো আপনি ছাড়া কেউ নেই…”

মুচকি হাসে একরাম সাহেব, মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। বাড়ির ভেতরে পা বাড়ায় বিজয়, একরাম সাহেব গাছ লাগাতে লাগাতে ডুব দেয় তার অতীতে। সে অতীত যার প্রতিটি পাতা প্রতারনা বিষবাষ্প আর আপনজনদের রক্তে রাঙানো!

একরাম সাহেবের ছোট ভাই এনামুল হক গ্রামে একটা কাজে গিয়ে তাদেরই গ্রামের মেয়ে মেহেরুন্নেসা মোহকে বিয়ে করে বাড়ি ফেরেন। একরাম সাহেবের তখন আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না কিন্তু এনামুল সাহেবের ব্যবসা উর্ধ্বমুখী। পরিবারে মোহর আগমন যেনো সেই ব্যবসায়ে চাঁদের মোহল লাগিয়ে দিলো। একরাম সাহেব নিজের পরিবার সামলাতে তখন হিমসিম খাচ্ছে বিধায় এনামুল বড় ভাই ও তার পরিবারকে নিজের বাড়িতে এনে রাখে। স্বামীর প্রতিপত্তি নিয়ে বরাবরই মোহর আলাদা দম্ভ ছিলো, সে কারনে একরাম সাহেবের বউ আর মেয়েকে প্রায়ই কটু কথা শুনতে হতো। তারা মুখ বুজে সবটা সহ্য করলেও সহ্য করতে পারতো না একরাম সাহেব। এর মাঝেই এনামুল সাহেবের এক বন্ধু বাড়িতে ব্যবসায়ের আলাপ করতে এসে মোহকে দেখে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। এনামুল সাহেবকে অর্থের লোভ দেখিয়ে কাবু করতে না পারলেও একরাম সাহেবকে অর্থের লোভ দেখিয়ে কাবু করতে পেরেছিলো বন্ধুটি।

সে বার এনামুল সাহেব ব্যবসায়ের কাজে শহরে গেছেন, মোহ তখন সবে মাত্র নিজের প্রথম সন্তান আগমনের খবর পেয়েছে। মোহ তখন তার অনাগত সন্তানের স্বপ্নে বিভোর, হঠাৎ একদিন একরাম সাহেব তার কাছে গিয়ে বললেন,

-“ছোট বউ, এনামুল তোমাকে মায়াজালে যেতে বলেছে। আজ রাতে সে ফিরবে, তোমার সঙ্গে আলাদা সময় কাটাতে চায়।”

মোহ খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে, যত্ন করে এনামুলের জন্য সাজে। অথচ সে জানে না, তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টা তার জন্য অপেক্ষা করছিলো সে রাতে।

এনামুল সাহেবের বন্ধুটি সে রাতে মোহকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করেছিলো, সে রাতে সম্মানের পাশাপাশি মোহ তার অনাগত সন্তানকেও হারিয়েছিলো। মোহ জানলো, ব্যবসায়ের লাভের জন্য মোহকে তার স্বামী বন্ধুর কাছে এক রাতের জন্য পাঠিয়েছে। আর এনামুল জানলো মোহ তাকে ঠকিয়ে তারই বন্ধুর সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝির শুরুটা এখানেই। এনামুল মোহকে ভীষণ ভালোবাসতো তাই হয়তো তাকে ছাড়তে পারে নি, মোহল ভুলটাকে ক্ষমা করে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে মোহও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক আচরন করতে লাগলো, একসময় মোহ আবারও সন্তান ধারন করলো। নির্দিষ্ট সময় পর বিজয় পৃথিবীতে এলো…

এক রাতে মোহ বিজয়কে একরাম সাহেবের বউয়ের কাছে রেখে এনামুলকে মায়াজালে ডেকে নিলো, সে রাতে এনামুলকে নৃশংসতার সঙ্গে খুন করে মোহ। এনামুলকে সে ভালোবেসে ঘর ছেড়ে এতোদূর এসেছিলো, সে এনামুলের থেকে প্রতারনা সহ্য করতে পারে নি সে। অথচ সে জানলোও না, তার সঙ্গে তার স্বামী কখনোই প্রতারনা করে নি। এনামুলকে ভীষণ ভালোবাসতো মোহ, তাই স্বামীকে খুন করে সে ঘরেই ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করে মোহ।

মোহ আর এনামুলের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলো একরাম সাহেব। তার ধারনা ছিলো এবার পুরো সম্পত্তি তার হবে। কিন্তু এনামুল আর মোহল মৃত্যুর পর উকিল এসে জানালো সব সম্পত্তি বিজয়ের নামে এবং তার পঁচিশ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পত্তি সে হস্তান্তর করতে পারবে না। এছাড়া এর মাঝে বিজয়ের বিয়ে হলে তার স্ত্রী সম্পত্তির অর্ধেকের অংশীদার হবে। একরাম সাহেব তাই চেয়েও বিজয়কে মারতে পারেন নি। তারপর একরাম সাহেব তার স্ত্রী আর কন্যাকে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেন আর বিজয়কে নিয়ে দেশে রয়ে যান। নিজে কোলে পিঠে করে বড় করেন বিজয়কে, একসময় ওকে নিয়ে দেশছাড়া হন। বিজয় জানে না, মায়াজাল তার বাবারই বাংলো বাড়ি, সে জানে না, মোহই তার মা মেহেরুন্নেসা! তার কাছে কখনো কোনো মেয়েকে আসতে দেন না একরাম সাহেব, কোনো মেয়েকে বিজয়ের ভালো লাগলে তাকে জিহানের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন। জিহান ছিলো একরাম সাহেবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক কিন্তু মিশুর মৃত্যুর পর জিহান এসব কাজ ছেড়ে দিতে চায়। বিভিন্নভাবে একরাম সাহেবকে ব্লাকমেইলও করে তাই বাধ্য হয়ে তাকে পৃথিবী থেকে সরাতে হয় একরাম সাহেবের। আর মাত্র ছয় মাস, তারপর বিজয়ের পঁচিশ বছর পূর্ণ হবে। সাধারণত কোনো কাগজে সই করার সময় বিজয় পড়ে না, সে তার বড় বাবাকে অন্ধবিশ্বাস করে… তাই সম্পত্তি লিখিয়ে নিতে বিশেষ সমস্যা হবে না। সম্পত্তি নিজের নামে হবার পর বিজয়কে খুন করে, এখানকার সব সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিজের পরিবারের কাছে পারি জমাবেন একরাম সাহেব। সব পরিকল্পনা করা আছে একরাম সাহেবের। তাই এ মুহূর্তে ছায়ানিকার মৃত্যু যেনো অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে। মুচকি হাসে একরাম সাহেব, এ মুহূর্তে সে তার পরিকল্পনা কিছুটা পরিবর্তন করেছে। বিজয়কে তিনি খুন করবেন না, বরং বিজয়কে ছায়ানিকার খুনের আসামী বানিয়ে সারাজীবন জেলে পঁচে মরার জন্য এ দেশে ফেলে যাবেন। তিনি ফিরে যাবেন তার স্ত্রী আর একমাত্র কন্যার কাছে, তার পরিবারের কাছে! যাদের ঠিকানা তিনি ছাড়া কেউ জানে না….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here